কয়েকদিন আগেই সোশ্যাল মিডিয়ায় একটি পোস্ট খুব ভাইরাল হয়েছিল। নভি মুম্বই-এর একটি ক্রেশে ১০ মাসের একটি বাচ্চাকে মারা এবং তুলে আছড়ে ফেলার ঘটনা জনসাধারণের সামনে চলে আসে। পুলিশ এবং বাচ্চাটির অভিভাবকেরা, ক্রেশের সিসি টিভির ফুটেজে পুরো ঘটনাটা দেখে, বাকরুদ্ধ হয়ে পড়েন। ক্যামেরার পর্দায় উঠে এসেছিল ডে-কেয়ার সেন্টারের আয়া বাচ্চাটিকে লাথি, থাপ্পড়ই শুধু মারছে না, তুলে সোফায় ও মাটিতে আছড়ে ফেলছে। এই ঘটনা প্রথম নয়, আগে এবং পরেও এধরনের ঘটনা ঘটেছে এবং ঘটছে দেশ জুড়ে। এর আগেও দিল্লি পুলিশ, ক্রেশ-এর মালিক ৭০ বছরের এক ব্যক্তিকে গ্রেপ্তার করে কারণ তার উপর অভিযোগ ছিল যে সে ওখানকার একটি ৫ বছরের বাচ্চার সঙ্গে অভব্য আচরণ করেছে।

প্রতিদিনই এধরনের ঘটনা ঘটছে, যেখানে ডে-কেয়ার সেন্টারগুলিতে বাচ্চারা মানসিক এবং শারীরিক ভাবে নির্যাতিত হচ্ছে।

সামাজিক গঠন রোজই বদলাচ্ছে। আগে একান্নবর্তী পরিবারে বাচ্চাকে দেখার জন্য দাদু, ঠাকুমা থেকে শুরু করে পরিবারের অন্যান্য সদস্যরা থাকতেন। সকলের মধ্যে থেকে দায়িত্বটা ভাগাভাগি হয়ে যাওয়ায় মায়ের ওপর চাপও যেমন কম পড়ত, তেমনি বাচ্চা মানুষ করতেও আলাদা করে কাউকে বেগ পেতে হতো না। কিন্তু সামাজিক পরিবর্তনের কারণে এখন পরিবারের পরিধি সীমিত হয়েছে। স্বামী-স্ত্রী-সন্তান– এই নিয়েই সকলের সংসার। তার উপর আছে স্বামী ও স্ত্রী উভয়েরই কর্মব্যস্ততা, নিজের নিজের কেরিয়ার। কেরিয়ারের কোনওরকম ক্ষতি এই প্রজন্ম মেনে নিতে পারে না, তাই শিশুর জন্মের পর মায়েদের ছুটি বরাদ্দ হয় গড়ে ২ মাস থেকে ৬ মাস। এর মধ্যেই সন্তানকে যতটা সময় দেওয়া যায় ততটা মায়েরা দিতে প্রস্তুত। কাজে যোগ দেওয়ার আগে তাই খোঁজ পড়ে সন্তানের জন্য সুরক্ষিত কোনও স্থানের যেখানে কোলের সন্তানকে নিশ্চিন্তে রেখে মায়েরা ফিরে যেতে পারে নিজেদের কর্মস্থলে। আর এর জন্য ক্রেশ বা ডে-কেয়ার সেন্টারগুলি ছাড়া ভালো অপশন আর কী হতে পারে? এখানে খাওয়া-দাওয়া থেকে শুরু করে খেলাধুলো, আরাম, নানারকম অ্যাক্টিভিটি শেখাবার ভালো ব্যবস্থা থাকে। অফিস যাওয়ার আগে মা-বাবারা বাচ্চাকে রেখে যান আর অফিস-ফেরতা বাচ্চাকে ক্রেশ থেকে বাড়ি নিয়ে আসেন। এটাই প্রায় রোজনামচায় দাঁড়িয়ে যায় অভিভাবকদের। ফেরার সময় কোনও কারণবশত ক্রেশে পৌঁছোতে লেট হয়ে গেলে আগেভাগে সেটাও জানিয়ে দিতে হয় ক্রেশের সঞ্চালককে।

তবে বেশিরভাগ মা-বাবাই বাচ্চাকে ডে-কেয়ার থেকে তুলে বাড়িতে নিয়ে যাওয়ার পর বাচ্চার সঙ্গে সময় কাটাবার পরিবর্তে নিজেদের কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়েন। কোনও ছুটির দিনেই তারা সময় পান বাচ্চার সঙ্গে কোয়ালিটি টাইম কাটাবার।

কিন্তু যে-সমস্ত মা-বাবাকে সন্তানকে সারাদিনের জন্য ডে-কেয়ারের ভরসায় ছাড়তে হয়, তাদের উচিত বাচ্চাকে নিয়মিত মনিটরিং করা। প্রথমত পুরোপুরি ডে-কেয়ারে পাঠিয়ে নিশ্চিন্ত হওয়া উচিত নয় কারণ তাতে বাচ্চার সঙ্গে মা-বাবার বন্ডিং ঠিকমতো তৈরি হয় না। বাচ্চারা এতে কিছুই মা-বাবার সঙ্গে শেয়ার করতে চায় না বা পারে না। ফলে নিজের অভিব্যক্তি প্রকাশ করতে না পেরে একাকী হয়ে পড়ে। এমনকী অনেক সময় ডে-কেয়ার সেন্টারে কোনওভাবে বাচ্চাদের উপর অত্যাচার করা হলেও শিশুমন বুঝে উঠতে পারে না যে তারা অত্যাচারিত হচ্ছে।

নিয়ম অনুযায়ী ক্রেশগুলির উচিত, ভালো ভাবে বাচ্চাদের খেয়াল রাখা, ভালো খাবার দেওয়া, নতুন নতুন অ্যাকটিভিটি শেখানো। এগুলো জানা সত্ত্বেও বাচ্চার প্রতি ওখানে কীরকম ব্যবহার করা হচ্ছে সেটা মনিটর করা মা-বাবার একান্ত কর্তব্য। কারণ বাচ্চারা হয়তো অনেকসময় কিছু বুঝিয়ে বলতে পারে না শুধু কাঁদতে থাকে আর মা-বাবারা ভেবে নেন তাদের সন্তান ক্রেশে থাকতে চাইছে না। আসল কারণ অনুসন্ধান করতে অনেকেই আগ্রহ বোধ করেন না।

মা-বাবার রোজকার দায়িত্ব

১)  অফিস থেকে বাড়ি ফেরার পর যতই ক্লান্ত বা ব্যস্ত থাকুন, বাচ্চার সঙ্গে সময় কাটানো খুব জরুরি। কথায় কথায় বাচ্চার কাছে জানতে চান সারাদিন ক্রেশে সে কী করেছে, কী খেয়েছে, নতুন কী শিখেছে? ওখানে সে কতটা মজা করে? ওখানকার সবাই তার সঙ্গে কীরকম ব্যবহার করে? বাচ্চা যদি পরিষ্কার করে বুঝিয়ে বলতে না-ও পারে বা বাচ্চার কোনও কথা একটু অস্বাভাবিক মনে হলে এড়িয়ে যাবেন না, তৎক্ষণাৎ জানার চেষ্টা করতে থাকুন, বাচ্চা কেন এরকম বলল?

২)  ক্রেশ থেকে ফেরার পর, পরীক্ষা করে নেওয়া উচিত বাচ্চার শরীরে কোনওরকম দাগ রয়েছে কিনা? যদি থাকে তাহলে জিজ্ঞেস করা দরকার দাগ কীভাবে হল। ন্যাপি বদলানো হয় কিনা সেটাও চেক করে নেওয়া উচিত। এছাড়াও বাড়ি থেকে কোনও খাবার দেওয়া হলে, ক্রেশে সেটা বাচ্চা খেয়েছে কিনা সেটাও বাচ্চার কাছে জেনে নেওয়াটা দরকার।

ক্রেশ কীভাবে বাছবেন?

১)  ইলেকট্রিসিটি এবং জলের কীরকম ব্যবস্থা, বিছানা পরিষ্কার কিনা, বাচ্চাদের খেলার কী ব্যবস্থা এবং কীধরনের খেলনা দেওয়া হয় বাচ্চাদের সেটা আগে দেখে নেওয়া খুব দরকার।

২)  ক্রেশ সবসময় খোলামেলা, আলো হাওয়ায় পরিপূর্ণ থাকা কাম্য।

৩)  ক্রেশে যারা বাচ্চাদের দেখাশোনা করে তারা কীরকম সেটা অভিভাবকদের দেখে নেওয়া উচিত। তারা বাচ্চাদের সঙ্গে কীরকম ব্যবহার করছে সেটা আগে জানা খুব দরকার।

৪)  যে-ক্রেশে বাচ্চাকে দিতে চান, সেখানে যেসব বাচ্চারা আগে থেকে আসছে তাদের মা-বাবার কাছে জানতে চান যে ক্রেশটি কেমন? তারা সন্তুষ্ট কিনা এবং কতদিন ধরে তাদের বাচ্চারা ওই ক্রেশে আসছে ইত্যাদি তথ্য সংগ্রহ করুন।

৫)  সস্তা এবং বাড়ির কাছে বলে ক্রেশ বাছবেন না। মনে রাখবেন আপনার বাচ্চাকে রোজ বেশ কয়েক ঘন্টা ওখানে থাকতে হবে সুতরাং পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতা দেখে তবেই ক্রেশ বাছুন।

 

আরো গল্প পড়তে ক্লিক করুন...