মেঘের দেশের রাজধানী শিলং, তার মাথায় মেঘালয়ের রানির শিরোপা। মেঘালয়ের আদি বাসিন্দারা হল খাসি, গারো ও জয়ন্তী এই তিনটি উপজাতি। ১৯৭১ সাল। অসম রাজ্যের খাসি, গারো ও জয়ন্তীয়া পাহাড়কে নিয়ে একটি পৃথক রাজ্য গঠনের প্রক্রিয়া শেষের মুখে। এই সময় প্রশ্ন উঠল নতুন রাজ্যের নামকরণ নিয়ে। এই জন্য গঠিত হল একটি কমিটি। তার অন্যতম সদস্য ছিলেন স্বনামধন্য ভাষাবিদ ডঃ সুনীতি কুমার চট্টোপাধ্যায়। অনেক আলোচনার পর স্থির হল রাজ্যের নাম মেঘালয়। ১৯৭২ সালের ২১ জানুয়ারি, মেঘালয় ভারতের একুশতম পূর্ণ রাজ্যরূপে আত্মপ্রকাশ করল।
মেঘালয় বলতে শুধু শিলং নয়। উদ্দেশ্য শিলং-কে কেন্দ্রে রেখে, মাওলিনং, নারটিয়াং, চেরাপুঞ্জি প্রভৃতি স্থান দেখে নেওয়া। ফেরার পথে উমিয়াম লেক রিসর্টে এক রাত কাটিয়ে গুয়াহাটি ছুঁয়ে ফিরে যাব কলকাতার উদ্দেশে। সময় বাঁচানোর জন্য কলকাতা থেকে গুয়াহাটি আসার ব্যবস্থা হয়েছে আকাশপথে।
গুয়াহাটি বিমানবন্দরে বেরিয়ে এসে দেখি যে সেখানে শিলং যাওয়ার গাড়ির বড়োই আকাল। একটি দুটি গাড়ি যেতে রাজি হলেও সেগুলি সব ছোটো গাড়ি আর ভাড়াও চাইছে অনেক বেশি। তাই স্থির করলাম মালপত্র নিয়ে চলে যাব গুয়াহাটি রেলস্টেশনের কাছে পল্টনবাজারে। সেখানে শিলংয়ের গাড়ি পাওয়ার সম্ভাবনা অনেক বেশি। দুটি ছোটো গাড়িতে মালপত্র নিয়ে চলে গেলাম পল্টনবাজার। গাড়ির স্ট্যান্ডের বাইরে ‘শিলং-শিলং’ বলে লোক ডাকছে। শুধু শিলং ড্রপ নয় পুরো সফরের জন্য টাটা সুমো সার্ভিসের সঙ্গে গাড়ির চুক্তি করে নিলাম। ভাড়াও বেশ ন্যায্য বলে মনে হল। গাড়ি শিলংয়ের হোটেলে নামিয়ে দিয়ে চলে যাবে। পরদিন থেকে ভ্রমণ শুরু।
গুয়াহাটি থেকে সড়কপথে ১০৩ কিমি দূরবর্তী শিলং পৌঁছোতে সময় লাগবে তিন থেকে চার ঘন্টা। গুয়াহাটি থেকে শিলং যাত্রার পথে প্রথম গুরুত্বপূর্ণ স্থান হল জোড়বাট– গুয়াহাটি থেকে ১৬ কিমি দূরে। এখানে পথ দুভাগ হয়ে গেছে। তেজপুর, কাজিরাঙা, জোরহাট এবং ডিব্রুগড় যেতে হলে বাঁদিকের পথে যেতে হবে আর শিলংয়ের পথ সোজা। জোড়বাট থেকে শিলংয়ের দূরত্ব ৮৩ কিমি। জোড়বাটকে পিছনে ফেলে রেখে, হালকা চড়াই পথ ধরে শিলংয়ের দিকে এগিয়ে যাওয়ার পথে একে একে পেরিয়ে এলাম বেশ কয়েকটি ছোটো বড়ো জনপদ– বার্নিহাট, উমলিং, নংপো আর উমসনিং। এর পরেই পথের ডানদিকে পড়ল অপরূপ উমিয়াম লেক যা স্থানীয়দের কাছে বড়াপানি নামে পরিচিত। রাস্তা থেকে একটি ভিউপয়েন্ট চোখে পড়ল। এই কৃত্রিম কিন্তু অপূর্ব লেকটি দেখতে দেখতে আরও এগিয়ে যাই। উমিয়াম লেক থেকে মওলাই হয়ে শিলংয়ের দূরত্ব প্রায় ১৬ কিমি।
শহরে ঢোকার মুখে একটু যানজট কাটিয়ে সন্ধের আগেই পৌঁছে গেলাম আমাদের আগামী চারদিনের ঠিকানা অর্কিড হোটেলে। হোটেলটি সরকারি, দাম একটু বেশি কিন্তু ঘরগুলি বড়ো, অন্যান্য ব্যবস্থাও বেশ ভালো। হোটেলটি পোলো রোডে একটু নিরিবিলিতে। বাজার দোকান সবই পুলিশ বাজারের দিকে, এই জায়গাটি পুলিশবাজার থেকে একটু দূরে। গাড়ি ছেড়ে দেওয়া হল, শর্তানুযায়ী পরদিন সকাল সাড়ে আটটায় হোটেলে রিপোর্ট করবে। আমাদের গন্তব্য মাওলিনং ও ডাওকি।
ভোরে উঠে স্নান, ব্রেকফাস্ট সারা হয়ে গেল সকাল ৮টার মধ্যে। ব্রেকফাস্টে টোস্ট, মাখন-জ্যাম, ওমলেট আর কলকাতা থেকে আনা মিষ্টি, চা-কফি তো আছেই। সকালে হালকা ঠান্ডা, একটা হাফ হাতা সোয়েটার পরলেই চলে যায় এই অক্টোবরের সকালে। গাড়িও এসে গেল সময়মতো। আমরা ন’টার আগেই মাওলিনংয়ের উদ্দেশ্যে যাত্রা শুরু করলাম। শিলং থেকে মাওলিনং ৯০ কিমি। ইতিমধ্যে খেয়াল হল আকাশ মেঘে ঢেকে গেছে, ঠান্ডা বাতাস দিতে শুরু করেছে। মেঘলা থাকুক অসুবিধা নেই কিন্তু বৃষ্টি হলেই বিপদ। মাওলিনং একটি ছোট্ট খ্রিস্টান আদিবাসী অধ্যুষিত গ্রাম যা সম্প্রতি এশিয়ার সবচেয়ে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন গ্রাম হিসাবে স্বীকৃত হয়েছে। শিলং থেকে মেঘালয় পর্যটনের বাস সারাদিনের প্রোগ্রামে এই গ্রাম দেখিয়ে আনে তবে নিজস্ব গাড়ি নিয়ে এলে অনেক স্বাধীনভাবে ঘোরাফেরা করা যায়।
শিলং থেকে চেরাপুঞ্জির পথে আমরা চলেছি। খানিক দূর যেতেই সাইনবোর্ডে এলিফ্যান্ট ফলসের দিকনির্দেশিকা নজরে এল। মূল রাস্তা থেকে ৫০০ মিটার দূরে। ফলসের গা বেয়ে সিঁড়ি আছে নীচে নামা যায়। তবে আজকে আমাদের এ পথ নয়। চেরাপুঞ্জির পথে যেতে যেতে উমতিয়াংগির কাছে রাস্তা দুভাগ হয়ে গেছে। একদিকে সোহরা বা চেরাপুঞ্জি অন্য পথটি ডাওকির দিকে। ডাওকির পথেই পড়বে মাওলিনং। কমলালেবুর জঙ্গল ছেড়ে এবার গাড়ি পাইন ও ফারের জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে চলেছে। ইতিমধ্যে বৃষ্টি শুরু হয়ে গেছে টিপটিপ করে। গাড়ি থেকে নেমে আর ছবি তোলার উপায় রইল না।
উমতিয়াংগি নদীর বাঁকে জানলা খুলে ছবি তুলতে গিয়ে হুড়মুড় করে বৃষ্টি এসে ভিজিয়ে দিল ক্যামেরা, জামাকাপড়। পূর্ব খাসি পাহাড়ের বুক চিরে কখনও বা ঘন জঙ্গল কখনও বা রুক্ষ পাহাড় আবার কখনও সবুজ উপত্যকা পেরিয়ে আমরা এগিয়ে চলেছি। গাড়ি ধীরে ধীরে পাহাড় থেকে উপত্যকার দিকে নেমে আসছে। পেরিয়ে চলি ছোটো ছোটো গ্রাম– লাতেনলিগট, পাইনুরসুলা প্রভৃতি। বৃষ্টির জন্য গাড়ি থেকে নামার উপায় নেই। চলতে চলতে দেখছি গ্রামের বাড়িঘর দোকানপাট আবার অনেক বাড়ির দাওয়ায় ফুলঝাড়ুর স্তুপ। ড্রাইভার দেখাল রাস্তার দুপাশেই ফুলঝাড়ু গাছের জঙ্গল।
পমটুং ব্রিজ পেরোতেই ডান দিকে রাস্তা ঢুকে গেছে মাওলিনং গ্রামের দিকে– এখান থেকে আরও ১৮ কিমি। আরও আধঘন্টা পরে পৌঁছে গেলাম মাওলিনং গ্রামে। গ্রামে ঢোকার আগে থাইলং নদী তবে তার জলধারা বেশ শীর্ণ। এখন বৃষ্টি থেমেছে তবে আকাশ এখনও মেঘে ঢাকা, আবার যে-কোনও সময়ে নামতে পারে।
গাড়ি এসে থামল গ্রামের বাইরে। অনেকটা ফাঁকা জায়গা জুড়ে অনেক গাড়ি বাস দাঁড়িয়ে আছে– সবই পর্যটকদের নিয়ে এসেছে। এই অল্প পরিচিত স্থান হঠাৎই কী করে এত জনপ্রিয় পর্যটনস্থল হয়ে উঠল বুঝতে পারলাম না। বাংলা কথাবার্তা বুঝিয়ে দিচ্ছে অনেক পর্যটকই বাঙালি তবে স্থানীয় মানুষরা অনেকেই হাজির। এখানকার অধিকাংশ মানুষই খাসি সম্প্রদায়ের, খাসি ভাষায় কথা বলে তবে ইংরেজিও জানে কেউ কেউ।
ডানদিকে নাহোয়েট গ্রাম আর বাঁদিকে মাওলিনং। গাড়ি থেকে নেমে আমরা প্রথমে চললাম নাহোয়েট গ্রামের পথে। কারণ এখানে রয়েছে একটি একতলা রুটব্রিজ। খুব বেশি হাঁটতে হবে না বলে আশ্বাস পেলাম। একটা ঢালু অসমান পাথুরে পথে এগিয়ে চলি। রাস্তার একপাশে দোকান, সেখানে চা কফি স্ন্যাক্স ছাড়াও নানা ধরনের হাতের কাজের উপহার সামগ্রী পাওয়া যাচ্ছে। খাসিদের হাতের কাজ খুব সুন্দর।
এই লিভিং রুট ব্রিজ সম্বন্ধে দু-এক কথা না বললে অন্যায় হবে। এই শিকড় সেতু সম্পর্কে আমাদের ড্রাইভারের কাছ থেকে আগেই কিছুটা জ্ঞান লাভ করেছি। মেঘালয়ে এই রুট ব্রিজ একেবারেই তাদের নিজেদের সৃষ্টি। নদী পারাপারের জন্য প্রকৃতি আর মানুষের বুদ্ধি মিলে রূপ পেয়েছে এই জীবন্ত শিকড় সেতু। খাসি উপজাতি মানুষেরা লক্ষ্য করেন এক বিশেষ প্রজাতির রবার গাছ যার নাম ফাইকাস ইল্সটিকা, যার মূল শিকড়গুলি অন্যান্য গাছের মতো মাটির নীচে থাকলেও বয়ঃপ্রাপ্তির সঙ্গে সঙ্গে শাখাশিকড়গুলি আড়াআড়ি মাটির ওপর বেড়ে ওঠে। কাজে লাগানো হয় সুপারি গাছকে। এই গাছের কান্ডের অর্ধাংশকে তারা এই কাজে ব্যবহার করেন। কাণ্ডগুলিকে ফাঁপা করে ঢোকানো হয় বেড়ে ওঠা রবার গাছের শিকড়। ফাঁপা সুপারি কাণ্ডকে অবলম্বন করে বাড়তে থাকে শিকড়। নদীর এক প্রান্ত থেকে এগিয়ে চলা শিকড় একসময় নদীর অপর প্রান্তের পাড়ে উপস্থিত হয়। ফাঁপা কাণ্ড ছেড়ে মাটি স্পর্শ করে। মাটিতে শিকড় ভালো ভাবে ঢুকে গেলেই ফাঁপা সুপারিকাণ্ড কেটে ফেলা হয়। এইভাবে একাধিক শিকড়কে নদীর দুই প্রান্তের মাটিতে গেঁথে দিয়েই সেতু তৈরি। সেতুর মাঝের ফাঁকফোকর পাথর কাঁকর ইত্যাদি দিয়ে ভরাট করা হয়। গোটা প্রক্রিয়াটি সম্পূর্ণ হতে কুড়ি থেকে পঁচিশ বছর সময় লাগে। এই ব্রিজের বয়স তিনশো বছর পেরিয়ে গেছে বলে শুনলাম। একসঙ্গে ৬০ জন পূর্ণ বয়স্ক মানুষের ভার বইতে সক্ষম এই জীবন্ত সেতু।
ঢালু পথ বেয়ে নামতে শুরু করেছি। সরু পথ, রাস্তার ধারের দোকানপাট এখন আর নেই, একপাশে খাদ আর অন্যদিকে পাহাড়ি জঙ্গল আর তার সঙ্গে মানুষের ঢল। শিলং-এ তো টুরিস্টদের এত ভিড় দেখিনি। এর মধ্যে শুরু হল বৃষ্টি এবার ঝমঝমিয়ে। ছাতা এক হাতে আর ক্যামেরার ব্যাগ অন্যহাতে, ভিড় সামলে এগিয়ে চলি।
পৌঁছে গেলাম লিভিং রুট ব্রিজে। পাহাড়ি নদী থাইলং-এর ওপর এই ব্রিজ নির্মাণ করা হয়েছে। ব্রিজের ওপর ছবি বা সেলফি তোলার জন্যে খুব হুড়োহুড়ি, ঠেলাঠেলি। অগত্যা ব্রিজ পেরিয়ে থাইলং নদীর ধার ধরে একটু হাঁটতে শুরু করলাম’ বৃষ্টি পড়েই চলেছে। নদীর জল কিন্তু খুব গভীর নয়, নুড়ি পাথর বোল্ডারের মধ্যে দিয়ে ধীর লয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। এই রুট ব্রিজ ভ্রমণার্থীদের এক অন্যতম আকর্ষণ তো বটেই তার সঙ্গে গ্রামবাসীদের কাছে এক পরম আশীর্বাদ। যেহেতু গাছটি থেকে সমানে ঝুরি উৎপন্ন হচ্ছে সেহেতু নতুন ঝুরি এসে পুরোনো ক্ষয়ে যাওয়া ঝুরিগুলির স্থান দখল করছে। ফলে আরও সুদৃঢ় হচ্ছে বাঁধন। ভিড় একটু হালকা হতে ব্রিজের ছবি তুলে ফেরার পথ ধরি। এবার চড়াই পথে ফেরা। কিছুটা এগিয়ে একটা দোকানে এক কাপ চা খেয়ে গলা ভেজালাম। তারপর আবার উপরে ওঠা।
রুট ব্রিজের আরও বড়ো আকর্ষণ আছে চেরাপুঞ্জি থেকে ১৪ কিমি দূরে লাইতা কিনাসিউ গ্রামের কাছে। সেখানে রয়েছে ডবল রুট ব্রিজ। এই রুট ব্রিজ দেখতে হলে ৫ কিমি চড়াই উৎরাই পথ অতিক্রম করতে হবে।
এবারে মাওলিনং গ্রামের মধ্যে প্রবেশ করি, তখনও প্রবল বেগে বৃষ্টি পড়ছে। সরু রাস্তায় প্রচুর গাড়ির মেলা। গাড়ি পার্ক করাও এক দায়, তার ওপর এই প্রবল বৃষ্টি। দুপুর হয়ে গেছে এবার যা হোক কিছু খাওয়ার ব্যবস্থা করতে হবে।
ভাতের হোটেল এখানে হাতে গোনা সেখানেও প্রচুর ভিড়। হোটেলে খাওয়ার বুকিং করে গ্রাম দেখতে বেরোই। গ্রামবাসীদের মিলিত প্রচেষ্টায় রাজ্যের এক কোণে পড়ে থাকা মাওলিনং, মেঘালয়ের পর্যটন মানচিত্রে স্থান করে নিয়েছে। ল্যান্ডস্কেপে ধরা দেয় ছোটো-বড়ো খাসি পাহাড়ের সারি। বাংলাদেশের সীমান্তবর্তী এই গ্রাম আজ সারা বিশ্বের আলোচনার বিষয়। গ্রামবাসীর সমবেত প্রয়াসে এটা সম্ভব হয়েছে। গ্রামকে পরিচ্ছন্ন রাখতে বিভিন্ন ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। গ্রাম জুড়ে বেতের তৈরি ডাস্টবিনের ছড়াছড়ি। কোথাও ময়লা জমলেই স্থান হয় এই ডাস্টবিনে। এই কারণেই মাওলিনং এশিয়ার সবচেয়ে পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন গ্রামের শিরোপার অন্যতম দাবিদার।
এখানে মানুষেরা ফুল ভালোবাসেন। মাওলিনং গ্রামে প্রায় প্রতিটি বাড়িতেই রয়েছে ছোটো-বড়ো ফুলের বাগান। যাদের জমির অভাব তারা বারান্দায় টব ঝুলিয়ে ফুল ফোটাচ্ছেন। নানাবর্ণের বোগেনভিলিয়া, বিভিন্ন ধরনের দুষ্প্রাপ্য অর্কিডে মোড়া মাওলিনং-এর পথঘাট।
বৃষ্টি থেকে রেহাই পাওয়ার জন্য একটি বাড়ির শেডের নীচে দাঁড়ালাম। বাড়ির বারান্দায় বসা এক বয়স্ক মানুষ সাদর আমন্ত্রণ জানালেন ভিতরে। হাতে বেশি সময় নেই তাই দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়েই তার সঙ্গে ভাঙা হিন্দি ও ইংরেজিতে আলাপ জমাই। তার মুখেই শুনি মাওলিনং-এর এক টুকরো ইতিহাস। একশো বছর আগে থেকেই মাওলিনং গ্রামে চলছে পরিচ্ছন্নতার ও পরিবেশ সচেতনতার কার্যক্রম। ২০০৩ সালে মাওলিনং গ্রামের চার্চে কাজ করতে আসা এক মেমসাহেবের নজরে পড়ে পুরো বিষয়টা। তাঁর আমন্ত্রণে ডিসকভারি চ্যানেল এসেছিল মাওলিনং সম্পর্কে ফিল্ম তুলতে। তাতেই বিশ্বের দরবারে পৌঁছে যায় মাওলিনং।
এরপর পিচের রাস্তা তৈরি হয়েছে। নিজেদের গ্রামকে আরও বেশি সুন্দর করে রাখার দায়িত্ব তুলে নিয়েছে স্থানীয় মানুষ। নিজেদের ক্ষেতের কাজ, ফুলঝাড়ু চাষ এসবের মধ্যেও রয়েছে গ্রাম পরিষ্কার রাখার লক্ষ্য। শুধু এই গ্রাম নয় আশপাশের গ্রামেও সেমিনারের বা আলোচনার মাধ্যমে প্রচার করে তাদের কর্মসূচী। প্লাস্টিক বর্জনও তারা রূপায়িত করেছে, যা আমরা এখনও পারিনি। মাওলিনং এ বাড়ি আছে একশোর কাছাকাছি, গ্রামবাসী পাঁচশো। এরা যদি পরিচ্ছন্নতার শিক্ষা সারা বিশ্ববাসীকে দিতে পারে, তাহলে আমরাই বা পারব না কেন?
কিছু ছবি তুলে ফিরে আসি খাবার হোটেলে। ভিড় একটু হালকা হয়েছে। আমরা খেতে বসার সুযোগ পেলাম, কিন্তু খাবার তো বাড়ন্ত। আরও দশ মিনিট অপেক্ষা করতে হল ভাত সিদ্ধ হবার জন্য। তবে মেনু খুবই সাধারণ– ভাত, ডাল, আলুভাজা আর কপির তরকারি, ডিমের যোগানও ফুরিয়ে গেছে। তাড়াতাড়ি খাওয়া শেষ করে উঠে পড়লাম কারণ মাওলিনং-এ আরও কয়েকটি দ্রষ্টব্য বাকি।
রাস্তার ধারে ব্যালেন্সিং রক। তারও দেখার প্রবেশমূল্য ১০ টাকা। রাস্তা থেকে একটু নীচে বিশাল এক চ্যাপটা গোলাকার শিলাখণ্ড, মাঝখানে একটি ছোট্ট পাথরের খন্ডের ওপর ভর করে দাঁড়িয়ে আছে মাটির ওপর। পাথর ও মাটির মধ্যে প্রায় দু ফুটের ব্যবধান আর এর চারপাশে নীচু গ্রিল দিয়ে ঘেরা। এই ছোট্ট পাথরখণ্ড কীভাবে বছরের পর পছর এই বিশাল পাথরের চাতালকে বহন করে যাচ্ছে তা সত্যিই বিস্ময়কর এক প্রাকৃতিক আশ্চর্য। আর একটু এগিয়েই রাস্তা থেকে দেখা যাচ্ছে মাওলিনং চার্চ, সামনে এক বড়ো ঘাসজমি। কিন্তু রাস্তার কাছে গেট তালাবন্ধ। চার্চের কাছে গিয়ে ছবি তুলতে হলে গ্রামের ভিতর দিয়ে যেতে হবে। বৃষ্টি তো পড়েই চলেছে। চার্চের ছবি তুলে ফিরে আসতে মিনিট দশেক সময় লাগল, তখনও গাড়ি ফিরে আসেনি। প্রবল বৃষ্টির মধ্যে আরও দশ মিনিট রাস্তায় দাঁড়িয়ে থাকার পর গাড়ি এল। বৃষ্টিতে জামা প্যান্ট ভিজে সপসপে।
এবারের গন্তব্য রিওয়াই গ্রামের স্কাই ভিউপয়েন্ট। এখানেও প্রবেশ মূল্য আছে ২০ টাকা। বৃষ্টি বোধহয় একটু কমেছে। খাসি ভাষায় এই ভিউপয়েন্টের নাম ‘ব্রন খংমেন’ (টিকিটের গায়েই মুদ্রিত)। টিকিট কেটে বাঁশের তৈরি এক অদ্ভুত সিঁড়ির সামনে দাঁড়ালাম। সিঁড়ি বাঁশের তৈরি আর তার বাঁধন হল বেতের। সিঁড়ি বেয়ে উঠতে থাকি। এ যেন অনেকটা গাছবাড়ির মতো তবে অনেকটাই বিস্তৃত তার প্রেক্ষাপট। একতলায় গাছের গুঁড়ি, বাঁশের সিঁড়ি বেয়ে পৌঁছোলাম গাছের ডালের গায়ে ঘরে। একদিকে এক লম্বা বারান্দা শেষ হয়েছে একটা ছোট্ট বাঁশের খুপরিতে, সেটাই হয়তো একদিকের ভিউপয়েন্ট। আর এক দিকের বাঁশের বারান্দার ধারে একটি ঘর সেটি আবার তালাবন্ধ। এই রকম হেলানো বাঁশের সিঁড়ি চলে গেছে তিনতলায়। সিঁড়ির ধারে বাঁশের কঞ্চির হাতল। প্রথমে একটু ভয় করলেও সাহস করে উঠে গেলাম। তিনতলার মাচা থেকে পুরো গ্রামটাই দেখা যায়। আবার শুরু হল বৃষ্টি। তাড়াতাড়ি নীচে নেমে এলাম।
বিকেল চারটে বেজে গেছে। আমাদের ড্রাইভার জানাল এই বৃষ্টি বাদলে অবেলায় ডাউকির পথে আর যাওয়া যাবে না। এখান থেকে ডাউকি যাতায়াত ৪০ কিমি, তারপর মাওলিনং থেকে শিলং ফেরা। এই বৃষ্টির মধ্যে অন্ধকারে ফেরা খুবই বিপজ্জনক। অতএব আর দেখা হল না সীমান্তের ইয়ামপোর্ট নদী। একটি সুন্দর জলপ্রপাত আর ডাউকির অনন্য প্রকৃতি। গাড়ি মুখ ঘোরাল শিলংয়ের দিকে। জলে ভেজা অবস্থায় যখন হোটেলে ফিরলাম তখন মনে হল সার্থক হয়েছে রাজ্যের নাম মেঘালয়।
হোটেলে ফিরে শুকনো হয়ে গরম গরম কফি আর পকোড়া দারুণ জমে গেল। রাতে ঘুমোতে যাওয়ার সময়েও বৃষ্টি চলছে। মনে আশঙ্কা নিয়ে ঘুমের দেশে চলে গেলাম।
পরের দিন সকালে ঘুম থেকে উঠে মনটা ভালো হয়ে গেল। আকাশ পরিষ্কার সূর্য উঠছে, নীল আকাশে সাদা মেঘের ভেলা ভেসে বেড়াচ্ছে। স্নান সেরে ব্রেকফাস্ট। আজকের মেনু পুরি, সবজি, কেক আর তার সঙ্গে চা, কফি। আজকে আমাদের সফর সূচীতে আছে মেঘালয়ের আর এক অল্প পরিচিত স্থান নারটিয়াং। জয়ন্তিয়া পাহাড়ের কোলে নারটিয়াং, জোয়াই অঞ্চলে অবস্থিত। নারটিয়াং, শিলং থেকে ৬৫ কিমি, সেখান থেকে জেলা সদর জোয়াই আরও ২৪ কিমি।
যথাসময়ে আমাদের যাত্রা শুরু হল। হয়তো গতকালের বৃষ্টির জন্যেই আজকের আবহাওয়া একটু শীতল। বেশ আরাম লাগছে। শিলংয়ের শহুরে অঞ্চল ছেড়ে গাড়ি চলেছে এক সবুজ প্রান্তরের মধ্যে দিয়ে। মাঝে মাঝে ছোটো ছোটো গ্রাম, ফসলের জমি আবার কখনও বা ছোটো ছোটো টিলা। জয়ন্তিয়া পাহাড় মেঘালয়ের একেবারে পুব দিকে অবস্থিত। উন্মুলং গ্রাম পেরিয়ে আমরা জয়ন্তিয়া হিলস্-এর এলাকায় প্রবেশ করলাম। সারা অঞ্চল জুড়ে ঢেউ খেলানো পাহাড় আর সবুজ উপত্যকা, তবে উঁচু পাহাড়ের শিখর এদিকে নেই। আজকে আমাদের প্রথম দ্রষ্টব্য থাডলেসকেইন লেক। পাঁচিল ঘেরা এই লেকের কাছে আমাদের গাড়ি এসে থামল। এই লেকের এক ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট রয়েছে। জয়ন্তিয়া রাজবংশের এক রাজার সেনাপতির নির্দ্দেশে এই লেকটি খনন করা হয়। রাস্তার ধারেই চির-পাইনে তিনদিক ঘেরা এই ছোটো লেক। একসময়ে এখানে রেস্তোরাঁ আর জলে বোটিংয়ের ব্যবস্থা ছিল। বর্তমানে অবশ্য তা বন্ধ আছে, তবে এই লেক আবার নতুন করে সেজে উঠছে। লেক ঘিরে তৈরি হচ্ছে নতুন রাস্তা। সেই কারণে অনেক মহিলা শ্রমিক এখানে কাজ করছে। লেকের এক ধারে বোট হাউস, তবে বোটই না চললে বোট হাউসে কী হবে?
গাড়ি এগিয়ে চলে জোয়াইয়ের দিকে। আমরা শিলং থেকে ৫০ কিমি-র বেশি পেরিয়ে এসেছি। এবার এক মাঠ ঘেঁসে গাড়ি থামল। ড্রাইভার জানাল আমরা যাব তিরসি প্রপাত দেখতে। তবে এই বিশাল মাঠ পেরিয়ে হাঁটতে হবে প্রায় এক কিলোমিটার। সবুজ আর হলুদে মোড়া শষ্যক্ষেত্রের আলপথ ধরে আমরা হাঁটছি। কোথাও বা বৃষ্টিতে আলপথ ভেঙে গেছে তখন মাঠের মধ্যে দিয়েই আমাদের পথ। ড্রাইভারই আমাদের পথ প্রদর্শক।
কিছুক্ষণের মধ্যেই পৌঁছে গেলাম প্রপাতের দোরগোড়ায়। সিঁড়ি দিয়ে উঠতে হবে প্রপাতের ভিউপয়েন্টে। বেশ বড়ো চাতাল রেলিং দিয়ে ঘেরা, একদিকে দেখা যাচ্ছে প্রপাতের উপরের অংশ আর অন্য দিকে নকশা করা কাঁথার মতো নানা রঙের শষ্যক্ষেত্র। একটি ফলকের লিপি থেকে জানা গেল এই তিরসি প্রপাতের সৌন্দর্যায়ন হয়েছে ২০০৬ সালে সরকারি প্রকল্পে। প্রপাতের পূর্ণ রূপ দেখতে হলে সিঁড়ি দিয়ে অনেকটা নীচে নামতে হবে। রডোডেনড্রন গাছের জঙ্গল ঘিরে রেখেছে জলের ধারাকে তবে গাছে এখন ফুল নেই। একেবারে নীচের তলা থেকে প্রপাতের প্রবল বেগে অবতরণ দৃশ্য দেখে মন বিমোহিত হল। বাতাসে ভাসছে অসংখ্য জলকণা। একটা স্নিগ্ধ শীতলতা ও স্যাঁতসেঁতে ভাব রয়েছে প্রপাতের নীচের তলায়।
এবার আমাদের যাত্রা নারটিয়াং গ্রামের দিকে। জোয়াইয়ের পথে আরও ১৫ কিমি এগিয়ে তারপর বাঁদিকে আরও ৫ কিমি পথ পেরোলে নারটিয়াং গ্রাম। এক সময় জয়ন্তিয়া রাজাদের রাজধানী ছিল এই নারটিয়াং। এখানে ছড়িয়ে আছে জয়ন্তিয়া রাজত্বের নানা প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন। নারটিয়াংয়ের খ্যাতি তার ঐতিহাসিক মনোলিথ পার্কের জন্য। মনোলিথ হল সংরক্ষিত বড়ো আকারের প্রস্তরখণ্ড, যেগুলিকে স্মৃতিস্তম্ভ বলা চলে। মনোলিথ পার্কে ঢুকতে কোনও টিকিট কাটতে হয় না। প্রবেশ করলাম এই পাথরের পুরাতাত্ত্বিক বাগানে। চারদিকে নানা আকারের ও উচ্চতার পাথরের স্ল্যাব পোঁতা রয়েছে। আঁকাবাঁকা রাস্তা চলে গেছে সেই প্রস্তর-অরণ্যের মধ্যে দিয়ে। নারটিয়াং গ্রামের এই অঞ্চলটির নাম অ্যাওমুলং– এখানেই এই রাজ্যের মধ্যে সবচেয়ে বেশি মনোলিথ দেখতে পাওয়া যায়। স্থানীয় মানুষের বিশ্বাসে মৃতের স্মারকরূপে মনোলিথ স্তম্ভ সৃষ্টি করা হয়। পৃথিবীর সর্বাপেক্ষা লম্বা মনোলিথ এই অঞ্চলেই রয়েছে। জয়ন্তিয়া উপকথা অনুযায়ী, বীর যোদ্ধা মারফালিস্কি ২৬ ফুট লম্বা সাড়ে ৬ ফুট চওড়া ও দেড় ফুট মোটা মনোলিথটি একহাতে খাড়া বসিয়েছিলেন। স্থানীয় রাজাদের গৌরবময় স্মৃতিতে এই সব মনোলিথ ১৫০০ সাল থেকে ১৮৮৩ সালের মধ্যে বসানো হয়েছিল।
মনোলিথ পার্কের পাশেই নারটিয়াং লেক তবে তার গেট তালাবন্ধ রয়েছে। গেটের ফাঁক দিয়ে যেটুকু দেখা যায় তাতে বোঝা গেল বেশ লম্বা জলাশয়, তার পাশ দিয়ে রাস্তা চলে গেছে, একটি বিশ্রামকক্ষও রয়েছে। তবে অযত্নের ছাপ চারদিকে, বড়ো বড়ো গাছের সঙ্গে ঝোপঝাড়ে ভরে গেছে চারদিক। আমরা এবার চলেছি নারটিয়াং দুর্গামন্দিরের উদ্দেশ্যে। গ্রামের মধ্যে দিয়ে পথ। দুর্গামন্দিরটি একটি উঁচু জমির ওপর, গাড়ির রাস্তা অনেকটাই নীচে। রাস্তা থেকে সিঁড়ি বেয়ে মন্দির চত্বরে প্রবেশ করতে হল। লাল-সাদা রঙের দুর্গামন্দির। লাল রঙের পতাকা উড়ছে মন্দিরের সামনে, বিভিন্ন তিথিতে বেশ জাঁকজমক করে পূজা হয় এই হিন্দু মন্দিরে।
খাসি পাহাড়ের বাসিন্দারা দেবদেবীর মূর্তি পূজায় বিশ্বাসী নয় বলে গাঁদাফুলের বেদীর ওপর বসানো একটি কাঠের গুঁড়িকে দুর্গার প্রতিরূপ হিসাবে পূজা করে। প্রচলিত কাহিনি অনুযায়ী এক জয়ন্তিয়া রাজা তাঁর হিন্দুধর্ম গ্রহণ উপলক্ষে এই দুর্গামন্দির প্রতিষ্ঠা করেন, প্রথমে মন্দিরটি গড়া হয় খাসিদের খড়ের চালের আদলে পরে আবার নতুন করে গড়া হয়। প্রাচীনকালে জয়ন্তিয়া রাজা, পূজা-পাঠের জন্য হিন্দু-ব্রাহ্মণদের নিয়ে আসেন এখানে। তাদের বংশধররাই আজও মন্দিরের পূজারি। এখানে একসময়ে নরবলির প্রচলন ছিল কিন্তু ইংরেজ আমলে তা বন্ধ করে দেওয়া হয়।
দুর্গামন্দির ছাড়া এখানে একটি শিবমন্দিরও রযেছে। দুর্গামন্দির থেকে একটু খাড়াই পথে পড়ে সেই শিবমন্দির। এই মন্দিরেও হিন্দু পূজারীই পূজা-পাঠ করে। নারটিয়াং-এ খাওয়ার কোনও হোটেল নেই, তাই শিলংয়ের অভিমুখে গাড়ি মুখ ঘোরাল। জোয়াই যাওয়ার চুক্তি আমাদের গাড়ির সঙ্গে হয়নি তাই মরিংনেং গ্রামের কাছে হাইওয়ে ধাবায় দুপুরের খাওয়া সাঙ্গ করে শিলংয়ে ফিরে চললাম।