সারাদিনের ক্লান্তি দূর করতে এবং শরীরকে চাঙ্গা রাখতে টানা ঘুম একান্তই দরকার। সুতরাং সারা বাড়িতে শোবার ঘরের আলাদা প্রয়োজনীয়তা অস্বীকার করা যায় না। বাড়ি সাজাবার সময় সকলেই শোবার ঘরের সজ্জায় একটু বিশেষ তদারকি করেন। নরম মোলায়েম পরিষ্কার বিছানা, দেয়ালের রঙের সঙ্গে পর্দার সামঞ্জস্য বজায় রাখা, হালকা স্নিগ্ধ আলোর ব্যবহার, মানানসই আসবাব ইত্যাদি। অথচ এত সু-ব্যবস্থা থাকা সত্ত্বেও অনেক সময়ই এত আরামেও নিশ্চিন্ত ঘুম অধরাই থেকে যায়। অনেক সময়েই এর কারণ হয় ঘরের ভিতরের অপরিশুদ্ধ বাতাস।
এখন প্রায় সকলেই ব্যস্ত জীবনযাপনে অভ্যস্ত। সুতরাং ব্যস্ততার স্ট্রেস কমাতে, অবসাদমুক্ত থাকতে এবং নিশ্চিন্ত আরামদায়ক ঘুমের জন্য দরকার শুদ্ধ ও পরিষ্কার বাতাসে নিঃশ্বাস নেওয়া। রাস্তার পলিউশন যাতে বাড়ির ভিতরে ঢুকে না পড়ে এবং বাড়ির ভিতরের বাতাস যাতে দূষণমুক্ত থাকতে পারে তার জন্য বাড়িতে কিছু গাছ রাখা যেতে পারে।
বাথরুম থেকে বেরোনো অ্যামোনিয়া গ্যাস, ডাস্টবিনের ফর্মালডিহাইড গ্যাস, ডিটারজেন্ট-এর বেনজিন, আসবাব থেকে বেরোনো ট্রাইক্লোরোইথিলিন, গ্যাস স্টোভের কার্বন মোনোঅক্সাইড এবং অপরিষ্কার জামাকাপড়ের দুর্গন্ধ ইত্যাদির প্রভাবকে নিষি্্ক্রয় করার জন্য এই ধরনের বিশেষ কিছু গাছ এয়ার পিউরিফায়ার-এর কাজ করে।
আমরা সকলেই জানি গাছ, রাত্রে কার্বন ডাইঅক্সাইড ছাড়ে, কিন্তু আমাদের দরকার অক্সিজেন। সূর্যের আলোয় গাছে ফোটোসিন্থেসিস প্রক্রিয়া চলতে থাকে যার ফলে গাছ, পরিবেশে থাকা কার্বন ডাইঅক্সাইড গ্যাস টেনে নিয়ে অক্সিজেন ছাড়তে থাকে। কিন্তু রাত্রে এর ঠিক উলটোটাই ঘটে।
কিন্তু বৈজ্ঞানিকদের মতে এমন কিছু গাছগাছড়া রয়েছে যেগুলি সূর্য অস্ত যাওয়ার পরেও অনেকক্ষণ পর্যন্ত অক্সিজেন ছাড়তে থাকে বাতাসে। বিষাক্ত গ্যাসের প্রভাব থেকে এই গাছগুলি মানুষকে সুরক্ষা প্রদান করে।
তবে আমাদের, কোন গাছটা কোথায় রাখলে উপকার পাওয়া যাবে, এই জ্ঞানের অভাব আছে। সুতরাং, আসুন জানা যাক কোন গাছগুলি দূষণযুক্ত বাতাসকে প্রভাবিত করে পরিবেশ দূষণমুক্ত করতে সক্ষম।
স্নেক প্লান্টঃ এই গাছ দিনে রাতে সবসময়ই অক্সিজেন ছাড়তে থাকে বাতাসে। গাছ-গাছড়ার জগতে এই ধরনের প্লান্টকে স্যানসেভিয়েরিয়া ট্রাইফাসিয়াটা নামেই সকলে জানে। যারা বাগান করতে ভালোবাসেন, তারা এটিকে স্নেক প্লান্ট বলেই জানেন। দিনে রাতে অক্সিজেন ছাড়ার ফলে বাতাসে অক্সিজেনের মাত্রা বেড়ে দূষণ রোধ করতে সাহায্য করে। বাথরুমে অ্যামোনিয়া গ্যাসের প্রভাব নিষি্্ক্রয় করতে এই ধরনের গাছ খুবই কার্যকারী। তাছাড়াও মাটিতে অথবা জানালায় এই গাছ রাখলে ডাস্টবিনের দুর্গন্ধও দূর করে এই ধরনের প্লান্ট। বাথরুমে যদি ফুলের সুগন্ধ কেউ চান তাহলে ক্রিসানথেমাম প্লান্ট রাখতে পারেন।
গোল্ডেন পোথোসঃ বাড়ির ভিতর ছায়াতে অথবা সূর্যের রশ্মির তেজ যে-জায়গায় কম পড়ে সেখানে এই ধরনের চওড়া পাতার (মানি প্লান্ট) প্লান্ট বাতাসে দূষণ রোধ করার ক্ষেত্রে সহায়ক। বাল্ব অথবা টিউবের আলোতেও এই গাছ জীবিত থাকে। বাতাসে প্রচণ্ড পরিমাণ আর্দ্রতাও এর কোনও ক্ষতি করতে পারে না। মস্ স্টিকের সাহায্যে কম জলে এই প্লান্ট বেশি ভালো ভাবে কাজ করে। অ্যালোভেরা প্লান্টের মতোই ডাস্টবিনের দুর্গন্ধযুক্ত গ্যাসের প্রভাব, এই গোল্ডেন পোরোস প্লান্টও রোধ করতে সাহায্য করে। অন্ধকারে হ্যাংগিং পটেও যদি এই প্ল্যান্ট রেখে দেওয়া যায় তাহলেও এটি এয়ার পিউরিফায়ারের কাজ করবে। সাধারণ দুর্গন্ধের সঙ্গে সঙ্গে গ্যাস স্টোভ থেকে নির্গত কার্বন মোনোঅক্সাইড গ্যাসকেও এই প্লান্ট দূর করতে সাহায্য করে।
উইপিং ফিগঃ বাড়ির ভিতর ভারী পর্দা, কার্পেট, আসবাব ইত্যাদি থেকেও গন্ধ নির্গত হয় যা ধীরে ধীরে বাতাসে শুদ্ধতার স্তরকে প্রভাবিত করে। উইপিং ফিগ এই ধরনের গন্ধকে শুদ্ধ করতে সাহায্য করে। অনেক সময় আসবাবপত্র থেকে রঙের একটা গন্ধ আসে। ওয়ারনক ড্র্যাসিনা নামের প্লান্ট এই গন্ধ দূর করতে সাহায্য করে। ঘরের জানালায় রাখা রোডোডেনড্রন সিমসি, প্লাইউড এবং ফোমের গদির গন্ধ শুষে নিয়ে ঘরের বাতাস গন্ধমুক্ত রাখে।
শোবার ঘরের পরদা এবং ড্রাই ক্লিন করা জামাকাপড়ের গন্ধ দূর করার জন্য, গরবেরা ডেজি প্লান্ট খুবই কার্যকরী। কিন্তু এই গাছ রাখতে গেলে খুবই যত্নের প্রয়োজন হয়। অ্যালোভেরা, স্নেক প্লান্টের মতোই রাতেও এই গাছ অক্সিজেন সাপ্লাই করে বাতাসে।
পিস লিলিঃ বাড়ির ভিতরে সবুজের সমারোহ যাদের পছন্দ, তারা বিভিন্ন ধরনের প্লান্ট দিয়ে ঘর সাজান ঠিকই– তবে অনেকেই চান এর সঙ্গে যোগ হোক সুগন্ধ যা ক্লান্ত মনকে আবেশে ভরে দেবে। বসন্ত ঋতুতে প্রস্ফুটিত সাদা পিস লিলি মনের এই সাধ অনায়াসেই পূরণ করতে পারবে। ছায়াঘেরা জায়গায় সপ্তাহে একবার মাত্র জল পেয়েই এই প্লান্ট বেঁচে থাকতে পারে এবং বাতাসে দূষণ প্রতিরোধ করার অদ্ভুত ক্ষমতা রয়েছে প্লান্ট-টির। ঘরের ভিতর সাবান, ডিটারজেন্ট-এর গন্ধ, ডাস্টবিনের দুর্গন্ধ সহজেই শুষে নেওয়ার ক্ষমতা রাখে। সুতরাং বাড়িতে এয়ার পিউরিফায়ার হিসেবে এর চাহিদা বিপুল।
এছাড়াও ফুলগাছ লাগাতে চাইলে, শোবার ঘরের জানালায় অ্যানথুরিয়াম অ্যানড্রিয়ানাম গোত্রের প্লান্ট-ও রাখা যেতে পারে যেগুলি স্বাভাবিক ভাবে একটু দামি।
রেড এজেড ড্র্যাসিনাঃ (ম্যাডাগাসকার ড্রাগন ট্রি) এই প্লান্ট বাড়ির ভিতর রাখলে বাতাসে দূষণ নিয়ন্ত্রণে থাকে।
গ্রেপ আইভিঃ মাঝারি সূর্যের আলো, অল্প জল এবং সামান্য যত্নেই এই প্লান্ট বাতাসকে দূষণমুক্ত রাখতে সক্ষম। সুস্থ গ্রেপ আইভি প্লান্ট যদি বাড়িতে শয়নকক্ষে খাটের পাশে রাখা হয় তাহলে ঘরের বাতাস শুদ্ধ থাকবে। গাছ বাড়তে থাকলে প্রচুর জল দিতে হবে। যাদের ত্বক সংবেদনশীল এবং অ্যালার্জির প্রবণতা আছে, তারা এই গাছ রাখলে উপকার পাবে। এই প্লান্ট অনেক ধরনের গ্যাস নিষি্্ক্রয় করতে সক্ষম।
রান্নাঘরে কার্বন মোনোঅক্সাইড গ্যাস থেকে অথবা বাড়ির বাইরে আগুন জ্বালালে যে-দুর্গন্ধ হয়, তার প্রভাব রোধ করতে রাবার প্লান্ট, ঘরে-বাইরে দু’জায়গায়ই খুব কার্যকরী।
ব্যাম্বু পামঃ এই প্লান্ট বাড়িতে থাকলে মাকড়সার জাল থেকে অব্যাহতি পাওয়া যায়। এই গাছ অন্দরসজ্জার জন্য সকলের পছন্দ ঠিকই কিন্তু ঘরের ভিতরের আর্দ্রতা শোষণ করার ক্ষমতা রয়েছে এদের। তাই যেখানে সোজাসুজি রোদ্দুর পড়ে, সেখানে এই গাছ না রাখাই ভালো। রান্নাঘর, ডাস্টবিন এমনকী সাবানের গন্ধও এই গাছ শুষে নিতে পারে।
বাড়িতে যদি লম্বা বারান্দা থাকে, তাহলে বাতাসে সুগন্ধ ছড়াবার জন্য ল্যাভেন্ডার প্লান্ট রাখা যেতে পারে।
স্পাইডার প্লান্টঃ টবে রেখে ঘরের ভিতর এই গাছ রাখলে জঞ্জালের গন্ধ দূর করবে সঙ্গে ঘরের বাতাসকেও দূষণমুক্ত রাখবে। প্রত্যেকটি এয়ার পিউরিফায়ার প্লান্ট যেমন অন্দরসজ্জার কাজে লাগে, তেমনি পরিবেশকে দূষণমুক্ত রাখতেও সাহায্য করে।