॥ ১ ॥
একটাও ল্যাম্পপোস্টের আলো জ্বলছে না আজ। কী হয়েছে কে জানে! প্রতিপদ বলে কিছুটা রক্ষে। ইন্টেনসিটি কমে গেলেও, পূর্ণিমার আলো জমা হচ্ছে নিশীথ সেন সরণির এই দোতলা বাড়ির ড্রযিংরুমে রাখা সারি সারি স্কচের বোতলে। এর মধ্যে একটা বোতলকে নির্বাচিত করে, গেলাস ভর্তি পূর্ণিমা গলায় ঢালছিলেন ফ্যালকন ইন্ডাস্ট্রিজ-এর কলকাতা ব্রাঞ্চের ম্যানেজার মি.সুনীল রায়।
এমন সময় বাইরে কলিং বেলের আওয়াজ। এখন তো কারও আসার কথা নয়। তৃণা আসত এই সময়ে, তবে সে সব তো অতীত। সোফার থেকে উঠে দরজা অবধি যেতে গিয়ে দেখলেন মাথাটা টলছে। না, ইদানীং একটু বেশি চড়াতে ইচ্ছা করছে নিজেকে। টলোমলো পায়ে উঠে গিয়ে ডোরহোল-এর মধ্যে চোখ রাখলেন তিনি। দেখলেন, একজন লোক একহাতে ছাতা নিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন। আর অন্য হাতে রুমাল দিয়ে মাথা মুছছেন। বাইরের দিকে চোখ চেয়ে দেখলেন, বৃষ্টি হচ্ছে বেশ মুষলধারে। কখন থেকে বৃষ্টি শুরু হয়েছে তিনি তা খেয়ালই করতে পারেননি। তবে যেটা খেয়াল করলেন সেটা হল, লোকটি যে-শার্টটা পরে এসেছেন, সেটা তাঁর ভীষণ চেনা। সাত-পাঁচ না ভেবেই দরজাটা খুলে বললেন, কে?
আগন্তুক হাসিমুখে তাঁর দিকে তাকিয়ে জবাব দিলেন, আসতে পারি?
একটু অবাক হয়ে বললেন মি. সেন, কিন্তু কেন? কে আপনি? কী চাই?
বাইরেই দাঁড় করিয়ে রাখবেন, না ভিতরে…
ওহ প্লিজ কাম ইন।
থ্যাংক্স।
আগন্তুক সোফাতে বসার পর বললেন মি. সেন,
বলুন, আমার কাছে কী দরকারে, এই অবেলায়?
একচুয়ালি দরকারটা আপনার।
আমার দরকার। আর আপনি ছুটে এসেছেন তার জন্য, স্ট্রেঞ্জ! একটু অবাক হলেন মি. সেন।
বলব বলব, দাঁড়ান। বলব বলেই তো এসেছি। একটু জল খেয়ে নিই।
জল কেন শুধু, স্কচ চলে? গভীর নেশায় চোখ দুটো ছোটো হয়ে আসছে তখন সেনবাবুর।
স্কচের গেলাসটায় এক ঢোক মেরে বললেন আগন্তুক,
আমাকে তৃণা পাঠিয়েছে।
এই নামটা শুনেই হুট করে নেশাটা যেন কেটে গেল সুনীলবাবুর। বললেন, ওহ আপনি সেই লইয়ার কাম বয়ফ্রেন্ড। হা-হা-হ-হা। বেশ এক ঢিলে দুই পাখি মারার জীবন্ত এক্সাম্পল। হা-হা-হা, সশব্দে গেলাসটাকে টেবিলে নামিয়ে রেখে নাটকীয় ভঙ্গিতে বলে উঠলেন তিনি।
হা-হা-হা বেশ ভালো মজার মানুষ তো আপনি। এইরকম মজা করতে করতে তৃণাকে ডিভোর্সটা দিয়ে দিন তো। এমনিও আপনাদের মধ্যে কোনও সম্পর্ক নেই। আপনিও যত তাড়াতাড়ি সম্ভব তৃণাকে ঘাড় থেকে ঝেড়ে ফেলতে চান। তারপর তৃণাকে ছেড়ে দিলেই তো অমৃতা আপনার।
এই কথাটা শুনেই দুম করে সোফা ছেড়ে উঠে দাঁড়াতে গেলেন মি. সেন। কিন্তু নেশার ঘোরে আবার বসে পড়লেন। সেই অবস্থায় বললেন জোর গলায়, এই এই মাইন্ড ইযোর বিজনেস। আপনি শুধু আপনারটুকু নিয়ে ভাবুন, বাকিটা আমার কনসার্ন। আর বাই দ্য ওয়ে আপনি কী চান বলুন তো? আমার মটকাটা গরম করাবেন না। তৃণাকে তো আমি বলেই দিয়েছি সাইন ও পাবে না। এখন কাটুন তো, কেটে পড়ুন। কুইক। আঙুল নাচাতে নাচাতে বললেন শেষ কথাগুলো।
বেশ, এর ফলটা ভুগতে হবে আপনাকে। বলেই উঠে হনহন করে বেরিয়ে গেলেন ভদ্রলোক।
লোকটি চলে যাওয়ার পরে দরজা বন্ধ করে মিউজিক প্লেয়ারটা চালালেন মি. সেন। লোকটা পুরো নেশাটারই দফারফা করে চলে গেছে। টয়লেট যাওয়ার জন্য উঠতে যাবেন, এমন সময়ে আবার কলিং বেল। উফ আবার কে এল ভাবতে ভাবতে দরজাটা খুলেই দেখেন সেই ব্যক্তি। তাকে দেখে রাগ আর বিরক্তি মেশানো গলায় বললেন, আবার এসেছেন আপনি? কী চান বলুন তো?
লোকটা তার দিকে ভুরু কুঁচকে একটু অবাক হওয়ার দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলল, আবার এসেছি মানে? আমি তো এই সবে ঢুকছি আপনার বাড়ি। আগে কখনও এসেছি বলে তো মনে হয় না।
এবার খানিকটা রাগও হল আবার হাসিও পেল মি. সেনের। তিনি হাসতে হাসতে বললেন, খেয়েছ তুমি দুপেগ তাতেই চড়ে গেছে নাকি। এই স্ট্যামিনা তোমার! রাখবে কী করে তৃণাকে হা-হা-হা-হা। এক ঘন্টার ওপর ধরে আমার ঘরে বসে আমার সাথে ড্রিংক করলে, তোমাকে দূর দূর করে তাড়ালাম আমি। এখন আবার নাটক করছ? চ্যাংড়ামো হচ্ছে!
ভদ্রলোক এবার রাগত গলায় বললেন, ভদ্র ভাবে কথা বলুন। চড়ে গিয়ে থাকলে বলুন, কাল আসছি। আপনার এত সন্দেহ থাকলে পাড়ার লোকেদের জিজ্ঞেস করে নিন, আমি কোন টাইমে ওদেরকে আপনার বাড়ির ঠিকানা জানতে চেয়েছি।
এই লোকটির গলায় এত জোর দেখে ভয় পেয়ে গেলেন সুনীলবাবু। তাহলে কি হ্যালুসিনেট করছিলেন এতক্ষণ! কিন্তু এটা কী করে সম্ভব। হ্যাঁ, নেশার ঘোরে এর আগেও ভুলভাল কাজ করেছেন, ভুলভাল দেখেছেন কিন্তু এইরকম পরিস্থিতি তাঁর আগে হয়নি। সঙ্গে সঙ্গে মনে পড়ে গেল, আগন্তুক তো একটা গেলাসে স্কচও খাচ্ছিলেন। গেলাসটা পেলেই তো প্রমাণ হয়ে যাবে এই লোকটা মিথ্যে কথা বলছে কিনা। সেই কথাটা মনে হতেই, এক সেকেন্ড বলে দরজাটা খোলা রেখেই ভিতরে চলে গেলেন। কিন্তু অদ্ভুত ভাবে টেবিলের ওপর শুধু তাঁর গেলাসটাই পড়ে আছে, আর অন্যটা নেই। তারপরেই তাকের দিকে চোখ যায়, দেখেন পাঁচটি গেলাসের মধ্যে চারটিই সেখানে সাজানো। মাথা খারাপ হয়ে যায় তাঁর।
এমনই সময় বাইরে থেকে আগন্তুক বলে ওঠেন, তাহলে কি কাল আসব আমি?
একটু কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে সেনবাবু তার উদ্দেশ্যে ভ্যাবাচ্যাকা খাওয়া গলায় বলেন, নাহ্, আসুন ভিতরে।
॥ ২ ॥
(একটি ফোনের সংলাপ, আগের ঘটনার মাস সাতেক আগে)
-হ্যালো
-হাই, হ্যালো পরে হবে। আগে কাজের কথা।
-আরে কী মুশকিল। কে আপনি? মনে হচ্ছে রং নম্বর।
-সুনীল রায়ের এক্স ওয়াইফ তো আপনি?
-এই কে আপনি? এক্স ওয়াইফ মানে? আমি ওনার স্ত্রী। কী সব উলেটাপালটা কথা বলছেন! এই রাখুন তো ফোন। না হলে আমি স্টেপ নিতে বাধ্য হব।
-স্টেপ নিতে হবে না বরং স্টেয়ারকেসের স্টেপ বরাবর নেমে আসুন দোতলার ঘর থেকে নীচে। বাইরে বেরোন, ক্যাব নিন। তারপর বলবেন, এসপ্ল্যানেড যাব। তারপর চৌরঙ্গির অস্টিন গাড়ির শোরুমটার সামনে এসে দাঁড়াবেন। এখন সাড়ে দশটা। এখন বেরোলে সাড়ে এগারোটায় পৌঁছে যাবেন।
-ইয়ার্কি হচ্ছে? আপনি কী করে জানলেন আমি দোতলায়? ওয়ান সেক… আপনি আমাকে স্টক করছেন। এবার কিন্তু পুলিশে যাব আমি।
-তাতে আপনার লাভ হবে না। আর আপনার স্বামীর প্রতি সহানুভূতিটা আরও বেড়ে যাবে আপনার। আর আপনার স্বামীকে গেমটা খেলতে আরও একদান এগিয়ে দেবেন। আপনি যে একটু আগে ফোনে পাস্তা অর্ডার করছিলেন, সেটাও জানি আমি। ক্ষতি করার ইচ্ছে থাকলে আমি কি ক্ষতিটা করতে পারতাম না! প্লিজ আসুন, অনেক কথা বলার আছে আপনাকে। উইল বি ওয়েটিং।
কথাটা বলেই ওপাশ থেকে নারী কন্ঠটা চুপ হয়ে যায় আর ফোনটাও সাথে সাথে কেটে যায়।
॥ ৩ ॥
ঘরে ঢুকেই সোফার ওপর বসে পড়ে লোকটি। মি: সেন কিছু বলার আগেই তিনি শুরু করেন, আমার নাম তড়িত্ সেনগুপ্ত, আমি অমৃতার ল-ইয়ার।
অমৃতার কথা শুনে মি: সেন খানিকটা অবাক হয়ে ভাবলেন, আবার হ্যালুসিনেট করছে না তো? হঠাত্ ঝাঁকুনি দিয়ে উঠে লোকটার কলার চেপে ধরলেন। বললেন, অনেক নাটক হয়েছে। কী চাও বলো তো তুমি? স্পিক আউট।
গলার থেকে হাতটা ছাড়িয়ে নিয়ে লোকটি বললেন, অ্যাড্রেনালিনটা কমান একটু। উকিলের গায়ে হাত দিচ্ছেন, জানেন তো কী হতে পারে?
তীব্র নেশার ঘোরেও পরিস্থিতি আন্দাজ করে থেমে গেলেন মি: সেন। তারপরই একটু শান্ত হয়ে ফোন করলেন অমৃতাকে।
অমৃতা ফোনটা ধরতেই, এই কী চাইছ বলো তো তুমি? একবার লোক পাঠাচ্ছ তৃণার নামে, একবার তোমার নামে।
-মানে, কী সব বলছ তুমি?
-মানেটাই তো জানতে চাইছি।
-শোনো আমিই পাঠিয়েছি তড়িতবাবুকে। উনি আমার উকিল। সে তৃণার লোক হতে যাবে কেন! আমি প্রেগন্যান্ট সেটা জানার পর থেকেই তুমি আমার সাথে সবরকম কনট্যাক্ট বন্ধ করে দিতে চাইছ। চাপ নেই, অ্যার্বশন আমি করিয়ে নেব। কিন্তু আমার পাঁচলাখ টাকা চাই। টাকাটা পেয়ে গেলে, তোমার সব দাবি আমি ছেড়ে দেব। আর টাকাটা দেবে তুমি। ওই পেপারে লেখা আছে যে, সুনির্মল বৃদ্ধাবাস-এর কল্যাণার্থে তাদের তহবিলে টাকাটা তুমি দান করছ। দ্যাখো আমি তোমার সুনামেরও ব্যবস্থা করে দিলাম। এবার লক্ষ্মী ছেলের মতো সাইনটা করো, কোনও ভয় নেই তোমার। তুমি ভাবতেই পার, একথার গ্যারান্টি কী? আমি আমার জবানবন্দি একটা ভিডিওতে রেকর্ড করেছি, সেটা এক্ষুণি তোমার মেলে ফরোয়ার্ড হয়ে যাবে। কিন্তু সইটা করার পর। এটুকু বিশ্বাস আমাকে করতেই হবে তোমার। তৃণা একটা কথাও জানতে পারবে না, তোমার এই স্ক্যান্ডেলও লুকানো থাকবে।
কথাটা বলেই ফোন কেটে দেয় অমৃতা।
একটু আগের সেই আধাভৌতিক ঘটনা, আর এখন অমৃতার এইসব কথা! না, কিছু ভাবতে পারছেন না। নেশায় চোখ ঢুলুঢুলু হয়ে আসছে।নার্ভের প্রবলেম আছে। তাই হাত-পা কাঁপে বেশি টেনশন হলে।
আর কিছু না ভেবে খসখস করে সই করে দিলেন সুনীলবাবু।
॥ ৪ ॥
পরের দিন সকালে ঘুম থেকে উঠতেই, হ্যাংওভারের তীব্র যন্ত্রণা আর মাথার ব্যথায় আবার কঁকিয়ে উঠলেন। মোবাইলটা হাতে নিয়ে সময় দেখতে গিয়ে দেখেন, তৃণার পাঠানো হোয়াটসঅ্যাপ মেসেজের নোটিফিকেশন। খুলে দেখেন তাতে লেখা আছে, থ্যাংক ইউ সো মাচ। কীসের জন্য হঠাত্ এই সব?
কিছু না মনে পড়াতে ফোন করলেন তৃণাকে।
-গুডমর্নিং, কিন্তু থ্যাংক ইউ কীসের?
আরে কালকে আমাদের ডিভোর্স পেপারটা সাইন করে দিলে না, থ্যাংক ইউ। আর বাই দ্য ওয়ে কালকে তুমি দুবার-ই এক লোককেই দেখেছিলে। আর ওই উকিল বয়ফ্রেন্ডটা আসলে অমৃতার। অমৃতা তোমার ক্ষমতার ভয়ে কিছু করে উঠতে পারছিল না। তবু একদিন সাহস জুটিয়ে আমায় দেখা করতে বলে। তারপরেই জানতে পারি অফিসে ভয় দেখিয়ে কী কী করেছ ওর সাথে। আমি তোমার এই নার্ভের রোগ বা সুরার প্রতি আশক্তির খবরটা দিই। কালকে নেশার ঘোরে তুমি দেখতে পাওনি। তড়িতবাবু প্রথমবার বেরোনোর সময় গেলাসটা নিয়ে দরজার পাশের টেবিলে রেখে দেন। দ্বিতীয়বার যখন তোমার হ্যালুসিনেশন হচ্ছে কি না সেটা বোঝার জন্য তুমি ভিতরে যাও, সেই ফাঁকে ওই গেলাসটা তাকে রেখে দেন উনি। সব কিছু আমিই বলে দিয়েছিলাম। এইরকম অদ্ভুতুড়ে ঘটনার চাপে ফেলে তোমায় দিয়ে সাইনটা করালাম। তুমি শুধু ওপরের পেপারগুলো দেখলে, নীচেরগুলো উলটালে না। যাক গে, আমিও সাইন করে রেডি করে রাখছি। এবার বাকিটা তড়িতবাবুই প্রসিড করবেন। আরেকটা কথা, অমৃতা আদৌ প্রেগন্যান্ট নয়। এত কাঁচা কাজ করলে? একটু যাচাই করলে না! ওকে… হ্যাভ আ নাইস ডে।
॥ ৫ ॥
একটা বৃদ্ধাবাসের সামনে কালো গাড়িটা থামল। গাড়ি থেকে বেরিয়ে এল তৃণা। তারপর পারমিশন নিয়ে সোজা ঢুকে গেলো ১২ নং ঘরের ভিতরে। খাটে বসে চুল আঁচড়াচ্ছিলেন এক বৃদ্ধা। তৃণা ছুটে গিয়ে জড়িয়ে ধরে বলল, পেরেছি মা, তোমার কুলাঙ্গার ছেলের অত্যাচার থেকে দুজনেই মুক্তি পেয়েছি। আমি তোমায় নিয়ে যেতে এসেছি, আমার নতুন ফ্ল্যাটে থাকবে চলো।