যারা আপশোশ করছেন আরিজোনার গ্র্যান্ড ক্যানিয়ন যেতে পারছেন না বলে– তাদের দুঃখ ঘোচাবে, ভারতেরই একটি অপূর্ব জায়গা, যা সৌন্দর্যে পাল্লা দিতে পারে গ্র্যান্ড ক্যানিয়নের সঙ্গে। অন্ধ্রপ্রদেশের কাডাপা জেলার অন্তর্গত গান্ডিকোটা, প্রকৃতির এক অপরূপ সৃষ্টি।
তবে শুরুতেই বলে নেওয়া ভালো যে, গান্ডিকোটা পৌঁছোনো একটু কঠিন, কারণ এর যোগাযোগ ব্যবস্থা একেবারেই অনুন্নত। একমাত্র বেঙ্গালুরু, চেন্নাই বা হায়দরাবাদ থেকে গাড়িতে পৌঁছোনো যাবে গান্ডিকোটা। এই সফরের অন্যতম পাওনা, বেলাম গুহা, গান্ডিকোটা ফোর্ট ও গুটি ফোর্ট দর্শন।
যারা ট্রেনে আসতে চান তারা তাডিপাট্রি, গুটি বা গুনটাকাল-এ নামতে পারেন। তবে তাডিপাট্রি বা
গুনটাকাল-এ কোনও হোটেল নেই। সেক্ষেত্রে গুটি নামাটাই বুদ্ধিমানের। গুটি থেকে গাড়িতে গান্ডিকোটা ফোর্টের সামনে অন্ধ্রপ্রদেশ ট্যুরিজম ‘হারিথা’-এ থাকার ব্যবস্থা করতে পারেন।
আমরা গুটি থেকে সকাল সকাল রওনা হলাম গাড়িতে। মোট তিনটি জেলা ছুঁয়ে শুরু হল যাত্রা। গুটি অনন্তপুরের অন্তর্গত, বেলাম, কুর্নুলের মধ্যে আর গান্ডিকোটা কাডাপা জেলায়। এটি অন্ধ্রপ্রদেশের শুষ্কতম অঞ্চল।
গান্ডিকোটার নদীখাতের অদূরেই গান্ডিকোটা ফোর্ট, এই জেলাকে সুরক্ষিত করতেই এমন কূটনৈতিক ভাবে এটি নদীখাতের পাশে তৈরি করা হয়েছিল। ত্রয়োদশ শতাব্দীতে তৈরি এই কেল্লার বেশিরভাগটা ধবংশের কবলে। ভেতরে একটি মসজিদ ও ভিউপয়েন্ট রয়েছে।
‘গান্ডি’ অর্থাৎ নদীখাত এবং ‘কোটা’ মানে দুর্গ। চাণক্যদের রাজত্বকালে এর নির্মাণ। গান্ডিকোটাকে হাম্পির সঙ্গে তুলনা করা হয়ে থাকে। এর কারণ এর মধ্যে পাথরে নির্মিত মন্দির ভাস্কর্যগুলির সঙ্গে হাম্পির মিল পাওয়া যায়। একটি প্রবেশদ্বারে অবশ্য ইসলামিক শৈলীর সুস্পষ্ট ইঙ্গিত রয়েছে। গেটের দুধারে লোহার শলাকা, যাতে বহিরাগত শত্রুর হাতি না প্রবেশ করতে পারে। কেল্লার চারপাশে একাধিক ওয়াচ টাওয়ার।
ভিতরে এখনও অটুট রয়েছে একটি চারমিনার। পায়রা রাখার জন্য ব্যবহূত হতো এই ধরনের স্থাপত্যগুলি। এখন এখানে বহু পায়রার ভরাভর্তি সংসার। আর রয়েছে একটি বন্দিশালা। এর উঁচু প্রাচীর ও ছোটো ছোটো ভেন্টিলেটর দেখেই বোঝা যায়, সমস্ত রাজ্যের বন্দিদের এখানেই রাখা হতো। চৌহদ্দির ভিতরে স্থিত মাধবরায় স্বামী মন্দিরের অদূরেই বিশাল জলাধার। এখন এখানেই গ্রামবাসীরা পাম্প বসিয়ে সেচকার্য চালায়। বহু গ্রামবাসীর বসবাস এই কেল্লার মধ্যে। তাদের জলও যোগান দেয় এই জলাধার।
দুর্গের মধ্যে সবচেয়ে বর্ণাঢ্যপূর্ণ মাধবরায় স্বামী মন্দির। গোপুরম সমৃদ্ধ চারতলা বিশিষ্ট মন্দির। পিলারে ও সিলিঙে খোদাই করা কারুকাজ। ১৫ -১৬ শতকে রাজা কৃষ্ণদেব রায়ের সৃষ্টি। আরও আগে তৈরি জুমা মসজিদ। তিনটি আর্চ ও দুটি মিনার বিশিষ্ট কেল্লার অন্তর্গত এই মসজিদে, এখনও কিছু নকশা করা দেয়াল রয়ে গেছে। একটি শস্য ভাণ্ডার রয়েছে। কালের কবল থেকে কীভাবে এগুলি অক্ষত রয়ে গেল কে জানে, তবে কেল্লার অভ্যন্তর দেখে বোঝাই যায় এগুলি কতটা প্ল্যানিং করে করা হয়েছিল। রঘুনাথ মন্দিরেরও কিছু দেয়াল-ভাস্কর্য এখনও অটুট।
এসব দেখে ভিউপয়েন্টে যাবার জন্য পিচ্ছিল পাথরে পা রেখে যেতে হবে। বেশ কিছুটা ক্লাইম্ব করে ভিউ পয়েন্টে পৌঁছোলে নদীখাতের নিসর্গ চোখে ভেসে উঠবে। পাথুরে ল্যান্ডস্কেপের মাঝখানে এক অপরূপ পিকচার পোস্টকার্ড। যেন, নীচে পেন্না নদী। যারা গনগনি দেখেছেন, তারাও মানবেন গনগনি এর তুলনায় কিছুই নয়। একমাত্র গ্র্যান্ড ক্যানিয়নের সঙ্গেই এর তুলনা চলে। চারপাশের সৌন্দর্য যেন জায়গাটাকে আরও রহস্যময় করে তুলেছে।
পরের দিন গাড়িভাড়া করে আমরা পৌঁছোলাম বেলাম গুহা। ভারতের দ্বিতীয় বৃহত্তম এই গুহা প্রায় ৩চ্চ্৯ মিটার দৈর্ঘ্যের। দেড় ঘন্টা লাগে ঘুরে দেখতে। গুহার প্রথম অংশে একটি বড়ো হল, সেখানে একসময় বৌদ্ধ ভিক্ষুরা প্রার্থনা করতেন। তারপর একটি প্রবেশদ্বার। স্ট্যাল্যাকটাইট পাথরে যেন তিনটি সিংহের মুখ তৈরি হয়েছে। আরও ভেতরে শিবলিঙ্গের মতো কিছু আকৃতি। এরপর একটি অংশে পৌঁছোলে স্ট্যালাকটাইট পাথরের কিছু স্ট্রাকচার যার দ্বারা সৃষ্টি হয়েছে সপ্তসুর। কাঠ দিয়ে বাজালে শোনা যায়। এ এক প্রাকৃতিক বিস্ময়।
কিছু কিছু অংশে হামাগুড়ি দিয়ে ঢুকতে হয়। পাথুরে সিলিং-এর একটি অংশে যেন সহস্র ফণাবিশিষ্ট একটি গোখরো সাপ। কোথাও আবার অজস্র ঝুরি সমেত একটি পাথুরে বটবৃক্ষ। প্রাকৃতিক ভাবে তৈরি এসব ভাস্কর্য সত্যি অবাক করে। গুহার গভীরতম স্থানে একটি জলস্রোত, যার নাম পাতালগঙ্গা। এই অপূর্ব ভ্রমণ মুখে বর্ণনা করার নয়, দেখে বিস্ময়ে মুগ্ধ হবার।