যোশিমঠ থেকে বদ্রিনাথগামী জিপ ছাড়ল বিকেল সোয়া ৩টে নাগাদ। চেনা পাহাড় ও উচ্ছ্বল অলকনন্দাকে পাশে রেখে প্রায়শই ভঙ্গুর পথে বদ্রিনাথ জিপ স্ট্যান্ডে পৌঁছোলাম বিকেল সাড়ে ৪টেয়। লাগেজ পিঠে তুলে মিনিট ৬-৭ হেঁটে চলে এলাম ভারত সেবাশ্রম সংঘের নতুন বাসভবনে। সেখান থেকে বদ্রিনাথ মন্দির প্রায় ঢিল-ছোঁড়া দূরত্বে। আমরা দুই বন্ধু দেখা করলাম আশ্রমের ভারপ্রাপ্ত মহারাজ-এর সঙ্গে। ঘর পেতে অসুবিধে হল না। চারতলা বাসভবনে দোতলার এক ঘরে ঠাঁই হল আমাদের। থাকার ব্যবস্থা প্রায় ভালো হোটেলের সমতুল্য। মেঝেতে কার্পেট পাতা, দুই শয্যা বিশিষ্ট খাটের দুপাশে আয়না সহ কাপ বোর্ড আর বাথরুমে গিজার-এর গরম জল। ঘর প্রতি ভাড়া ৬০০ টাকা।

গরম জলে হাত-মুখ ধুয়ে নীচে নেমে এলাম। এক দোকানে এসে গরম চা খেলাম। এবার চলে এলাম অলকনন্দার দক্ষিণ তীরে অবস্থিত বদ্রিনাথ মন্দিরে। নর ও নারায়ণ পর্বত দুটির মাঝে এই বদ্রিক্ষেত্র। শ্রীক্ষেত্রের উচ্চতা ১০,২২৪ ফুট।

 

বিকেল সাড়ে ৫টা, প্রচণ্ড ঠান্ডায় মন্দির প্রাঙ্গণে ভিড় নেই। সিংহদ্বার দিয়ে প্রবেশ করে প্রথমে নাট মন্দির, তারপর গর্ভমন্দির। প্রাণ ভরে দর্শন করলাম বদ্রিনাথজিকে। মন্দির প্রদক্ষিণ করে এসে বসলাম আদি গুরু শ্রীশঙ্করাচার্যের শুভ্র মূর্তির পদতলে। সন্ধ্যা সাড়ে ছটায় প্রভু বদ্রিনাথজির আরতি শুরু হল মহাসমারোহে। কেরালার নাম্বুদিরি বংশোদ্ভূত ব্রাহ্মণ পুরোহিত রাওয়ালজি যখন আরতি করছিলেন, আমি অপলকে দেখছিলাম বদ্রিবিশালজিকে। কালো শালগ্রাম শিলায় নির্মিত ধ্যানমগ্ন চতুর্ভুজ মূর্তি নারায়ণের। দুটি হাত ভগ্ন– শৃঙ্গারের সময় চন্দন দিয়ে হাত দুটি গড়ে নেওয়া হয়। প্রভুর কপালে চন্দন তিলক, গলায় মালা, শরীরে মূল্যবান পোশাক এবং মাথায় সোনার ছাতা। দুই হাতে যোগমুদ্রা। নারায়ণের কপালে হীরকনির্মিত উজ্জ্বল তৃতীয় নেত্র। প্রভুর বাম পাশে নর ও নারায়ণের মূর্তি। ডানপাশে ধনপতি কুবের, গরুড় এবং সিদ্ধিদাতা গণেশ। নারায়ণের সামনে কৃষ্ণসখা উদ্ধব এবং বীণা-সহ দেবর্ষি নারদ। শীতকালে ওই উদ্ধবজির মূর্তিকে নারায়ণের প্রতিনিধি হিসেবে যোশিমঠে নিয়ে গিয়ে পূজা করা হয়।

প্রজ্জ্বলিত দীপশিখা, ধূপের সুগন্ধ এবং ঘণ্টাধবনিতে রচিত হয়েছে এক স্বর্গীয় পরিবেশ। আধ ঘণ্টা পরে আরতি শেষ হলে মন্দির চত্বর ঘুরে দেখলাম। সেখানে ছোটো ছোটো মন্দিরে পর পর রয়েছেন হনুমানজি, গণেশজি, নবদুর্গা, লক্ষ্মীদেবী এবং শেষে মুণ্ডহীন ঘণ্টাকর্ণজি। মন্দিরের প্রধান প্রবেশ দ্বারে গরুড় মূর্তি শোভা পাচ্ছে। বাঁদিক থেকে প্রদক্ষিণ করলে প্রথমে মা লক্ষ্মীর মন্দির, তারপর ভোগমণ্ডি– যেখানে বদ্রিনাথজির ভোগ রন্ধন করা হয় এবং প্রভুকে ভোগ উৎসর্গ করার পরে, সেই প্রসাদি-ভোগ বিতরণ করা হয় সকল পূণ্যার্থীকে। ভোগমণ্ডির পর মন্দির কার্যালয় এবং তার পাশে সিংহাসনে উপবিষ্ট শ্বেত পাথরে নির্মিত শ্রীশঙ্করাচার্যের অতি সুন্দর মূর্তি।

আনন্দ চিত্তে বেরিয়ে এলাম মন্দির চত্বর থেকে। এবার ঘুরে ঘুরে দেখে নিলাম উলটোদিকে আলোকোজ্জ্বল দোকানগুলো। রাত ৮টার পরে একটা ছোটো হোটেলে এসে গরম রুটি-ডাল-সবজিতে ডিনার সারলাম। ভারত সেবাশ্রমে ফিরে মহারাজকে শুভরাত্রি জানিয়ে চলে এলাম নিজেদের ঘরে।

সকাল ৭টায় উঠে মুখ ধুয়ে পরিষ্কার হলাম। সাড়ে ৭টার মধ্যে তপ্তকুণ্ডের কাছে পৌঁছলাম। কুণ্ডের অবস্থান মন্দিরের সামনে কিছুটা নীচে। তপ্তকুণ্ড আসলে বেশ কয়েকটি গন্ধকপূর্ণ উষ্ণ প্রস্রবণের সমষ্টিতে তৈরি। এখানে মোট পাঁচটি কুণ্ড আছে– ঋষিগঙ্গা, কুর্মধারা, প্রহ্লাদধারা, তপ্তকুণ্ড ও নারদকুণ্ড। ওই পাঁচ কুণ্ডকে বলা হয় পঞ্চতীর্থ। তপ্তকুণ্ডের জলের উষ্ণতা বছরভর ৫৫ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেড। গরম পোশাক বন্ধুর কাছে রেখে স্নানের পোশাকে চলে এলাম কুণ্ডের পাশে। প্রথমে পা দুটি জলে ডোবাতে মনে হল তা বুঝি পুড়েই যাবে, কারণ বাইরের উষ্ণতা মাত্র ৩-৪ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেড। এরপর ধীরে ধীরে কুণ্ডের জলে সমগ্র শরীর ডোবাতে অনুভব করলাম কি আরামদায়ক এই স্নান। আমি কুণ্ড থেকে উঠে আসতেই বন্ধু গেল স্নানে, অনেকক্ষণের জন্য।

পরিষ্কার পোশাক পরিধান করে চেনা দোকান থেকে বদ্রিনাথজির পূজার ডালি সাজিয়ে নিলাম দুজনে। সকাল সাড়ে ৮টায় মন্দিরে পৌঁছোলাম। ছোটো লাইনে দাঁড়িয়ে পূজা দেওয়া সম্পন্ন হল ৯টার মধ্যেই। তারপর মন্দির কার্যালয় থেকে ‘যাত্রী ভোগ’-এর দু’টি রসিদ কেটে নিলাম। এই রসিদ না কাটলেও চলে, কারণ মন্দিরে উপস্থিত সব দর্শনার্থীকেই বিনামূল্যে ভোগ-প্রসাদ দেওয়া হয়। দোকান থেকে পূজার ডালি দুটো প্যাক করিয়ে চলে এলাম মন্দির চত্বরের বাইরে। মন্দিরের উলটো দিকে অলকনন্দার তীরে অবস্থিত এক ভালো হোটেলে গরম আলু পরোটা ও চায়ে নাস্তা সেরে নিলাম। ঘরে ফিরলাম সকাল ১০টা নাগাদ।

ঘরে বসে না থেকে চলে এলাম আশ্রমের ছাদে। সেখান থেকে পাখির চোখে দেখছিলাম ক্রমবর্দ্ধমান বদ্রিনাথ শহরকে, যা চামোলী জেলার এক নগর পঞ্চায়েত। পবিত্র বদ্রিনাথধাম নর ও নারায়ণ পর্বতদুটির মাঝে বিস্তৃত– নীলকণ্ঠ (৬৫৯৮ মিটার) শৃঙ্গের ৯ কিলোমিটার পূর্বে এবং নন্দাদেবী (৭৮১৬ মিটার) শৃঙ্গের ৬২ কিলোমিটার উত্তর-পশ্চিমে অবস্থিত। নবম শতাব্দীতে হিন্দু ধর্মের মহান সংস্কারক আদিশঙ্করাচার্য দ্বারা বদ্রিনাথ এক পুণ্য তীর্থস্থান হিসেবে পুনঃপ্রতিষ্ঠিত হয়। বদ্রিনাথ মন্দির বহুবার ভূমিকম্প ও ধস-এর কারণে ধবংসপ্রাপ্ত হয়। বর্তমান মন্দির ‘গর্ভগৃহ’, ‘দর্শন মণ্ডপ’ ও ‘সভা মণ্ডপ’ নিয়ে গঠিত। মন্দিরের স্থাপত্যশৈলী ও উজ্জ্বল রঙে বৌদ্ধবিহার-এর সঙ্গে সাদৃশ্য লক্ষ্য করা যায়। আশ্রমের ছাদ থেকে জুম করে ছবি তোলার সময়ে হঠাৎই লেন্সে ধরা পড়ল ‘চরণ পাদুকা’ যাওয়ার পথ। তখনই দুজনে মিলে ঠিক করলাম, দুপুরে মন্দিরে ভোগ খাওয়ার পর যাব সেই জায়গায়।

শহরে একটু ঘোরাঘুরি করে দুপুর ১২টা নাগাদ আবার চলে এলাম মন্দিরে। ভোগ-প্রসাদের লাইনে দাঁড়ালাম মন্দির প্রদক্ষিণ করার পর। সোয়া ১২টায় ভোগ বিতরণ শুরু হল। আমরা প্রসাদ পেলাম সাড়ে ১২টায়। মিনিট ২০ পরেই চরণ পাদুকা-র পথে হাঁটা শুরু করলাম। বদ্রিনাথ মন্দিরের পিছন দিক থেকে রাস্তা এগিয়েছে। কালী কমলীওয়ালা ভবন অতিক্রম করে কিছুটা এগিয়ে ডান দিকে চড়াই পথ গিয়েছে চরণ পাদুকা পর্যন্ত।

দূরত্ব প্রায় আড়াই কিলোমিটার। কিছুটা দূরত্ব অতিক্রম করে পেৌঁছোলাম ক্রিয়াযোগ প্রশিক্ষণ কেন্দ্রে। ছবি তুলে এগিয়ে চললাম লক্ষ্যের দিকে। চড়াই পথে আরও ৫০০ মিটার দূরত্ব পেরিয়ে পৌঁছলাম হনুমান গুফায়। সেখানে এক সন্ন্যাসী থাকেন। খাওয়ার পরই হাঁটা, তাই চড়াই ভাঙতে একটু কষ্ট হচ্ছিল। এবার চড়াই পথে প্রায় ১ কিলোমিটার হেঁটে পৌঁছলাম গুপ্তগঙ্গা গুফায়। সেখানেও বাস করেন এক সন্ন্যাসী। তাঁর কাছ থেকে জানলাম, গুহার নীচে বয়ে চলেছে এক নদী, নাম গুপ্তগঙ্গা। বারো মাসই জল থাকে সেখানে।

ধীরে ধীরে পার হচ্ছিলাম ছোটো-বড়ো বোল্ডার। চারিপাশের প্রকৃতি রুক্ষ– গাছপালা বলতে পাথরের খাঁজে খাঁজে শুধু কাঁটা-গুল্ম। আরও কিছু দূর এগোতে দেখি, পথের পাশে ছোটো, শিলানির্মিত নন্দাদেবী মন্দির। মন্দিরে প্রণাম জানিয়ে এগিয়ে গেলাম। ইতিমধ্যে আবহাওয়া খারাপ হয়েছে। প্রথমে কনকনে ঠান্ডা বাতাস, তারপরই শুরু হল তুষারপাত। হালকা বরফকণা ঝরে পড়তে লাগল আমাদের ওপর। এদিকে কয়েকশো মিটার দূরেই যে অভীষ্ট লক্ষ্য! এগিয়ে যাওয়া থামাই কী করে!

মিনিট তিনেক পরেই বন্ধ হল তুষারপাত এবং ১০ মিনিট পরেই পৌঁছলাম ১১,০৮৯ ফুট উচ্চতায় অবস্থিত চরণ পাদুকায়। সামনেই এক বিশাল প্রস্তর খণ্ড, যার উপর ভগবান বিষ্ণুর উজ্জ্বল পদচিহ্ন। কথিত আছে, প্রভু বিষ্ণু পৃথিবীতে প্রথম বার পা রাখেন এই স্থানেই। ভাগবৎ পুরাণ থেকে জানা যায়, ভগবান শ্রীকৃষ্ণ তাঁর বন্ধু তথা মন্ত্রী উদ্ধবকে বলেন, তাঁর চরণ পাদুকা-সহ বদ্রিনাথে এসে অলকনন্দাকে দর্শন করতে। অবাক হয়ে দেখছিলাম পাদুকা চিহ্ন দুটিকে– লাল সিঁদুর দিয়ে রাঙিয়ে রাখা হয়েছে। ছবি তুললাম চরণ পাদুকার। মেঘলা আবহাওয়া, তবু দেখতে পাচ্ছি গাড়োয়ালের রানি নীলকণ্ঠকে, এবং উলটোদিকে নর পর্বতকে। চরণ পাদুকার কাছে বয়ে চলেছে পবিত্র ঋষিগঙ্গা।

আমরা নামতে শুরু করলাম সাবধানে, কারণ তুষারপাতের পর পিছল পথে পদস্খলনের সম্ভাবনা থাকে। দুপুর ২ টো ৪৫ মিনিটে আমরা ফিরে এলাম বদ্রিনাথ মন্দিরের কাছে। তখনই শুরু হল দ্বিতীয় বারের তুষারপাত। প্রচণ্ড ঠান্ডায় কিছুটা পথ ছুটে এসে ঢুকে পড়লাম আমাদের চেনা চা-দোকানে। দোকানি সর্বাঙ্গে মুড়ি দিয়ে ঘুমোচ্ছিল। তাকে উঠিয়ে আমরা দোকানের অনেকটা ভিতরে গিয়ে বসলাম। দোকানি পরম যত্নে আদাসহ দুধ-চা খাওয়াল আমাদের। আশ্রমের ঘরে ফিরলাম বিকেল সাড়ে ৩টে নাগাদ।

সন্ধ্যা সাড়ে ৫টার পরে আবার পথে বার হলাম। প্রথমেই জেনে নিলাম, মানাগ্রাম যাওয়ার গাড়ি কোথা থেকে ছাড়ে। তারপর হাঁটতে হাঁটতে চলে এলাম মন্দিরে। ভিড় কম, এসে দাঁড়ালাম গর্ভগৃহের সামনে। সাড়ে ছটায় বদ্রিবিশালজির আরতি শুরু হল। আবার সেই আনন্দময় অনুভূতি! সন্ধ্যা ৭টা আরতি শেষ হল। প্রচণ্ড ঠান্ডা– দিন ১৫ পরেই বন্ধ হবে মন্দিরের দরজা। পরের ছ মাস বদ্রিনারায়ণ পূজিত হবেন যোশিমঠের শ্রীনৃসিংহ মন্দিরে।

মন্দির চত্বর থেকে চলে এলাম পথে। এক বড়ো দোকানে বসে খেলাম চা ও সিঙ্গাড়া। এরপর মন্দির সংলগ্ন দোকানগুলি ঘুরে ঘুরে দেখলাম এবং কিছু কেনাকাটাও করলাম। রাত সাড়ে ৮টা নাগাদ এসে পৌঁছলাম হোটেলে। গরম রুটি-ডাল-সবজিতে ডিনার সেরে ঘরে ফিরলাম রাত করে।

সকাল সাড়ে ছটায় বিছানার মায়া কাটিয়ে উঠে পড়লাম। ঘর থেকে বারান্দায় আসতেই দেখি অদূরেই বরফ-ঢাকা, অপরূপা নীলকণ্ঠ শৃঙ্গ সূর্যালোকে সোনালি বর্ণ ধারণ করেছে। মুখ ধুয়ে চা পান করলাম আয়েশ করে। স্নান সেরে তৈরি হতে পৌনে ৮টা বেজে গেল। ভারত সেবাশ্রম থেকে মানা গ্রাম যাবার কার স্ট্যান্ড মাত্র ৩ মিনিটের হাঁটা পথ। এই পথে শেয়ার জিপ পাওয়া যায় না। তাই মানা গ্রাম যাতায়াতের জন্য একটা গাড়ি ভাড়া করা হল ৪০০ টাকায়। গাড়িতে বসতেই ড্রাইভার জানাল, পেৌঁছোনোর পর আমাদের ২ ঘণ্টা সময় দেওয়া হবে মানা গ্রাম ঘুরে দেখার জন্য। সকাল সোয়া ৮টায় গাড়িতে চেপে যাত্রা করলাম মানা-র পথে।

বদ্রিনাথ থেকে দূরত্ব মাত্র ৩ কিলোমিটার। এই পথে কিছুটা এগোলেই ভৃগু গুম্ফা– ভৃগুমুনির তপস্যাস্থল। তারপর মাতামূর্তি মার্গ। পাহাড়ের ঢালে কিছুটা উচ্চতায় মাতামূর্তির ছোট্ট এক মন্দির। মাতামূর্তি (মাতা মুক্তি) ছিলেন নর ও নারায়ণের মা। মসৃণ রাস্তার বাঁ পাশে অনেকটা নীচে বয়ে চলেছে অলকনন্দা। মানা ভারত-চিন (তিব্বত) সীমান্তে শেষ গ্রাম। ১ কিলোমিটার অতিক্রম করতেই পথের ডান পাশে বেশ কয়েকটা মিলিটারি ক্যাম্প– ভারতের অতন্দ্র প্রহরীরা সদাই ব্যস্ত সেখানে।

গাড়ি চলেছে মধ্যম গতিতে। পথের দু’পাশেই রুক্ষ পাহাড়– সেখানে রৌদ্র-ছায়ার খেলা। অলকনন্দার ওপাড়ে পাহাড়ের কোলে সেনাবাহিনীর অফিস ও কোয়ার্টার। অলকনন্দার পুল পার হয়ে আসতে হবে মানা গ্রামে। এই স্থানেই সরস্বতী ও অলকনন্দার সঙ্গম, নাম কেশবপ্রয়াগ। মিনিট ১০ পরেই রাস্তার উপর স্বাগতবার্তা – সীমান্ত গ্রাম মানা, ইন্ডিয়াজ লাস্ট ভিলেজ। চামোলী জেলায় অবস্থিত এই গ্রামকে উত্তরাখণ্ড সরকার ‘পর্যটন গ্রাম’ আখ্যা দিয়েছে। গাড়ি এসে থামল স্ট্যান্ডে। ড্রাইভার আবার মনে করিয়ে দিল, মানা গ্রামে আমাদের জন্য বরাদ্দ ঠিক ২ ঘণ্টা।

মানা গ্রামে মহাভারতের স্মৃতি আজও বিদ্যমান। জনমানসে বিশ্বাস, পঞ্চপাণ্ডব মহাপ্রস্থানের পথে এই মানা গ্রাম হয়েই এগিয়ে যান স্বর্গারোহিনীর উদ্দেশে। দ্রৌপদী বেগবতী সরস্বতী নদী পার হতে অসমর্থ হলে মহাবলী ভীম একটি লম্বাকৃতি প্রস্তরখণ্ড নিয়ে দুই পাহাড়ের খাঁজে ফেলে তাঁর পারাপারের ব্যবস্থা করে দেন। রেলিং দিয়ে ঘেরা এই জায়গার নাম তাই ‘ভীমপোল’। এই মানা গ্রাম হল পুরাণ বর্ণিত মণিভদ্রাশ্রম– পৃথিবীর আদিগ্রাম। যে পর্বতের উপর এই গ্রাম, সেই পর্বতের নাম মারীচ। তাই, এই স্থানের আদি অধিবাসীদের বলা হয় ‘মার্চা’। সকাল ৯টা, তিব্বত সীমান্তে ভারতের শেষ গ্রামে তখনও ব্যস্ততা শুরু হয়নি। গ্রামের রাস্তা পাকা। দু’পাশেই স্থানীয় অধিবাসীদের তৈরি উলের পোশাকের দোকান– কয়েকটি সবেমাত্র খুলেছে। এক চায়ের দোকানে জিজ্ঞেস করতে স্থানীয় এক ভদ্রলোক এসে দেখিয়ে দিলেন, গণেশ গুফা যাবার পথ।

মানা গ্রামের অবস্থান সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে ৩২১৯ মিটার উচ্চতায়। জাতীয় সড়ক ৫৮-এর শেষ প্রান্তে এই গ্রাম। এখানকার অধিবাসীরা প্রধানত মার্চা, জাড ও ভোটিয়া উপজাতি। বদ্রিনাথ মন্দির বন্ধ হওয়ার পরই মানা গ্রামের সমস্ত অধিবাসী নীচে নেমে যায় অতিরিক্ত তুষারপাতের কারণে। চড়াই পথে, ঘরবাড়ির পাশ দিয়ে হেঁটে পৌঁছে গেলাম গণেশ গুফায়। কথিত আছে, গণপতি গণেশ মহর্ষি বেদব্যাসকে এইস্থানেই মহাভারতের কাহিনি বর্ণনা করেন। সুন্দর, শান্ত পরিবেশে ওই গুফা– দু’পাশে গাছপালা, পিছনে পাহাড়।

সিঁড়ি দিয়ে উঠে এসে প্রবেশ করলাম গুফায় এবং প্রণাম জানালাম গণেশজিকে। একটু এগিয়েই ব্যাস গুফা– ব্যাসদেব তাঁর পত্নী বিটিকাকে নিয়ে এখানেই থাকতেন। কথিত আছে, চতুর্বেদ রচনাকালে ব্যাসদেব এই গুফাতেই বাস করতেন। গুহার মাঝে কালো পাথরে তৈরি ব্যাসদেব-এর উপবিষ্ট মূর্তি। গুহার বাইরের দেয়ালে লাল অক্ষরে লেখা – তাঁর পবিত্র গুহা ৫৩২১ বছরের পুরোনো। ব্যাস গুফার কাছেই এক চায়ের দোকান যেখানে সাইন বোর্ডে লেখা – ভারত কী আখিরি চায় দুকান, ইন্ডিয়াজ লাস্ট টি শপ’। সেই দোকানে বসে চা খেলাম দু’জনে এবং তার ছবি তুললাম মেমেন্টো হিসেবে।

এবার আমরা এগিয়ে চললাম ভীমপুল-এর পথে। ৫-৬ মিনিট হাঁটার পর কিছুটা নীচে নেমে এসে পৌঁছলাম সেই স্থানে। দেখি, দুই পাহাড়ের মাঝ দিয়ে তীব্র বেগে নেমে আসছে সরস্বতী নদী। ভীমপুল একটি বিশাল লম্বাটে পাথর, দুই পাহাড়ের মাঝে বেগবতী সরস্বতীর উপর আড়াআড়ি ভাবে অবস্থিত। বিপরীত দিকে সরস্বতী মন্দির পাহাড়ের কোলে। বিদ্যাদেবীকে প্রণাম জানিয়ে, সিঁড়ি দিয়ে উপরে উঠে এলাম এবং ৬-৭ মিনিট হেঁটে পৌঁছে গেলাম কার স্ট্যান্ডে।

গাড়ির ড্রাইভার আমাদের অপেক্ষাতেই ছিল। আমরা গাড়িতে উঠে বসতেই সে ইঞ্জিন স্টার্ট করল। সুন্দর, সাজানো, ছোট্ট মানা গ্রাম আমাদের মুগ্ধ করেছিল। জেনেছিলাম, মানা গ্রাম আসলে ছিল গন্ধর্বদের দেশ। পুরাণ বর্ণিত স্বর্গ। নীলকণ্ঠ পর্বতের কোলে বাস করতেন উর্বশীরা– পরে তাঁরা বসুধারার পথে কুবেরের আলয়ে অলকাপুরীতে চলে যান। ভাবছিলাম, হাতে আর একদিন সময় থাকলে যেতে পারতাম ৬ কিলোমিটার দূরে বসুধারা জলপ্রপাতের স্বর্গীয় রূপ দেখতে।

এইসব ভাবতে ভাবতে দেড় কিলোমিটার অতিক্রম করে পেৌঁছে গেলাম মিলিটারি ক্যাম্পের কাছে। গাড়ি থেকে নেমে সেখানে উপস্থিত জওয়ানদের সঙ্গে করমর্দন করলাম। আমি সর্বদাই গর্ববোধ করি ভারতীয় সেনাবাহিনীর জন্য। সামনেই রাস্তার উপর বর্ডার রোড অর্গানাইজেশনের বিরাট হোর্ডিং-এ লেখা – লাস্ট ইন্ডিয়ান ভিলেজ, সীমান্ত গ্রাম মানা। আমাদের গাড়িতে জায়গা রয়েছে দেখে দু’জন সেনা অফিসার আমাদের সঙ্গে বদ্রিনাথ চলে এলেন। তাঁরা এগিয়ে গেলেন আমাদের বিদায় জানিয়ে। আমরাও গাড়ির ভাড়া মিটিয়ে ধীর পায়ে চলে এলাম বদ্রিনাথ মন্দিরে। বেলা ১১টার পরেই দর্শন হল বদ্রিনাথজির। এবার চলে এলাম ব্রহ্মকমল রেস্তোরাঁয় চা-নাস্তা সেরে নিতে। ফিরে এলাম ভারত সেবাশ্রমের নির্দিষ্ট ঘরে। দ্রুত লাগেজ গুছিয়ে নিলাম। মহারাজের সঙ্গে দেখা করে প্রণাম জানালাম তাঁকে। কথা দিলাম, আবার আসব পরিবারের সঙ্গে।

লাগেজ পিঠে নিয়ে প্রায় ১০ মিনিট হেঁটে পৌঁছলাম শহরের বাস/কার স্ট্যান্ড-এ। প্রায় ২০ মিনিট অপেক্ষা করার পর যোশিমঠ যাবার শেয়ার জিপে উঠতে পারলাম। পাঁচ মিনিট পরেই জিপ যাত্রা শুরু করল যোশিমঠের পথে। মন পড়ে রইল, পরম পবিত্র বদ্রিনাথধাম-এ। হূদয়ে উপলব্ধি করলাম, চরণ পাদুকা ও মানা গ্রাম-এর অমোঘ আকর্ষণ।

 

আরো গল্প পড়তে ক্লিক করুন...