অজানাকে জানা এবং অচেনাকে চেনার এক স্পৃহা বা ইচ্ছে সকলের মধ্যেই থাকে। আর এর মধ্যেই লুকিয়ে আছে এক অপার আনন্দ। তাই মানুষ এই আনন্দের মধু-সঞ্চারণে এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় ঘুরে চলেছে। ভ্রমণের আনন্দ আমাদের সকলেরই অল্পবিস্তর আছে।
যদিও আজকাল খবরের কাগজ বা টিভি খুললেই চোখে পড়ে বিশ্বজুড়ে নানা সংকটের কথা। কিন্তু এসব সত্বেও মানুষের মনে প্রেমের জোয়ারের মোটেই ভাটা পড়েনি। আর বাঙালিরা রোমান্টিক হবে না, এরকম কথা ভাবাই যায় না। বিশেষ করে যারা প্রকৃতি দেখেছেন, দেখেছেন ভালোবাসা।
মানুষ ভালোবাসার খবর সময়মতো পৌঁছে দেয় নিজের প্রিয় মানুষটির কাছে। ভালোবাসার জন্য নির্দিষ্ট কোনও সময় বা স্থানের প্রয়োজন নেই। প্রাকৃতিক ও সামাজিক ভাবে গোছানো এবং নিরাপদ তেমনই কয়েটি শহর আছে, যেগুলোকে সকলেই রোমান্টিক বা ভালোবাসার শহর বলেই জানেন।
প্যারিস
এই বিশ্বের সবচেয়ে রোমান্টিক শহর কোনটি? এই প্রশ্ন করলে সকলেই এক বাক্যে জবাব দেবেন প্যারিস। ফ্রান্সের রাজধানী শহর প্যারিসকে প্রেমিক-প্রেমিকাদের স্বপ্ননগরী বলেও অনেকে উল্লেখ করেন। এই প্যারিস-এ কৃষ্টি ও সংস্কৃতির এক অপূর্ব মেলবন্ধন দেখা যায়। প্যারিসকে দেখে প্রেমে পড়েননি এমন লোক হয়তো খুঁজে পাওয়া যাবে না।
যারা একবার ফ্রান্সে বেড়াতে গেছেন অথচ প্যারিস-এ যাননি, এমন মানুষ খুঁজে পাওয়া খুব কঠিন হবে। প্রেমে-ভালোবাসায় মাখামাখি এ শহরের প্রতিটি রাস্তা, স্থাপত্য আর ক্যাফে। নববিবাহিত দম্পতিরাও ছুটে যান প্যারিসে। রাতেরবেলা প্যারিসের সৌন্দর্য আরও মনোমুগ্ধকর, যা লিখে বর্ণনা করা খুবই মুশকিল।
নির্জনে যখন বৃষ্টির ফোঁটা পড়ে প্যারিসের বৃষ্টি-ভেজা সেই পথে হেঁটে আপনাকে নিজেকে ভাগ্যবান বলে মনে হবে। যারা সংস্কৃতি-প্রেমী তাদের কাছে প্যারিস এক কল্পনার শহর। পর্যটকদের প্রিয় এই শহরটি নতুন প্রেমিক-প্রেমিকা ও নবদম্পতিদের কাছে সময় কাটানোর জন্য উপযুক্ত শহর।
হনিমুনে যেতে হলে প্যারিসে যান সৌন্দর্য উপভোগ করতে। এই শহরের মতো সাজানো গোছানো শহর খুব কমই দেখা যায়। এখানকার পরিচ্ছন্ন ও স্বচ্ছ আবহাওয়ায় ঘুরে বেড়াতে বেড়াতে, মনের মধ্যে মুহূর্তেই আনন্দের জোয়ার ওঠে। ভরে যায় মন, প্রাণ। কণ্ঠ দিয়ে বেরিয়ে আসে সংগীতের মূর্ছনা। হারিয়ে যেতে ইচ্ছে করে প্রকৃতির খেয়ালের সাথে। তাই প্যারিসের সাথে অন্য কোনও শহরের তুলনা করে চলে না।
লাভ লক প্যারিসের শিন নদীর ওপর যে ব্রিজ আছে, তাতে লাগানো আছে কোটি কোটি তালা। সারা বিশ্বের প্রেমিক-প্রেমিকা যুগল সেখানে গিয়ে তালায় তাদের নাম লিখে চাবিটা ছুড়ে দেয় নদীতে। তাদের বিশ্বাস, চাবি ছাড়া এই তালার মতোই দুজনের হৃদয় যুগলবন্দি হয়ে থাকবে চিরকাল।
এই প্রসঙ্গে পাঠকদের জানাই, এই অদ্ভুত কাণ্ড কিন্তু শুধু ফ্রান্সেই ঘটে না। কারণ প্রেমিক-প্রেমিকারা ছড়িয়ে আছে সারা বিশ্ব জুড়ে। আলজেরিয়া, অস্ট্রেলিয়া, যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, কানাডা, ফ্রান্স, আয়ারল্যান্ড, ইতালি, জার্মানি, ব্রাজিল নানা দেশেই এমন ব্রিজ দেখতে পাওয়া যায়।
অনেকেই শুনলে অবাক হবেন প্রায় ১০০ বছর ধরে প্রেমিক-প্রেমিকারা এই লাভ লক বা প্রেমের তালা জুড়ে দেওয়ার চর্চা করে আসছেন। পাঠক হিসেবে অনেকের মনেই প্রশ্ন জাগা স্বাভাবিক, এর শুরুটা কীভাবে হয়েছিল?
অনেকেই বলেন, প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় নাডা নামের এক সার্বিয়ান বালিকা, স্থানীয় এক অফিসার যুবকের প্রেমে পড়েছিল। যুবকটির নাম ছিল রেলজা। কিন্তু কিছুদিন পরেই রেলজা গ্রিসে যুদ্ধ করতে চলে যায়। গ্রিসে গিয়ে রেলজা সেখানকার একটি মেয়ের প্রেমে পড়ে যায়। স্বাভাবিক ভাবেই ভুলে যায় নাডাকে। সেই বিরহেই প্রাণ হারায় প্রেমিকা নাডা।
এই হৃদয় বিদারক ঘটনা সার্বিয়ার চারিদিকে আগুনের মতো ছড়িয়ে পড়ে। এই ঘটনার পর থেকেই বানজার এলাকার মেযেরা একটি তালার মাঝে প্রেমিক-প্রেমিকা দুজনের নামের প্রথম অক্ষর লিখে সেটি ঝুলিয়ে দিত বানজারের একটা ব্রিজে। কারণ প্রতিদিন বিকেলে সেই ব্রিজেই নাডা এবং রেলজা দেখা করত। এই ইতিহাস পরে ছড়িয়ে যায় সারা পৃথিবীতে।
পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের ব্রিজের ওপর লাভ লক লাগানোর শুরু, সম্ভবত তখন থেকেই। তাই আজও এই জায়গাগুলো রোমান্টিক স্পট হিসেবে চিহ্নিত হয়ে আছে। তাই পর্যটকেরা বেড়াতে গেলে এই জায়গাগুলো দেখে আসতে ভুলবেন না। কি ভাবছেন? আপনিও একটা তালা লাগিয়ে আসবেন নাকি সেখানে, প্রেম-বন্ধনকে আরও দৃঢ় করতে?
ভেনিস
পৃথিবীর ভাসমান শহরের কথা বললে প্রথমেই মনে পড়ে যায় ভেনিসের কথা। ইতালির ভেনিসের মতো নান্দনিক শহর পৃথিবীতে খুব কমই আছে। ভেনিসের বুক চিরে বয়ে গেছে স্বচ্ছ জলের প্রবাহ। পরিষ্কার জলের এই লেকগুলো এতটাই স্বচ্ছ যেন মনে হয়, গা ঘেঁষে মাথা উঁচু করা বাড়িগুলোর প্রতিবিম্ব আর আকাশে ছুটে চলা মেঘ নেমে এসেছে জলে। সেখানে বেড়ানোর জন্য রয়েছে বিশেষ ধরনের নৌকা। সেসব নৌকায় করে আপনি যেতে পারবেন এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায়, তাও আবার দুদিকের বাড়িগুলোর মাঝখান দিয়ে। আমাদের এখানের রাস্তাগুলোর মতো ভেনিসে কোলাহল নেই, নেই যান্ত্রিক ব্যস্ততা। নেই গাড়ির বা হর্নের শব্দ পলিউশন, না আছে বাযু দূষণ। চারিদিকে শুধুই প্রশান্তি।
পর্যটকদের পদচারণায় ভেনিস মুখর থাকে বেশির ভাগ সময়। তবে বিশ্বব্যাপী যেভাবে জলবাযুর পরিবর্তন হচ্ছে এবং দূষণের মাত্রা বেড়ে চলেছে, তাতে সারা বিশ্ব আজ চিন্তিত। বর্তমানে অবশ্য ভেনিসের অবস্থা খুব একটা ভালো নয়। বিগত ৫০ বছরের মধ্যে বর্তমানে জলের উচ্চতা সর্বোচ্চ পর্যায় পৌঁছেছে। এর ফলে ২০১৯ সালে বন্যার জলে ডুবে গিয়েছিল ভেনিস শহরের পর্যটন অঞ্চলগুলো। ক্ষয়ক্ষতিও হয়েছিল অনেক।
লিসবন
পর্তুগাল-এর লিসবন শহরকে বলা হয় শিল্পী আর লেখকদের তীর্থভূমি। সারা বিশ্ব থেকে বিখ্যাত সব লেখক ও অভিনয় শিল্পীরা এসে জড়ো হন লিসবন-এ। প্রাকৃতিক ভাবে সৌন্দর্য মণ্ডিত এই শহর চোখ জুড়িয়ে দেয় পর্যটকদের। এ শহরের চারপাশ দেখলে আপনার মনে হতে পারে, এই নগরীকে হয়তো কোনও চিত্রশিল্পী মনের মাধুরী মিশিয়ে সযত্নে এঁকেছেন। এত সৌন্দর্যে ভরা শহর, পৃথিবীতে খুব কমই দেখতে পাওয়া যায়।
লিসবন-এর বাতাস যেমন দূষণহীন, তেমনি শহরটির নাতিশীতোষ্ণ আবহাওয়া আর নিরাপদ পরিবেশ শহরটিকে আরও আকর্ষণীয় করে। সেখানে রাস্তা দিয়ে হেঁটে গেলে আপনার দৃষ্টি কেড়ে নেবে রাস্তার দুধারের প্রাকৃতিক নিসর্গ। এই শহরের রূপলাবণ্য ও প্রাকৃতিক সৌন্দর্য দেখে অনেকেই মুগ্ধ হয়ে বলে থাকেন, লিসবন হল গুপ্ত রহস্যের শহর।
এ তো গেল কিছু রোমান্টিক শহরের কথা। এবার আপনাদের বিদেশের এমন কিছু জায়গার কথা জানাব, যা খুব অল্প খরচেই আপনারা ঘুরে আসতে পারেন। স্বল্প খরচে যদি বিদেশ ঘুরে আসা যায় তবে মন্দ কি! একটি বেড়াতে যাওয়ার ওয়েবসাইট-এ বিদেশের ১০টি গন্তব্য স্থানকে সবচেয়ে সস্তায় ভ্রমণের স্থান বলে জানিয়েছে।
১) মিশর-এর সাউর্দান নীল ভ্যালিকে বিশ্বের বৃহত্তম ভ্রমণ গাইড বই প্রকাশক লোনলি প্ল্যানেট, সস্তায় ভ্রমণের একটি স্থান বলে উল্লেখ করেছে। সেখানে গেলে বিশ্বের অনেক পুরোনো ইতিহাস আপনার জানা হয়ে যাবে। জ্ঞানের ভাণ্ডার অনেক বেশি উন্মোচিত হবে।
২) পোল্যান্ড-এর ওজ শহরটি হল সে দেশের তৃতীয় বৃহত্তম শহর। শহরটির খুব দ্রুত পরিবর্তন ঘটছে। বিভিন্ন শিল্প এলাকায় সংস্কারের পাশাপাশি নানা স্থাপত্য প্রকল্প নেওয়া হয়েছে এই শহরে। সেখানকার পুরোনো কলকারখানা থেকে বহু ইমারতকেই সাংস্কৃতিক কেন্দ্রে রূপান্তরিত করা হচ্ছে। থাকছে কেনাকাটা এবং বিনোদনের নানা ব্যবস্থা।
৩) যুক্তরাষ্ট্রের গ্রেট স্মোকি মাউন্টেনস ন্যাশানাল পার্কটি যদিও লোকালয় থেকে বহু দূরে, তবুও আজকাল এর কথা জানতে আর কারও বাকি নেই। প্রতিবছর এখন সেখানে ভ্রমণ করতে প্রায় ১ কোটি পর্যটক যান। শুনলে অনেকেই অবাক হবেন যে, এই পার্কে প্রবেশ করতে কোনও প্রবেশমূল্য নেই।
৪) মালদ্বীপের কথা আজকাল সবার মুখে মুখে। মালদ্বীপের অনেক দ্বীপেই থাকা, খাওয়ার খরচ বেশ সস্তা। বিশেষ করে যেসব দ্বীপে কম রিসর্ট আছে, সেখানে মূলত স্থানীয়রা তাদের গেস্টহাউস ভাড়া দেন এবং সেখানে আপনি মালদ্বীপের সাংস্কৃতিক পরিবেশের মধ্যে থাকতে পারবেন।
৫) যুক্তরাষ্ট্রের আর একটি সস্তায় থাকার শহর হল হিউস্টন। শহরটি খুবই সুন্দর এবং সেখানে আপনি ঘোরাঘুরি শুরু করতে পারেন এর জাদুঘর এলাকা থেকে। হাঁটা দূরত্বের মধ্যে সেখানে আছে ১৯টি জাদুঘর। এর মধ্যে ১০টিতে প্রবেশ করতে কোনও টিকিট লাগে না। অন্যগুলোতে বিশেষ কিছু দিনে বিনামূল্যে প্রবেশ করা যায়।
৬) আর্জেন্টিনা গত কয়েক বছর ধরে নানা রকম অফার দিয়ে আসছে পর্যটকদের আকর্ষণ করার জন্য। এখানেই শেষ নয়, তারা কয়েটি দেশের নাগরিকদের জন্য ভিসা ফি-তেও মূল্যছাড় দিয়ে থাকে।
৭) এবার আসি বাংলাদেশের কথায়। আমাদের পাশের দেশ এবং আমরা সবাই জানি সেখানে খুব সস্তায় থাকা এবং খাওয়া যায়। সেখানে এশিয়ার দীর্ঘতম এবং বিশ্বের তৃতীয় দীর্ঘতম সমুদ্র সৈকত কক্সবাজার আছে। আছে জাতীয় উদ্যান সুন্দরবন। এছাড়াও সেখানে ইউনেস্কো বিশ্ব ঐত্যিহ্যের তালিকাভুক্ত কয়েটি স্থান আছে, যেমন ষাট গম্বুজ মসজিদ, আছে পাহাড়পুরের বৌদ্ধ বিহার ইত্যাদি। দেশটি বৈচিত্র্যে ভরপুর। সেখানে সব দেশের পর্যটকদের জন্যই খুব সস্তায় ভ্রমণের ব্যবস্থা আছে।
৮) আলবেনিয়াতে আছে দারুণ কিছু সমুদ্র সৈকত, আছে স্বতন্ত্র ইতিহাস। সেখানকার ফল এবং খাবার পরিবেশনা শিল্পের পর্যায়ে পড়ে। এছাড়াও সেখানে বেশ কিছু প্রত্নতাত্ত্বিক স্থান আছে। আলবেনিয়া হল এমন একটি জায়গা যেখানে আপনি সুন্দর পাহাড়ি এলাকায় হাইকিং করতে পারবেন, ছোটো ছোটো গ্রামগুলোতে অনায়াসেই থাকতে পারবেন। সেখানকার সংস্কৃতির সাথে পরিচিত হতে পারবেন। সেখানে গেলে আলবেনিয়ার রাজধানী তিরানায় ঘুরে আসতে ভুলবেন না।
৯) আপনি যদি দক্ষিণ আমেরিকার সবচেয়ে সুন্দর জায়গায় কম সময়ে যেতে চান, তাহলে আপনাকে দেখতে যেতে হবে ইকুয়েডর। সেখানে সবুজে ঘেরা আন্দেস পর্বতমালা, বর্ণিল ঔপনিবেশিক শহর, অ্যামাজন অরণ্য এবং প্রশান্ত মহাসাগরের সৌন্দর্য আপনাকে মুগ্ধ করবেই। ছোট্ট এই দেশটিতে প্রচুর বাস চলাচল করে এবং ভাড়া খুবই কম।
১০) যদি খুবই অল্প খরচে ইউরোপের সবকিছু একই জায়গায় কেউ দেখতে চায়, তবে তাকে যেতে হবে স্লোভেনিয়া। যে-কোনও আলপাইন দেশগুলোর চেয়ে এই দেশটি অনেক সস্তা। সেখানকার সড়ক এবং রেলপথে যাত্রাও অনেক আরামদায়ক।
কী ভাবছেন? এবার দেশ ছেড়ে বিদেশেই পাড়ি জমাবেন! তাহলে আর দেরি নয়, রওনা হন বিদেশ ভ্রমণের উদ্দেশে।