নদীর নাম যদি হয় ‘জিয়াভরালি’ তাহলে তাকে দেখামাত্র জিয়া অর্থাৎ হূদয় যে ভরবে এ তো স্বাভাবিক! কল্পনার পাখায় উড়াল দিয়ে, এবার তাই আমাদের গন্তব্য অসমের জিয়াভরালি ও তৎসংলগ্ন বনস্থলি নামেরি ন্যাশনাল পার্ক। মাছ ধরার নেশা যাদের তারা একবাক্যে চিনে নেবেন এই অঞ্চলের সুখ্যাত ‘পটাসালি-অ্যাংলিং ক্যাম্প’-কে। আমাদের থাকার জন্য একটি দিন রাখা হয়েছে এই অ্যাংলিং ক্যাম্পে, বাকি দুটো দিন থাকব ন্যাশনাল পার্কের সীমানায় নামেরি ইকো ক্যাম্পের জাঙ্গল টেন্ট-এ। Nameri Wild Life Range-র রেঞ্জ অফিসারের সৌজন্যে মিলেছে বুকিং।

Guwahati থেকে Tezpur হয়ে বিকেল বিকেল পৌঁছেছি পটাসালিতে। ভরালি নদীর সৌন্দর্য দুচোখ ভরে দেখি। বনের গাঁ ঘেঁষে যেন একটি নীল দুপাট্টার মতো বয়ে চলেছে এই নদী। জঙ্গলের ব্যাকড্রপে নদীর পাড় ধরে হাঁটতে হাঁটতে সূর্যকে বিদায় জানাই।

পরদিন একজন গাইডের সাহায্যে আমাদের জঙ্গল ভ্রমণ। সংখ্যায় কমে আসা হোয়াইট উইংড উড ডাক-এর বাস এই নদীতে। জিয়াভরালি ও তার অসংখ্য শাখা নদী ন্যাশনাল পার্কটিকে সবুজ ও সতেজ করে রাখে। সম্বর, বার্কিং ডিয়ার, হগ ডিয়ার, বুনো শূকর, গৌর ও অল্পসংখ্যক বাঘ রয়েছে নামেরিতে। বর্ষায় ফুলে ফেঁপে ভয়ংকরী রূপ নেয় জিয়াভরালি। কিন্তু অজস্র পাখির বাসস্থান এই বনস্থলি। ওরিয়েন্টাল কিংফিশার, হোয়াইট চিক্ড পার্টরিজ, মাউন্টেন ইমপেরিয়াল পিজিয়ন, ব্লু নেক্ড পিট্টা, স্লেন্ডার বিল্ড ওরিওল, হিল ব্লু ফ্লাইক্যাচার প্রভৃতি বহু জাতের, বহু রঙের পাখির আবাস এই নামেরি। এছাড়া মায়ানমারিজ পাইথন, ফিলড বক্স টার্টল, সাউথ ইস্ট এশিয়ান লিফ টার্টল, আসাম রুফড্ টার্টল প্রভৃতি উভচরের বাসও এই জঙ্গলে।

গাইড পথ চেনায়, আমারাও পাখি দেখতে দেখতে এগোই। একজায়গায় দাঁড়িয়ে পড়ি চারটি বিরাট হর্নবিল দেখে। ক্রমে দেখি হর্নবিলের আস্ত একটি ঝাঁক। ওদের বিরক্ত না করে এগোতে থাকি নিঃশব্দে। জাঙ্গল ট্রেক-এর অভিজ্ঞতা এই প্রথম, তাই পদে পদে শিহরণ লাগে। ফেরার পথে দেখি একটা বিশাল পাইথন, গাছের নীচে কুণ্ডলী পাকিয়ে শুয়ে।

দুপুরে আমাদের র‍্যাফটিং-এ যাওয়ার প্ল্যান। লাঞ্চ সেরে সেই মতো বেরিয়ে বোটম্যান আমাদের র‍্যাফট-এ করে নদীভ্রমণে নিয়ে চলল। নানারকম জলচর পাখি দেখতে দেখতে জলে ভেসে বেড়ানোর অভিজ্ঞতাটিও দারুণ। সূর্য অস্ত যাচ্ছে তাই আর দেরি না করে ফিরে এলাম জাঙ্গল টেন্ট-এ। নানারকম বন্য জন্তুর ডাক শুনতে শুনতে ঘুমোনোর অভিজ্ঞতাও বেশ থ্রিলিং।

নামেরিতে যেহেতু জিপ সাফারির কোনও ব্যবস্থা নেই, তাই আর্মড গার্ডের সঙ্গে পায়ে হেঁটে জঙ্গল ভ্রমণের প্ল্যানটিই বহাল রইল পরদিনও। ভোরবেলায় জন্তুর দেখা মিলবে এই আশায় ক্যামেরা কাঁধে বেরিয়ে পড়ি। কাদাজল পেরিয়ে বনের গভীরে ঢুকে, নদীর ধারের একটি ওয়াচটাওয়ারে উঠে প্রতিক্ষা করতে থাকি। শিশিরে ভেজা পাতায় সরসর শব্দ করে এসে বসে, একটি পিন টেল্ড গ্রিন পিজিয়ন। উড়ে যায় দুটি হর্নবিল ও সেই সঙ্গে টিয়ার ঝাঁক। বেশ খানিক অপেক্ষার পর দেখি জল খেতে এসেছে একঝাঁক বার্কিং ডিয়ার। একটা সম্বর ঝোপের মধ্যে থেকে উঁকি দিয়ে চলে গেল। গার্ডের কাছে খবর ছিল বুনো হাতির একটা দল আছে কাছেপিঠে কোথাও। হঠাৎই কানে এল তাদের বৃংহণ। কিন্তু ওখানে অপেক্ষা করার আর সাহস হল না কারওই। অজানা বিপদের ঝুঁকি কাটিয়ে ফিরে চললাম ক্যাম্পের দিকে।

 

আরো গল্প পড়তে ক্লিক করুন...