জম্মু ও কাশ্মীর রাজ্যের উত্তরাংশে অবস্থিত লাডাক বা লাদাখ। তবে নাম যাইহোক না কেন, অর্থ একই। ‘লা’ মানে গিরিবর্ত্ম আর ‘ডাক’ বা ‘দাখ’ মানে দেশ। অর্থাৎ, গিরিবর্ত্মের দেশ। ‘লাস্ট সাংগ্রিলা’ বা ‘দি ল্যান্ড অব দি ম্যুন’ও বলে লোকে। হিউয়েন সাঙ-এর ভারত বিবরণীতে ‘মা-লো-ফো’ অর্থাৎ ‘লালভূমি’ বলে উল্লেখ আছে। স্থানীয় লোকেরা কেউ-কেউ ‘বরফের দেশ’ বা ‘পাহাড়ের দেশ’ও বলে থাকেন। কয়েকহাজার বছর আগে লাদাখে বসবাস করতেন যাযাবর সম্প্রদায়ের লোকেরা। পরে অবশ্য বিভিন্ন দেশের মানুষের মিশ্রণে গড়ে ওঠে লাদাখি জাতি। এখানে শাসকেরও বদল ঘটেছে বারবার।
লাদাখের পথ ছড়িয়ে রয়েছে তিন দেশের (চিন, ভারত, পাকিস্তান) সীমান্ত জুড়ে। সিংগে-চু বা সিন্ধু-লাদাখের মুখ্য নদ। অতীতে এই শহর ছিল প্রাচীর-ঘেরা। ছিল তিনটি প্রবেশদ্বার। কিন্তু শহর প্রসারিত হওয়ায় ভাঙা পড়েছে অনেক প্রাচীর। তবে এখনও স্মৃতি রোমন্থন করায় বাজার লাগোয়া কিংস গেটটি।
মধ্যযুগীয় বৌদ্ধ সংস্কৃতির এই পীঠস্থান অর্থাৎ লাদাখ, ১৯৭৪ সাল থেকে ভ্রমণার্থীদের কাছে দরজা খুলে দিয়েছে। যাঁরা লাদাখ বেড়াতে গেছেন, তাঁরা প্রত্যেকে মুগ্ধ হয়েছেন বৈচিত্র্যেভরা লাদাখের প্রকৃতি দেখে।
ভারতের উত্তর থেকে জন্মু ও কাশ্মীরের পশ্চিম পর্যন্ত বিস্তৃত (৮২৬৬৫ বর্গ কিমি) লাদাখভূমি। এখানে তিব্বতি ভাষায় কথা বলে লোকে। তবে হিন্দি ও উর্দুরও চল আছে।
গ্রীষ্ম ও শীত–মুখ্যত এই দুই ঋতুই অনুভব করা যায় লাদাখে। বৃষ্টি প্রায় হয় না বললেই চলে। গ্রীষ্মের দিনগুলিতে লাদাখে সূর্য ওঠে সাড়ে পাঁচটারও আগে এবং অস্ত যায় সন্ধ্যা সাড়ে আটটারও পরে। তবে চলাফেরায় নানান বিধিনিষেধ আছে লাদাখভূমে।
লে এবং কার্গিল এই দুই জেলায় এখন ভাগ হয়ে গেছে লাদাখ। সিন্ধু উপত্যকার মধ্যভাগ নিয়ে লে জেলা আর জাঁসকর ও সুরু উপত্যকার সঙ্গে সিন্ধু নদের অংশ জুড়ে গড়ে উঠেছে কার্গিল জেলা।
চোখ জুড়ানো প্রকৃতির মাঝে এক ছোট্ট শহর লে। লে’র মনাস্ট্রি বা গুম্ফাগুলিও অসাধারণ। এইসব গুম্ফাকে ঘিরে সারাবছরই নাচ-গান ইত্যাদি হয়ে থাকে। বসন্তে তীরন্দাজি উৎসবও কম জনপ্রিয় নয়। দলাইলামার জন্ম উৎসবকে কেন্দ্র করেও লাদাখবাসীর উৎসাহ উদ্দীপনা চোখে পড়ার মতো। দু’দিন ধরে চলে এই অনুষ্ঠান। এই অনুষ্ঠানের শেষদিনে দুষ্টের দমনে কুশপুত্তলিকা দাহ করা হয়। এছাড়া উপাসনাও চলে আনুষ্ঠানিক ভাবে।
লে শহরের চারপাশ ঘিরে রয়েছে পাহাড়। পাহাড় লাগোয়া মৌচাকের মতো ঘর-বাড়িগুলি পাথরে তৈরি। বড়ো রাস্তার দুপাশে প্রচুর দোকানপাট রয়েছে। লাদাখি যুবতিরাই ওইসব দোকানের বিক্রেতা। ওখানকার ছেলেরা গৌচা (জোব্বাধর্মী পোশাক) এবং মাথায় টুপি পরে। আর কানঢাকা টুপি-সহ কুনটপ পরে মেয়েরা। ওইসব টুপির রকমফের বংশপরিচয় বহন করে। তবে শুধু চকচকে পোশাকই নয়, রুপোর তৈরি গয়নাও পরতে দেখা যায় লাদাখ অধিবাসীদের।
লে রাজপ্রাসাদও বেশ চমকপ্রদ। নয়তল বিশিষ্ট এই প্রাসাদের শিরে রয়েছে এক আকর্ষণীয় রেড গুম্ফা। রয়েছে বুদ্ধের স্বর্ণমূর্তি। পুঁথি, পাণ্ডলিপি ও ছবির সংগ্রহশালাও রয়েছে ওই প্রসাদে। শহরটাকে বেশ ভালো ভাবে দেখে নেওয়া যায় প্রাসাদ শীর্ষ থেকে। এখানকার স্টক প্রাসাদে বসবাস করেন রাজপরিবারের সদস্যরা। লে শহরের পশ্চিমে, রাজগিরের আদলে গড়ে উঠেছে শান্তিস্তুপ। এর প্রতিষ্ঠাতা জাপানিজ বৌদ্ধসংঘ। বুদ্ধের সম্পর্কে নানা তথ্য খোদাই করা আছে এই স্তুপে।
১২ টি গুম্ফা বেশ উল্লেখযোগ্য লে শহরে। তবে কয়েকটি গুম্ফা দেখতে অনুমতি লাগে। প্রতিটি গুম্ফাতে যাতায়াত করা যায় খুব সহজে।
সিন্ধু নদের তীরে (স্পিটাকের কাছে) বিমানবন্দরও আছে লে শহরে। আর এই বিমানবন্দর থেকে বাস, ট্যাক্সি, জিপ ইত্যাদি যানবাহন পাওয়া যায় অনায়াসে। তবে বাসের টিকিটের চাহিদা বেড়ে গিয়ে মাঝেমধ্যে সামান্য অসুবিধায় পড়তে হয় যাত্রীদের।
লাদাখের আর এক জেলা শহর কারগিল। নাকতুর, ওরজন, ও হোরকারঃতিন পাহাড়ের মাঝে এই জেলা শহরের অবস্থান। আগে এই জেলার নাম ছিল খারখিল। একসময় বালতিস্তানের রাজধানীও ছিল এই খারখিল বা কারগিল। লে ও শ্রীনগর থেকে নয় থেকে দশঘণ্টা বাসযাত্রা করে পৌঁছোতে হবে কারগিল। গম, বার্লি এসবই হচ্ছে কারগিলের প্রধান ফসল। তবে প্রচুর ফলবাগিচাও রয়েছে এই শহরের বিভিন্ন জায়গায়। এখানকার ইমামবাড়া (তুর্কি স্থাপত্য) মসজিদও বেশ আকর্ষণীয়। সিয়া মুসলিমরা মহাসমারোহে এখানে মহরম উৎযাপন করেন। এছাড়া এখানে পাহাড়ে ট্রেকিংয়ের জন্যও সবরকম সরঞ্জাম ভাড়ায় পাওয়া যায়। আর কারগিলের গ্রাম্যবসতিও বেশ উপভোগ্য। তবে আর দেরি কেন? লাদাখের নয়নাভিরাম নৈসর্গিক শোভা একবার নিজে চোখেই দেখে আসুন না কেন!
কীভাবে যাবেনঃ কলকাতা থেকে রেলপথে শিমলা পৌঁছোতে হবে। তারপর ওখান থেকে সড়কপথে মানালি হয়ে লাদাখ (লে) যাওয়া যায়। এছাড়া জম্মুতাওয়াই স্টেশনে নেমেও লাদাখ পৌঁছোনো যায়। আর বায়ুপথে যেতে চাইলে, কলকাতা বিমানবন্দর থেকে যাত্রা শুরু করতে পারেন। অবশ্য বিমানেও ভায়া দিল্লি হয়ে লাদাখ যেতে হবে। তবে লাদাখ ভ্রমণে গেলে, সচিত্র পরিচয়পত্র অবশ্যই সঙ্গে রাখবেন। কারণ, জাতীয় নিরাপত্তার কারণে যে-কোনও সময় পরিচয়পত্র দেখতে চাওয়া হতে পারে।
কোথায় থাকবেনঃ প্রচুর হোটেল আছে লাদাখে। লোকের বাড়িতেও অল্প খরচে অতিথির মতো থাকা যায়। এছাড়া কলকাতায় জন্মু ও কাশ্মীরের টুরিজম ডেভেলপমেন্ট কর্পোরেশনে যোগাযোগ করলেও লাদাখে থাকার ব্যবস্থা হতে পারে।
চলবে…