খারদুংলা, নুব্রা ভ্যালি, প্যাংগন ও সাংলা ঘুরে আমরা পৌঁছোলাম লে-তে। আগের জায়গাগুলোর তুলনায় লে-র তাপমাত্রা একটু কম বলে মনে হয়েছে। লাদাখ ভ্রমণ অসম্পূর্ণ থেকে যায় লে-র কিছু অসামান্য জায়গা না দেখলে।
লে–আলচি–কার্গিল–জোজিলা পাস–সোনমার্গ–শ্রীনগর
সকালে কাচের জানলার পর্দা সরাতেই সূর্যালোকের মধুর আলিঙ্গন। মুখ ধুয়ে ঘরে আনালাম গরম চা। এরপর স্নান সেরে প্রাতরাশ। ব্রেকফাস্ট সেরে ট্রাভেলার গাড়ি করে বের হলাম।
প্রথমে আমরা চলেছি লে-কার্গিল রোড ধরে ৪ কিলোমিটার দূরে হল অফ ফেম-এ। টিকিট কেটে প্রবেশ করলাম ভারতীয় সেনাদের তৈরি এক অসাধারণ মিউজিয়ামে। ইন্দোপাক যুদ্ধে নিহত বীর সৈনিকদের স্মৃতির উদ্দেশ্যে নির্মিত এই মিউজিয়াম। এখানে প্রবেশ করলেই অনুভত হয় মাতৃভমির সম্মান রক্ষার্থে তাঁদের চরম আত্মত্যাগের অর্থ। এর উপরতলায় রয়েছে অপারেশন বিজয় গ্যালারি যেখানে দেখতে পাওয়া যাবে কার্গিল যুদ্ধে ব্যবহৃত বিভিন্ন অস্ত্রশস্ত্র, সঙ্গে ভারতীয় সেনাবাহিনীর দখল করা পাক অস্ত্র ও গোলা-বারুদ। অন্য বিভাগে প্রদর্শিত হচ্ছে সিয়াচেন অঞ্চলে ভারতীয় সেনাদের ব্যবহৃত পোশাক-পরিচ্ছদ, গ্লেসিয়ারে সেনা ছাউনি, বরফের উপর বাসস্থান ও প্রশিক্ষণের ছবি। মিউজিয়ামের সু্য়ভেনির শপ থেকে কিনতে পাওয়া যায় টি-শার্ট, টুপি, কফি-মগ, পশমিনা শাল ইত্যাদি। মিউজিয়াম খোলা থাকে সকাল ৯টা থেকে দুপুর ১টা এবং বেলা ২টা থেকে সন্ধে ৭টা পর্যন্ত।
আমাদের পরের গন্তব্য লে শহর থেকে ২৫ কিলোমিটার দূরত্বে পাথর সাহিব গুরুদোয়ারা। ন্যাশনাল হাইওয়ে ১ ধরে চলেছি। বেশ মসৃণ রাস্তা। বাঁ পাশে দূরে পাহাড়ের মাথায় বরফের কারুকার্য। ডান পাশের পাহাড়গুলো অপেক্ষাকৃত নীচু, বাদামি বর্ণের। পাথর সাহিব পেঁছে সেবকদের থেকে কমলা রঙের রুমাল নিয়ে মাথায় জড়িয়ে প্রবেশ করি গুরুদোয়ারায়। এখানে এক সাইনবোর্ডে লেখা নেপাল, সিকিম, তিব্বত, ইয়ারখন্ড ও লে হয়ে গুরু নানকজি এখানে এসে পেঁছেছিলেন ১৫১৭ সালে।
এই অঞ্চলেই এক পাহাড়ে বাস করত এক দুষ্ট দানব। সে স্থানীয় লোকজনদের আক্রমণ করে তাদের হত্যা করে, খেয়ে ফেলত। এই খবর শুনে নানকজি সেখানে পেঁছে নদীতীরে সাধনা করতে থাকেন। এতে স্থানীয় লোকরা খুশি এবং কিছুটা নিশ্চিন্ত হয়। কিন্তু দানব তাঁর আগমনে ক্রদ্ধ হয়ে নানকজিকে হত্যার পরিকল্পনা করে। একদিন গুরুজি যখন প্রার্থনায় নিবিষ্ট ছিলেন, ওই দানব তখন পাহাড়ের ওপর থেকে এক বিশাল প্রস্তরখণ্ড গড়িয়ে দেয়, তাঁকে হত্যার জন্য। গুরুজির শরীরের স্পর্শ পেতেই ওই প্রস্তরখণ্ড অবিশ্বাস্য ভাবে মোমের মতো নরম হয়ে যায় এবং তাঁর শরীরের পশ্চাত্ভাগ ওই পাথরের মধ্যে ধীরে ধীরে ঢুকে যায়।
এদিকে তাঁর প্রার্থনা চলতেই থাকে। গুরুজিকে মৃত ভেবে দানব তখন তাঁর কাছে নেমে আসে এবং তাঁকে সম্পূর্ণ সুস্থ দেখে আশ্চর্য হয়ে যায়। দানব তখন প্রচণ্ড রাগে পাথরে পদাঘাত করে এবং তার ডান পায়ে পাতা ঢুকে যায় ওই পাথরে। এই ঘটনায় দানব অনুতপ্ত হয় এবং বুঝতে পারে গুরুজি ঈশ্বরের আশীর্বাদধন্য এক পবিত্র মানুষ। সে তখনই নানকজির পায়ে পড়ে তার কৃতকর্মের জন্য ক্ষমা চায়। গুরুজি তখন দানবকে উপদেশ দেন, বাকি জীবনটা মানবসেবায় নিয়োজিত করতে। আজও পূণ্যার্থীরা গুরুদোয়ারায় ওই পবিত্র পাথর দেখে আনন্দ লাভ করেন।
এবার গন্তব্য ম্যাগনেটিক হিল। লে শহর থেকে প্রায় ৩০ কিমি দূরত্বে এর অবস্থান। গাড়ি যেখানে এসে থামল, পাহাড়ের পাদদেশ সেখান থেকে কয়েশ মিটার দূরে। বহু পর্যটক ও স্থানীয় বাসিন্দাদের মতে, এই পথটুকুতে মাধ্যাকর্ষণ নীতির বিপরীত ঘটনা ঘটতে দেখা যায়। এই পথে চলন্ত গাড়িকে নাকি পাহাড়ের তীব্র চৌম্বক শক্তি উপরের দিকে টেনে নেয়। গবেষকরা এই ঘটনার দুটি ব্যাখ্যা দিয়েছেন প্রথমটি হল, চৌম্বক শক্তি নীতি যার বলে, পাহাড় থেকে এক তীব্র চৌম্বক শক্তি বিকিরিত হতে থাকে। যা তার আওতার মধ্যে চলমান গাড়িকে নিজের দিকে উপরে টেনে নেয়। এমনকী অতীতে ভারতীয় বাযুসেনা পর্যন্ত তাদের বিমানপথ পরিবর্তন করতে বাধ্য হয়। দ্বিতীয়টি হল, দৃষ্টিভ্রম নীতি যা বলে, পাহাড়টি মোটেই কোনও চৌম্বক শক্তির উত্স নয়। বরং জায়গাটির অবস্থান ও চারিপাশের ঢাল সেখানে ওই পাহাড়ের অবস্থানের দৃষ্টিভ্রম ঘটায়। এগিয়ে চললাম পরবর্তী গন্তব্যের পথে।
দারুণ আবহাওয়া, পরিষ্কার নীল আকাশ। এগিয়ে চলেছি লে থেকে ৬৬ কিলোমিটার দূরে সিন্ধু নদের তীরে অবস্থিত আলচি গ্রামে। যা খালসি তহশিলের অন্তর্গত। আলচিতেই লাদাখের সবচেয়ে পুরোনো মনাস্ট্রিগুলির অবস্থান। বাঁ পাশে বয়ে চলেছে সিন্ধু নদ। রাস্তার ধারে উইলো ও পপলার প্ল্যান্টেশন। ডান পাশে সর্ষে খেত। বাঁ দিকে দূরে বরফের আল্পনায় সেজে থাকা পাহাড়। নিম্মু শহর পেরিয়েছি কিছুক্ষণ আগেই। এবার রাস্তার বাঁ পাশে অ্যাপ্রিকট প্ল্যান্টেশন। লাদাখ ভ্রমণেই প্রথমবার দেখছি এই গাছ।
দুপাশের রুক্ষ জমিতে ছোটো-বড়ো মাটি-রঙা ছোটো পাহাড়। তার পিছনে বরফ-মাখা উঁচু পাহাড় অসাধারণ সুন্দর লাগছে দেখতে। ডান দিকে সবুজ চারণভমি, সেখানে চরে বেড়াচ্ছে গরু ও ভেড়া। অবশেষে বেলা ১টা নাগাদ পৌঁছোলাম সাসপোল-এ। এই ছোট্ট শহরে হোটেল, গেস্ট হাউস সবই আছে। বাঁ পাশে বহমান সিন্ধুনদ যথেষ্ট বেগবান। পাহাড় ও তৃণভমির এক অসাধারণ ল্যান্ডস্কেপ দেখতে দেখতে, পেঁছে গেলাম আলচি। ছবির মতো সুন্দর গ্রাম।
আলচি মনাস্ট্রির আধ কিলোমিটার দূর থেকেই রাস্তার দুপাশে গাড়ির ভিড়। কিছুটা এগিয়ে পেঁছে গেলাম এক রেস্তোরাঁয়। এখানে লাঞ্চ সেরে মিনিট পাঁচেক হেঁটে পৌঁছে গেলাম আলচি মনাস্ট্রির টিকিট ঘরে। প্রবেশ মূল্য জনপ্রতি ১০০ টাকা। আলচি চোসখোর কমপ্লেক্স লাদাখের প্রাচীনতম মন্দির সমষ্টি। লোত্সাভা রিনচেন জাংপো দ্বারা একাদশ শতাব্দীতে নির্মিত মাটির প্রাচীরে ঘেরা ইটের ঘরগুলিকে বলা হয় লাখাং (মন্দির)। পাঁচটি বিভিন্ন মন্দিরের নাম ভৈরাকোনা, সামসেক, লোত্সাভা, জামিযাং এবং লাখাং সোমা। ভৈরাকোনা ও সামসেক লাখাং নির্মাণ করেন রিনচেন জাংপো।
রিনচেন জাংপো প্রশিক্ষিত হন কাশ্মীরে এবং আলচিতে ফেরার সময় সঙ্গে নিয়ে আসেন ৩২ জন কাশ্মীরি শিল্পীকে। রিনচেন জাংপো-র তত্ত্বাবধানে পশ্চিম হিমালয়ে নির্মিত ১০৮টি মন্দিরের মধ্যে, বেশ কয়েটি তৈরি হয় লাদাখের আলচি, মঙ্গু ও সুমদা-তে। তাদের মধ্যে আলচির মন্দিরগুলিই শ্রেষ্ঠরূপে সংরক্ষিত এবং বিশ্বব্যাপী প্রশংসিত। রিনচেন জাংপো দ্বারা প্রোথিত গাছটি আজও বিদ্যমান।
লাখাং-এর মধ্যস্থলে ভৈরাকোনা-র মূর্তি দাঁড়িয়ে আলচির সম্পদের প্রামাণ্য হিসেবে মন্দিরে রয়েছেন দেবদেবী, অপ্সরা এবং অন্যান্য স্বর্গীয় সত্ত্বা বিভিন্ন আকার, বর্ণ ও মূদ্রায়।
এবার পৌঁছোলাম সামসেক লাখাং। তিনতলার এই মন্দিরে রয়েছে অবলোকিতেশ্বর, মৈত্রেয় এবং মঞ্জুশ্রীর তিনটি বিশাল মূর্তি যথাক্রমে সমবেদনা, বন্ধুত্ব ও জ্ঞানকে প্রকাশ করে। মৈত্রেয় বুদ্ধের পরিচ্ছদে শাক্যমুনির জীবনকাহিনি আঁকা রয়েছে। অবলোকিতেশ্বর-এর পোশাক, রাজপ্রাসাদ, মন্দির ও জীবনের নানা ঘটনা দর্শন করায়। লোত্সাভা মন্দির রিনচেন জাংপো-র প্রতি উত্সর্গীকৃত, যিনি সংস্কৃত ভাষায় লেখা বৌদ্ধতত্ত্বকে তিব্বতি ভাষায় অনুবাদ করেন। এখানে অবলোকিতেশ্বর, শাক্যমুনি এবং রিনচেন জাংপো-র মূর্তি রয়েছে। লাখাং সোমা-র অর্থ নতুন মন্দির। কাছেই রয়েছে টিবেটান মার্কেট।
এবার ফিরে চলেছি সিন্ধু ও জানস্কা নদীর সঙ্গম দেখতে। বাসগো পেরিয়ে নিম্মু, এখানে মিলিটারি পুলিশের বিরাট স্টেশন রয়েছে। পৌঁছে গেলাম সঙ্গম প্যাডলিং স্টেশন, লে শহর থেকে ৩৮ কিলোমিটার। মিলন ঘটেছে দুই নদীর। পায়ে পায়ে এগিয়ে গেলাম সঙ্গমস্থলের কাছে। সিন্ধু নদের নীল জল আর জানস্কা নদীর ঘোলা জলকে পরিষ্কার দেখতে পাচ্ছি। পিছনে পশ্চিম হিমালয়ে উপস্থিতি। এক স্বর্গীয় দৃশ্যের সাক্ষী হয়ে থাকলাম। জানস্কা সিন্ধুরই এক উপনদী।
আজ লে-র সাইট সিযিং-এর ব্যবস্থা। প্রাতরাশ সেরে হোটেল থেকে যাত্রা শুরু করে মিনিট কুড়ি পরে এসে পৌছোলাম শ্যে-তে। রাস্তার দুই পাশে শোভা পাচ্ছে উইলো ও পপলার গাছের সারি। এখানেই রয়েছে থ্রি ইডিয়টস খ্যাত রাঞ্চোস। বেশ প্রশস্ত জায়গায় রয়েে ভরুক হোয়াইট লোটাস স্কুল। রয়েছে রাঞ্চোস কাফে, ইডিওটিক স্কুল ইত্যাদি। পরবর্তী গন্তব্য হেমিস গুম্ফা, লে থেকে ৪৫ কিলোমিটার দূরত্বে অবস্থান। কিছুক্ষণের মধ্যেই পেরিয়ে গেলাম থিকসে। আমরা চলেছি ন্যাশনাল হাইওয়ে৩ ধরে। ১০,৫৮০ ফুট উচ্চতায় অবস্থিত কারু এসে পৌঁছোলাম। এখানেও রয়েছে একটি মিলিটারি স্টেশন। ডান দিকে মানালি যাবার পথ। বেলা ১২টা নাগাদ এসে পেঁছোলাম হেমিস গুম্ফায়।
লাদাখে আসা পর্যটকদের কাছে হেমিস মনাস্ট্রির আকর্ষণ অতীব। সিন্ধু নদের পশ্চিম তীরে পাহাড়ের কোলে অবস্থান এই মনাস্ট্রির। দুকপা বৌদ্ধগোষ্ঠীর ওই মনাস্ট্রিতে রয়েছে বেশ কিছু আকর্ষণীয় থাঙ্কা যা প্রদর্শিত হয় বিখ্যাত হেমিস উত্সবে। ইতিহাস জানায়, হেমিস মনাস্ট্রির অস্তিত্ব ছিল একাদশ শতাব্দীর আগে থেকেই। নারোপা, যিনি যোগী তিলোপা-র শিষ্য এবং অনুবাদক মাপার গুরু, এই মনাস্ট্রির সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। নারোপাকে কাগু গোষ্ঠীর প্রতিষ্ঠাতা মানা হয়। তাই হেমিস মনাস্ট্রিকে কাগু বৌদ্ধগোষ্ঠীর প্রধান পীঠস্থান বলে স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছে।
অনেকগুলো সিঁড়ি ভেঙে পৌঁছোলাম হেমিস মনাস্ট্রির প্রবেশদ্বারে। মন্দিরের ভিতরে ঢুকে দেখলাম তামা দিয়ে বাঁধানো বুদ্ধদেবের ২৮ ফুট উঁচু এক সুন্দর মূর্তি। সঙ্গে রয়েছে সোনা ও রুপো দিয়ে তৈরি কয়েটি স্তূপ। এবার গেলাম মনাস্ট্রি চত্বরে অবস্থিত মিউজিয়ামে। সেখানে দেখলাম বেশ কয়েটি প্রাচীন ধর্মীয় ও ঐতিহাসিক চিত্র (থাঙ্কা), ১৭-১৯ শতকে নির্মিত অস্ত্রশস্ত্র, পাথর ও পিতলের বাসনপত্র, রুপোর তৈরি শিঙা। দেখলাম, বিশেষ চারটি মুখোশ যেগুলো চার দরজা (দিক)-র অভিভাবক এবং আরও চারটি মুখোশ যেগুলোর মাহাত্ম কৃষিজমির রক্ষক হিসেবে। জানলাম, হেমিস উত্সবে দুদিন ধরে অসাধারণ চাম নৃত্য বা মুখোশ নাচ অনুষ্ঠিত হয়।
ফিরে চললাম থিকসের পথে। এখানে লাঞ্চ সেরে চললাম থিকসে গুম্ফা দেখতে। গেলুগ বৌদ্ধগোষ্ঠীর অধীনে এই গুম্ফা। লে শহরের ১৯ কিলোমিটার পূর্বে এক পাহাড়ের মাথায় অবস্থিত এই মনাস্ট্রি। লাদাখের মধ্যভাগে অবস্থিত বৃহত্তম এই গুম্ফার সঙ্গে তিব্বতের লাসা শহরের পটোলা প্রাসাদ-এর সাদৃশ্য লক্ষ্য করা যায়। প্রায় ১১,৮০০ ফুট উচ্চতায় অবস্থিত বারোতলা বিশিষ্ট এই গুম্ফায় রয়েছে বৌদ্ধ শিল্পকলার বহু সম্ভার। স্তূপ, মূর্তি, থাঙ্কা, দেয়াল চিত্র এবং বিভিন্ন প্রকার তরবারি। তবে চোখ ফেরানো যায় না ৪৯ ফুট উঁচু মৈত্রেয় বুদ্ধের অসাধারণ মূর্তি থেকে, ১৯৭০ সালে যার উদ্ঘাটন করেন দলাই লামা।
গুম্ফার দুইতলা জুড়ে থাকা ওই বুদ্ধমূর্তি লাদাখে বৃহত্তম। লাল, গেরুয়া ও সাদা রঙে সজ্জিত মনাস্ট্রিতে ৬০ জন লামা থাকতে পারেন। সঙ্গে আছে বৌদ্ধনারীদের থাকার জন্য পৃথক নারীমঠ। প্রধান প্রার্থনা কক্ষের দেয়ালে আঁকা রয়েছে তিব্বতীয় ক্যালেন্ডার -সহ জীবনচক্র। অ্যাসেম্বলি হলে দেখা যাবে সহস্র হাত বিশিষ্ট অবলোকিতেশ্বর, সঙ্গে পদ্মসম্ভব। তারাদেবী-কে উত্সর্গ করা মন্দিরে রয়েছে দেবীর ২১টি প্রতিমা। গুরুত্ব ও ক্ষমতার বিচারে হেমিস গুম্ফার পরেই স্থান থিকসে গুম্ফার। ডিস্কিট, স্পিটুক, লিকির ও স্টক-এ অবস্থিত দশটি গুম্ফা রয়েছে থিকসে গুম্ফার অধীনে।
এবার দিনের শেষ গন্তব্য শ্যে প্যালেস। ছোটো এক টিলার উপর অবস্থিত এই প্রাসাদে পৌঁছোতে ভাঙতে হবে কিছুটা চড়াই। লে থেকে ১৫ কিলোমিটার দূরে লে-মানালি রোডের পাশেই শ্যে পাহাড়ের উপর অবস্থিত, তিনতলা বিশিষ্ট ওই শ্যে প্রাসাদের এক জটিল কাঠামো। ১৬৫৫ সালে লাদাখের রাজা দেলদান নামগিয়াল দ্বারা নির্মিত প্রাসাদের অনেকটাই এখন ধ্বংসের মুখে। এক সময় শ্যে প্রাসাদ ছিল লাদাখের রাজাদের গ্রীষ্মকালীন আবাস। একই সময়ে প্যালেস কমপ্লেক্স-এর মধ্যেই তৈরি হয় শ্যে মনাস্ট্রি। রাজা দেলদান পিতা সেঙ্গে নামগিয়াল-এর স্মৃতির উদ্দেশ্যে ওই মনাস্ট্রি তৈরি করান। তামায় তৈরি ও সোনায় বাঁধানো ৩৯ ফুট উঁচু শাক্যমুনি বুদ্ধের বসে থাকা স্ট্যাচুর কারণে এই মনাস্ট্রি বিখ্যাত। সমগ্র লাদাখে ওই স্ট্যাচুই দ্বিতীয় বৃহত্তম। হোটেলে ফিরলাম বিকেল সাড়ে ৫টায়।
সকাল থেকেই আকাশ মেঘলা। লাদাখ বেড়ানোর আজই শেষ দিন। পরদিন সকালের ফ্লাইটে দিল্লি এবং সন্ধের ফ্লাইটে কলকাতায় ফেরা। তাই মনটা একটু ভারী। ব্রেকফাস্ট সেরে লে-তে শেষ দিনের সাইট সিযিং শুরু হল। প্রথম গন্তব্য ১৩ কিলোমিটার দূরে, ১১৮৪১ ফুট উচ্চতায়, স্টক ভিলেজ-এ অবস্থিত শান্তি স্তূপ। প্রায় ২০০ সিঁড়ি ভেঙে উঠে এলাম স্তূপে। লে জেলার চানপা-তে এক টিলার উপর অবস্থিত ওই গম্বুজাকৃতি স্তূপ (চোর্তেন)-এর রং সাদা। শান্তি স্তূপ তৈরি হয় জাপানি ও লাদাখি বৌদ্ধদের প্রচেষ্টায়।
শান্তি স্তূপ-এর নীচে রাখা আছে বুদ্ধদেবের কিছু স্মৃতিচিহ্ন, যা দলাই লামা দ্বারা অনুমোদিত। এই স্তূপ লাদাখের পর্যটকদের কাছে এক অতি প্রিয় স্থান যেখান থেকে চারপাশের প্রাকৃতিক দৃশ্য দেখা যায়। এই স্তূপের গঠন দুই স্তরে প্রথম স্তরে রয়েছে ধর্মচক্র, যার দুইপাশে দুই হরিণ। মাঝের প্ল্যাটফর্মে বুদ্ধের সোনালি চিত্র। দ্বিতীয় স্তরে বুদ্ধদেবের জন্ম, মৃতু্য় (মহানির্বাণ) এবং ধ্যানমগ্ন অবস্থায় অশুভ শক্তির দমন চিত্রিত হয়েে। শান্তি স্তূপ তৈরি হয়েছিল বিশ্বশান্তি প্রসারের উদ্দেশ্যে এবং বৌদ্ধধর্মের ২৫০০ বছর পূর্তি উদ্যাপনের জন্য। আজ এই স্তূপকে জাপান ও লাদাখের মৈত্রির স্মারক মানা হয়।
আমাদের পরের গন্তব্য শঙ্কর গুম্ফা। ১৫ মিনিটের মধ্যে পৌঁছে গেলাম এই মনাস্ট্রিতে। এই প্রতিষ্ঠান স্পিতুক মনাস্ট্রির ভারপ্রাপ্ত প্রধান কুশক বকুলা-র বাসস্থান। এই গুম্ফা গাছগাছালির মাঝে অবস্থিত কয়েকটি আধুনিক, আকর্ষণীয় ভবনের সমষ্টি যেখানে ২০ জন সন্ন্যাসী থাকতে পারেন। এই জায়গায় বৈদ্যুতিক আলো থাকার জন্য সন্ধেবেলাতেও দর্শন করা যায়। কয়েটি সিঁড়ি বেয়ে উঠে এলাম মনাস্ট্রিতে। দরজা দিয়ে প্রবেশ করে সোজা চলে এলাম দু খাং বা অ্যাসেম্বলি হল-এ। সেখানে দরজার ডান পাশে তিনটি সবুজ ড্রাম। হলের দেয়াল ও প্রবেশদ্বারে উজ্জ্বল রং। কাঠের সিঁড়ি দিয়ে উপরতলায় গেলে দেখা যাবে দুকার লাকাং বা মূর্তির বাসস্থান। সেখানে রয়েে অবলোকিতেশ্বর-এর মুর্তি। যার সহস্র মাথা এবং অস্ত্রসহ সহস্রটি হাত। ঘরের দেয়াল চিত্রিত হয়েছে তিব্বতি ক্যালেন্ডার, মান্ডালা এবং সন্ন্যাসীদের জন্য পালনীয় নিয়মাবলী। সিঁড়ি দিয়ে আরও উপরে উঠলে মঠাধ্যক্ষের ঘর, অতিথি ভবন এবং লাইব্রেরি। ভালো লাগল মনাস্ট্রির শান্ত পরিবেশ।
শঙ্কর গুম্ফা দর্শন শেষে গাড়িতে করে চললাম আমাদের লাদাখ ভ্রমণের শেষ গন্তব্য লে প্যালেস-এর দিকে। হালকা চড়াই পথে কিছুদূর হেঁটে প্রবেশমূল্য দিয়ে টিকিট নিলাম। প্যালেসে প্রবেশ করে বিভিন্ন তলা পর্যবেক্ষণ করে বুঝলাম, মূল প্রাসাদের কাষ্ঠ-নির্মিত কাঠামো অপরিবর্তিত রেখে তাকে মজবুত করা হয়েছে সিমেন্ট সহযোগে। লাসায় অবস্থিত পটোলা প্যালেস-এর, অগ্রদূত লে প্যালেস স্থাপিত হয় ১৬ শতক (১৫৭০-১৬৪২)-এ রাজা সেঙ্গে নামগিয়াল দ্বারা।
নতলা বিশিষ্ট এই প্যালেসের উপরের কয়েটি তলায় বাস করতেন রাজপরিবার। নীচের তলাগুলো ব্যবহৃত হতো আস্তাবল ও ভাঁড়ার ঘর হিসেবে। প্রাসাদের ছাদ থেকে লে শহর এবং জানস্কার পর্বতমালায় অবস্থিত স্টক কাংরি পাহাড়ের সুন্দর রূপ প্রত্যক্ষ করা যায়। প্রাসাদের পিছনে উত্তর দিকে অসাধারণ লাদাখ পর্বতমালা।
লে প্যালেস পরিত্যক্ত হয় ১৯ শতকের মধ্যভাগে যখন জম্মুর ডোগরা বাহিনী লাদাখ দখল করে রাজপরিবারকে বাধ্য করে স্টক প্যালেস-এ চলে যেতে। এএসআই লে প্যালেস-এর প্রভত সংস্কার সাধন করেছে। প্যালেস মিউজিয়ামে রয়েে বহু জহরত, গহনা, রাজপোশাক ও মুকুট। চিনা থাংকা-র এক অসাধারণ সংগ্রহ, যেগুলি ৪৫০ বছরেরও বেশি পুরোনো এবং আজও সমান উজ্জ্বল। প্যালেসের নীচে রয়েে নামগুয়াল স্তূপ, চান্দাজিক গুম্ফা এবং চাম্বা লাখতাং। প্রায় ঘন্টা খানেক সময় লাগল ঘুরে ঘুরে ওই প্রাসাদ দেখতে। দেখা শেষে ফিরে চললাম হোটেলে। এবার লাঞ্চ সেরে বিশ্রাম।
এয়ারপোর্টে এসে শুনলাম, খারাপ আবহাওয়া এবং দুর্বল দৃশ্যমানতার জন্য একের পর এক ফ্লাইট বাতিল হচ্ছে। ব্যস, আমরা হতবাক! লাগেজ নিয়ে বাইরে চলে আসতে হল। আমরা আলোচনা করে ঠিক করলাম, যে-কোনও উপায়ে শ্রীনগর চলে যেতে হবে। জম্মুগামী একটা টেম্পো ট্রাভেলারে ব্যবস্থা হল।
শ্রীনগর যাবার রাস্তা বেশ খারাপ। বাঁ পাশে বয়ে চলেছে উজ্জ্বল সিন্ধু নদ। তার অববাহিকায় চরে বেড়াচ্ছে বহু ঘোড়া আর ভেড়া! তার পিছনে বরফ ঢাকা পাহাড়। ভাবছিলাম, সুবিশাল সিন্ধু উপত্যকার অনেকটাই গত কয়েদিনে ঘুরে বেড়িয়েছি।
শ্রীনগর পেঁছোনোর কিছু আগে আমাদের গাড়িতে পুলিশের তল্লাশি হল। ড্রাইভারের সঙ্গে নীচু স্বরে সামান্য কথাবার্তার পর পুলিশ যেতে দিল আমাদের গাড়িকে। শ্রীনগরে পৌঁছোলাম রাত সাড়ে ১০টায়। হোটেলে ঢুকে হাত-মুখ ধুয়ে ডিনার সেরে ঘরে গেলাম।
পরদিন দুপুর ১২টায় পৌঁছে গেলাম এয়ারপোর্টে। শ্রীনগর বিমানবন্দরের সরকারি নাম শেখ উল-আলম ইন্টারন্যাশনাল এয়ারপোর্ট। প্রায় ৫,৪২৯ ফুট উচ্চতায় অবস্থিত ওই বিমানবন্দর ইন্ডিয়ান এয়ার ফোর্স ও এয়ারপোর্ট অথরিটি অফ ইণ্ডিয়া-র অধীনে। যথাসময়ে বিমানে উঠে বসলাম। উড়ান ছাড়তেই মনটা কেমন যেন উদাস হয়ে গেল! স্বপ্নের দেশ-কে যে সত্যিই পিছনে ফেলে এলাম।