রায়মাটাং-এর ডেরা ছেড়ে রাঙামাটি পরের ঘাঁটি। গাড়িতে উঠতে যাব, সরযু কারকি তার সোমত্ত মেয়েটিকে গুঁজে দিয়ে বলল, ওকে হাটের মুখে নামিয়ে দেবেন। এদিকে হাট কোথায় আজ? এই পাহাড় উতরোলেই বুধবারের জটারে হাট। ‘জটারে’ শব্দটায় মুখে মৃদু হাসির লক্ষণ ফুটে উঠল তার। গাড়িতে ততক্ষণে সতেরো বছর বয়সি চন্দ্রা কারকি ঢুকে পড়লে অনিল ভান্ডারি তার গাড়িটি সচল করল।
দু’ধারে গভীর বন। পাথুরে পথে বোলেরো মাতালের মতো টালমাটাল নামতে থাকে। এ পথে শ্বাপদের সন্ত্রাসে চলাচল বড়ো সাবধানে, ভান্ডারি বলছিল। বিশেষ করে গউর, শুয়োর, হাতি। হাতির হান্ডায় (দল) পড়ে গেলে জীবন চৌপাট। চন্দ্রাদের চলাচল এ ভাবেই? মেয়েটি বলে পথ তো একটাই। তোমাদের পড়াশোনা? আমাদের হ্যামিলটনগঞ্জে আসল বাড়ি। ওখানে থেকে কলেজের ফার্স্ট ইয়ার। দাদা ইংরেজি অনার্স করছে। রায়মাটাং-এ তিরিশ বিঘে জমি লিজ নিয়ে ট্যুরিস্ট রিসর্ট গড়ে বাবা-মা পাহাড়ে। আমরা ভাই বোন হ্যামিলটনে। আর ছুটি পেলেই ছুটি রায়মাটাং। বাঃ! ব্যবস্থা তো বেশ। কোথায় বেশ? দেখছেন তো রাস্তা।
ততক্ষণে গাড়ি নেমেছে গেলডুং নদীতে। তারপর আরও দুই নদী, রায়মাটাং ও পানা। চন্দ্রা বেশ বলিয়ে মেয়ে। বলে– ট্যুরিস্ট বুকিং হ্যামিলটনে বসে আমিই সামলাই। পাহাড়ে তো প্রায়শ টাওয়ার ফেল। নদীতে গাড়ি থামাতে হল। নদীকে ঘিরে ধরেছে কয়েকটি দামাল পাহাড়। তাদের ফাঁস কেটে বেরিয়ে গেছে গেলডুং। ছবিবাজ বন্ধুটির শার্টার পড়তেই থাকে। সেই প্রকৃতির মাঝে নেমে এসেছে লেমন রং মেয়ে চন্দ্রা। তার বেশ খানিক উচ্চতা, হৃষ্ট স্বাস্থ্য, পেলব শরীর। মাথায় ওড়নার গুন্ঠনে হাসিখুশি দাঁড়ায় যেন বিউটি কনটেস্টে। ছবি ওঠে এক…দুই…চার নানা মুদ্রায়। নদী-পাহাড়ের জট কাটিয়ে গাড়ি নেমে এল সমতলে। এখানে ফৗজিদের ব্যারাকের সামনেই মদো মাতালের হাট। জটারে অর্থে নেপালিতে তাই বোঝালেও শাকসবজি, শুকনো মাছ, প্রসাধনী, এনামেল বাসন থেকে জুতো জামা, সবই স্বল্প সাধ্যের। তারই ভাঁজে ভাঁজে পেঁয়াজি আলুবড়া আর ঝাঁঝ পানি। নারী-পুরুষ নির্বিশেষে গণতান্ত্রিক নেশাভূমি। জায়গাটা খোলামেলা। হাট ঘেঁষে চা বাগান। মনোরম পরিবেশে কঞ্চির বেঞ্চে মার্চের দুপুরে বসে আমরাও এনার্জি টনিক নিয়ে ফেলি কয়েক চুমুক করে। অর্থাৎ ছোটো কাচের গেলাসে খয়েরি চা। একেবারে চা বলয়ে বসে চা নামক যে তরলটি গলধঃকরণ করি তাতে না স্বাদ, না গন্ধ। চন্দ্রাকে ছেড়ে এবং জটারে থেকে গাড়ি ছাড়ে। ভান্ডারি ভাষ্য দেয়– এবারে চা বাগানের চ্যানেলে পড়ে গেলেন। আর যে নেশাটি না হলে সকাল-বিকেল বিকল, তাদের জন্মভূমি প্রাণ ভরে দেখে নিন। সত্যিই তো যত দূর দৃষ্টি যায় সবুজ সমুদ্র। নিথর, নিস্তব্ধ। এটা রাধারানি চা বাগান। এই গাছগুলির বয়স কত হবে আন্দাজ দিন তো? কত? বারো-পনেরো বছর? না মশায়, ন্যূনতম পঞ্চাশ। আমাদের নেশার যোগান দিতে গাছগুলির অবিরাম আত্মবলিদান, ভাবুন তো। ভান্ডারি ধরিয়ে দেয় ভাবনাটা। ঠিক। ছাঁটাই কলে না পড়লে একটা গাছ কতদূর বাড়তে পারে? কুড়ি ফুট তো হামেশাই। বীজের জন্যে সংরক্ষিত গাছের ফল সংগ্রহ করতে গাছে চড়তে হয়।
চা-চক্বরে পড়ে ভুলেই গেছি যে গাড়ি থেমেছে। পাইলট বেরিয়ে এসে বলে, একটা অবাক মানুষ দেখে যান। অবাকই বটে। পিপুল আর ময়না গাছের জোড়ের মুখে প্রায় ২৫ ফুট উঁচু কোটরে ১৪ বছর ধরে বাস করছে এক গাছ-বুড়ো ওরফে জী ভাইয়া। তাকে পেয়েও গেলাম গাছের নীচে। বয়স অনুমান ৭০ বছর। ক্ষয়াটে, ৫ ফুট ৪ ইঞ্চি আনুমানিক উচ্চতা। বসত গড়তে তোমার ভিটে মাটি জুটল না হে? জুটল কোথায় স্যার? চুয়াপাড়া বাগানের মজদুর ছিলাম। নোকরি ছুটে গেল! ছোটো একটি ঝুপড়ি বানিয়ে থাকছিলাম। বন দপ্তর থেকে এসে তুলে দিল। ভাবলাম মাটিকেই ত্যাগ দেব। তাই এই ব্যবস্থা। গাছ-ঘরে সুখ-সুবিধা? বড়ো সুবিধা জমি দখলের মামলা নাই। বান বন্যায় হ্যানস্তা নাই। জানোয়ারের তরাস নাই। সাপ শ্বাপদ আছে, তারা উপর ডালের ভাড়াটে। শত্রু-মিত্র এক সঙ্গে থেকে আপস করে ফেলেছি। একখানা ভাম দখল নিতে চেয়েছিল, তো মানুষ দেখে বিপদ মানল। হর দিন তোমার পেট চলে কি করে? গাছ-বুড়ো একটু হেঁয়ালির আশ্রয় নেয়– বৃক্ষেতে বাস, ভিক্ষেতে গ্রাস। গাছের নীচটায় বসে ভিক্ষান্ন ফুটিয়ে খাই। আতান্তরের দিনেতে বনের ফল ফলারে আহার। কি সিমপ্লিফায়েড জীবনাচার জী ভাইয়ার। সত্যি কত রঙ্গ চলে দুনিয়ায়।
আবার গাড়ির ছুট। বাঁ দিকে চলছে রাধারানি, ডান দিকে নয়া বস্তি ফরেস্ট রেঞ্জ। সামনে এক নদীর নোটিস পড়েছে– পানা। কিছু আগে এর সঙ্গে জুড়েছে স্ফীতকায় বসরা নদী। ফলে মার্চেও পানায় ভালো জল। পেরোবে কি ভাবে? ভান্ডারি বলে– এ স্যার বোলেরো, জল-জঙ্গল, পাহাড় ডোন্ট কেয়ার। কিন্তু তার আগে এক দফা থামতে হবে যে। এখানে তো কিছু নেই স্যার। কেন? নদী আছে। বিকেলের নরম আলো কিছু পরেই ডানা গোটাবে। সেই গেরুয়া আলোয় পানাকে দেখব না? নদী যদি বলেন পাশাখাকে দেখাব চলুন। সে-ও হবে।
নদীর পিঠে ছড়ানো বোল্ডার বেছে নিয়ে বসেছি। মাথার উপর দিয়ে ঘর-মুখো ময়না উড়ে গেল শান্ত রাধারানি বাগান ছুঁয়ে। আর পাথুরে নদী পানার ভাঁজে ভাঁজে যে রহস্য লুকোনো আছে, প্রকট হল বিকেলের মরা আলোর কমলা টাচ্-এ। কিন্তু সময় যে বাদ সাধল। গাড়িতে গিয়ে বসতেই কয়েক হ্যাঁচকা টানে জল পেরিয়ে ওপারে গিয়ে উঠলাম। নদী পেরোতেই জঙ্গল এসে হাজির। নিরঙ্কুশ সেগুনের বন। রাঙামাটির রেঞ্জে পড়ে সে এক অনন্ত সেগুন যাত্রা। কোথায় চলেছ হে পাইলট? রহস্যে ঝুলিয়ে রেখে সে বলে একটা মজার গ্রাম দেখাই আপনাদের। আবার মজা? মজা ঠিক নয়, সাজা বলতে পারেন। সাজার গ্রাম? হ্যাঁ তো দেখুন আগে।
জঙ্গলের পেটের মধ্যে গ্রাম ভুত্রি। আর গ্রামের পাশে শুয়ে আছে সেই পানা নদীটা। একদিকে বনের শ্বাপদ, অপর দিকে নদীর বিপদ। গাড়ি থেকে নেমে পড়েছি গ্রামের পথে। সুপুরি ছায়ায় গ্রাম। ছিটে বেড়ার দেয়াল, মাথায় টিন। নিকোনো উঠোন, তুলসী মঞ্চ, রাঙচিতায় উঠোন ঘেরা। মেটে পথের দু’ধারে গেরস্ত বাড়ি। কে বলবে আষাঢ়-শ্রাবণে ডুয়ার্সে যখন অঝোরে বৃষ্টি, বসরা পানার পেট ফুলে এখন-তখন দশা, নদীর সেই দুর্জয় বিক্রম আছড়ে পড়ে ভুতরি গ্রামে।
কথা হচ্ছিল কেদার দাজুর সঙ্গে। ছোট্ট ছিমছাম কাঁচা বাড়ি তার। ফলন্ত লাউ মাচা, সিম, বেগুন কেয়ারি। এক-ঘরা হোম স্টে করেছে। এ গ্রাম স্যার দুনিয়ার বার। দেখছেন তো পূব দিকে অতবড়ো নদী, শিয়রে ঘন বন। দিনে রাতে হাতি-হাঙ্গামা। জীবনের সব প্রয়োজনে নদী পেরিয়ে, চা বাগান পেরিয়ে কালচিনি বাজার ১২ কিমি। সময়ে অসময়ে যাতায়াত? এ ক্ষেত্রে বাইক বড়ো অমায়িক, কত সংকট উৎরে দেয়। নদীর বুকে চলা, তাই বর্ষা ব্যতিরেকে। তো, আপনার হোম
স্টে-তে থাকতে গেলে কী করতে হবে? খুব সিম্পল, থাকতে হবে। আজই থেকে যান। দু’কদম এগোলে বসন্তের বন। জঙ্গলে ফুলের জলসা লেগেছে। লাটোরে এখন ফুল ঝরার পালা। সাদা ফুলে ভরে আছে ডালি। দুধি লতায় ফুল আসছে। লসুনিতে ফুল ফুটছে। জঙ্গলে আছে দমাই গাছ। এর পাকা ফল খেতে সুস্বাদু। লিচুর মতো ফল ফালাসে। আরও পাবেন কুটমেরু, গিনার, ময়না, পড়াবি, চিকরাশি আরও কত। আমার ঘর থেকে দেড় কদম এগোলে পানা। মার্চের নদী এখন পোষ-মানা ময়াল, কোনও ফোঁসফাঁস নেই। দেদার অফার দিয়ে বসলেন কেদার। আমাদের যে পরের ঝাঁপ পাশাখা, তারপর রাঙামাটি। এদিকে বেলা গুটিয়ে এসেছে। লোভ দমন করে দাজুবাবুকে বিদায় দিয়ে ভুতরি ছাড়লাম।
বেলা ডুবে এসেছে। ভান্ডারি ক্ষ্যাপা শার্দুলের মতো তার বাহনটিকে ছুটিয়ে দিল। আমরা এবারে চা বাগানের প্যাঁচে পড়ে গিয়েছি। সেন্ট্রাল ডুয়ার্স চা বাগান। অনেকটা সময় ধরে চা বাগানের কেয়ারি ধরে ছুটে বেড়ায় গাড়ি। এক সময় বেশ খানিক চড়াই টেনে বাগানের মধ্যেই গাড়ি ভিড়িয়ে দিল ভান্ডারি। নেমে এসে বলল, দেখুন স্যার। নিঝুম পরিবেশ। চারিদিকে অথৈ সবুজে সেন্ট্রাল ডুয়ার্স গ্রিন ওসান। সান্ধ্য পাখিরা ডানায় ঢেউ-এর ছন্দ নিয়ে উড়ে যাচ্ছে ভুটান পাহাড়ে। ভান্ডারি বলে নীচে তাকিয়ে দেখুন একবার। এতক্ষণ নজরে আসেনি, অ-নে-ক নীচে দিয়ে বয়ে চলা একটি নদী ওপারের পাহাড়ের পা চেটে দূরে মিলিয়ে গেছে। ও পাশাখা। ডানদিকে কোনাকুনি ভুটানি এক সিমেন্ট কলের চিমনি দিয়ে ধোঁয়া উগরে আন্তর্জাতিক সীমানার বেড়া ভেঙে ভারতের আকাশে ভেসে বেড়াচ্ছে। নদী-পাহাড় আর ধোঁয়ার বাহার এক ফ্রেমে জুড়ে নিয়ে দেখতে থাকি। অভ্রর ছবি-যন্ত্র ঘন ঘন ক্লিক দিচ্ছে। পাহাড়ের ঢালে মুঠো মুঠো ঘর বাড়ি ঝুলে আছে। তার সামনে দাঁড়িয়ে ভাবতে থাকি স্রেফ এক নদী-ঝাঁপের এ-পার ও-পারে দুই দেশ। এক দেশের মানচিত্রে পর্বত প্রমাণ সমস্যা। আর ওই দেশটিতে দেখেছি শিষ্টাচারে বাঁধা সহজ সরল খুশিয়াল জীবনের বহতা। পাহাড়ের ভাঁজে ভাঁজে ফুটে থাকা মানব-কুসুম।
চকিতে তাকিয়ে দেখি পশ্চিম দিগন্তে বেলা ডুবছে। আর আমাদের ছবিওয়ালার যন্ত্রে মুদ্রিত হচ্ছে বেলা শেষের নরম আলোয় চা-সমুদ্রে ভাসমান এক বালিকার ছায়া-ছবি (সিল্যুট)। মেয়েটি সপ্রতিভ পদক্ষেপে এগিয়ে এসে পরিচয় দেয়, আমি নন্দিনী ছেত্রী। সেন্ট্রাল ডুয়ার্সে থাকা হয়। সে কথা বলে অভ্রর সঙ্গে। আমি দূর থেকে দেখি বাগানের নরম সবুজের মাঝে অপরাহ্নের ম্রিয়মান আলোয় মাখামাখি একটি আহেলি যৗবনের রূপশ্রী। দেখি তার কাঁধ ছাপানো চুলের ঢেউ, টানা ভ্রু যুগল, কথার উচ্ছ্বলতায় চোখ দুটি টলটল নীল সায়রের জল। সেই জলে যেমন মৃণাল ফোটে, তার অগোচরে বুঝি ভুজঙ্গের উদ্যত ফণাও। মেয়েটির বাবা চা বাগানের আপার গ্রেড কর্মী। সে পড়ে দার্জিলিং-এর এক অভিজাত স্কুলের উপর ধাপে। থাকে মিশন হস্টেলে, আর ছুটিতে ছুটে আসে চা বাগানে।
নন্দিনী ইংরিজি-হিন্দি-বাংলার মিক্সচারে বলে, ডুয়ার্স আমার প্রথম প্রেম। আমি এখানকারই ভূমিকন্যা। চা বাগানেই জন্ম। চা-মেয়েদের অনেকেই আমার বন্ধু। অভ্র প্রশ্ন রাখে– তোমার ঘর থেকে মেনে নেয় কুলি ব্যারাকের সঙ্গে এই মাখামাখি? আমার ড্যাড-ই বরং বলে, মানুষকে কাজ দিয়ে তার বিচার কোরো না, তার আসল পরিচয় মনুষ্যত্বে। সব সময় চেষ্টা করবে অসময়ে এই মানুষগুলির পাশে দাঁড়াতে। এই শ্রেণির মেয়ের মুখে এমন অবাক করা কথা শুনে সামনে এসে দাঁড়িয়েছি। বাতাসের খুনসুটিতে তার কেশরাশি ব্যতিব্যস্ত প্রায়। কারণে অকারণে হাসিতে ঝলকায় বিদ্যুৎ। অল্প অনুরোধেই সে সহজ ভঙ্গিতে দাঁড়ায় লেন্সের সামনে। কথার মাঝে তার প্রতিটি মুড খোদাই হতে থাকে যন্ত্রে।
নদীর উপরে আঁধার নামছে। পাহাড় ঢেকেছে অন্ধকারে। পাশাখার ছলাৎ-ছল শব্দ স্পষ্ট শোনা যাচ্ছে। আমি মুখোমুখি হই নন্দিনীর– বেলা যে পড়ে এল, একা ফিরবে কি করে? আমার উৎকণ্ঠায় সে সহজ ভঙ্গিতে বলে, একা কোথায় আঙ্কল? সঙ্গে রাজু আছে না? ও কুলি লাইনেরই ছেলে। পড়াশোনায় ব্রিলিয়ান্ট। এতক্ষণে নজরে এল লাল বাইকে অপেক্ষারত একটি যুবক। ও তোমার কে হয়? এমন আচমকা প্রশ্নে নিজেই অপ্রস্তুত হয়ে পড়ি। নন্দিনী আলতো এক হাসি ভাসিয়ে দিয়ে উঠে বসল বাইকের পিছনে এবং হুস করে অদৃশ্য হয়ে গেল। সেই হাসিতে বুঝি তার মনের গোপন কথাটি রহে না গোপনে। ছটফটে মেয়েটির এই হঠাৎ চলে যাওয়া প্রকৃতিকে যেন শূন্য করে দিয়ে গেল!
রাঙামাটির জন্য সময় উৎরে গেছে। নতুন স্পটে রাতের আঁধারে গিয়ে লাভ কি? ভান্ডারি উস্কে দিয়ে বলে রাঙামাটিকে দেখতে বেরিয়ে ফাউ দেখে ফিরবেন– সে কেমন হল স্যার? তা হলে তোমার কি বক্তব্য স্যার? সে বলে– উঠে বসুন। সন্ধে এখনও তেমন পাকেনি। মাথার উপরে চাঁদ আছে, রাঙামাটি দেখিয়ে দিই আপনাদের।
চাঁদনি রাতে চা বাগানের ব্যারিকেড ভেঙে গাড়ি ছুটছে। মার্চের সন্ধ্যায় হিমেল বাতাস মন্দ নয়। আর জানলা দিয়ে পিছলে যাচ্ছে জ্যোৎস্না ধোয়া চা বাগান। অনেকটা সময় ঘুরে পাইলট থামল একটি চা শপে। এতক্ষণে মনে পড়ল চায়ের তেষ্টা। দোকানে বেশ কিছু ক্রেতা সমাগম। তাঁদের কেউ একজন কৗতূহলী প্রশ্ন ছুড়ে দেন– এদিকে কোথায় পাক খাচ্ছেন বলুন তো? বার তিনেক একই পথে দেখছি ঘোরাঘুরি করতে। ভদ্রলোকের প্রশ্নটা ভান্ডারিকে চালান করে দিই। সে নিরুত্তর। গভীর মনোযোগে চায়ের পাত্র শেষ করে উঠে দাঁড়িয়ে বলল, চলুন স্যার। সময় অপচয় না করে আমরাও উঠে পড়েছি। ঘড়িতে যত সময় এগোচ্ছে, আমরা বুঝি পিছিয়ে পড়ছি। গাড়ি চা বাগানের প্যাঁচে পড়ে লাট খাচ্ছে। এবারে চালককে সরাসরি শুধোই– তুমি রাঙামাটি চেনো তো হে? ভান্ডারি এবারে হেসে দেয়– কি যে বলেন স্যার। হাসিমারার ছেলে আমি, রাঙামাটি চিনব না? এ লাইনে তেরো বছর হয়ে গেল। তা হলে ঘুরে বেড়াচ্ছ কেন?
ভুলভুলাইয়ার দাঁবে পড়ে গেছি যে।
সেটি কে?
চা বাগানের ভূত। চাঁদনি রাতের নির্জন বাগানে ওরা ঘোরে, মানুষকে বাগে পেলে এভাবে…। এখন উপায়? ওর জাল কেটে বেরোবার ফিকির খুঁজছি। আপনারা স্থির হয়ে বসুন স্যার। সন্ধে খুব একটা পাকেনি এখনও। ভূতের উপরে ভবিষ্যৎ ছেড়ে দিয়ে বসে থাকি। জ্যোৎস্না ভেজা চা বাগান এতক্ষণ আমাদের কাছে স্বর্গীয় মনে হচ্ছিল, তাকেই এখন ভৗতিক মনে হয়। প্রতিটি বাঁকেই বুঝি ঘোমটা টানা সাদা থান পরা কেউ চকিতে মিলিয়ে গেল! ফলে সফরে জুড়ে গেল রোমাঞ্চ। সেই রোমাঞ্চের মাত্রা চড়ছে আকাশে মেঘ-আলোর কারসাজিতে। অকারণে চা গাছগুলি নড়ে উঠছে কেন ভান্ডারি? চালকের মুখে চাবি পড়ে গেছে। আমরা তো আগে থেকেই পাষাণবৎ হয়ে আছি। বাইরে বোর্ডে নজর পড়ল লেখা– তোর্সা চা বাগান। তার চ্যানেল দিয়ে বেশ কিছুক্ষণ ছুটে বেড়িয়ে ভান্ডারি মুখ খুলল– ঘড়িটা দেখুন তো স্যার। সময় এখন ছ’টা চল্লিশ মিনিট। ব্যাটা ছেড়েছে এতক্ষণে। আমাদের একজন কৗতূহলী প্রশ্ন ছুড়ল– ভুলভুলাইয়া ব্যাটা না বেটি ও ভাই ভান্ডারি? চাপা গুমোট কেটে গাড়ির মধ্যে মৃদু হাসির কুহর উঠল।
অবশেষে রাঙামাটি বনবাংলো। দোতলা বাংলোর উপরের ব্যালকনিতে বসে দেখি মাথার উপরে আলো ঝলমল একটি পাহাড়ি জনপদ। চৗকিদার বিক্রম লামা চিনিয়ে দেয়– ওই হল স্যার ভুটানের ফুন্টশিলিং। এদিকটা বাংলার জয়গাঁ। এ তো হাত বাড়ালেই ছোঁয়া যাচ্ছে ভাই। হবেই তো দূরত্বটা দেখুন, মাত্র ৪ কিমি। আমাদের এখান থেকে হাসিমারা ১৪ কিমি। হ্যামিলটন ৩০ কিমি। আর কালচিনি বাজার? আর ৪ কিমি জুড়ুন। রাঙামাটি পর্যটন মানচিত্রে ব্রাত্য কেন? কোনও উত্তর পাইনি। এর চারিদিকে মোটামুটি চা বাগান অঞ্চল। যার অর্থ সকাল হলেই হুটার বাজিয়ে বাগান চালু হল। কুলি লাইন থেকে বেরিয়ে আসে মেয়েরা। দলবদ্ধ ভাবে চলে প্লাকারের দল তাদের বাগানে। সকাল থেকে বিকেল, দুই পাতা এক কলির খেলা চলে কয়েক খেপে। বেলা গুটিয়ে এলে ফের হুটার বাজিয়ে ছুটি।
সেই বেলায় আমরাও ফিরছিলাম রাঙামাটি চা বাগানের পাশ দিয়ে। দেখলাম মেয়েরা কাপড়ের ঝোলায় কাঁচা পাতা নিয়ে বসে আছে। গাড়ি থামিয়ে নেমে আসি ওদের কাছে। তোমাদের কাজ তো শেষ, ঘর যাবে না? একজন মাঝ বয়সি মদেশীয় মহিলা বলে– ওমনি ঘর যাব? কাজের রেকর্ড করাব না? প্রতিদিন তিন দফা পাত্তি ওজন হবে, নামে নামে রেকর্ড হবে তবে না হপ্তা পাব। বসে আছি, পাত্তি কাঁটায় উঠছে। বইদার রেকর্ড করছে। কাজ শেষ হলে তবে না ফেরা। ঘর কোথায়? রাঙামাটির কুলি লাইন, খোখরা বস্তি। ওদের সারাদিনে সংসারের কাজের জন্য বরাদ্দ শুধু বিকেলটুকু। ঘরে ফিরেই রাতের রান্না, পরের দিনের দুপুরের খাবার তৈরি করে রাতের খাওয়া সাঙ্গ করে সমগ্র চা পাড়ায় ব্ল্যাক আউট। পরদিন ভোরেই যে আবার হুটারের শমন।
ব্যতিক্রম শুধু হপ্তা দিনে। বাগান মজদুরের পেমেন্টের দিন। ওই দিন বাগানের গেটে হাট বসে। কামিনরা টিপ ছাপের হপ্তা নিয়ে ঘরে ফিরে চেহারায় কলি ফিরিয়ে দলবদ্ধ ভাবে হাট করতে এসে সারা সপ্তাহের বরাদ্দ তুলে নিয়ে যায়। পরদিন সানডে, অর্থাৎ নিয়ম মতো সকালেই গির্জায় যেতে হবে। প্রসঙ্গত বলা– ডুয়ার্স বাগানগুলির বেশিরভাগ মজদুর আজ যিশু সাহেবের কবলে। বাগানের হপ্তা দিনে পুরুষ মজদুরদের মেজাজ থাকে চড়া মাত্রায় বাঁধা। তাদের মজুরির বেশিটাই যায় আফগান ব্যাংকের ধার শুধতে। বাকিটা সুরা এবং জুয়ায় উড়িয়ে দিয়ে নিঃস্ব হরিদাস হয়ে ঘরে ফেরা। এক দিকে চা মেয়েদের নিত্যকর্ম পদ্ধতি শুনি। ওদিকে মেয়েদের হরেক মুড খোদাই হয়ে চলে ছবি যন্ত্রে।
রাঙামাটির ভৌগোলিক অবস্থানটি হল– পূর্ব দিকে রাঙামাটি চা বাগান, বসরা নদী। পশ্চিমে তোর্সা চা বাগান। উত্তরে জয়গাঁ, ফুন্টশিলিং। দক্ষিণে দলসিংপাড়া, হাসিমারা। এদিকে চা বাগানই মুখ্য। চাষাবাদ সামান্য। নেপালি প্রধান অধিবাসী। রাঙামাটি থেকে নিত্য বাজার, মল্লিক বাজারের দূরত্ব ৩ কিমি। যাতায়াতের অটো আছে। শনি-মঙ্গলে মঙ্গলাবাড়িতে ছোটো হাট বসে। এদিকে গাড়ি নিয়ে ঘুরতে পারেন চা বাগান, বসরা নদী, ফুন্টশিলিং, হাসিমারা হয়ে কোদালবস্তি, এসডি রোড হয়ে চিলাপাতার তোর্সা রিভার ঘুরতে চাইলে বাড়তি রোমাঞ্চ। সঙ্গে মেন্দাবাড়িও জুড়ে নিন।
রাঙামাটি ছেড়ে ওঠার মুখে আমাদের মধ্যে ভূত-ভীতু সঙ্গীটি প্রশ্ন করে বসে– তোমাদের চা বাগানে ভূতের প্রকোপ কেমন হে? ভূত? কই শুনিনি তো! খানিক বিস্ময়ের সুরেই বলল সুকুমার গুরুং। ভাওয়া ওঁরাও ওকে থামিয়ে দিয়ে বলে ঠিক বলেছেন স্যার। রেডিও কার্জির মেয়ে জার্লিনা প্রেম ঘটিত ব্যাপারে খুন হয়ে তিন দিন পড়েছিল সেন্ট্রাল বাগানে। তার আত্মা নাকি খুনের বদলা নিতে ভুলভুলাইয়া হয়ে ঘুরে বেড়ায় বলে শুনেছি। তবে রাঙামাটিতে তার কোনও ছায়া পড়েনি। কেন স্যার? পড়েছিলেন ওর পাল্লায়? না-না তেমন কিছু নয়। ভান্ডারির মুখে শুনছিলাম চা বাগানের ভূতের কথা, তাই…। আমাদের রাঙামাটি আবিষ্কার শেষ করে উঠে বসলাম গাড়িতে। প্রয়োজনীয় তথ্য
শিয়ালদা থেকে রাতের কাঞ্চনকন্যায় উঠে পরদিন সকালে হাসিমারা স্টেশনে নেমে ১৪ কিমি দূরত্বে রাঙামাটি। স্টেশনেই ভাড়া গাড়ি পাওয়া যাবে। চমৎকার দ্বিতল বাংলোয় উপর নীচে ঘর। বুকিং দেবেন ডিএফডি, বক্সা টাইগার রিজার্ভ-পশ্চিম। পোস্ট-আলিপুরদুয়ার কোর্ট। জেলা-আলিপুরদুয়ার।