একসময় কালাপানি-তে দ্বীপান্তর হবে শুনলেই বুকের ভেতর রক্তস্রোত যেন জমাট বেঁধে যেত। ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের সেই রক্তাক্ত ইতিহাস বুকে করে আজও আন্দামান তার আপন মহিমায় উজ্জ্বল হয়ে রয়েছে ভারতীয় মানচিত্রে। তবে আন্দামান প্রাকৃতিক সৌন্দর্য আর অতুলনীয় বৈচিত্র্যময়তার জন্যও বিখ্যাত। বায়ুপথে পোর্ট ব্লেয়ার পৌঁছে সেই সৌন্দর্যের সাক্ষী হতেই এবারের সফর। সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের সবুজদ্বীপের রাজার স্মৃতিমেদুরতা বুকে নিয়ে যাত্রা। বহু দ্বীপের সমন্বয়ে তৈরি আন্দামানের, মাত্র কয়েকটি দ্বীপে মানুষের বাস।
আমাদের নির্দিষ্ট রিসর্টে পৌঁছে আশপাশের দৃশ্য দেখে মন ভরে গেল। সামনেই নীল জলের সমুদ্র। বারান্দায় বসেই বেশ সময় কেটে যায়। লাঞ্চ সেরে ঘুরে নিলাম কাছেই কর্বিনস্ কোভ বিচ। যাওয়ার পথেই চোখে পড়ে রস আইল্যান্ড। বিকেলে পৌঁছোলাম সেলুলার জেল। মনটা অচিরেই ভারী হয়ে আসে বহু স্বাধীনতা সংগ্রামীর ফাঁসির মঞ্চটি দেখে। এই জেলেই একসময় বন্দী ছিলেন বিপ্লবী বীর সাভারকর।
পরদিন প্রাতরাশ সেরে আমাদের গন্তব্য রস আইল্যান্ডের উদ্দেশে রওনা দিলাম। জেটি থেকে ১০ মিনিটের বোটযাত্রা। একসময় এই দ্বীপ রাজধানী ছিল আন্দামানের। এখনও কিছু পুরোনো স্থাপত্য রয়ে গেছে ওই দ্বীপে।
এরপরের গন্তব্য চিড়িয়াটাপু। একটা অটোয় চড়ে রওনা দিলাম অরণ্যে ঘেরা পথ দিয়ে। এই জঙ্গলে প্রচুর পাখির বাস। তাই হয়তো জায়গাটার নাম চিড়িয়াটাপু। সামনেই আদিগন্ত সমুদ্র ও এক ফালি মায়াময় বিচ। এক অপূর্ব সূর্যাস্তের সাক্ষী হলাম চিড়িয়াটাপুতে। ফিরে এসে সি-ফুড সমৃদ্ধ ডিনার খেয়ে মন ভরে গেল।
পরদিন ভোর ভোর উঠে আমরা তৈরি হলাম জলিবয় দ্বীপের উদ্দেশে রওনা দেব বলে। এর জন্য ওয়ানডুর থেকে বোট-এ উঠতে হয়। ওয়ানডুর পোর্ট ব্লেয়ার থেকে ৩০ কিমি দূরে। টিকিট নিয়ে আমরা বোটে উঠলাম সকাল ৯টায়। ওই বোট দ্বীপ ঘুরে দেখার জন্য আমাদের ঘন্টা তিনেক সময় বরাদ্দ করেছে। দ্বীপটি মহাত্মা গান্ধি মেরিন ন্যাশনাল পার্কের অন্তর্গত। এখানে সংরক্ষিত কোরাল ও নানা জলজ উদ্ভিদ দেখে মন ভরে গেল। বোটে করে নিয়ে যায় এই কোরাল রিফ দেখতে। বোটের তলদেশ কাচের তৈরি। ফলে জলজীবন স্বচ্ছ ভাবে দেখা যায় এই বোটযাত্রায়। কোরাল ছাড়াও দেখতে পেলাম ক্রাউন, প্যারট, জেব্রা, স্টারফিশ প্রভৃতি নানা মাছ। ২টো অক্টোপাসও দেখা গেল কাচের গা ঘেঁষে যেতে। ওখানে স্নরকেলিং-এর ব্যবস্থা থাকায় আমরা গাইডের সাহায্যে আরও একটু গভীর সমদ্রে ডুব সাঁতার দিলাম, আরও কিছু জলচর দেখব বলে। সাঁতার শেষে বেশ ক্লান্ত হয়ে হোটেলে ফিরলাম লাঞ্চ সারতে। সেদিন বিকেলে হাঁটাপথে অ্যানথ্রোপোলজিকাল মিউজিয়াম ঘুরে এলাম।
পরদিনটা নির্দিষ্ট ছিল জাহাজে করে হ্যাভলক ও রাধানগর দ্বীপ দেখার জন্য। ফিনিক্স বে জেটি থেকে জাহাজ ছাড়ল। নীল জলরাশি পেরিয়ে ২ ঘণ্টা পর পৌঁছোলাম হ্যাভলক। নির্জন দ্বীপটিতে খুব স্বল্প জনবসতি। একটা সুন্দর রিসর্ট-এ পৌঁছোলাম। তার নাম সি-শেল। নারকেল গাছের ছায়া ঘেরা সুন্দর লনে ছিল মধ্যাহ্নভোজের আয়োজন। কাছেই বিচ। খানিক বিশ্রাম নিয়ে আমরা রাধানগর বিচের উদ্দেশে রওনা হলাম। সিলভার স্যান্ড-এর জন্য বিখ্যাত এক রোমান্টিক বিচ এটি। এশিয়ার দ্বিতীয়তম সুন্দর বিচ বলে খ্যাত।
হ্যাভলকের দ্বিতীয় দিনের সকালটা বহু প্রতীক্ষিত ছিল। আমাদের প্ল্যান স্কুবা ডাইভিং-এর। গো-ডাইভ ইন্ডিয়া সেন্টারের ইন্সট্রাক্টর আমাদের বুঝিয়ে দিলেন কী করতে হবে। ৬-৮ ফিট জলের নীচে ডাইভ দিয়ে এর পর জলের নীচের পৃথিবীটাকে আরও কাছ থেকে দেখার সুযোগ মিলল। প্রায় এক ঘন্টা জলের নীচে সাঁতার কাটার এই অভিজ্ঞতা, সারা জীবনেও ভোলার নয়।
পরদিন আবারও জাহাজে উঠে আমরা পোর্টব্লেয়ার ফিরলাম। এবার ঘরে ফেরার পালা। চোখে লেগে রইল প্রবাল দ্বীপের অতলের ওই রহস্যময়তা, ভাষায় যার বর্ণনা হয় না।