হাতছানি
তখন তেড়ে বর্ষা, জুনের শেষের দিক… বেড়াবার জায়গা খুঁজছি নেটে। আলগোছে এটা-সেটা দেখতে দেখতে চোখে পড়ল বরফঢাকা পাহাড়ের কোলে পান্না সবুজ শেষনাগ। পাহাড়ি ঢালে ভেড়া চরছে আর রুক্ষ প্রকৃতির মাঝখান দিয়ে সুতোর মতো এক চিলতে পথের পরতে-পরতে এঁকেবেঁকে মানুষের সারি। লোভ উসকে দেবার একশো আয়োজন নিয়ে কভার পিকচার হাতছানিতে রেডি। পেজটি আসলে অমরনাথ যাত্রার ও যাত্রার ফর্ম এখান থেকেই জমা নিচ্ছে। ব্যস, নেটসার্ফিং-এর ক্যাজুয়াল ভাব গোল্লায় গিয়ে লাফিয়ে উঠল মন ‘যাব’ বলে। কিন্তু কীভাবে? বাকি প্রয়োজন মিটলে তবে না! মিডিল অফ জুনে যাত্রা শুরু হয়েছে যা বন্ধ হতে জুলাইয়ের শেষ। তার মানে হাতে পাচ্ছি বিশ-বাইশটা দিন। এর মধ্যেই ফর্ম ফিলআপ, রিজার্ভেশন, পোশাক-আশাক, ফিট সার্টিফিকেট… কঠিন জায়গার কঠিন প্রস্তুতি।
খ্যাপামি
জানি, ঝাঁকায় করে টিকিট নিয়ে রেল দফতর বসে নেই যে চাইলেই দু’খিলি পান খাইয়ে হাত বাড়াবেন ‘নিন গো দিদি’ বলে। তবু… চোখের ওপর উড়ছে অমরাবতীর আকাশ- বরফঠান্ডা বাতাস। পিছু হটার ভাবনা আমলই পাচ্ছে না। এ পথ মোটে দেড়-দু’মাসের জন্য খুলেই ফের তুষার গ্রাসের কবলে চলে যায়। সুতরাং মিস মানে সেই পরের বছর। সঙ্গে-সঙ্গে নেট-এ যেতে হল ট্রেন টিকিটের সাইটে। কিন্তু সবাই যে খেয়ালি নন তার ছাপ ছড়িয়ে আছে অ্যাভেলেবিলিটির পাতায়। ‘নো রুম’ পড়তে-পড়তে চোখে চালশে। ওরই মধ্যে হিমগিরি এক্সপ্রেসে ক’টা বাঁচাখোঁচা তখনও। এবার সঙ্গী হিসেবে যাদের পেতে চাই, জিজ্ঞাসা না করেই টিকিট কাটলাম তাদেরও।
বেড়ানোর ইচ্ছে একটা খ্যাপামির মতো। আমি ফড়িং হয়ে ছোট্ট পাখায় উড়ি তো মন দৌড়োয় ফিঙের ডানায়। অথচ ক-ত-কি-ছু। আছে ফর্ম ফিলআপ, সঙ্গীদের অনুমোদন… তবু ডেফিনিট পা ফেলেছি যেই, মন ‘পিসুটপ’-এর চড়াই ভাঙছে। ‘পেতে চাই’-টা জোরদার ছিল বলে এগোনো যাচ্ছে আর ইচ্ছেকে মান দিতে গেলে যেতেও হয়। আগ্রাসী আমি আদ্যান্ত এগিয়েও ঝকমারি চলছেই। বাকিদের যে বলাই হয়নি। কিন্তু কে জানত ঘাপটি মেরে আছে বিপুল বিস্ময়। ‘অমরনাথ’ শোনামাত্র তাদের উৎসাহের বাঁধ ভাঙল, বুঝিয়ে দিল ভুল।
‘দহ’ থেকে দয়া-য়
এবার নড়ে চড়ে বসতে হল। টিকিটের খোঁজে ঘোরাঘুরি শুরু হতেই দিল্লি অবধি ‘দুরন্ত এক্সপ্রেস’ ও ‘রাজধানী-জম্মু’র ই-টিকিট হয়ে গেল। পরের পর্যায়ে শুধু পহেলগাঁ অবধি পৌঁছোনো চাই। পড়লাম এবার হেলিকপ্টার নিয়ে। অমরনাথ শ্রাইন বোর্ডের যে সাইট দেখে অ্যাদ্দুর এগোলাম, এবার সেখান থেকে চাই রেজিস্ট্রেশন। ফর্মের সাধাসিধে প্রশ্নাবলী নিয়ে দিব্যি চলেছি, আটকালাম ‘হেল্থ’এ এসে। ডক্টরের নো অবজেকশন সার্টিফিকেট চাই। আরও চাই বললেই তো পাই না। ব্লাডগ্রুপ টেস্ট করানো, দুরারোগ্য রোগী নই জানিয়ে ডা.-এর মুচলেকা দেওয়া… অবশেষে দিন পাঁচেকে সব জুটিয়ে নিয়ে বসা গেল। কিন্তু সাইট এবার দাঁত ছরকুটে চেত্তা খাওয়া ঘুড়ি। ‘যাব’-‘যাব’ পাগলামি আর ঘাঁটাঘাঁটিতে তিনি একজস্টেড, খুললই না। প্রায় কাঁচা ঘুঁটি পাকা করে ফেলে শেষে কিনা দহ? ভাবা ছিল পহেলগাঁও থেকে চন্দনবাড়ি হয়ে ঘোড়ায় যাব ও ফিরব বালতাল দিয়ে হেলিকপ্টারে। হেঁটে হবে না, কেন না রাস্তা বিপদসংকুল। ঘনঘন ল্যান্ডস্লাইড, স্টিফ চড়াই-উতরাই ও খাদ পাহাড়ের মাঝখান দিয়ে কখনও ফুট দু-একের রাস্তা। এ সবও পরে, আগে রেজিস্ট্রেশন দরকার।
অতঃপর মেল-এ হেলিকপ্টার সার্ভিসেস-এর টেক্সট- ‘উড়ান অ্যাভেল করতে চাইলে টিকিট কাটুন- না হলে প্রেফারেন্স ডেটে পাবেন না।’ ফের সাইটে গিয়ে রেজিস্ট্রেশন করলাম এবং পঞ্চতরণী-বালতাল হেলিকপ্টর-এর টিকিট কেটে ফেললাম।
যাত্রা হল শুরু
যেই সব মিটে গেল, শুরু হল হাজারো প্রস্তুতি। ব্যাপারটা ইউজ্যুয়াল বেড়ানোর মতন যে নয় তা বুঝে গেছি। এরই মধ্যে দূরের এক যাত্রা-সাথির ফোন, কি কিনবে, কতটা প্রিপারেশন, স্লিপিংব্যাগ, সোয়েটার, জ্যাকেট… উত্তর দিতে-দিতে ও সবটার সঙ্গে জুড়তে জুড়তে ফের ছন্দে ফিরলাম। জুলাইয়ের তৃতীয় সপ্তাহ। ভোর সবে প্ল্যাটফর্মের কারশেড ছুঁয়ে নামছে, আমরা পৗঁছে গেলাম জম্মু। জানতাম যে জম্মু থেকে পহেলগাঁও শেয়ার জিপে যাওয়াই শ্রেয়। ওদিকে ট্যাক্সির পর ট্যাক্সি ছাড়লেও সবাই ‘শ্রীনগর শ্রীনগর’ চ্যাঁচায়। ক্রমশ যাত্রীশূন্য স্ট্যান্ডে ‘পহেলগাঁও’ শোনার অপেক্ষায় শুধু আমরাই দাঁড়িয়ে। অমরনাথের যাত্রী প্রায় নেই বললেই হয়। যদিও এই শেষ দিকে যাওয়ায় অসুবিধের চেয়ে সুবিধে পেয়েছি বেশি। আসছি তা’তে পরে। আগে বেসক্যাম্পে পৌঁছোই।
উড়াল
প্রায় ঘন্টাখানেক বাদে এক ড্রাইভার এল বোলেরো চালিয়ে। বাড়ি তার পহেলগাঁও, পথে পাবলিক পেলে রথ দেখা কলা বেচা সেরে নেবে। ভাগ্যিস! মুক্তচিত্তে এবার সুস্থির হয়ে বসা গেল। গাড়ি ছাড়তেই মনে ফূর্তির রোদ। একে অজানাকে জানার ইচ্ছেয় ভিতরটা লাফাচ্ছে তায় কাছে দূরের পাহাড়ে অফুরন্ত সবুজ। সময়টা ঠিকঠাক। জুলাই, মানে কাশ্মীরের গ্রীষ্মকাল। পরিপাটি রাস্তা, ভোরবেলাকার পবিত্রতা দিয়ে ধুয়ে যাচ্ছে সকাল। গাড়ি ছেড়েছে তখন আটটা। বেলা বাড়তে রেস্টুরেন্টে লাঞ্চ সেরে ফের উঠলাম ড্রাইভারের পাশের সিটে। সারাদিনে কখনও নদী, কখনও আপেল খেত, কখনও ড্রাইভারের বাড়ির উঠোন পেরিয়ে একসময় পৌঁছে গেলাম পহেলগাঁও। তখন সন্ধ্যার মুখ, কোথাও উঠতে হবে। তিনটে দেখাদেখির পরে সটান উঠলাম সেই হোটেলটায় যেটা বাসআড্ডা থেকে দেখা যাচ্ছিল দূরে– জঙ্গলের কপালে টিপের মতো। একেবারেই নতুন, সবুজ বনানীর ফাঁকে জ্বলজ্বল করছিল লাল-হলুদ বাহার নিয়ে একলা। খানিকটা উঁচুতে। এখন ‘নেব-নেব না’-র দোনামনা দেখে মালিক আশ্বস্ত করল, ‘নেচারমে রহনে কে লিয়ে আয়ে হো, রহে যাও। আনে যানে কা দিক্বত নেহি, মেন চৗকমে হোটেল কা গাড়ি ছোড় দেগা।’ আর কি চাই, চোখের সামনে লিডার নদী, নদীর পাশে ঘোড়ার সারি আর সাতশো কিসিমের ফুলের বিছানা বিছিয়ে পহেলগাঁও আনমনে শুয়ে। তার সবুজ এলোচুলের মাঝখানে কুয়াশার সাতকাহন। যেন সম্ভাবনার স্বপ্নে মজে টুকরো-টুকরো সুখের মুখ।
পূর্তি দিয়ে পূণ্যি
আমাদের যাত্রা পরদিনই, সুতরাং সরেজমিন তদারকিতে বেরোতে হল। শ্রাইন বোর্ড অফিসের খোঁজ, কিছু জানা, নিজেদেরটা জানানো, সেই বুঝে ব্যবস্থা নেওয়া, কাজ অঢেল। খোঁজখবর নিতে, গিয়ে পড়লাম এক বিস্তৃত প্রাঙ্গণে। সাজগোজ করা অফিস, নানা ধর্মের পতাকা ওড়ানো ভক্তবৃন্দ, মোবাইল রিচার্জ ও সিম বদলের দোকান, তাগাড় দেওয়া সোয়েটার-কম্বল, তাঁবু, ফুডস্টল। ঠিক মনঃপূত হল না পরিবেশ। কেমন যেন খাবি খাওয়া বিধবস্ত দশা। অফিস আছে, লোক নেই। তাঁবু অনেক, মানুষ নেই। শুধু ফুডস্টলগুলো মুখর। অমরনাথ শ্রাইন বোর্ড এখান থেকেই যাত্রা শুরুর ব্যবস্থা রেখেছে। এটাই বেসক্যাম্প, কিন্তু প্রকৃতিগত ভাবে ভাঙা হাট। ইতিমধ্যে অফিসে লোক এল, কাজকর্ম মিটিয়ে গুটি গুটি এগোলাম স্টলের দিকে।
এই একটা ব্যাপার সারা অমরনাথের মুখ্য জায়গাগুলো জুড়ে। কী খাবার এখানে আছে আর কী যে নেই তা গবেষণার বিষয়। ভারতের সমস্ত রাজ্যের সেরা খাবারের দেদার আয়োজন। সবটা এ-ক্লাস শুধু নয়, পরিষেবাও বিনামূল্যে। চা থেকে চানা-বাটোরা থেকে সবজি, পায়েস, রোস্টেড পেস্তা-আখরোট-কাজু, ফল, ফুচকা, লাড্ডু, লো-ফ্যাট কার্ড, ব্রেড-রোটি, উপমা, জিরা রাইস, পোলাও মায় ফ্রুট জুস, হার্বাল টি, জোয়ান, বলে শেষ হবে না মেনু। বিভিন্ন ভাণ্ডারায় ২০ থেকে শুরু করে প্রায় ৫৬ রকম আইটেম। সেবা কার্যে নিয়োজিত কত যে মানুষ, আর সমস্ত কাজটা ভাণ্ডারা অর্গানাইজেশন করে চলেছে অমরনাথ সাইনবোর্ডের সঙ্গে সঙ্গতি রেখে। সেবকদল কোনও কোনও ভাণ্ডারায় পরিচয়জ্ঞাপক ড্রেসে আছে তো কেউ-কেউ ক্যাজুয়াল ড্রেসে। লক্ষ্য সেই এক– সেবাদান। পূর্ণার্থীকে তৃিঀ৫ দিয়ে পূণ্যির দান জমানো। ওই উচ্চতা, এত মানুষ, আবহাওয়ার বৈপরিত্য সামলে যে কি করে তা অর্গানাইজড ওয়েতে চলেছে, না দেখলে বোঝা যাবে না। কোথাও জমে থাকা জঞ্জাল নেই, খাবারের প্রতিটি ট্রে বার্নারের ওপর তীব্র ঠান্ডাতেও ছ্যাঁকা লাগা উত্তাপে উষ্ণ। গ্যাস সিলিন্ডার, কাঁচা বাজার, চাল-চিনি-মশলাপাতি, কত যে স্টক, বিপুল যজ্ঞ। নিজেরাই হেঁটে উঠতে পারছি না ওদিকে এতসব মজুত প্রতি পাঁচ-সাত কিলোমিটার অন্তর। বরফে বরফ চারিধার, পিসুটপের চড়াই, তারপরেও, বিস্ময় অতল।
জয় জওয়ান
চন্দনবাড়ি থেকে মোট ৩২ কিলোমিটার পথে যতই উত্তর দিতে দিতে যাই না কেন, শেষ হয় না প্রশ্ন। ১৬ কিমি পর্যন্ত শেষনাগের রাস্তা ঝিম ধরানো সৌন্দর্যের খনি যেমন, তেমনি কঠিনতম। যদিও এ পথের সর্বোচ্চ পয়েন্ট মহাগুনাস পাস, যে পাস শেষনাগ ও পঞ্চতরণীর পিককে দোলনার মতো ধরে আছে। শেষনাগ থেকে ১৪ কিমি দূরে পঞ্চতরণী, রূপ ও মহিমায় সেরার সেরা। কী নেই সেখানে, জল, জঙ্গল, বরফিলা চূড়া, ঝরণা, সাঁকো, সোঁতা, মৗনতা। মাধুরী অশেষ। এরপর ৩ কিমি এগোতেই সংগম পয়েন্টে বালতালের রাস্তার সঙ্গে দেখা। বাকি ৩ কিমি উতরাই ও গ্লেসিয়ার। পেরোতে পারলেই বিপুল বিস্তার নিয়ে অমরনাথ গুহা।
এই সারা পথ জুড়ে ভারতীয় সেনাবাহিনীর অবদান বিবরণের বাইরে। কে কোথায় হাঁটতে পারছে না, দেবদূতের মতো হাজির জওয়ান। কেউ অন্ধকারে হা-ক্লান্ত হয়ে আসছে, তাঁকে টর্চের আলো দেখিয়ে এনে গরম পানীয়ে চাঙ্গা করছে জওয়ান, কারুর শারীরিক অসুবিধেয় কোলে করে এনে চিকিৎসার ব্যবস্থা করা, সব কিছু সামলাচ্ছে হাসিমুখে। স্লঁরা মনপ্রাণ সঁপে নিয়োজিত বলেই যাত্রা নিরুদ্বিগ্ন। যদি কর্তব্য ও মহানুভবতার দিক এটা হয় তো বাকি খাটনি অন্যত্র। সেখানে দেশের দায়, দশের দায়। যেমন কথায় কথায় রাস্তায় ল্যান্ডস্লাইড, সে সমস্ত পরিষ্কার করে পূর্বাবস্থায় ফেরানো, যাত্রা পরিচালনা করা… একদম তুখোড় কুশলতা।
আজকের দিনে অমরনাথ যাত্রা আর হানাদারীর বার্তা একটা সমাপাতনের মতো। একের উচ্চারণে অন্যটি আপনি এসে দাঁড়ায়। এ জায়গার এফিসিয়েন্সি প্রশ্নাতীত। এক হাতে রিলিফ অন্য হাতে আর্মস নিয়ে সেনাদল কর্তব্যকর্মে নিবিড়। ছেয়ে আছে সর্বত্র… ভর্তি যাত্রীসহ বাস আসছে সেখানে, অস্থায়ী টেন্টে, ভাণ্ডারায়। যদিও সিকিউরিটি ফোর্সের কাছে নাইট ভিশন ক্যাপাবিলিটির সহযোগ ভরপুর, আছে বুলেট প্রুফ বাঙ্কার, তবু চ্যালেঞ্জ বইকি। সজাগ, সতর্ক, নিবেদিত প্রাণ জওয়ান-মনোযোগ পথের প্রতি ইঞ্চিতে।
প্রস্তুতি
ঘোড়া ঠিক করতে গিয়ে পড়েছি বিপুল সমস্যায়। এখন প্রায় ফাঁকা মাঠ, গোল দিলেই বল জড়াবে জালে। মানে ওপরে ওঠার যাত্রী নেই অথচ ঘোড়াওয়ালা ঢের। শেষের দিকে আসার ফল ফলতে শুরু করেছে। যতদূর দৃষ্টি যায়, দেদার ফাঁকা। সবুজ পাহাড়, গায়ে তার ঘাস চিবুনি একটি-দুটি ভেড়া আর মাঝে মধ্যেই তিরতিরিয়ে নেমে আসা সোঁতা। পা ভিজিয়ে গা ভিজিয়ে গান শুনিয়ে চলল। ছবিতে যেমন অহরহ দেখে থাকি, তেমন সারি সারি পিলপিলানো মানুষ নেই। শুরুতেই তাই দারুণ ভালো লাগা।
কিন্তু বেশিক্ষণ মুগ্ধতায় থাকা গেল না, ঘোড়া চড়াই ভাঙছে। সাংঘাতিক খাড়াই রাস্তায় টালমাটাল শরীর ক্লান্ত হচ্ছে ঘোড়ায় বসেও। যে সে নয়, এ পিসুটপের চড়াই, যাত্রা শুরু হল শক্ত প্রশ্ন দিয়ে। এন্তার এলোপাতাড়ি আপ-ডাউন, কাদা আর ঘোড়ার পটিতে থকথকে পথে ঘোড়াবাবাজির চার ঠ্যাং-এর কোনও এক ঠ্যাং ছেতরে চলেছে। গেল গেল ভাব সারাক্ষণ। বুঝতে পারছি, বরফ গলছে। খাতা বন্ধ করতে চলেছে পাহাড়, মাটি-জলে পথ বিপৎসংকুল। হেঁটে না উঠেও দম পুরো ফুস।
বাঁচাখোঁচা দমটুকু হাতড়ে নিয়ে চলেছি। মহাগুনাস পাস পেরোলাম, পেরোলাম পোষপাতরী। এখানে পাহাড়ের চূড়া যেন কেকের ওপরের আইসিং। ভারি যত্ন দিয়ে সাজানো। কুয়াশার চাদর সরিয়ে সূর্য কখনও দ্যুতি ছড়াচ্ছে, কখনও মুখ ঢাকছে। যেতে-যেতে বারবার মনের মধ্যে প্রণিপাত, তিনি চেয়েছেন বলেই আসতে পেরেছি, তিনি চাইলে তবেই ফিরতে পারব। এ এমন এক বন্যতা, যা চেতনাকে কিনারায় নিয়ে রাখে। যে-কোনও মুহূর্তে যা কিছু ঘটতে পারে। বেঁচে থাকতে পারি নাও পারি, এ’কথা রিংরিং করে মনের মধ্যে অনর্গল। এই রূপশালী প্রকৃতির কী ছেড়ে কী দেখি, কাকে যে দেখি। দুরূহ রাস্তা পেরোবার কিছু কানুন আছে, যা জানা ছিল না, অবস্থার ফেরে পড়ে বুঝলাম। যেমন এতটাই বেয়াড়া বাঁক কোথাও, যে সওয়ারিসমেত ঘোড়া নিয়ে এগোনোর প্রশ্ন ওঠে না, নামতেই হয়। তারপর সহিস ঘোড়া সামলে এগিয়ে যায়, গিয়ে দাঁড়ায় অপেক্ষাকৃত সুবিধেজনক জায়গায় আর মোক্ষম চ্যালেঞ্জে পড়ে যাত্রী। আসলে সরু যে পথে হেঁটে এগোচ্ছি, উলটোদিক থেকে সে পথেই আসছে ঘোড়া। হাজারো হাজারো ঘোড়ার বর্জ্য, বরফ গলা জল, ঝিরঝিরে ঝরনার উড়তি কণা, খাদ, কখনও পায়ের গোছ অবধি ডুবে যাওয়া তুষারপথ সামলে এগোনো। এই মাপের দুরূহ অবস্থা ভাবতে পারিনি বলেই ফেলে মারার শাস্তি জুটেছে মনে হয়। ছাড়ান নেই। পেরোতে হবে মানে হবেই।
স্বপ্নের নানারূপ
কেঁদে ককিয়ে, আধো বেঁচে আধো মরে একসময় পৌঁছে গেলাম শেষনাগ। ওটুকু অপারগতা বাদ দিলে সহিসকে পাই যে-কোনও অবস্থানে, যে-কোনও অবস্থায়। এখানে জীবন-মৃত্যুর চুল পরিমাণ ফাঁকের মধ্যে ঘোড়াওয়ালার ছড়ি-লাগামই ভরসা। ঘোড়া নিশ্চিন্তে পিছলোচ্ছে আর সওয়ারি সহিস-ভরসায় বিন্দাস। সে দায় তার, সওয়ার ও সওয়ারি দু’জনের। কীভাবে সে পারছে জানি না তবে অমরনাথের পথে এ আর এক দর্শন ‘অমরাথের’। নিজেকে শতধায় তিনি ছড়িয়ে রেখেছেন সর্বত্র!
এগিয়ে যাচ্ছি এগোতে হবে বলেই। ভাণ্ডারায় ঢোকার অবকাশ নেই, থাকব পঞ্চতরণীতে। উষ্ণ খাবার সেধে সেধে দিচ্ছে তারা সারাক্ষণ। এমনকী ঘোড়ায় চড়ে যখন এগোচ্ছি, দৗড়ে এসে কেউ ফ্রুটজুস ধরিয়ে গেল তো পাশের ভাণ্ডারার মানুষ দিয়ে গেল লাঠি, কেউ রুদ্রাক্ষ। পূণ্যের এই সেবাদানী ব্যাখ্যায় ও পার্থিব প্রাপ্তিবিহীন উদ্যোগে আপ্লুত মন আর্দ্র হয়েছে শতবার।
রূপের খনি
বেলা গেছে, বিকেলও ফুরোতে চলল। এসে গেছি শুদ্ধি-লোভে সবুজ জলের কোলে। এ কোল পাতা আছে অমরনাথ গুহার ৬ কিমি আগে। তুষারলিঙ্গের কাছে পৌঁছোনো যদি একটা লক্ষ্য হয়, তবে পৌঁছোতে যতগুলি উপলক্ষ্য, অমরনাথ তার সবটা জুড়ে আছেন নিজেকে একশো ভাগে ভেঙে। এমনই এক ছোট্ট ভাগের নাম- পঞ্চতরণী। সৌন্দর্যে, বন্যতায়, আবহাওয়ার আনপ্রেডিক্টেবল ধাঁচধরণ নিয়ে তার উপস্থিতি তীব্র, স্বনিয়ন্ত্রিত। গা থেকে বচ্ছরকার বরফ খসিয়ে ফেলে এই ফুটে ওঠার মাঝে দেড়মাস কেটে গেছে, তবু আদিম ভাব তার এখনও সোচ্চার। এখানে রাত কাটাতে হবে ভেবেই ভিতরে ধুকুরপুকুর ভয়। চারিদিকে প্রচুর তাঁবু, তবু মাথায় ছাউনি তাদের কোনওটা নীল, কোনওটা সবুজ, কমলা, লাল। পাহাড় জুড়ে বরফ, পাদদেশে তার সবে জন্মানো কাঁচাসবুজ গুল্ম, তিরতিরে সোঁতার ওপর কাঠের সাঁকো আর রাজকীয় গরিমায় পঞ্চতরণীর শ্রেষ্ঠ মহিমা হয়ে টলটলাচ্ছে স্বপ্নসবুজ জল। এই ঐশ্বরিক সৌন্দর্য শুধু উপলব্ধির। কীসের টানে আমি এখানে তার উত্তর প্রতি পরতে সাজিয়ে বসে আছে চরাচর। না এলে অপূর্ণ জীবন।
বেছেবুছে তাঁবুতে
পৌঁছে গেছি। এবার বেছেবুছে একটা তাঁবুতে উঠলাম। হ্যাঁ, ঠিকই, বেছেবুছে। এই যে বললাম, শেষের দিকে আসার সুফল ফলতেঞ্জশুরু করেছে।ঞ্জএক-একটা তাঁবুতে কম করে বারো থেকে ষোলোটি শোবার জায়গা, অথচ কোথাওই দু’তিন জনের বেশি নেই। আমরা খুঁজেপেতে পুরো খালি একটাই চাইলাম, হয়েও গেল ব্যবস্থা। আহা, তারপর থেকে শুধু শীতে জবুথুবু কাঁপা, আর প্রকৃতিতে তাকিয়ে তাকিয়ে আনমনা হওয়া। ব্যস। এরই মধ্যে শরীরে ঠান্ডা আর অন্তরে রূপময় প্রকৃতির দাপট সইয়ে নিয়ে অন্দরে ফিরে চাইলাম। এক কোণায় একটা ব্যাটারি-হারিকেন আর পায়ের তলায় বিছানো খড়ের ওপর সারসার খাটিয়া। তবু যাহোক ঠিকঠাক এখানটা। কিন্তু পঞ্চতরণী থেকে অমরনাথ যেতে যেসব তাঁবু, তা সোজাসুজি বরফের ওপর পাতা। ভাবতেই পারলাম না মানুষ থাকল কী করে- তা সে যতই খড় বিছানো ঘর আর স্লিপিং ব্যাগের ওম হোক।
ভেতরে এসেও মন বসছে না। সূর্য ঢলছে, দিন পালাচ্ছে। মোটে একটা রাতের থাকায় কী জানি কী মিস করছি, অপার্থিব কিছু কি হারাচ্ছি? বাইরে বেরোলাম। সরু, পাথুরে পথে পাহাড়ি ঝরনা খেলছে, পা ফেলছি সতর্ক হয়ে। আচমকা কোনও বাঁকে সবুজরঙা জল দেখা দিয়েই মেলাচ্ছে, তারপর হঠাৎই একসময় টন টন বরফের মাঝে পান্নারঙা আলো, পৗঁছে গেছি স্বপ্ননদীর কাছে। হূদকোরকে কাঁপন, বুঝতে পারছি- ফুল ফুটছে। পাহাড় পাহাড় বেয়ে ধারা। স্রোতস্বিনী নামতে নামতে তুষার সোঁতায় বদলে গিয়ে মিশছে জলে, চুড়োর খাঁজে-ভাঁজে আটকে যাচ্ছে চারু মেঘের দল। জল আয়নায় পাহাড়ের প্রতিচ্ছবি আর বাস্তব চোখের আঙিনায় সিধেসাদা পরমেশ। কাকে দেখি! ছায়ামায়ার মুখ না বাউলিনি বিউটি এই ভাবতেই বেলা গেল। হু-হু ঠান্ডা হাওয়া যে কোথা থেকে আসছে ধেয়ে কে জানে।
আকাশ-পাহাড়-লেক ছাপিয়ে নজর গেল নীচের সাঁকোয়, সে একলা ভিজছে, ওপর দিয়ে ছোটো ছোটো ঢেউয়ের তিরতিরে জল অনর্গল।
দেখব ভিতরপুরে
ঘোড়াওলা ভোর পাঁচটায় আসবে বলে গেল, তাড়াতাড়ি বেরোতে চায়। অমরনাথ ঘুরে পঞ্চতরণীতে আমাদের রেখে ওরা সেদিনই ফিরবে। ফিরব আমরাও। হেলিকপ্টারে বালতালের পথে। এবার ঘুমোবার আপ্রাণ চেষ্টায় কাটল সারারাত। কী যে অস্বস্তি, কেন যে চারটে কম্বলের নীচেও কাঁপছি কে জানে। ‘চলো বহেনজি’ শুনে ধড়মড়িয়ে বাইরে এলাম। ঝকঝকে আকাশে তখনও তকতকে তারার মেলা। জমে যাচ্ছি ঠান্ডায়। টর্চের আলোয় দেখি কাঁধের কাছ থেকে ছিঁড়ে পরা লতপতানো সোয়াটারের তরুণ সহিসটি হাস্যমুখের আহ্বানে। প্রসন্ন হয়ে উঠল মন। বেরোলাম গায়ে শীত-তাড়ুনি একশো জগঝম্প চাপিয়ে।
এখন সবাই ফিরতি পথের যাত্রী- দর্শন শেষে নামছে আর আমি যাচ্ছি উজানে, ফাঁকার মজা নেব বলে। অনেকে বলেছিল এত দেরিতে গিয়ে কী পাবে? তুষারলিঙ্গ গলে যাবে, মিথ্যে কষ্ট করা। কিন্তু কেন? লেক-পাহাড়ের কিনারায় গজিয়েছে সবুজ ঘাস, একই ছাঁটে বেড়েছে তার মাপসই রেখা। বছরভরের বরফ-ঢাকা পাহাড় মোটে দেড় মাসের রোদ-সোহাগে যে সবুজের জন্ম দিল, সে দৃশ্য কিছু না? সাঁকোর জলখেলার দিকে চেয়ে-চেয়ে আমার যে চোখ ঝাপসা হচ্ছে, এটা কিছু না? দোকান-বিক্রেতার থেকে ফুল-নৈবিদ্য কিনে পুজো দিচ্ছে অমরনাথের। এটা উদ্দীপনার না? কেন ছোটো করে নেব আমার পাওনা-গণ্ডার হিসেব? হয়তো তুষারলিঙ্গের কাছে এমনই কোনও বৈভব লুকিয়ে আছে অপেক্ষায়, সেটাই দেখব… যা সবার নজরে এল না। এই ছড়িয়ে থাকা একশো ‘অমরনাথ’-এর টানই আমায় অমরনাথ-এ এনেছে।