ফারাক্বা থেকে গাড়ি লেফ্ট টার্ন নিতেই রাস্তার চরিত্র বদলে গেল। পরিষ্কার আকাশ, ঝকঝকে আবহাওয়া, চোখ ধাঁধানো রোদ। মে মাসের শেষ সপ্তাহ। গরমে শরীর চিড়বিড় করছে। তারপর দুর্বিষহ জার্নি। এনটিপিসি পার করতে আরও খারাপ হাল রাস্তার। কোনও কালে পিচ পড়লেও এখন চিহ্নমাত্র নেই। রুক্ষ মাঠের মতো মেটে রঙের রাস্তায় এখানে সেখানে বড়ো বড়ো গর্ত। সন্তর্পণে গর্ত বাঁচিয়ে গতিবেগ কুড়ির উপর উঠছে না। সাত কিলোমিটার এভাবে হোঁচট খেতে খেতে এগোনোর পর ‘ওয়েলকাম টু ঝাড়খণ্ড’ লেখা বোর্ড। গ্রামের নাম পূরণচাঁদিপুর। ছোটো একটা কালভার্ট। বাংলা-ঝাড়খণ্ড সীমান্ত।
কালভার্ট পেরোতেই ভোজবাজির মতো বদলে গেল রাস্তার চরিত্র। পিচঢালা মসৃণ এন এইচ ৮০। বদলে গেল চারপাশের পরিবেশ। সবুজ গাছপালা, লাল মোরাম বিছানো রাস্তা, ছোটো ছোটো গ্রাম– পরবর্তী চব্বিশ কিলোমিটার রাস্তা দেখতে দেখতে পেরিয়ে এলাম। বারহারোয়া সাহেবগঞ্জ জেলার সদর। হাওড়া থেকে দূরত্ব ২৮৫ কিলোমিটার। রেলপথে যোগাযোগ আছে হাওড়া এবং কলকাতার সাথে। যদিও আমরা বেরিয়েছি লং-ড্রাইভে। বন্ধুরা মিলে হইচই করতে করতে। বারহারোয়াকে পেছনে ফেলে আরও ২৭ কিমি অতিক্রম করে রাজমহল পৌঁছোই ন’টা নাগাদ। আমাদের মূল গন্তব্য। রাজমহলকে কেন্দ্র করে দেখে নেব আশেপাশের আরও অনেক জায়গা।
হোটেলে উঠে স্নান-খাওয়া সেরে ঘণ্টা দুয়েকের বিশ্রাম। কাল সারারাত রাস্তায় কেটেছে। কলকাতা থেকে প্রায় ঘণ্টা সাতেকের রাস্তা। সকলেই কমবেশি ক্লান্ত। বিশেষ করে ড্রাইভার ছেলেটি। ওর নাম ডালটন। বেশ মিশুকে। বিছানায় শরীর এলাতেই চোখের পাতা বুজে এল।
ঘণ্টা দু’য়েকের ভাতঘুম দিয়ে তিনটে নাগাদ বেরিয়ে পড়লাম। রাজমহল খুব ছোটো শহর। ঘণ্টা দুয়েকের মধ্যে দেখে নেওয়া যায় একদা বিহার, বর্তমানে ঝাড়খণ্ড– সাহেবগঞ্জ জেলার গঙ্গা তীরবর্তী ঐতিহাসিক শহর রাজমহল। বহু পুরোনো রাজমহলের ইতিহাস। এক ঝলক সেই ইতিহাসের দিকে না তাকালে রাজমহলকে চিনতে অসুবিধা হবে।
খ্রিস্টের জন্মেরও আগে গ্রিকদূত মেগাস্থিনিস সেলুকাসের বর্ণনাতে রাজমহলের উল্লেখ পাওয়া যায়। পরবর্তীকালে (৬৪৫ খ্রিঃ) চিনা পরিব্রাজক হিউয়েন সাঙ তাঁর ভ্রমণবৃত্তান্তে তেলিয়াগড়ি ফোর্ট ও রাজমহলের উল্লেখ করেন। তাঁর বর্ণনা থেকেই জানতে পারি কোনও একসময় এখানে বৃহদাকার বৗদ্ধবিহার ছিল। তেরোশো শতাব্দীতে দিল্লিতে তুর্কি শাসনকালে বকতিয়ার খিলজি বাংলা আক্রমণ ও দখল করেন। ১৫৭৬ সালে আক্রমণ করেন মোগলরা। রাজমহলের যুদ্ধে তারা জয়লাভ করলে বাংলায় মোগল শাসনের ভিত্তি স্থাপিত হয়। আকবরের বিশ্বস্ত সেনাপতি মানসিংহকে পাঠানো হয় শাসনভার দিয়ে। রাজমহলে তিনি রাজধানী স্থাপন করেন। যদিও অল্প কিছুদিনের জন্য। পরবর্তীকালে (১৬৫৯ খ্রিঃ) শাহজাহানের দ্বিতীয় পুত্র সুজাকে বাংলার শাসক হিসাবে পাঠালে পুনরায় তিনি রাজমহলে রাজধানী স্থাপন করেন এবং শাসনকার্য চালান।