বোহেমিয়ান জীবনযাপনকেই হৃদরোগে আক্রান্ত হওয়ার প্রধান কারণ হিসাবে চিহ্নিত করছেন চিকিৎসকরা। এছাড়া, সতর্কতা স্লবং চিকিৎসা পদ্ধতি সম্পর্কে অজ্ঞানতার কারণেও রোগীরা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন এমনই ফল প্রকাশিত হয়েছে সমীক্ষায়। ধূমপান, মদ্যপান, হরমোন থেরাপির কুফল ছাড়াও, হৃদযন্ত্র বিকল হতে পারে বেশিদিন জন্মনিরোধক ওষুধ সেবন করলেও। হৃদরোগে আক্রান্ত হওয়া এবং আরও নানারকম সতর্কতামূলক বিষয়ে সম্প্রতি গুরুত্বপূর্ণ পরামর্শ দিলেন ডা. সৌম্য পাত্র।
হঠাৎ বুকে ব্যথা অনুভব করলে কী করা উচিত?
অনেকেই এ বিষয়ে সচেতন থাকেন না যে, বুকে ব্যথা হৃদরোগের একটি পূর্বাভাষ। বুকে ব্যথা হওয়াটা হৃদরোগের একটি সাধারণ লক্ষণ হওয়া সত্ত্বেও, অনেক সময়ই বুকে ব্যথার সঙ্গে হৃদরোগের সম্পর্কের কথা ভাবেন না অনেকেই। এক্ষেত্রে অন্যান্য লক্ষণ-এর দিকে নজর দিতে হয়। এছাড়া, হঠাৎ বুকে ব্যথা হলে, পাশে থাকা কাউকে জানানো জরুরি।
মহিলাদের ক্ষেত্রে হৃদরোগের লক্ষণ কী?
মহিলাদের ক্ষেত্রে হৃদরোগের সাধারণ ছয়টি লক্ষণ হল–
- বুকে ব্যথা এবং অস্বস্তি বোধ হওয়া। বুকে ব্যথা হওয়াটা হৃদরোগের একটি সাধারণ লক্ষণ। তা হলেও কিছু কিছু মহিলাদের ক্ষেত্রে এই বিষয়ে পুরুষদের থেকে পৃথক অভিজ্ঞতা হয়ে থাকে।
- হাতে, পিঠে, ঘাড়ে অথবা চোয়ালে ব্যথা অনুভব হয়। পাকস্থলিতে ব্যথা হয়।
- শ্বাসকষ্ট দেখা দিতে পারে। নাক দিয়ে রক্ত বের হয়, মাথা ঘোরার লক্ষণ দেখা দেয়।
- ঘাম বের হতে থাকে।
- শরীরে ক্লান্তি বা অবসাদ আসে।
আপনার স্বাভাবিক দৈনন্দিন কাজ করতে করতে যদি হঠাৎ করে ক্লান্তি বোধ করেন, তখন আপনাকে এই বিষয়ে অবহেলা না করে নজর দিতে হবে।
ক্লান্তি ভাব এবং সেই সঙ্গে বুকে প্রবল ব্যথা অনুভব করলে অবশ্যই সঙ্গে সঙ্গে ব্যবস্থা নিন।
সাধারণ ও হালকা কাজ, যেমন বিছানা করা, বাথরুমের দিকে যাওয়া অথবা দোকান-বাজারে যাওয়া, ইত্যাদি কাজেও যদি আপনার অস্বাভাবিক বেশি ক্লান্তি অনুভব হয়, তখন সেদিকে নজর দেওয়াটা জরুরি।
যদি ঘুমে বিঘ্ন ঘটে বা ঠিকমতো ঘুম না হয়, তখন সেটাও লক্ষ্য রাখতে হবে।
ঘাম হওয়া অথবা স্বাভাবিক শ্বাসকার্যের যদি বিঘ্ন ঘটে, তাহলে সতর্ক থাকতে হবে।
মহিলাদের ক্ষেত্রে বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে কম ব্যায়াম ও পরিশ্রমের কারণে এবং দেহের ওজন বেড়ে যাবার কারণে শ্বাসকার্যের বিঘ্ন ঘটতে পারে। অনেক মহিলাদের ক্ষেত্রে মেনোপজ-এর সময় সাধারণ লক্ষণ হল– শরীর গরম হয়ে যাওয়া এবং জ্বালা-জ্বালা ভাব।
কী কী কারণে হৃদরোগে আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা বাড়ে?
বেশি রাত জাগা, মানসিক চাপ, ডায়াবেটিস, ফাস্ট ফুড, ধূমপান, মদ্যপান, হরমোন থেরাপি ছাড়াও, বেশিদিন জন্ম-নিরোধক সেবন করলেও হূদরোগ হতে পারে। ওবেসিটিও হৃদযন্ত্র বিকল করতে পারে। রক্তে ব্যাড কোলেস্ট্রলের মাত্রা বেড়ে গেলেও হৃদরোগে আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা বাড়ে। এছাড়া করোনারি হার্ট ডিজিজ থাকলেও হৃদরোগ জটিল রূপ নেয়।
কোন বিষয়গুলির দিকে নজর দিতে হবে?
চিকিৎসককে যে-সমস্ত বিষয়গুলি খুলে বলতে হবে–
- দিন দিন দেহের ওজন লক্ষ্যণীয়ভাবে বেড়ে গেলে
- পায়ের তলা, গোড়ালি অথবা দেহের অন্য অংশ ঘেমে যেতে থাকলে
- স্বাভাবিক ভাবে শ্বাসকার্য করার পক্ষে কষ্টকর হতে থাকলে
- দৈনন্দিন কাজকর্মের সময় অস্বাভাবিক ক্লান্তি অনুভব করলে
- ঘনঘন জ্বর হতে থাকলে
প্রায় সময় বুকে ব্যথা অনুভব করলে
হৃদযন্ত্রটি ঠিকমতো কাজ করছে কিনা তা সাধারণ ভাবে বুঝবার উপায় কী?
- কফের রং লালাভ হয়ে গেলে। কফের সঙ্গে রক্ত মেশা মিউকাস বের হলে
- মনের মধ্যে বিভ্রান্তি দেখা দিচ্ছে, ঠিকমতো চিন্তা-ভাবনা করতে পারছেন না। মাথা ঘোরা ভাব অথবা হালকা মাথাব্যথা অনুভব হলে
- খাবার অভ্যাসের বদল ঘটছে অথবা খাবার খেতে অনিচ্ছা দেখা দিলে
এই অবস্থায় কী করা উচিত?
- দেরি না করে চিকিৎসকের কাছে গিয়ে এই বিষয়ে তার পরামর্শ গ্রহণ করুন
- খাবারের লেবেলগুলি ভালোভাবে দেখুন এবং উচ্চ মাত্রায় সোডিয়াম (লবণ) রয়েছে, সেই ধরনের খাবার এড়িয়ে চলুন
- নিজের স্বাস্থ্যের প্রতি যত্নশীল হোন এবং সেই বিষয়টিকে অগ্রাধিকার দিন।
যদি কারওর শ্বাসকার্য বন্ধ হয়ে যায়, তখন কী করতে হবে?
সিপিআর তখন জীবনকে রক্ষা করতে পারে। কার্ডিও পালমোনারি রিসাসিটেশন (সিপিআর) হল প্রকৃত অর্থেই একটি জীবনরক্ষাকারী চিকিৎসা পদ্ধতি, যার সাহায্যে হৃদরোগে আক্রান্ত কোনও মানুষের জীবনকে রক্ষা করা যায়। যখন মানুষের হৃদযন্ত্রটি কাজ করতে পারে না, তখন এই পদ্ধতির সাহায্যে রক্তকে পাম্প করে সারা দেহে ছড়িয়ে দেওয়া হয়। এক্ষেত্রে রোগীর মুখে মুখ দিয়ে অক্সিজেন সরবরাহ করতে হবে এবং দু’হাত দিয়ে বুকে পাম্প করতে হবে।
সিপিআর ব্যবস্থা চালু করার পর শরীরের মধ্যে কী ধরনের উন্নতির লক্ষণ দেখা দিতে পারে?
- কাশি হওয়া
- চোখ খুলে তাকানো
- কথা বলতে পারা এবং উদ্দেশ্যপূর্ণভাবে অঙ্গ সঞ্চালন করা
- স্বাভাবিক ভাবে শ্বাসকার্য করতে পারা
- আর যখন অসুস্থ ব্যক্তি তার চেতনা ফিরে পাবে এবং ধীরে ধীরে স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরতে শুরু করবে, তখন সিপিআর বন্ধ করে দিতে হবে। যদি দেখা যায় যে, রোগী স্বাভাবিকভাবে শ্বাসকার্য করছে কিন্তু অচেতন রয়ে গিয়েছে, তখন তার জ্ঞান ফিরে না পাওয়া পর্যন্ত তার দিকে নজর রাখুন। দেখা গিয়েছে যে ভারতীয়দের মধ্যে ৯৮ শতাংশই সিপিআর সম্পর্কে কিছু জানেন না।
সিপিআর কেবলমাত্র জলে ডুবে যাওয়া মানুষকে বাঁচিয়ে তোলার পক্ষে কার্যকরই নয়, এটা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ প্রাথমিক চিকিৎসা। এর সাহায্যে অজ্ঞান হয়ে যাওয়া কিংবা হৃদরোগে আক্রান্ত মানুষকে বাঁচিয়ে তোলা যায়। যারা সিপিআর-এর সাহায্য পেয়েছে, তাদের ক্ষেত্রে জীবন রক্ষা দুই বা তিনগুণ বেড়ে গিয়েছে। ভারতে প্রকৃত তথ্যের অভাবে এই বিষয়গুলি পরিচালনা করা কঠিন হয়ে পড়ে। তাহলেও ভারতকেই কিন্তু বলা হয় হূদরোগ, ডায়াবেটিস এবং ওবেসিটি-র দেশ। আসল বিষয় হল– হৃদরোগ হবার মতো কারণগুলি আমাদের দেশেই বেশি মাত্রায় প্রকাশ পায়। সেই কারণে হৃদরোগে মৃত্যুর হার আমাদের দেশেই সবচেয়ে বেশি।।
মহিলাদের সিপিআর গ্রহণ করার ক্ষেত্রে বিভিন্ন বিষয়গুলি কী কী?
সমীক্ষা করে দেখা গিয়েছে যে, মহিলারা পুরুষদের তুলনায় সিপিআর-কে কম পছন্দ করেন। সমাজে লিঙ্গ বিচারের বিষয়টিই এখানে প্রধান কারণ হিসেবে দেখা দেয়। মহিলাদের ক্ষেত্রে এ বিষয়ে নানাবিধ ভয় বেশি করে কাজ করে। এর মধ্যে রয়েছে ভুল বোঝার ভয়। তাছাড়া সিপিআর-এর সময় মহিলাদের বুকে বেশি করে চাপ দেবার বিষয়টি অনেকে পছন্দ করে না। সেই কারণে তারা সিপিআর নিতে দ্বিধা করে। তাছাড়া আমাদের সমাজ পশ্চিমি সমাজ ব্যবস্থার চেয়ে অনেক আলাদা। তাই বেশি করে শারীরিক ঘনিষ্ঠতাকে আমাদের সমাজ মেনে নিতে পারে না। তাই প্রত্যেককে সিপিআর সম্পর্কে ট্রেনিং দেওয়াটা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এই বিষয়টি সেই সমস্ত মানুষের কাছে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ, যারা সাধারণ মানুষের মধ্যে কাজ করে। যেমন– ট্রাফিক পুলিশ কিংবা জরুরি পরিষেবায় কর্মরত মানুষ। তথ্য পরিসংখ্যান বলছে, ভারতে হূদরোগীর সংখ্যা ক্রমশ বেড়েই চলেছে। এই অবস্থায় মনে করা যেতে পারে যে, সিপিআর চিকিৎসা পদ্ধতি শিখে নিয়ে এর হাত থেকে রোগীদের রক্ষা করার চেষ্টা করা উচিত প্রত্যেকের।
হৃদযন্ত্র বিকল হওয়ার হাত থেকে আমরা কীভাবে বাঁচতে পারি?
হৃদযন্ত্র বিকল হওয়ার চিকিৎসা পদ্ধতির সার্থক প্রয়োগ আমাদের জীবনকে দীর্ঘস্থায়ী করতে পারে। আমাদের জীবনযাপনের মানকেও বাড়াতে সাহায্য করে। হূদযন্ত্র বিকল হওয়ার চিকিৎসা ওষুধ প্রয়োগের সাহায্যে করা যেতে পারে। যেমন ক্লান্তি, শ্বাসকষ্ট, ঘেমে যাওয়া ইত্যাদি নিয়ন্ত্রণ করার জন্য যথাযথ ওষুধ প্রয়োগ করতে হবে। এর মাধ্যমে দেহে শক্তির মাত্রা বাড়ানো সম্ভব হয়। পাশাপাশি মানুষকেও শারীরিক ভাবে সক্ষম হয়ে ওঠার চেষ্টা করে যেতে হবে। সৗভাগ্যক্রমে হূদযন্ত্র বিকল হওয়ার চিকিৎসা পদ্ধতি আমাদের সামনে রয়েছে। ভালো ভাবে চিকিৎসা এবং পরিচর্যা পেলে এবং চিকিৎসকের পরামর্শ ঠিক মতো মেনে চললে, হূদরোগের বিষয়ে সচেতন হলে নিশ্চিন্তে জীবনযাপন করা সম্ভব।
চিকিৎসক আপনার শারীরিক অবস্থা পর্যবেক্ষণ করে যে ওষুধ আপনাকে গ্রহণ করতে বলবেন, আপনি চিকিৎসকের সেই পরামর্শ মেনে চলবেন। তাঁর নির্দেশমতো খাবার গ্রহণ এবং নির্দিষ্ট কিছু ব্যায়াম করে যেতে হবে আপনাকে। তাহলেই হৃদরোগের হাত থেকে আপনি রক্ষা পেতে পারেন।