কেউ ঝুঁকে পড়ে পায়ে হাত রাখতেই চমকে উঠল বন্দনা। ‘না-না, বলে সংকুচিত হয়ে উঠলেও যে প্রণাম করতে এসেছিল, সে কোনও ওজর-আপত্তি শুনতে আগ্রহী নয়। লোকটি চলে যাওয়ার পরই বন্দনা চোখ বন্ধ করে নিয়েছিল। এই সময়ে তার মন অতীত স্মৃতির নানা গলিপথে ঘুরে বেড়াতে শুরু করে। একের পর এক মুখ ভেসে উঠতে শুরু করল স্মৃতিপটে। অনেকগুলি মুখ ধোঁয়াশায় আবছা হয়ে এসেছে। মুখ মনে আসছে, অথচ মুখের মালিকের নাম মনে পড়ছে না। এখন কারওর উপরেই সে আর ভরসা করতে পারে না। তা সত্ত্বেও শৈশবের এক স্বভাব সে কখনওই ছাড়তে পারেনি। মানুষের সুখ-দুঃখ, হাসিকান্নার পাশে থাকার অভ্যাসেই সে স্কুলের চাকরির পাশাপাশি সমাজসেবাকেও ব্রত হিসাবে নিয়েছে।
সন্ধে সাতটার সময় সুদর্শন পান্ডের বাড়িতে তার ছোটোছেলের জন্মদিনের অনুষ্ঠান ছিল। বিশেষ ইচ্ছে ছিল না যাওয়ার। কিন্তু সুদর্শন তার সমাজসেবী সংস্থা ‘অর্চনা’র সদস্য। বন্দনা স্নান করল, আলমারি থেকে নামিয়ে একটা ময়ূরকণ্ঠী রঙের উজ্জ্বল শাড়ি পরল, সামান্য সাজল, বেরিয়ে পড়ল তারপর।
সুদর্শনের বাড়িতে আজ উৎসবের মেজাজ। ইতিমধ্যে অন্য অতিথিরাও দলে দলে আসতে শুরু করে দিয়েছেন। সকলের সঙ্গে বন্দনার পরিচয় করিয়ে দিয়ে সুদর্শন বলতে লাগল, ‘ইনি বন্দনা দত্ত, ‘অর্চনা’ স্বেচ্ছাসেবী সংস্থার প্রধান।’কয়েকটি কৌতূহলী চোখ চমকে তাকাল বন্দনার দিকে। বন্দনা এ ধরনের দৃষ্টিপাতে অভ্যস্ত। আগে অস্বস্তি হতো তার। এখন আর হয় না। পঁয়তাল্লিশে পড়ল সে গতমাসে। হয়তো এখনও তার ধারালো চোখমুখ আর টানটান শরীর বাইরে লোকের কাছে আকর্ষক মনে হয়। কিন্তু, এরই পাশাপাশি তাদের চোখে অন্য একটা প্রশ্ন ফুটে উঠতে দেখে বন্দনা ভেবে কুল পায় না। সেই চোখগুলি প্রশ্ন করে, ‘এত সুন্দরী হওয়া সত্ত্বেও কেন আপনি বিয়ে করেননি বন্দনা?’
এককালে এইসব প্রশ্ন তাকে বিরক্ত করত, এখন আর করে না। এরই মধ্যে কোনও কোনও কৌতূহলী সাহসী পুরুষ তার কাছাকাছি আসার চেষ্টা করে। কারওর বাচ্চার অ্যাডমিশন নিয়ে সমস্যা, কারওর বা সংসারে পণ দেওয়া নিয়ে ঝামেলা। এসব কিছু না থাকলে সমাজসেবা করার ঝুটো ইচ্ছের ছুতোয় কাছে আসার প্রক্রিয়া জারি থাকে। অনেকক্ষেত্রে বন্দনা এমনও টের পেয়েছে, হয়তো কোনও সমস্যাই নেই, তবু, কোনও কোনও পুরুষ শুধু তার সঙ্গ পাবে এই আশায় তার সঙ্গে দেখা করতে চেয়েছে।
চিরকালই বন্দনার মধ্যে তার সামাজিক প্রতিষ্ঠা সম্পর্কে স্পষ্ট ধারণা এবং আত্মমর্যাদাবোধ খুবই বেশি। অভিজ্ঞতা থেকে সে শিখেছে, কার সঙ্গে কতটা কথা বলতে হবে, কার সঙ্গে কতটা দূরত্ব বজায় রাখা সংগত। সুদর্শনের ঘরোয়া পার্টি খুব জমে উঠেছিল। খাওয়াদাওয়ার ভালো বন্দোবস্ত, বন্দনা দেরি করল না। এমনিতেই তার শরীরটা খুব একটা ভালো নেই। সামান্য কিছু খেয়ে সে তাড়াতাড়ি বাড়ি পৌঁছোতে চাইছিল। প্লেটে খাবার নিয়ে দু-এক চামচও খায়নি, এমন সময় পাশে এসে দাঁড়াল বিজন। নিজের প্লেট হাতে নিয়ে সে বন্দনার পাশে দাঁড়িয়ে কথায় কথায় বলল ‘আপনার কাছে আমি কৃতজ্ঞ।’
বন্দনা একটু অবাক চোখে তাকাতেই সে ফের বলল, ‘আপনিই তো মৃদুলাকে বুঝিয়ে সুঝিয়ে ঠিক রাস্তায় ফিরিয়ে এনেছেন।’
মৃদুলা বিজনের একমাত্র মেয়ে। যে-স্কুলে বন্দনা অধ্যক্ষ, সেখানেই পড়ে মৃদুলা। অনেকদিন ধরেই তার নামে নানা অভিযোগ আসছিল। ক্লাসরুমে অনুপস্থিত থাকে। ছেলেবন্ধুদের সঙ্গে এখানে-ওখানে ঘুরে বেড়ায়, অভিযোগের কোনও অন্ত নেই। উপায়ান্তর না দেখে বিজন তখন বন্দনার দ্বারস্থ হয়। সেই ওদের প্রথম দেখা। তারপর বেশ কয়েকবার বিজন এসেছে তার কাছে। অনেক কষ্টের কথা বলেছে। বন্দনা এখনও বোঝে না, কোনওরকম আকর্ষণ থেকেই কি সে তার কাছে আসত? নাকি, সত্যিই সে ব্যতিব্যস্ত ছিল তার মেয়ের ব্যাপারে?
সে সময় বন্দনা মৃদুলাকে ডেকে অনেক বুঝিয়েছিল। বুঝিয়েছিল, নদীর জল আর সময় কারু জন্য অপেক্ষা করে না। সময় থাকতে থাকতে তার যথাযথ উপযোগিতাটাও জরুরি। তাতে ভবিষ্যৎ জীবন সুন্দর ও সুখের হবে। তার কথায় কী যে জাদু থাকে, যে-শোনে সে মন্ত্রমুগ্ধের মতো শোনে। এসব ঘটনার পর একদিন হঠাৎ-ই বিজন এসে হাজির। তার নিশ্চিন্ত মুখচোখ দেখে খানিকটা স্বস্তি পেল বন্দনা। বিজন বললছ ‘মৃদুলা খুব প্রশংসা করে আপনার। এখন তো দেখছি বাড়িতেও খুব মন দিয়ে পড়াশোনা করছে।’উপকারের কথা অধিকাংশ ক্ষেত্রে মানুষ ভুলে যায়। কিন্তু, বিজন সেই বিরল প্রকৃতির মানুষ, যে, কৃতজ্ঞ থাকতে ভালোবাসে আর বারবার সেই কথার পুনরাবৃত্তি করে বন্দনাকেও কিছু ভুলতে দেয় না।
‘আচ্ছা ম্যাডাম, রাজনীতির জগতের মানুষজনও তো সকলেই আপনাকে চেনে। আপনার এক কথায় কত লোকের কত কাজ হয়ে যায়!’
একটু হকচকিয়ে গেল বন্দনা। তার ব্যাপারে বিজন এত খবর রাখে কেন? মনের দোলাচল তার কথাতেও বের হয়ে এল, ‘আপনি তো দেখছি, আমার সম্পর্কে প্রচুর খবর রাখেন।’
‘সত্যি বলতে কি ম্যাডাম,’ বিজন বলল, ‘ব্যাপারটাকে কাকতালীয় বলতে পারেন, কিন্তু, আপনার অতীত ও বর্তমানের অনেক কথাই আমার জানা।’
বন্দনা হেসে ফেলল, ‘আমার সম্পর্কে এত কিছু যখন জানেন, তখন নিশ্চয়ই আমার ভবিষ্যৎটাও জানেন আপনি!’
একথা শুনে একটু চুপ করে রইল বিজন। তারপর নীচু গলায় কেটে-কেটে বলল, ‘ভবিষ্যৎ তো আপনার নিজেকেই স্থির করতে হবে।’ তারপর হঠাৎ-ই সে খুব গম্ভীর হয়ে গেল।
সেদিন পার্টি শেষ করে বাড়ি চলে আসার পর থেকে বেশ কিছুদিন বন্দনা বিজনের কথাগুলি ভাবছিল। ভাবছিল, কী বিচিত্র মানুষ এই বিজন! বলে কিনা তার অতীত-বর্তমান, সবকিছু সে জানে! বন্দনার অতীত… কোন অতীত?
বন্দনার বাবা ছিলেন বামপন্থী রাজনীতির সক্রিয় কর্মী। একসময় অনেক লড়াই দেখেছে বন্দনা, ঘরে-বাইরে। পার্টি গড়ে ওঠার সময়ে বহু মানুষ স্বতঃস্ফূর্তভাবে এমন স্যাক্রিফাইস করেছেন। অত্যধিক পরিশ্রমে বন্দনার বাবার শরীর ভেঙে গিয়েছিল শেষদিকে। সেই টালমাটাল সময়ে বন্দনা দেখেছে কী প্রচণ্ড কষ্টে সংসার সামলেছেন মা! বিএ পাশ করেই তাই বন্দনাকে চাকরির খোঁজে বের হতে হল। অন্য আর পাঁচটা সমবয়সি মেয়ের কাছে সেই সময়টা ছিল চোখে রঙিন স্বপ্নের জাল বোনার। আর তখনই স্বপ্ন দেখার সঙ্গে বন্দনার ছিল আড়ি। কাঁধের উপর যে বিরাট সংসারের দায়! সুজয়, আরাধনা দুই ভাইবোন, আর মা। পুরো সংসারকে টানতে স্কুলের চাকরির পরেও বাড়িতে কোচিংক্লাস খুলতে হল বন্দনাকে। তারপর হঠাৎ-ই একদিন মা’ও মারা গেলেন। মাথার উপর আর রইল না কেউ। ওই সময় বড়ো অসহায় হয়ে পড়েছিল বন্দনা। সময় সব ক্ষত মুছিয়ে দেয়। জীবনের স্বভাবই হল গড়িয়ে যাওয়া। কিন্তু সুজয় আর আরাধনার সংসার সাজিয়ে দিয়ে যখন সে একটু নিজের দিকে তাকানোর সময় পেল, দেখল, চুলে ততদিনে পাক ধরেছে।
অতীতের ইতিহাসের পাতা উলটালে তার চোখ জলে ভিজে আসে। মনে হয়, এক পলকে সে পৌঁছে গেছে সেই গাঁ-এ, যেখানে দাদু-দিদা’র সঙ্গে কয়েকদিন খুব আনন্দে কেটেছিল। সারাদিন গ্রামের সমবয়সি ছেলেমেয়েদের সঙ্গে ছুটোছুটি করে প্রজাপতি ধরে বেড়ানোর সুখ ভোলা যায় না। ভোলা যায় না, তারপর পাকদণ্ডি পথ বেয়ে অনেক বেশি রাস্তা ঘুরে দেরি করে বাড়ি ফেরা …।
ওই কয়েকটা বছর সংসারের উপর দিয়ে খুবই ঝড়ঝাপটা গেছে। রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়া বাবা কোনওভাবেই কোনও চাকরির ব্যবস্থা করে উঠতে পারছিলেন না। বাধ্য হয়েই দাদু-দিদা, মা আর ভাইবোনদের নিয়ে গিয়েছিলেন গ্রামের বাড়িতে। আস্তে আস্তে ভাইবোনরাও বড়ো হচ্ছিল। বাবা বাধ্য হয়ে শহরে নিয়ে এলেন সকলকে। এখন এই নিশ্চিন্ত জীবনের অবসরে চোখ বুজলেই গ্রামের সেই পাকদণ্ডি পথ চোখে ভাসে। পাকদণ্ডি হচ্ছে সেই পথ, যেটি মানুষের চলাচলের মাধ্যমে আপনা-আপনিই তৈরি হয়ে যায়।
বন্দনা নিজেও জানে, সারাজীবন ধরে সে পাকদণ্ডিই হয়ে রইল। চেনাপরিচিত মানুষজনের কাছে, এমনকী ভাইবোনদের কাছেও। একমাত্র বিজন অন্যরকম। যখনই দেখা হয়, অত্যন্ত আন্তরিক হাসিতে সে অভিবাদন জানায়। বিজনের ভাবনাচিন্তার ধরন ভালো লাগে বন্দনার। কিন্তু, সে তার অতীত বিষয়ে কী জানে, সেটা জানার আগ্রহ থাকলেও সংকোচবশত কোনও কথা জিজ্ঞেস করতে পারে না বন্দনা। অতীত… কোন অতীত? এ প্রশ্ন কতবার তার ঠোঁটের ডগায় চলে এসেছে। শেষ মুহূর্তে সামলে নিয়েছে বন্দনা। অনেকদিন হল, বিজন আসেনি। স্কুলে মৃদুলার সঙ্গে দেখা হতে বন্দনা তার কাছে বিজনের কথা জানতে চাইল। মৃদুলা জানাল, তার বাবা খুব অসুস্থ হয়ে পড়েছে। বিজনের ব্যক্তিত্ব আর শালীনতাবোধ সেই প্রথমদিন থেকেই বন্দনাকে মুগ্ধ করে। হয়তো এইজন্যই সে ঠিক করল, এক সন্ধেয় বিজনকে সে দেখে আসবে।
বিজন শুয়ে ছিল, বন্দনাকে ঘরে ঢুকতে দেখে তাড়াতাড়ি উঠে বসল সে। ‘আরে, ম্যাডাম…। আপনি…,’ তার মুখে যেন প্রথমে কোনও কথাই জোগাল না। বিছানা থেকে উঠে বসার চেষ্টা করতে যেতেই বাধা দিল বন্দনা, বলল ‘আপনি উঠবেন না, শুয়ে থাকুন। মৃদুলা বলল আপনি অসুস্থ, তাই, দেখতে চলে এলাম।‘ যেন কোনও ঘোরের মধ্যে থেকে বন্দনার প্রশ্নের জবাব দিতে থাকল বিজন। তারপর হঠাৎ-ই বিছানার উপরে সোজা হয়ে বসে বলল, ‘বন্দনা, এখনও কি তোমার প্রজাপতি ধরার শখ আছে?’
বন্দনা চমকে উঠল। দুটো কারণে। বিজন ‘আপনি’র সম্পর্ক ভেঙে দিল। সচেতনভাবে ভেঙে দিল নাকি? পাশাপাশি, প্রজাপতির পিছনে ছোটার প্রসঙ্গও তাকে খুব আশ্চর্য করে দিল। ‘তুমি… আপনি…,’ কোন সম্বোধনে কীভাবে যে কথা শুরু করবে তাই বুঝে উঠতে পারছিল না বন্দনা।
‘তুমি-ই চলুক না বন্দনা…। তোমার মনে আছে, তোমার প্রজাপতি ধরার অভিযানে একজন থাকত, বিজু নামে?’ বন্দনার দিকে সরাসরি না তাকিয়েই বলল বিজন।
‘আরে…?’ বলতে গিয়ে খুশি উছলে পড়ল বন্দনার গলায়। মনে হল, সত্যি সত্যি আর একবার সে প্রজাপতি ধরার সেই বয়সে পৌঁছে গেছে। ‘ছোটোবেলাটা কী আশ্চর্য, তাই না? ছেড়ে গিয়েও যেন আজীবন জীবনের সঙ্গে জড়িয়ে থাকে। আরে… সেইজন্যেই তুমি বারবার বলতে আমার অতীতের কথা জানো?’ বালিকাসুলভ খুশি ঝিলিক দিয়ে উঠল বন্দনার চোখে। সে ঘরের চারদিকে চোখ বুলিয়ে জানতে চাইল, ‘মৃদুলাকে দেখছি না, সে কোথায়?’
‘মৃদুলা বন্ধুর বাড়ি গেছে।’
‘আর ওর মা?’, জিজ্ঞেস করল বন্দনা। একটা কৌতূহলও ছিল। বিজনের সঙ্গে বিভিন্ন জায়গায় যতবার দেখা হয়েছে, ওকে একাই দেখেছে। ‘সে নেই বন্দনা,’ গভীর একটা শ্বাস নিয়ে বিজন বলল, ‘মৃদুলার যখন দশ বছর বয়স, তখনই ওর মা…।’
সেদিনের পর থেকে বন্দনার সঙ্গে প্রায়ই বিজনের দেখা হতে থাকল। বন্দনা তার চাকরি ও সমাজসেবা নিয়ে ব্যস্ত থাকলেও কেন কে জানে, বিজনের ফোন এলে সে খুশি হয়ে উঠত, আর বিজনের সঙ্গে দেখা করা আর কথা বলার জন্য ব্যাকুল হয়ে উঠল তার মন। সরষেখেতের পিছনে প্রজাপতি ধরতে যাওয়ার দিনগুলির স্মৃতি তাকে যেন তাড়িয়ে নিয়ে বেড়াত।
বন্দনার জীবনে কখনও প্রেম আসেনি। মাঝেমধ্যে একা থাকলে বন্দনা ভাবতে বসত, এই যে বিজনের জন্য একটা আকুলতা সে টের পায় মনের মধ্যে, একেই কি প্রেম বলে? ভিতরে ভিতরে এক ভীষণ যন্ত্রণা অথচ উপর-উপর সব শান্ত। যে-যার নিজস্ব সামাজিক মর্যাদার জালে বন্দি, যে-যার নিজস্ব খোলসে আবদ্ধ।
সমস্যাটা হল অন্য জায়গায়। বন্দনা যদিও টিচার্স রুম-এ বসে না, তবু, কানে এল, বন্দনা এবং বিজনের একসঙ্গে ঘোরাফেরার বিষয়টিকে অনেকেই রীতিমতো চর্চার বিষয় করে তুলেছে। বন্দনা খুব চিন্তায় পড়ে গেল। সারাজীবনে অন্য লোকে কী ভাবল তা নিয়ে আদৌ ভাবেনি সে। কিন্তু, এখন তার একটা সামাজিক মর্যাদা রয়েছে। নিজেকে কি তাহলে সে গুটিয়ে নেবে? কিন্তু, মন কেন চাইছে অন্য কিছু? কেন বালিকার মতো অবুঝ হয়ে উঠছে? আবেগে ভেসে নিজের সব প্রতিষ্ঠা ও মর্যাদাকে কি সে বিসর্জনের চতুর্দোলায় তুলে দেবে? অনেক ভেবে বন্দনা স্থির করল, মনে লাগাম পরানো দরকার। বিজন এরপর থেকে ফোন করে দেখা করতে চাইলে সে ঘুরিয়ে অসম্মতি জানাতে শুরু করে দিল। বেশ কিছুদিন ‘না’ শোনার পর বিজনও ফোন করা বন্ধ করে দিল।
জীবন দৌড়ে চলছিল। প্রথম-প্রথম একটু অস্বস্তি হলেও বন্দনা কাজকর্মের মধ্যে ভুলে থাকার চেষ্টা করছিল রুদ্ধ আবেগ। কিন্তু হঠাৎই একদিন মৃদুলার এক কাণ্ড বন্দনা আর বিজন দুজনকেই চমকে দিল।
তার সমাজসেবী সংস্থার দফতরে বসে ফাইলপত্র ঘাঁটছিল বন্দনা। দেখা করতে আসা মানুষজন খানিকক্ষণ আগেই বিদায় নিয়েছে। সন্ধে হয়ে এসেছে। হঠাৎ-ই ফোন। বন্দনা ‘হ্যালো’ বলতেই, ওপার থেকে মৃদুলা বলে উঠল, ‘ম্যাডাম, বাবা হঠাৎ খুব অসুস্থ হয়ে পড়েছে। আপনি এক্ষুনি একবার আসতে পারবেন? আমি কী করব, কিছুই বুঝতে পারছি না।‘ মৃদুলার উদ্বেগ-মাখা কণ্ঠস্বর খুবই বিচলিত করে দিল বন্দনাকে। ফোন রেখে কোনওমতে রাস্তায় নেমেই সে ট্যাক্সি ধরল।
বিজনের বাড়ির দরজায় ট্যাক্সি থামতে নেমে পড়ল বন্দনা। ট্যাক্সিওলাকে ভাড়া মিটিয়ে খুচরোও ফেরত নিল না। কিন্তু বিজনের ঘরে ঢুকে সে সত্যিই চমকে উঠল। বসার ঘরের হেলানো চেয়ারে দিব্যি পা তুলে বসে খবরের কাগজ পড়ছিল বিজন। শরীরে অসুস্থতার কোনও লক্ষণ পর্যন্ত নেই। সে বলে উঠল ‘আরে, তুমি তো দেখছি দিব্যি সুস্থ আছ। মৃদুলা যে বলল তোমার ভীষণ শরীর খারাপ?’
‘তাই নাকি,’ অবাক হওয়া গলায় বিজনও বলে ওঠে, ‘মৃদুলা এরকম বলবে কেন?’ তাদের কথাবার্তার মাঝখানেই পাশের ঘর থেকে বের হয়ে এল মৃদুলা। বলল, ‘আমি বলছি বাবা, কেন ফোন করেছিলাম।’
মৃদুলার কথায় বিজন ও বন্দনা দুজনেই বিব্রত হয়ে পড়ল। দুজনের অর্থবহ দৃষ্টিবিনিময় হল। দুজনের মনেই সম্ভবত একই ভাবনা খেলা করতে থাকল, তাদের ঘনিষ্ঠতার বিষয়ে কোনও গুরুতর অভিযোগ করতে চায় নাকি মৃদুলা! বন্দনার মনে একটা গ্লানি এল। নিজের বয়স ও সম্মান ভুলে তার কখনওই এরকম আচরণ করা ঠিক হয়নি। কেন এত বড়ো ভুলের পথে পা বাড়াল সে! এখন তো এর মাশুল গুনতেই হবে। নিজের হূদস্পন্দনও তার কানে আসছিল।
ঘরের মধ্যের দমবন্ধ ভাবটা কাটিয়ে তখনই মৃদুলা হেসে বিজনের গলা জড়িয়ে ধরে বলে উঠল, ‘বাবা, আগে আমার একটা প্রশ্নের উত্তর দাও।‘ বিজন খুব বিব্রত চোখে দেখল মৃদুলাকে। মৃদুলা হাসি ধরে রেখে বলল, ‘আজকাল তোমরা দুজন আর একসঙ্গে কোথাও বের হও না কেন?’
দুজনের কেউ-ই এই প্রশ্ন আশা করেনি। চমকে উঠে দুজনেই দুজনকে দেখল। খানিকক্ষণ ঘরে যেন হাওয়াবাতাস বন্ধ হয়ে রইল। তারপর বিজনই নিজেকে খানিকটা সামলে নিয়ে বলল, ‘সময় কোথায় পাই মৃদু?’ মৃদুলা হাসল না, বলল ‘কথাটা আন্টি বললে মানা যায়। নিজের চাকরি ছাড়াও তার অনেক কাজ। তা সত্ত্বেও তো উনি সময় বের করতেন।’
মৃদুলার এমন স্পষ্ট কথায় লজ্জা পেল বন্দনা। চোখ তুলে একবার মৃদুলার দিকে তাকাতেই তার চোখে দুষ্টুমির রং দেখতে পেল সে। ‘আচ্ছা, সে না হয় ঠিক আছে! কিন্তু, আগে বলো, আমাদের দুজনের একসঙ্গে ঘোরাফেরা করাটা কি তোমার অপছন্দ?’ জিজ্ঞেস করল বন্দনা।
‘একদম নয়,’ মৃদুলা বলল।
মৃদুলা নয়, বরং মা-হারা এক মেয়ের গলায় ভালোবাসা আর স্নেহের চাহিদা ঝরে পড়তে দেখল বন্দনা। তার চোখদু’টিও আবেগে ভিজে এল।
‘বাবা, তুমি নিজেই জানো না, তুমি কতটা অসুস্থ!’ একথা বলেই মৃদুলা বন্দনার দিকে তাকিয়ে বলল, ‘আন্টি ওই দিনগুলোতে বাবার চেহারায় কত জৌলুস ছিল! যেন নতুন জীবন পেয়েছে বলে মনে হতো! অথচ, এখন…।’ মৃদুলার কথায় বিজনের দিকে তাকাল বন্দনা। মৃদুলা ঠিকই বলেছে, একই অনুভবের সাগরে সে ও বিজন দুজনেই সাঁতার কেটেছে এতদিন।
‘আর এখন…।’মৃদুলা তার বক্তব্য জারি রাখে, ‘বাবা বিকেল থেকে মনমরা হয়ে বসে থাকে। হয় টিভি দেখে, নয়তো বাসি খবরের কাগজটাই দু’বার, তিনবার করে পড়ে। বাবার মনমরা ভাবটা তুমিই দূর করতে পারো আন্টি।’
বন্দনার মনে হল, মৃদুলাকে যতটা বালিকা ভাবত সে ও বিজন, সে ততটা ছোটো আর নেই। বন্দনাকে, তার এই পরিণত বয়সেও একরাশ লজ্জা যেন ঢেকে ফেলল। তার বিব্রত ভাব কাটাতে এবার বিজনই বলে উঠল, ‘মৃদু, বাকি জীবন একসঙ্গে চলার ফয়সালা তো আমরা করেই ফেলেছি! আমাদের সিদ্ধান্তকে তুমি কীভাবে নিলে সেটাও একবার আমরা যাচাই করে নিতে চেয়েছিলাম।’
‘বাবা…,’ মৃদুলা খুশিতে উদ্বেল হয়ে উঠে এক হাতে বিজন, অন্য হাতে বন্দনার হাত ধরে বলে উঠল ‘আমি একলা থাকতে থাকতে হাঁফিয়ে উঠেছি বাবা। আমারও মায়ের হাতের ছোঁয়া পেতে ইচ্ছে করে…।’ মৃদুলার চোখের কোনে টলটল করা জল বন্দনার মাতৃহূদয়কে উদ্বেল করে তুলল। হঠাৎ-ই মনে হল, এই ভালোবাসার জন্য এতকাল মরুভূমি হয়ে ছিল তার মনের ভিতরটা।
মৃদুলা পাশের ঘরে চলে যেতেই বিজন বলল, ‘বন্দনা, তোমার কোনও আপত্তি নেই তো?’
‘কীসে আপত্তি?’ খুব অবাক চোখে বিজনের দিকে তাকিয়ে বলল বন্দনা। আবার একটা পাকদণ্ডির সামনে এসে দাঁড়িয়েছে বন্দনা। কিন্তু এই পথটা যেন তার আর অচেনা ঠেকছে না।
‘না, মানে…।’ কোনওমতে বলল বিজন।
‘আর না-মানে, না-মানে করতে হবে না। অনেক হয়েছে, এবার ওঠো। মৃদুলাকে নিয়ে আজ রাতের খাবারটা বাইরেই সারব। দেখলে না মেয়েটা কত দুঃখী!’