ওয়ার্ল্ড হেলথ অর্গানাইজেশন-এর মতানুযায়ী, টেলিমেডিসিন হল এমন একটি পদ্ধতি, যেখানে চিকিৎসার ব্যবস্থা করা যায় প্রযোজনে। আর সেই সকল তথ্যের আদান-প্রদান করা, যার দ্বারা রোগ নির্ণয়, রোগীর চিকিৎসা ইত্যাদি সবকিছুর পদ্ধতি নিয়ে আলোচনা করা, এছাড়াও, বিভিন্ন পরীক্ষক এবং স্বাস্থ্য কর্মীদের মূল্যায়ন এবং শিক্ষা প্রদানের ব্যবস্থা করা। এই পদ্ধতির অন্যতম লক্ষ্য হল প্রত্যেকের জন্য চিকিৎসার ব্যবস্থা করা।
ভারতে টেলিমেডিসিন পদ্ধতির শর্তানুযায়ী, একজন কর্মরত চিকিৎসক তখনই এই পদ্ধতির ব্যবহার করতে পারবেন, যখন তিনি যথেষ্ট দক্ষ হবেন এই সিদ্ধান্ত গ্রহণ করার জন্য যে, রোগীকে সামনাসামনি পরিদর্শন জরুরি নাকি অনলাইনে পরামর্শদান যথেষ্ট। চিকিৎসককে অবশ্যই খেয়াল রাখতে হবে, যেন তার চিকিৎসায় কোনওরকম খামতি না থাকে।
স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ দফতরের পক্ষ থেকে, ২০২০ সালের ২৫ মার্চ টেলিমেডিসিন পদ্ধতি অনুশীলন করার বিভিন্ন নিয়মাবলী, ২০২০ প্রকাশ করা হয়েছে। যা ইন্ডিয়ান মেডিকেল কাউন্সিল অ্যাক্ট, ১৯৫৬-র অধীনে প্রযোজ্য। তবে, এই নিয়মাবলীর অধীন থেকে বর্জিত থাকবে ইন্ডিয়ান মেডিকেল কাউন্সিল। যাইহোক, টেলিমেডিসিনের উদ্দেশ্য হল সকলের চিকিৎসার প্রয়োজন মেটানো। উপরোক্ত নিয়মাবলী প্রযোজ্য হবে রেজিস্টার্ড মেডিকেল প্র্যাক্টিশনার (RMP)-দের উপর, ১৯৫৬-এর আইন অনুযায়ী। উল্লিখিত নিয়মাবলী অনুযায়ী কর্মরত চিকিৎসক টেলিমেডিসিন পদ্ধতির মাধ্যমে রোগীদের চিকিৎসা করতে পারবেন। টেলিমেডিসিন পদ্ধতিতে রোগীদের কাছে শব্দ, কথা, লেখনী বা ডিজিটাল যে-কোনও উপায়ে তথ্য পাঠানো সম্ভব।
টেলিমেডিসিন পদ্ধতি চালনার জন্য সাতটি অতি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়কে লক্ষ্য রাখা জরুরি। যেমন যার সাহায্য নেবেন তিনি আরএমপি অর্থাৎ রেজিস্টার্ড প্র্যাক্টিশনার কিনা, সঠিক ভাবে রোগ নির্ণয়, যোগাযোগের সঠিক মাধ্যম, প্রশ্নোত্তর পর্ব, সঠিক পরামর্শদান, রোগীর মূল্যায়ন এবং উপযুক্ত চিকিৎসা দিতে সক্ষম কিনা।
একজন আরএমপি, টেলিমেডিসিন পদ্ধতিতে পরামর্শ প্রদানের জন্য যে-কোনও রকমের মাধ্যম অর্থাৎ টেলিফোন, ভিডিও, কম্পিউটার, ইন্টারনেট, মোবাইল, বিভিন্ন চ্যাটিং অ্যাপ্লিকেশন যথা হোয়াটসঅ্যাপ, ফেসবুক, মেসেঞ্জার ইত্যাদির ব্যবহার করতে পারেন। এছাড়াও, টেলিমেডিসিন পদ্ধতিতে তথ্যপ্রদানের জন্য ইমেল, স্কাইপ, ফ্যাক্স ইত্যাদি অ্যাপ্লিকেশনও ব্যবহার করা যেতে পারে।
টেলিমেডিসিন পদ্ধতি, যোগাযোগের মাধ্যম অনুযায়ী বা তথ্যজ্ঞাপনের সময় অনুসারে, চিকিৎসক-রোগী অথবা চিকিৎসক-স্বাস্থ্যকর্মী বা এক চিকিৎসকের সঙ্গে অন্য চিকিৎসকের পরামর্শদান অনুসারে মোট চার প্রকারের হয়ে থাকে। এদের মধ্যে ভিডিও, অডিও এবং টেক্সট (চ্যাট, ইমেল, মেসেজ, ফ্যাক্স ইত্যাদি) অন্যতম। এই সকল প্রযুক্তির প্রত্যেকটির নিজস্ব সুবিধা, অসুবিধা এবং গ্রহণযোগ্যতা আছে। যার জন্য অনেক সময়ই নির্দিষ্ট ক্ষেত্রে চিকিৎসা সংক্রান্ত পরামর্শদান পর্যাপ্ত এবং অপর্যাপ্ত উভয়ই হতে পারে। সেইজন্য প্রত্যেক ক্ষেত্রেই এই সকল প্রযুক্তির উপকারিতা এবং সীমাবদ্ধতা সম্পর্কে অবগত থাকা উচিত। যদিও টেলিমেডিসিনের মাধ্যমে পরামর্শদান আরএমপি-দের বিভিন্ন সংক্রামক অবস্থার থেকে রক্ষা করতে পারে, তবুও এটি কখনই শারীরিক উপস্থিতির দ্বারা পরীক্ষার মাধ্যমে চিকিৎসার পদ্ধতির মতো সুফলদায়ক নয়। যেখানে স্পর্শ এবং অনুভব করা অত্যাবশ্যক, সেখানে এই নতুন প্রযুক্তি খুব একটা কার্যকরী নয়।
টেলিমেডিসিনের ভিডিও প্রণালী যেমন বিভিন্ন অ্যাপ্লিকেশনে ভিডিও চ্যাট, ফেসটাইম ইত্যাদি রোগীকে পরামর্শদানের জন্য সবচেয়ে কার্যকরী উপায়। তবে, এই পদ্ধতির থেকে সম্মুখে রোগীকে পরীক্ষা করে পরামর্শ দেওয়া আরএমপি-দের জন্য বেশি সহজতর। ভিডিও প্রণালীর ক্ষেত্রে সবচেয়ে বড়ো সীমাবদ্ধতা হল উভয়পক্ষের ইন্টারনেট সংযোগ ব্যবস্থা। এছাড়াও, ভিডিও প্রণালীতে রোগীর গোপনীয়তা বজায় রাখা একটি অতি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়।
ফোনে অডিও প্রণালী অর্থাৎ, ভিওআইপি, বিভিন্ন অ্যাপ্লিকেশনের দ্বারা পরামর্শদান যদিও অতি সহজলভ্য এবং কিছুক্ষেত্রে উপযুক্ত, তবুও, ত্বক, চোখ, জিভ ইত্যাদির পরীক্ষার ক্ষেত্রে এই পদ্ধতি অনুপযুক্ত।
টেক্সট-প্রযুক্তি ব্যবস্থা বলতে বোঝায় বিশেষত চ্যাট সংক্রান্ত ব্যবস্থা। স্মার্টফোনে অথবা কোনও ইলেকট্রনিক্স ডিভাইসের বিভিন্ন অ্যাপ্লিকেশন যেমন হোয়াটসঅ্যাপ, গুগল হ্যাংআউটস, ফেসবুক, মেসেঞ্জার অথবা এসএমএস ইত্যাদির মাধ্যমে সুবিধাজনক ভাবে এবং খুব কম সময়ে মধ্যে পরামর্শদান সম্ভব। তবে সনাক্তকরণ এবং ডকুমেন্টেশন এই প্রণালীর একটি অবিচ্ছেদ্য অংশ। কোনও জরুরি অবস্থায় তৎক্ষণাৎ পরামর্শপ্রদান এই পদ্ধতির মাধ্যমে করা সম্ভব। চাক্ষুষ পরিদর্শন এবং শারীরিক স্পর্শ ছাড়াও এই প্রণালীর আরেকটি বড়ো সীমাবদ্ধতা হল মৌখিক সংকেতের অনুপস্থিতি। যার ফলে রোগীর সঙ্গে চিকিৎসকের সুসম্পর্ক গড়ে উঠতে অনেকাংশেই বাধা পেতে পারে।
ASYNCHRO-NOUS প্রণালীর অর্থাৎ ইমেইল, ফ্যাক্স ইত্যাদির সবচেয়ে বড়ো সুবিধা হল কোনও বিশেষ নির্দিষ্ট অ্যাপ্লিকেশন ছাড়াই সহজলভ্য। ছবি, রিপোর্ট, তথ্য ইত্যাদিও সহজেই ডাউনলোড এবং শেয়ার করা সম্ভব। কোনও দ্বিতীয় পরামর্শ গ্রহণের ক্ষেত্রে এই প্রণালী বেশ উপযোগী। কিন্তু এই প্রণালীর সীমাবদ্ধতা হল এই প্রণালীতে রোগের সনাক্তকরণ শুধুমাত্র ডকুমেন্টের উপর নির্ভর করেই করতে হয়।
টেলিমেডিসিনের সুবিধাগুলির মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ হল— কম খরচে রোগীরা চিকিৎসা ব্যবস্থা দ্রুত এবং সহজেই গ্রহণ করতে পারে। স্বাস্থ্যকর্মীদের কাছে এই পদ্ধতির সুবিধা হল— বিশেষ ঝামেলা ব্যতীত বাড়তি আয় সম্ভব এবং রোগ ছড়ানোর ভয়ও কম থাকে।