সম্প্রতি বলিউডের একটি ছবি ‘সিক্রেট সুপারস্টার’-এ আমরা দেখেছি, বাড়িতে স্বামী-স্ত্রীয়ের মধ্যে ঝগড়ার জন্য তাদের ছেলে-মেয়েরা কতটা সাফার করছে। অবশ্য ছবির শেষে দাম্পত্য সম্পর্কের ইতি দেখানো হলেও, ওই দম্পতিরই কন্যাসন্তানটি স্বতন্ত্র পরিচয় তৈরি করে নিতে সফল হয়।
কিন্তু সকলের ভাগ্যই এমন সুপ্রসন্ন হয় না। শহরের এক নামি স্কুলের শিক্ষিকা মনীষা গোস্বামীর অস্বাভাবিক মৃত্যুর পর পুলিশ, পারিবারিক কলহের সন্দেহবশত মনীষার স্বামী সুখেন্দুকে গ্রেফতার করে। কিন্তু সুখেন্দুর মা-বাবা সুখেন্দুর দুই মেয়েকে নিয়ে কোনও আত্মীয়ের বাড়ি আত্মগোপন করে।
মনীষার ভাই, সুখেন্দুর বিরুদ্ধে লিখিত অভিযোগ জমা করে যে সুখেন্দু তার স্ত্রীকে নানাভাবে অত্যাচার করত।মণীষার ভাই জানিয়েছিল, তিনতলা থেকে ধাক্বা দিয়ে নীচে ফেলে দিয়েছিল সুখেন্দু ওর দিদিকে এবং তাতেই দিদির মৃত্যু হয়। কিন্তু সুখেন্দু বয়ান দিয়েছিল, বাপের বাড়িতে যাওয়া নিয়ে দুজনের মধ্যে কথা কাটাকাটি হয় এবং তাতেই মণীষা হঠাৎ করে উপর থেকে লাফ দেয়।
মণীষা মারা যায়। সুখেন্দুর লক-আপে স্থান হয়। পুলিশ নিজের মতো করে কেস গুছোতে আরম্ভ করে। এই কেস কতদিন চলবে ঠিক নেই। হয়তো আদালতে তারিখ বদলাতেই থাকবে। কিন্তু মণীষা আর সুখেন্দুর বাচ্চাদের কী হবে এটা কি কারও মনে হয়েছে? এই ক্ষেত্রে আইনও নিশ্চুপ। বাচ্চাদের একজনের বয়স দু’বছর আর ছোটোটার বয়স দশ মাস। ঠাকুমা, ঠাকুরদা কতদিন ওদের দেখাশোনা করতে পারবে? পড়াশোনারই বা কী হবে? এই ধরনের অনেক প্রশ্নই রয়েছে, যার উত্তর না সমাজের কাছে আছে, আর না আইনের মোটা মোটা বইতে লেখা আছে।
মনোবৈজ্ঞানিক ডা. সরকারের কাছে প্রশ্ন রাখা হলে তিনি জানালেন এই সমস্যা এখন প্রায় এপিডেমিকের পর্যায় চলে গেছে। কোর্টে এই ধরনের কত যে কেস চলছে তার ঠিক মতো পরিসংখ্যান কারও কাছেই নেই। তাঁর নিজের কাছেও এরকম বহু দম্পতি আসেন নিজেদের এবং বাচ্চাদের কাউন্সেলিং করাতে।
একটি উদাহরণ দিলেন। স্বামী-স্ত্রী তাদের দুই সন্তানকে নিয়ে এসেছিলেন কাউন্সেলিং-এর প্রয়োজনে। বড়ো দুজনের সঙ্গে কথা বলার পর বাচ্চাদের জিজ্ঞেস করা হয় মা-বাবার মধ্যে কে বেশি ঝগড়া করে? দুজনেই উত্তর না দিয়ে শুধু মা-বাবার মুখের দিকে তাকিয়ে চুপচাপ বসে থাকে।
দুজনকে আলাদা অন্য একটা ঘরে নিয়ে যাওয়া হলে, ৬ বছরের বাচ্চাটি জানায়, মা-বাবা সবসময় অশান্তি করতে থাকে। বিবাদের পর দুজনেই আলাদা করে বাচ্চাদের জিজ্ঞেস করে কে বেশি ঝগড়া করে, মা না বাবা? ঝগড়া কে শুরু করেছিল ইত্যাদি ইত্যাদি। এই প্রশ্নের কোনও উত্তর বাচ্চারা দিতে পারে না। ঝগড়া করার পর দুজনেই গিয়ে শুয়ে পড়ে। দুটি বাচ্চাকেই ব্রেড বা বিস্কুট খেয়ে রাত্রে শুয়ে পড়তে হয়। কখনও কখনও ৬-৭ দিন পর্যন্ত মা-বাবার মধ্যে কথাবার্তা হয় না। ওই সময় বাচ্চাদের স্কুলেও পাঠানো হয় না এমনকী ওদের মা ঠিক করে রান্নাবান্নাও করে না তখন।
মনোবিদদের মতে মা-বাবাকেই আইডিয়াল মনে করে প্রত্যেক সন্তান। সুতরাং মা-বাবার মধ্যে ঝগড়া হলে বাচ্চাদের মনের সিংহাসন থেকে মা-বাবার স্থান অনেক নীচে নেমে আসে। এতে বাচ্চারা মানসিক আঘাত পায়। বাচ্চা কষ্টটার কথা কাউকে বলতে পারে না, মনে মনে গুমরোতে থাকে। ফলে বাচ্চার মানসিক এবং শারীরিক বিকাশ বাধাপ্রাপ্ত হয়। যে বাড়িতে অভিভাবকেরা নিজেদের মধ্যে ঝগড়া বেশি করে, বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই সেই বাড়ির বাচ্চারা মানসিক বিকারের অথবা ডিপ্রেশনের শিকার হয়। কখনও আবার বাচ্চাদের মধ্যে অসম্ভব রাগ দেখা যায় আবার কেউ কেউ অপরাধ জগতেও পা রাখে।
বাচ্চার মনে কনফিউশন জন্মায় মা-বাবার ঝগড়ার ফলে
মা-বাবার মধ্যে ঝগড়া হলে, তার সরাসরি প্রভাব পড়ে বাচ্চার উপর। ক্ষতি হয় বাচ্চারই বেশি। স্বামী-স্ত্রী নিজেদের মধ্যে ঝগড়া করে বাচ্চার চোখে নিজেকে ঠিক প্রমাণ করার জন্য, একে অপরের বিরুদ্ধে বাচ্চার মনে বিষ ঢালতে শুরু করে। লড়াই করার পর মা বাচ্চাকে বোঝায়, বাবাই আসলে দোষী, সবসময় ঝগড়া করে। বাবার সঙ্গে খবরদার যেন সে কথা না বলে, তাহলে বাবা রাগের মাথায় তাকেও মারধর করতে পারে। বাবা আবার সন্তানকে বোঝায় পুরো ঝগড়াটার জন্য বাচ্চার মা প্রথম থেকেই দায়ী। ‘মা’ মানুষটা খুব খারাপ। দুই পক্ষের কথা শুনে বাচ্চার মনে কনফিউশন তৈরি হয়। যাদের সে এতদিন পৃথিবীর সবথেকে ভালো মা-বাবা জেনে এসেছে, সেই দুজন মানুষই কী করে একে অপরের নিন্দে করছে সেটা শিশুমন ভেবে পায় না।
মা-বাবার ডিভোর্সের পর কঠিন পরীক্ষার সম্মুখীন
ডিভোর্সের পর ওই দম্পতির সন্তানরাই সবথেকে বেশি কঠিন পরীক্ষার সম্মুখীন হয়। ডিভোর্সের কেস চলাকালীন মা-বাবা সন্তানদের নিজের নিজের কাছে রাখার জেদ ধরে বসেন। সম্প্রতি এমনই ঘটনা খবরের কাগজেও চোখে পড়েছে। মা-বাবা দুজনেই ডাক্তার। তাদের একমাত্র শিশুকন্যা হাসপাতালে ভর্তি অথচ তাদের নিজস্ব সমস্যা এবং ইগোর কারণে বাচ্চার চিকিৎসার পদ্ধতি নিয়ে টানাপোড়েনের ঘটনায় শেষমেশ বাচ্চাটির মৃত্যু হয়। আদালতে এমনই বহু কেস চলাকালীন মা-বাবা দুজনেই দাবি করেন বাচ্চা তাদের কাছে থাকলে বেশি ভালো থাকবে অপরজন বাচ্চাকে ভালোভাবে রাখতে পারবে না। কখনও আদালত, নির্ধারিত মেয়াদ ঠিক করে দেয় বাচ্চাকে রাখার। যেমন মায়ের কাছে একমাস থাকবে আবার বাবার কাছেও একমাস থাকবে বাচ্চা। এর ফলে মা-বাবার সঙ্গে দেখা তো হয় শিশুটির কিন্তু মা-বাবার সত্যিকারের স্নেহ কি সে আদৌ পায়? মা নিজেকে ভালো প্রমাণ করতে গিয়ে বাচ্চাকে নতুন নতুন খেলনা, কাপড়জামা হয়তো কিনে দেয়। এদিকে বাবা তার থেকেও দামি জিনিসপত্র কিনে দিয়ে প্রমাণ করতে চায়, তার থেকে ভালো বাবা আর হয় না। ইগো-র বশবর্তী হয়ে দুজনেই বুঝতে পারে না যে বাচ্চার আসল আনন্দ হল দু’জনকে একসঙ্গে পাওয়া। মা-বাবা একসঙ্গে থাকলেই বাচ্চা খুশি। আলাদা আলাদা ভাবে মা-বাবার সঙ্গে দেখা করে, দামি উপহার পেয়েও বাচ্চার সরল মন কিছুতেই আনন্দ লাভ করতে পারে না।
পারিবারিক বিবাদের মুখে অসহায় শিশুরা
শুধু মা-বাবার ঝগড়াই নয়, বাড়িতে বড়োদের মধ্যে ঝগড়া হওয়ার কারণেও বাচ্চারাই সব থেকে বেশি কষ্ট পায়। বাড়িতে বাবা-কাকা-জেঠুর মধ্যে হঠাৎ কেন ঝগড়া হচ্ছে, বাড়িতে পুলিশ আসছে, সকলে কোর্ট-কাছারি ছুটছে এইসব দেখে বাচ্চাও বিভ্রান্ত হয়ে পড়ে। অথচ এদেরকেই হয়তো একসঙ্গে উঠতে বসতে দেখেছে বাড়ির বাচ্চারা। বাচ্চার শিশুমন বুঝে উঠতে পারে না কী কারণে হঠাৎ বাড়ির সকলে একে অপরের শত্রু হয়ে উঠেছে।
শহরের এক নামকরা উকিল বিষয়টি বিশ্লেষণ করতে গিয়ে উদাহরণ হিসেবে নিজের একটি কেসের কথা জানালেন। একটি পরিবারের চার ভাইয়ের মধ্যে শুরু হয় সম্পত্তি নিয়ে ঝগড়া ঝামেলা। ব্যাপারটা পুলিশ অবধি গড়ায়। চারজনের মধ্যে এক ভাই অপর ভাইদের বিরুদ্ধে, তাদের বউদের বিরুদ্ধে এমনকী সেই ভাইদের বাচ্চাদের বিরদ্ধেও থানায় এফআইআর লজ করে। বাচ্চাদের মধ্যে একটি দশ বছরের ছেলেও ছিল যার বিরুদ্ধে মারধর করার আরোপ দেওয়া হয়। কেসটি আদালতে ৮ বছর পর্যন্ত চলেছিল। সেই ১০ বছরের বাচ্চা আজ ২৪ বছরের যুবক। কিন্তু ছেলেটির মনে আজও কাকার উপর বিদ্বেষ এতটুকুও কমেনি।
এই কেসটি থেকে পরিষ্কার হয়ে যায় কেসকাছারি ঝগড়া করে বড়োরা পরে নিজের নিজের কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়ে কিন্তু শিশুদের মনে এই ঝগড়া-বিবাদ, ক্ষতিকর ছাপ ফেলে যায়। যার ফলে মনের মধ্যে রাগ পুষে রেখেই এরা বড়ো হয়ে ওঠে।
শিশুমনে জেল আদালত ইত্যাদির ছায়া
মা-বাবার ডিভোর্স চলাকালীন অথবা কোনও অপরাধের দরুন যদি হাজতবাস হয় কোনও অভিভাবকের, তাহলে তাদের সন্তানই ক্ষতিগ্রস্ত বেশি হয়। মা-বাবার হাত ধরে যদি আদালত চত্বরে যেতে হয় বাচ্চাকে, সেখানে কাঠগড়ায় মা-বাবাকে উঠতে দেখলে শিশুমনে সাংঘাতিক প্রভাব পড়ে। এছাড়াও হাতকড়া পরিয়ে যদি মা কিংবা বাবাকে পুলিশের সঙ্গে যেতে দেখে কোনও শিশু, তাহলেও সারা জীবনের মতো ওই দৃশ্য সে মন থেকে মুছে ফেলতে পারে না। মনে প্রশ্ন তার থেকেই যায় যে, কী দোষে তার প্রিয় মানুষটাকে হাতকড়া পরিয়ে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে? সে বাড়িতে কবে ফিরবে? জেলে কেন তাকে রাখা হচ্ছে?
বাচ্চাদের উপর কুপ্রভাব
১) বাচ্চারা চুপচাপ হয়ে যায়। কারও সঙ্গে মেলামেশা করতে চায় না
২) ঘুমের ব্যাঘাত ঘটে। স্বপ্নে মা-বাবার ঝগড়ার দৃশ্যই বারবার উঠে আসে
৩) অনেক বাচ্চা ড্রাগের শিকার হয়ে পড়ে
৪) ঝগড়াটে, বদমেজাজি এবং খিটখিটে হয়ে পড়ে
৫) অপরাধের জগতেও ঢুকে পড়ার প্রবণতা দেখা যায়
৬) পড়াশোনা বন্ধ হয়ে যাওয়ার উপক্রম হয়
৭) ডিপ্রেশনের শিকার হতে পারে বাচ্চা
৮) বাচ্চার মানসিক এবং শারীরিক বৃদ্ধি রোধ হতে পারে