কুমায়ুন পর্বতমালার কোলে রয়েছে পর্যটকদের মন কেড়ে নেওয়ার মতো অজস্র ছুটি কাটানোর জায়গা। এর মধ্যে সবচেয়ে পরিচিত জায়গাটি নৈনিতাল। ছেলেমেয়েদের স্কুল কলেজে গ্রীষ্মের ছুটি পড়লে ভ্রমণপিপাসু বাঙালি প্রায়ই যেখানে যাওয়ার পরিকল্পনা করে।

নৈনিতালের মূল আকর্ষণ এখানকার প্রাকৃতিক সৌন্দর্য। নৈনি লেক, পাহাড়, পপলার-চিনার-দেওদার গাছে ছাওয়া রাস্তা এসবই মুগ্ধ করার পক্ষে যথেষ্ট। নৈনিতালে পৌঁছোনোও খুব কঠিন নয়। দিল্লি এবং নৈনিতালের মধ্যে নিয়মিত বাস যাতায়াত করে। লখনউ থেকেও বাস সার্ভিস আছে। নৈনি লেকের পাড়েই বাসস্ট্যান্ড। লেকের পাড় ধরে হেঁটে নৈনিতাল শেষ হলে মাল্লিতাল। পর্যটকদের বিনোদনের হাজারও পশরা সাজানো এখানে। আছে গল্ফ কোর্স, চিলড্রেন্স পার্ক, ঝরনা, স্কেটিং।

মাল্লিতাল পেরোলে তাল্লিতাল। এটি বাজারহাটের জন্য নির্দিষ্ট এলাকা। নৈনিতালে পাহাড়ের গায়ে চমৎকার চিড়িয়াখানাটিও পর্যটকদের মন কেড়ে নেয়।

নৈনিতাল চেনা শহর। কুমায়ুন পর্বতমালার কোলে আরও অজস্র জায়গা আছে, যা অল্প চেনা। যেমন, চৌকোরি, কৌশানি, পাউরি, পিথোরাগড়, বিনসর কিংবা আলমোড়া অথবা রানিখেত।

কুমায়ুনের বিরাট পর্বতশ্রেণির সঙ্গে ভারতীয় পুরাণকথার আশ্চর্য এক সংযোগ খুঁজে পাওয়া যায়। বিশেষত, মহাভারতে বর্ণিত অনেক ঘটনার সঙ্গেই এই পর্বতমালার সম্পর্ক রয়েছে।

কুমায়ুন পর্বতমালার ৭২০০ফুট উচ্চতায় পিথোরাগড় জেলা। এই জেলারই একটি সীমান্ত শহর মুনশিয়ারি। সীমান্ত শহর এই কারণে যে, শহরটির পুবে নেপাল এবং উত্তরে তিব্বত। চন্দক, থল, ধবজ, কেদার ও কুন্দর এই পাঁচটি পাহাড়ে ঘেরা এই শহর। দুয়েকটা দিন কাটিয়ে যেতে পারেন এখানেও। পথে পড়বে রামগঙ্গানদীর তীরে থল। ভীষণ ভয় পাওয়ানো রাস্তা উঠে গেছে পাহাড়ের গা বেয়ে। হেয়ারপিন বেন্ড। অনেক নীচে বয়ে যাচ্ছে নদী। হঠাৎ-ই দেখতে পাবেন বিরথি জলপ্রপাত। নীচে সৌন্দর্যমণ্ডিত বিরথি গ্রাম। বাস থামবে কালামুনি গিরিবর্ত্ম্যে।

এখানেই পঞ্চচুল্লিকে প্রথমবারের জন্য দেখতে পাবেন। শোনা যায়, পঞ্চচুল্লির পাঁচটি চুলায় দ্রৌপদী তাঁর পাঁচজন স্বামীর জন্য রান্না করতেন। এখন অবশ্য এক ঝলক দেখে এই ইতিহাসকে পুনরুদ্ধার করার রাস্তা নেই। কেন-না পঞ্চচুল্লির কোলে মুনশিয়ারি এখন মহকুমা শহর। কুমায়ুন মণ্ডলের একটি বাংলো আছে এখানে। বাংলোর জানলা দিয়ে পাহাড়ে সূর্যোদয় ও সূর্যাস্ত দেখতে দেখতে ঘোর লেগে যাবে।

মুনশিয়ারি থেকে ফেরার পথে চট করে আরও কয়েকটা জায়গা দেখে নেওয়া যায়। যেমন, মিলাম ও রালাম হিমবাহ। যদিও পৌঁছোনোর রাস্তাটা খুবই দুর্গম! তারপর যেতে পারেন পাঁচ কিমি দূরের বেতুলিধর এবং খালিয়াটপে। শীতকালে স্কি করা যায় এখানে।

আলমোড়ার বাস ছাড়ে ভোররাতে। মুনশিয়ারি থেকে বাসে থল হয়ে পৌঁছে যান কুমায়ুনের আর-একটি দর্শনীয় স্থান নির্জন চৌকোরিতে। সারাটা রাস্তা পাইনবনের মধ্যে দিয়ে যেতে হবে। অপূর্ব জার্নি।

চৌকোরিতে আবার আকাশ জুড়ে মাথা ঠোকাঠুকি করছে, একাধিক গম্ভীর পর্বতচূড়া – নন্দাদেবী, পঞ্চচুল্লি, ত্রিশূল। বাংলোর বাইরে এসে বসুন। এক অদ্ভুত ধ্যানগম্ভীরতা আপনাকে পেয়ে বসবে এই নির্জন পাহাড়ি আবহে। এখানে একটি ভিউ টাওয়ারও আছে। সেখানে উঠে আশেপাশের প্রকৃতির শোভা মন ভরে উপভোগ করুন।

চৌকোরি থেকে মাত্র ৩ কিমি দূরে কোটমুন্যা। যাওয়ার জন্য শেয়ার জিপ পাবেন। কোটমুন্যাতে এইজন্য আসতে বলছি কারণ, এখানে পাহাড়ের মাথায় একটি কস্তুরিমৃগ রিসার্চ সেন্টার রয়েছে। ভারতে মাত্র তিনটি এমন রিসার্চ সেন্টার আছে। কোটমুন্যারটি ছাড়া আর দুটি হিমাচলের কুফরিতে এবং চামোলির পাঙ্গেরবাসায়।

চৌকোরি থেকে বিখ্যাত পাতালভুবনেশ্বরের দূরত্ব মাত্র ৩৮ কিমি। শেয়ার জিপ যায়। তবে সবচেয়ে ভালো হচ্ছে লজের ম্যানেজারকে বলে গাড়ির বন্দোবস্ত করা। পাতালভুবনেশ্বর এক স্মরণীয় অভিজ্ঞতা হয়ে থাকবে। ক্যামেরা-জুতো-মোবাইল-নাম-ঠিকানা সব জমা করে গাইড বা পুরোহিতের সঙ্গে পিছল পাথর বেয়ে পাতালপ্রবেশের পথে চলুন। আশেপাশে, চুনাপাথরের উপর জল চুঁইয়ে পড়ে প্রাকৃতিকভাবেই নানা মূর্তি তৈরি হয়েছে। গুহার গা ছমছমে পরিবেশে খানিকক্ষণ কাটিয়ে, উপরে আলোর জগতে ফিরে আসার পর মনে হবে যেন নতুন জন্ম হল। আসলে কুমায়ুন বারবারই নানাভাবে নতুন জন্ম দেয় পর্যটকদের।

জরুরি তথ্য

নৈনিতালের সবচেয়ে কাছের বিমানবন্দরটি পন্থনগরে। হাওড়া থেকে ট্রেনও রয়েছে অনেকগুলি। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য, কাঠগোদাম-হাওড়া বাঘ এক্সপ্রেস ভায়া লখনউ, কাঠগোদাম-মোরাদাবাদ-দিল্লি রানিখেত এক্সপ্রেস, লালকুয়া-আগ্রা কুমায়ুন এক্সপ্রেস, লালকুয়া-লখনউ নৈনিতাল এক্সপ্রেস প্রভৃতি। সড়কপথেও দিল্লি ও লখনউয়ের সঙ্গে যোগাযোগ রয়েছে নৈনিতালের। রাত্রিবেলা এই দুটি শহর থেকে বাস যায়। এসি ডিলাক্স বাস-ও পাবেন।

মুনশিয়ারি যেতে হলে – হাওড়া থেকে বাঘ এক্সপ্রেসে কাঠগোদাম বা হলদোয়ানিতে নেমে আলমোড়ায় পৌঁছোতে হবে। সেখান থেকে ভোরে বাস ছাড়ে। মুনশিয়ারি মাত্র ২৪০ কিমি দূরে। আবার, অমৃতসর মেল ধরে লখনউয়ে নেমে, রাত্রিবেলা নৈনিতাল এক্সপ্রেসে চেপে, টনকপুর পৌঁছে গাড়িতে বা শেয়ার জিপে মুনশিয়ারিতে আসতে পারেন। এই রুটের সুবিধা হল, টনকপুরে এলে পিথোরগড়টাও দেখে নেওয়া যায়।

 

আরো গল্প পড়তে ক্লিক করুন...