সব শিশুর কাছেই মা-বাবা হল রোল মডেল। বাচ্চার কাছে নিজের মা-বাবার থেকে ভালো কেউ হতে পারে না। সুতরাং মা-বাবাকেই অনুসরণ করার চেষ্টা করে বাচ্চা। কিন্তু পরিস্থিতি যখন অনুকূল থাকে না, মা-বাবার ঝগড়ার মুখোমুখি হতে হয় বাচ্চাকে প্রতিনিয়ত। ঠিক তখনই শিশুর মনের মধ্যে আঁকা পারফেক্ট মা-বাবার ছবিটা গুঁড়িয়ে যেতে আরম্ভ করে। সে হয় হিংস্র মনোভাবের হয়ে ওঠে, নয়তো অবসাদে ডুবে যায়। আবার কখনও মা-বাবার দেখানো পথই অনুসরণ করে ঝগড়ুটে বা মারকুটে হয়ে ওঠে।

সামাজিক ব্যবহার কী হওয়া উচিত তার পাঠ বাচ্চারা সাধারণত মা-বাবার কাছ থেকেই পায়। যদিও অভিভাবকেরা সবসময়ই চেষ্টা করেন, নিজেরা ভুল কিছু না করতে, যাতে তার খারাপ প্রভাব বাচ্চার উপর না পড়ে। কিন্তু ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে হয়তো তারা শিশুটির সামনেই এমন ভুল করে বসেন, যার প্রভাব শিশুমনে পড়তে বাধ্য।

চাইল্ড সাইকোলজিস্টদের মতে, তাদের কাছে এমন অনেক কেস আসে, যেখানে বাচ্চার মা-বাবা নিজেদের ঝগড়া শেষ হলে, নিজেকে নির্দোষ প্রমাণ করার দায় থেকে একে অপরের নামে বাচ্চার কাছে দোষ চাপাবার চেষ্টা করে। ফলে বাচ্চা আরও কনফিউজড হয়ে যায়।

বাচ্চার উপর বড়োদের ঝগড়ার প্রভাব

  • আবসাদ : যে-বাচ্চা বাড়িতে মা-বাবাকে সবসময় ঝগড়া করতে দেখে বড়ো হতে থাকে, তার অবসাদগ্রস্ত হওয়াটা খুব স্বাভাবিক। বাচ্চা ভালোবাসার অভাব বোধ করে, যার ফলে বাচ্চা ডিপ্রেশনে চলে যায়।
  • সবসময় ভয়ে ভয়ে থাকে : শিশুটির সামনে ঝগড়া বিবাদ, মারামারি, গালিগালাজ করা, বাচ্চাকে কতটা প্রভাবিত করতে পারে, সেটা অনেক মা-বাবাই ঝগড়া করার সময় ভুলে যান। মা-বাবাকে ঝগড়া করতে দেখলে বাচ্চা ভয় পেয়ে যায়।
  • মানসিক অশান্তিতে ভোগে শিশু : বাড়িতে বড়োদের মধ্যে, বিশেষ করে মা-বাবার মধ্যে অশান্তি দেখলে, শিশুটির মধ্যেও মানসিক সমস্যা তৈরি হয়। তার ইনোসেন্স নষ্ট হয়ে যায়। জেদি এবং খিটখিটে মেজাজের হয়ে উঠতে থাকে। তার এই সমস্যার কারণ উপলব্ধি করতে করতে, বেশিরভাগ সময়ে মা-বাবা অনেক দেরি করে ফেলেন।
  • জীবনে অনেক কিছু হারিয়ে ফেলে : যে-বাচ্চার বাড়িতে সবসময় ঝগড়া, অশান্তির পরিবেশ থাকে, সেই বাচ্চার মানসিক বিকাশ বাধাপ্রাপ্ত হয়। অন্য শিশুদের তুলনায় খেলাধুলো, পড়াশোনায় পিছিয়ে পড়তে থাকে।
  • নিজেকেই দাযী করে : মা-বাবার মধ্যে রোজ দ্বৈরথ দেখতে দেখতে শিশুর মনে হতে থাকে সে এর জন্য দাযী। শিশুটি ডিপ্রেশনে চলে যায়, চুপচাপ হয়ে পড়ে। অনেক সময় আত্মহননের পথও বেছে নেয়।
  • ভরসা করা ছেড়ে দেয় : ঝগড়ার পরিবেশ বাচ্চাকে হতাশ করে তোলে। কিছুই তার মন ভালো করতে পারে না। কাউকে সে চট করে বিশ্বাস করতে পারে না এবং কেউ ভালোবাসলেও সেটা তার কাছে কৃত্রিম বলে মনে হয়।

খুব ছোটো বয়সের বাচ্চার উপর মা-বাবার বিবাদের প্রভাব একটু অন্য ভাবে পড়ে। শিশুটির, মা-বাবার মধ্যে হওয়া কথোপকথন ঠিক বুঝতে না পারলেও, তাদের মুড পরিষ্কার ধরা পড়ে বাচ্চার কাছে। দেখা যায় যে-পরিবারে স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে অশান্তি লেগেই থাকে, সেই বাড়ির শিশুটি নিজের মধ্যে গুটিয়ে যায়। তার মনে হয়, এবার মা-বাবা আলাদা হয়ে যাবে। তার সঙ্গে কেউ আর থাকবে না। নিজেকে অসুরক্ষিত মনে করে এবং কারও সঙ্গে মেলামেশা করতে আর কোথাও যেতে আসতেও দ্বিধাবোধ করে।

সন্তান বড়ো হয়ে গেলে মা-বাবা ভেবে নেন, নিজেদের ঝগড়ায় সে কারও একটা পক্ষ অবশ্যই নেবে। কিন্তু এই পরিস্থিতিতে বাচ্চার দমবন্ধ হয়ে আসার উপক্রম হয়। তার মনে হয়, এখানে সে না চাইতেই জড়িয়ে পড়ছে। কখনও কখনও সে গ্লানির শিকার হয়ে পড়ে এবং বাড়ির ওই পরিবেশের জন্য নিজেকে দোষী ভেবে নেয়।

শুধু মানসিক নয়, ঝগড়াঝাঁটির প্রভাব শরীরের ইমিউন সিস্টেমের উপরেও পড়ে। ফলে যে-কোনও অসুস্থতার সঙ্গে লড়ার শক্তি শরীর হারিয়ে ফেলে। বাড়িতে মা-বাবার মধ্যে অসন্তোষ বা দীর্ঘদিন ধরে চলতে থাকা ডিভোর্স কেস-এর প্রভাব, সন্তানের কোমল মনের উপর এসে পড়ে। সে শুধু শৈশবেই নয়, এর নেতিবাচক প্রভাবের সঙ্গে সারা জীবন ধরে যুঝতে থাকে।

পড়াশোনায় পর্যন্ত এর প্রভাব এসে পড়ে। এর ফলে শিক্ষার ক্ষেত্রে ভালো রেজাল্ট করতে পারে না বাচ্চা। এই নিয়ে অনেক সমীক্ষা করা হয়েছে। মা-বাবার সম্পর্ক নিয়ে বাচ্চার মনে অনিশ্চয়তা থাকলে, স্বাভাবিক ভাবেই তার নেতিবাচক প্রভাব পড়ে শিশুটির উপর।

এছাড়াও স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে অপ্রীতিকর সম্পর্ক বাচ্চার শরীরের উপর যেমন খারাপ প্রভাব ফেলে, তেমনি তার মানসিক বিকাশেও বাধা দেয়। নানা ধরনের মানসিক বিকার উৎপন্ন হতে পারে। হয় শিশুটি নিরাপত্তাহীনতায় ভোগে আর নয়তো ভুল পথে পা বাড়ায়। সুতরাং বড়োদেরই খেয়াল রাখতে হবে, তাদের ঝগড়ার প্রভাব কোনও ভাবেই যেন সন্তানের উপর না পড়ে। খুব স্বাভাবিক ভাবেই অন্যান্য আর-দশটা অভিভাবকদের মতোই, বাচ্চাকে মানুষ করার দাযিত্ব পালন করতে হবে।

 

অভিভাবকদের কী করা উচিত

  • নিজেকে গুরুত্ব না দিয়ে সন্তানের কথা আগে ভাবুন
  • সব স্বামী-স্ত্রীর মধ্যেই ঝগড়া হয়। কিন্তু যখন একজন রেগে রয়েছে তখন আর একজনের চুপ করে যাওয়াই বাঞ্ছনীয়। এতে পরিবেশ নিয়ন্ত্রণে থাকে
  • নিজেদের ঝগড়ায় বাচ্চাকে শামিল করবেন না
  • কোনও কথায় স্বামী-স্ত্রীর মনোমালিন্য হলেও শিশুটির সামনে একে অপরকে অপমান করবেন না
  • বাচ্চার সামনে খারাপ ভাষা প্রযোগ করবেন না
  • শিশুটির সামনে একে অপরকে গালিগালাজ করবেন না
  • খেয়াল রাখবেন যে-কথা আপনার মনে কষ্ট দিতে পারে, সেটা বাচ্চার কোমল হৃদয়কে কতটা আঘাত করতে পারে
  • স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে ঝগড়া বন্ধ না হলে অবশ্যই কাউন্সেলর-এর কাছে যান এবং পরামর্শ নিন।
আরো গল্প পড়তে ক্লিক করুন...