দেবযানী তাকাল শ্বেতকেতুর দিকে। বুঝতে পারল বাচ্চাদের সঙ্গে একজোট হয়ে ইচ্ছে করেই ওরা পেছনে লাগছে দেবযানীর। মায়ের হাত থেকে মোবাইলটা নিতে নিতে ছোটো ছেলে ঋক্ বলল, ‘মোবাইলটা আমাকে দাও তো, আমিই দিদাকে বলে দিচ্ছি তুমি, মামার বিয়েতে আসতে পারবে না। দিদা জিজ্ঞেস করলে বলব তুমি ভীষ্মের প্রতিজ্ঞা নিয়েছ যে তুমি আমাদের সঙ্গে কোথাও যাবে না।’

ঋকের কথা শেষ হতেই শ্বেতকেতু, ছেলের হাত থেকে মোবাইলটা নিতে নিতে বলল, ‘আরে আমি থাকতে তুই দিদাকে কথাটা বলবি সেটা ভালো দেখায় না। তার চেয়ে বরং আমিই তোর দিদাকে ভালো করে বুঝিয়ে বলে দিই যে, তোর মামার বিয়েতে উনি একাই সবদিক সামলান কারণ তাঁর আদরের মেয়ে কোথাও না-যাওয়ার প্রতিজ্ঞা করে বসে আছে।’

মায়ের ফোনটা পেয়ে দেবযানীর রাগ একটু কম হয়েছিল ঠিকই, কিন্তু শ্বেতকেতুদের হাসিঠাট্টায় ওর মাথাটা আবার গরম হয়ে উঠল।

সবেমাত্র সিমলা, কুলু-মানালি বেড়িয়ে এসে ওরা সবাই একঘণ্টা হল বাড়ি ঢুকেছে। বাড়িতে ঢুকেই ওদের দৌরাত্ম্য শুরু। দু’দিনের ট্রেনের ধকল সয়ে তখনও গায়ের ব্যথাও মরেনি দেবযানীর, জিনিসপত্র চারিদিকে ছড়িয়ে রেখে শ্বেতকেতু আর বাচ্চারা টিভি চালিয়ে বসে পড়েছে সোফায়।

আর শুধু বসা হলেও একরকম, জুতোগুলো দরজার মুখেই ডাঁই হয়ে পড়ে রইল। কেউ গুছিয়ে তুলে রাখার কোনও চেষ্টা করল না। উপরন্তু শ্বেতকেতুর গলা ভেসে এল, ‘দেবযানী প্লিজ এক কাপ ভালো করে চা করো তো। হোটেলের ওই বিচ্ছিরি চা খেয়ে খেয়ে মুখটা একদম মরে গেছে।’

‘মা, বাবার চা যখন করছই আমাদেরও একটু ম্যাগি বানিয়ে দাও না প্লিজ। কতদিন ম্যাগি খাইনি। ওখানে রাস্তায় ম্যাগি তৈরি করছিল, তোমরাই তো খেতে দিলে না। বলেছিলে বাড়িতে এসে বানিয়ে দেবে। মা, প্লিজ ভীষণ খিদে পেয়েছে,’ বড়ো ছেলে গৌরব নিজের ইচ্ছে প্রকাশ করল।

‘মা, আমি ম্যাগি খাব না। আমাকে ব্রেড আর অমলেট করে দাও,’ ঋক্-ও চেঁচিয়ে জানান দিতে দ্বিধা করল না।

ওদের অর্ডারগুলো সবই দেবযানীর কানে ঢুকল কিন্তু ওর মন পড়েছিল বাড়ির পড়ে থাকা অন্যান্য কাজের উপর। বারান্দায় সারা সপ্তাহের খবরের কাগজ ডাঁই হয়ে পড়ে আছে। কাগজের লোকটা ভালো করেই জানত, ওরা ১০-১২ দিনের জন্য থাকবে না। দেবযানী নিজে ওকে জানিয়েছিল আর ওই কয়েকদিন কাগজ দিতেও বারণ করেছিল। তবু লোকটা কাগজ দিয়ে গেছে। ওগুলো তুলে কাগজ রাখার জায়গায় গুছিয়ে রাখার দরকার। দু’দিকের বারান্দায় অনেক গাছ লাগিয়েছিল দেবযানী টব্ কিনে কিনে। গাছগুলোও জলের অভাবে মৃতপ্রায় হয়ে এসেছে, ওগুলোতেও জল দিতে হবে। মেঝেতে ধুলো পড়ে সাদা হয়ে আছে। তারই মধ্যে আসতে যেতে পায়ের ছাপ পড়ছে। কাজের মেয়েটা বিকেলে আসবে বলেছে, কিন্তু তার আগে একবার ঘরগুলো ঝাড়ু না দিলে নিজেরই অস্বস্তি হচ্ছে দেবযানীর।

হঠাৎ-ই মনে পড়ল দেবযানীর, বিছানার চাদরগুলো তুলে ফেলতে হবে। ধুলোতে সব ভরে আছে। বাচ্চারা একবার বিছানায় উঠে বসলে ওদের নড়িয়ে চাদর পালটানো প্রায় অসম্ভব। আর তাছাড়া গৌরবটার আবার অ্যালার্জির ধাত আছে।

তারপর এতদিন সমানে বাইরের খাবার খাওয়া হয়েছে। আজ আর বাইরের খাবার আনলেও কেউ খেতে চাইবে না। সুতরাং বাড়িতেই কিছু না কিছু বানাতেই হবে।

দুই-চারদিনের জন্য বাড়ি ছেড়ে কোথাও গেলেই দেবযানীর বাড়ি ফিরেই মেজাজ বিগড়ে যায়। বাড়ি ফিরতেই কাজের পাহাড়। তখন মনে হয় কেন যে বেড়াতে যাওয়া? শ্বেতকেতু আর বাচ্চারা তো জিনিসপত্র বাড়িতে ঢুকিয়ে দিয়েই কর্তব্যের ইতি করে। আর কোনও কাজে ওদের আর পাওয়া যায় না। বাড়ির সমস্ত কাজ করতে হয় দেবযানীকেই।

শ্বেতকেতু আর বাচ্চারা দেবযানীকে কাজের ফরমায়েশ করে টিভির সামনে গ্যাঁট হয়ে বসে রইল। রান্নাঘরে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেবযানী ভাবতে লাগল কোথা থেকে কাজ আরম্ভ করবে।

ও ভালো করেই জানত, স্বামীর এবং বাচ্চাদের ফরমায়েশ না মেটানো পর্যন্ত ওকে শান্তিতে কেউ কাজ করতে দেবে না, চ্যাঁচাতেই থাকবে। ট্রেন থেকে নেমে বাড়িতে ফিরে স্নান না করা পর্যন্ত দেবযানীর শান্তি হয় না। কিন্তু এত কাজ পড়ে আছে ভেবে স্নানের ইচ্ছে ত্যাগ করে ফটাফট চা চড়িয়ে দিল আর অন্য গ্যাসে ম্যাগি করতে লেগে গেল। টোস্টারে ছেলের জন্য ব্রেড সেঁকতে দিল। ম্যাগি নামিয়ে অমলেট ভেজে নিয়ে সবশেষে দুটো কাপে চা ঢেলে ট্রে-তে সাজিয়ে বসবার ঘরে এসে ঢুকল। সোফার গায়ে ক্লান্ত পিঠ-টা এলিয়ে দিয়ে বসল। ট্রে-টাও উঠে ওর হাত থেকে কেউ নেওয়ার চেষ্টা করল না। অথচ টেবিলে রাখতেই তিনজন ঝাঁপিয়ে পড়ল চা আর খাবারের উপর।

পথের ক্লান্তি দূর করতে সকলের সঙ্গে বসে দেবযানীও চায়ের কাপে চুমুক লাগাল। টিভির পর্দায় চোখ রেখে চা খেতে খেতে ওর চোখ বুঁজে আসছিল ক্লান্তিতে। ঘুমোলে চলবে না, এই ভেবে কোমরে শাড়ির আঁচল গুঁজে উঠে দাঁড়াল। স্নান করে নোংরা জামাকাপড় ছেড়ে ফেলার হুকুম জারি করে চা আর খাবারের প্লেটগুলো উঠিয়ে নিয়ে ঘর ছেড়ে রান্নাঘরের দিকে পা বাড়াল দেবযানী।

ঘরদোর ঝাড়াঝুড়ি পরিষ্কার করে, বিছানার নোংরা চাদরগুলো মেশিনে কাচতে গিয়ে খেয়াল করল, ওপরে ট্যাংকের জলটা চেক করা হয়নি। এখুনি কাউকে উপরে পাঠানো দরকার। কলে হঠাৎ করে জল চলে গেলে অসুবিধায় পড়তে হবে।

দেবযানী হাঁক দিল, ‘ঋক্, একবার উপরের ট্যাংকটা গিয়ে দেখে আয় তো জল আছে কিনা। নয়তো পাম্পটা চালাতে হবে।’

‘মা, আমি শুয়ে পড়েছি। দাদাকে বলো দেখে আসতে।’

ঋকের উত্তর শুনেই দেবযানীর মাথাটা গরম হয়ে গেল। গৌরব বোধহয় ঋকের উত্তরটা শুনতে পেয়েছিল। দৌড়ে মায়ের কাছে এসে জিজ্ঞেস করল, ‘কী করতে হবে?’

‘একবার উপরের জলের ট্যাংকটা দেখে আয় তো, জল আছে কিনা?’

‘আচ্ছা মা, এক্ষুণি দেখে আসছি।’

‘বাবাঃ যাক। কারও তো আমার উপর দয়া হল।’

মেশিনে সাবান দিয়ে জল ভরতে ভরতেই গৌরব নীচে নেমে এল, ‘মা জলের ট্যাংক ভর্তি রয়েছে। এবার আমি শুতে যাচ্ছি। একঘণ্টার আগে আমাকে আর ডাকবে না। ততক্ষণে নিশ্চয়ই তোমার দুপুরের খাবার বানানো হয়ে যাবে।’ বলে ও শোবার ঘরের দিকে পা বাড়াল। দেবযানী ভালো করেই জানে খাটে শুয়ে গৌরব দুই চোখের পাতা এক করবে না। শুয়ে শুয়ে মোবাইলে গেম খেলতে ব্যস্ত হয়ে পড়বে।

দেবযানীর রাগ হল। ওর একার উপর সারা বাড়ির কাজের দায়িত্ব অথচ দ্যাখো বাকি তিনজন মানুষ কীরকম নির্লিপ্ত। লজ্জার মাথা খেয়েও কেউ সাহায্যের হাত বাড়াতে এগিয়ে আসে না।

বাইরে যাওয়ার কথা উঠলেই তিনজন বসে যাবে প্ল্যানিং নিয়ে। ব্যস ওই অবধি। যাওয়ার আগেও সব গোছগাছ করার দায়িত্ব যেমন দেবযানীর, বাড়ি ফিরে আসার পরেও ছড়িয়ে থাকা কাজের ভার সবই দেবযানীকে নিজের ঘাড়ে তুলে নিতে হয়।

দেবযানীর মনে হল, নাঃ অনেক হল। আর এভাবে সবকিছু মেনে নেওয়া যায় না। সবাই ওর ভালোমানুষির সুযোগ নিচ্ছে। অথচ ও ভালো রইল কিনা সেটা জানার কারও কোনও আগ্রহ নেই। এটা হাই টাইম যে ওদের এই ভুল শুধরে দেবার দরকার। বাড়ির প্রতিও যে ওদের একটা দায়িত্ব আছে সেটাও ওদের মনে করিয়ে দেওয়া দরকার। ভাবতে ভাবতে দেবযানী পড়ে থাকা কাজে হাত লাগাল।

ঘরদোর মোটামুটি পরিষ্কার করে স্নান সেরে ভাতের মধ্যে ডিম, কাপড়ের পুঁটুলি মোড়া ডাল দিয়ে সেদ্ধ করে নিল। হাঁক পাড়ল টেবিলে সকলকে খেতে আসার জন্য। সকলে এসে বসলে দেবযানী খাবার পরিবেশন করতে করতে বলা শুরু করল, ‘লম্বা জার্নি করে আমরা চারজনেই এসেছি অথচ তোমরা তিনজন বিশ্রাম নিয়ে এখন খেতে বসেছ। আর আমার ক্ষেত্রে অন্য নিয়ম কেন? আমিও তো তোমাদের মতোই মানুষ তাই আমিও নিশ্চয়ই ক্লান্ত হই। অথচ তোমাদের মনে হয় বিশ্রাম নেওয়ার অধিকার কেবল আমারই নেই।’

‘কেন? তুমিও বিশ্রাম নাও, কে মানা করেছে?’ শ্বেতকেতু দেবযানীকে থামিয়ে বলে ওঠে।

‘তোমরা ঘরদোর নোংরা থাকলে মেনে নেবে তো? দুপুরে টেবিলে গরম গরম খাবার না পেলেও চলবে তো? তোমাদের ধারণাটাই এটা হয়ে গেছে যে, যা কাজ ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে সেটা বাড়িই হোক আর বাইরেই হোক সেটার দায়িত্ব পুরোটাই আমাকে নিতে হবে। তাই আমি ঠিক করেছি তোমাদের সঙ্গে আমি আর কোথাও বাইরে যাব না। তিনজনে মিলে যখন বাইরে যাওয়ার প্রোগ্রাম বানাও তখন আমাকে তোমাদের মনে পড়ে না। অথচ যাওয়ার আগে সব গুছিয়ে নিয়ে যাওয়া থেকে শুরু করে এসে সব গোছগাছ করে তোলা, সবই আমার ঘাড়ে ফেলে দাও। এমনকী জামাকাপড় গুছিয়ে যখন সুটকেসে ভরি তোমরা কেউ সামনে দাঁড়াও না পর্যন্ত। কিন্তু বাইরে গিয়েই এটা আনোনি কেন, ওটা ভরোনি কেন ইত্যাদি নিয়ে আমার উপর চ্যাঁচাতে তোমাদের এতটুকুও বিবেকে বাধে না।’

গৌরব বলে উঠল, ‘আচ্ছা মা, আমরা সরি। আর কখনও এরকম হবে না।’

‘থাম তোরা। বাড়িতে ফেরার পরেও তোরা কিছুই করিস না। কত কাজ পড়ে থাকে বাড়িতে। একটু যদি সকলে মিলে করে নেওয়া হয় তাহলে কারও ওপর সেটা বোঝা হয়ে ওঠে না। তোদের সবার বিশ্রাম চাই, এসি চালিয়ে গা এলিয়ে টিভি দেখা চাই আর আমার কি এসবের কোনও প্রয়োজন নেই?’

দেবযানীর কথা শুনে তিনজনেই তাড়াতাড়ি খাওয়া শেষ করে উঠে দাঁড়াল। খাবারের প্লেট উঠিয়ে মাজার জায়গায় রেখে দিল যেটা দেবযানী কোনওদিন ওদের করতে দেখেনি।

‘বলো এবার কী করতে হবে? আমরা তিন বাপ ব্যাটায় ফটাফট করে দিচ্ছি,’ শ্বেতকেতু হাত ধুতে ধুতেই জিজ্ঞেস করল।

দেবযানীর মোবাইলটা বেজে উঠল শোবার ঘরে। ইচ্ছে না করলেও ফোনটা ধরতে দেবযানী শোবার ঘরের দিকে পা বাড়াল। মায়ের ফোন দেখে তুলে নিল ফোনটা,

‘হ্যালো?’

‘হ্যাঁ-রে দেবী? কখন ফিরলি তোরা? কেমন ঘুরলি?’

‘ভালো, মা।’

‘আচ্ছা শোন, দীপের বিয়ে ঠিক হয়ে গেছে। মেয়ের বাড়ির সকলে বসার ঘরে রয়েছেন। আশীর্বাদ আর বিয়ের দিন ঠিক করা বাকি। যত তাড়াতাড়ি দিন পাওয়া যাবে, আমি দিন ঠিক করে আবার তোকে ফোন করব। তুই মোটামুটি গোছগাছ শুরু করে দে। তুই না আসা পর্যন্ত আমি ঠিকমতো কোনও কাজ করতে পারব না।’

মায়ের ফোন রেখে দিয়ে দেবযানী শোবার ঘর থেকে বেরিয়ে এসে শ্বেতকেতুর মুখোমুখি হল, ‘শুনছ, দীপের বিয়ে মা ঠিক করে ফেলেছে। যত তাড়াতাড়ি সম্ভব মা বিয়ে দিয়ে দিতে চায়। তারিখ ঠিক করেই মা জানাবে। আমাদের, মা গোছগাছ শুরু করতে বলেছে।’

‘কিন্তু তুমি মামার বিয়েতে যাবে?’ ঋক্ জিজ্ঞেস করল।

‘হ্যাঁ, যাব-না কেন? কেন তোরা মামার বিয়েতে যাবি না?’ দেবযানী একটু আশ্চর্য হয়েই ছেলেকে জিজ্ঞেস করল।

‘যাব তো ভেবেছিলাম, কিন্তু খানিকক্ষণ আগেই তো তুমি বলছিলে আমাদের সঙ্গে তুমি কোথাও যাওয়া-আসার প্রোগ্রাম করবে না। বরং দিদাকে ফোন করে বলে দিচ্ছি আমরা মামার বিয়েতে আসতে পারছি না। আমাদের জন্য দিদা যেন অপেক্ষা না করে।’

শ্বেতকেতুও যেন এমনই একটা সুযোগের অপেক্ষা করছিল। যে-কোনও ভাবে ছেলেদের সঙ্গে যোগ দিয়ে দেবযানীকে ক্ষেপিয়ে তোলার এমন একটা সুযোগ হাতছাড়া করতে চাইল না। ঋকের হাত থেকে একপ্রকার ফোনটা ছিনিয়ে নিয়ে বলা শুরু করল, যে ঋকের থেকে ওই নাকি ভালোভাবে বোঝাতে পারবে শাশুড়িকে, যে ওনার আদরের মেয়ে কেন ভাইয়ের বিয়ে অ্যাটেন্ড করতে পারবে না।

খানিক আগেই দেবযানীর রাগ দেখে তিনজনেই বাড়ির কাজ করতে উঠেপড়ে লেগেছিল। কিন্তু দেবযানীর মায়ের ফোনটা আসতেই আবার যে-কে সেই।

দেবযানীর মেজাজ কিছুটা ঠান্ডা হয়েছে দেখেই তিনজনে খানিকক্ষণ এদিক-ওদিক ছড়িয়ে ছিটিয়ে এঘর-ওঘর ঘুরে আবার টিভি চালিয়ে বসে পড়ল। এসব দেখে দেবযানীর আর চ্যাঁচামেচি করতে ইচ্ছে করল না। পড়ে থাকা বাকি কাজ সারতে হাত লাগাল।

পরের দিন শ্বেতকেতু অফিস বেরোবার পরে পরেই বাচ্চারাও স্কুলের জন্য তৈরি হয়ে বেরিয়ে গেল। গৌরবের ক্লাস এইট সুতরাং কামাই করানো যাবে না। দাদাকে দেখাদেখি ক্লাস ফোর-এ পড়লেও ঋক্ নিজেকে খুব বড়ো ভাবে তাই দাদা স্কুলে যাবে আর ও বাড়ি থাকবে এটা কিছুতেই হতে পারে না। ঋক্ও তাই দাদার সঙ্গে স্কুলে চলে গেল। একা একাই দেবযানী দোকান বাজার গিয়ে প্রয়োজনীয় সবকিছু কিনে নিয়ে এল। ধীরে ধীরে দীপের বিয়ের জন্যও কেনাকাটা সারতে হবে মাথায় এল দেবযানীর। আগে থেকে প্ল্যান করে রাখাটা জরুরি মনে হল।

দীপের বিয়ের কথা ভাবতেই দেবযানীর যাওয়ার আগের গোছগাছ আর ফিরে আসার পরে বাড়িঘর পরিষ্কার করার ঝামেলার কথা মনে হতেই ডিপ্রেশন হওয়া আরম্ভ হল।

শ্বেতকেতু আর ছেলেদের অসহযোগিতা দেবযানীকে মনে মনে দুর্বল করে তুলেছিল। অল্পতেই ও ঘাবড়ে যেত। ও জানত, সবাই ওকে ভালোবাসে কিন্তু সাহায্য করার বেলায় পাশে কেউ নেই। এমনকী জামাকাপড় কিনতে গিয়েও যদি দেবযানী ছেলেদের যেতে বলত উত্তর পেত, ‘প্লিজ মা, তুমি পছন্দ করে নিয়ে এসো। দোকানে ভিড়ের মধ্যে যেতে ইচ্ছে করে না।’

ছেলেদের পছন্দ-অপছন্দের বিষয় নিয়ে যখনই দেবযানী সন্দেহ প্রকাশ করেছে তারা উত্তর দিয়েছে, ‘মাম্মা, তুমি দোকান থেকে জামার ছবিটা তুলে একটা হোয়াট্‌স আপ্ কোরো। আমরা আমাদের পছন্দ হয়েছে কিনা তোমাকে জানিয়ে দেব।’

নিজের পছন্দে জামাকাপড় কিনে আনলেও কি কম জ্বালা দেবযানীর। কখনও ছেলেদের ডিজাইন পছন্দ হয় না আর কখনও বা রং। দেবযানীকে আবার দৌড়োতে হয় পোশাক বদলাবার জন্য। বাচ্চারা কখনও মায়ের সঙ্গে যায় তবে বেশিরভাগই দেবযানীকে একাই যেতে হয়।

বাচ্চারা যতদিন ছোটো ছিল, ভালো ছিল। দেবযানীর কথা শুনে চলত। কিন্তু এখন নিজেদের যেটা পছন্দ সেটাই পরবে, সেটাই করবে। দেবযানীর মাঝেমধ্যেই মনে হয় দুই ছেলের বদলে দুটো মেয়ে হলে মায়ের সঙ্গে শপিংও যেত আবার বাড়ির কাজেও মাকে সাহায্য করত।

দেবযানী, ঘিরে আসা হতাশা দূরে ঠেলে সরাবার চেষ্টা করল। কিছু একটা ওকে করতেই হবে তিনজনকে সোজা রাস্তায় নিয়ে আসার জন্য। ওদের দায়িত্বটা যেমন ওদের বোঝানো দরকার তেমনি দেবযানীর পরিস্থিতিটাও ওদের অনুধাবন করাটা দরকার। বাড়ির কাজ করতে করতেই দেবযানীর মনের মধ্যে এই একটাই কথা বারবার ঘুরপাক খেতে আরম্ভ করল। কিছু একটা প্ল্যান করতেই হবে।

দেবযানী জানে, একমাত্র শালা এবং একমাত্র মামা-র বিয়ে নিয়ে শ্বেতকেতু এবং বাচ্চারা কতটা উৎসাহী। দেবযানীও নিজের ভাইকে কতটা ভালোবাসে সেটাও সকলের জানা। এটাকেই অস্ত্র বানিয়ে দেবযানী নিজের প্ল্যানকে রূপ দেওয়ার পন্থা খুঁজতে লাগল। এক মাস পরেই ভাইয়ের বিয়ে ঠিক হয়ে গেছে সুতরাং দেবযানী হিসেব করল হাতে সময় খুব কম।

মনে মনে ঠিক করে নিল দেবযানী যে, শ্বেতকেতু আর ছেলেরা সকালে অফিস, স্কুল বেরিয়ে গেলে তারপরেই বিয়ের জন্য দোকান বাজার করতে বেরোবে এবং ও দীপের বিয়ের জন্য কেনাকাটা আরম্ভ করে দিয়েছে, বাড়িতে কাউকে জানতে দেবে না।

যেমন চিন্তা তেমনি কাজ। বাজার করে করে সব জিনিস দেবযানী বক্স খাটে ভরে রাখত যাতে কারও চোখে না পড়ে যায়। জামাকাপড়গুলো কিনেও কাউকে দেখাল না দেবযানী। সকলের সামনে স্বাভাবিক থাকার নাটক করত ও। দীপের বিয়ে নিয়ে স্বামী, ছেলেদের সামনে কোনও উৎসাহও দেখাত না এবং কোনওরকম আলোচনা থেকেও নিজেকে দূরে রাখত।

দশ-পনেরো দিন সকলে নিজের নিজের কাজ, পড়াশোনা নিয়ে ব্যস্ত হয়ে রইল। কারও খেয়ালই হল না দীপের বিয়ে নিয়ে দেবযানীর তরফ থেকে কোনও উচ্চবাচ্য নেই। সব যেন ঠান্ডা হয়ে গেছে। হঠাৎ-ই একদিন ডিনারের টেবিলে দীপের বিয়ের প্রসঙ্গ তুলে শ্বেতকেতু কথা তোলার চেষ্টা করল। কিন্তু দেবযানীর নিরুত্তাপ ব্যবহারে ও অবাক হয়ে গেল। বাচ্চারাও মামার বিয়েতে মায়ের উৎসাহ না দেখে মুষড়ে পড়ল। দেবযানী আড়চোখে তিনজনকে একবার দেখে নিল। সকলেই এ-ওর মুখ চাওয়াচাওয়ি করছে কিন্তু বাচ্চারা মা-কে কারণ জিজ্ঞেস করার সাহস করতে পারল না।

অগত্যা শ্বেতকেতুই বিড়ালের গলায় ঘণ্টা বাঁধার দায়িত্বটা নিল।

‘কী ব্যাপার দেবযানী? দীপের বিয়ে এসে গেল আর তুমি চুপচাপ বসে আছ… এখনও পর্যন্ত বিয়ের জন্য কেনাকাটা, গোছগাছ আরম্ভ করলে না… সবকিছু ঠিক আছে তো?

‘হ্যাঁ ঠিক আছে।’ জেনেবুঝেই দেবযানী ছোট্ট উত্তর দিল। কিন্তু উত্তর শুনে শ্বেতকেতু খুশি হল না সেটা ওর মুখ দেখেই স্পষ্ট বুঝতে পারল দেবযানী।

‘কিছু হয়েছে?’ দেবযানীকে চুপ করে থাকতে দেখে শ্বেতকেতু কিছুটা বিচলিত হয়েছে মনে হল।

তির লক্ষ্যে লেগেছে বুঝতে পেরে দেবযানী মনে মনে খুশি হল কিন্তু মুখে তার প্রকাশ ঘটতে দিল না। গম্ভীর হয়ে জিজ্ঞেস করল, ‘এত প্রশ্ন কেন করছ? আমি দীপের বিয়েতে যাচ্ছি না।’

‘কেন? কী হল? সমস্বরে তিনজনে প্রশ্নটা ছুড়ে দিল দেবযানীকে। তিনজনের মুখই রক্তশূণ্য।

‘কেন আমার ভীষ্মের প্রতিজ্ঞা ভুলে গেলি?’ গৌরবের দিকে তাকিয়ে দেবযানী প্রশ্নটা করে।

‘উফ! মাম্মা! মামার বিয়েটা হয়ে যেতে দাও। তারপর যা খুশি প্রতিজ্ঞা কোরো।’ দুষ্টুমি ভরা চোখে ঋক্ মা-কে অনুরোধ করার ভঙ্গিতে বলে। ঋক্-কে দেখে দেবযানীর হাসি পেয়ে যায়, অনেক কষ্টে নিজেকে সামলে নেয় ও। জানে গম্ভীর থাকাটা অত্যন্ত আবশ্যক।

‘ঋক্ আমি এই ব্যাপারে সিরিয়াস। আমার কথাটা নিয়ে হাসিঠাট্টা করার কোনও দরকার নেই।’ দেবযানী এই বলে প্লেট-টা হাতে নিয়ে টেবিল ছেড়ে উঠে পড়ল। রান্নাঘরের দিকে যেতে যেতে দেবযানীর, গৌরবের ফিসফিস করে বলা কথা কানে এল।

‘বাবা, মনে হচ্ছে মা এবার আমাদের উপর খুব রেগে গেছে। নয়তো মামার বিয়ে নিয়ে মায়ের মধ্যে কোনও উৎসাহ দেখছি না কেন? মামার বিয়ে অথচ মা চুপচাপ বাড়িতে বসে। আমাদেরও কোনও কাজ করার কথা বলছে না। তুমি মা-র সঙ্গে কথা বলে দ্যাখো না মা-র কী হয়েছে?’

‘তোরা চিন্তা করিস না। মা রেগে থাকলে আমি ঠিক সামলে নেব,’ শ্বেতকেতু বাচ্চাদের উদ্দেশ্য করে বলল।

পরের দিন শ্বেতকেতু অফিস থেকে দেবযানীকে ফোন করল, ‘দেবযানী, আজ অফিসে বলে একটু তাড়াতাড়ি বেরোবার ব্যবস্থা করতে পেরেছি। তুমি বরং চারটে নাগাদ এসপ্ল্যানেড মেট্রো স্টেশনের সামনে দাঁড়াও। আমি অফিস থেকে ওখানেই চলে আসব। দীপের বিয়ের শপিং যতটা পারা যায় সেরে ফেলা দরকার। আমারও দুটো সেট শার্ট-প্যান্ট কিনতে হবে। তোমার নিজেরও যা-যা দরকার সেগুলোও কিনে নেওয়া যাবে।’

অনেক কষ্টে হাসি চেপে দেবযানী শ্বেতকেতুর কথায় সায় দিল। কথা শেষ করে ফোন ছেড়ে দেবযানী ভাবল, যতদিন ভালো করে কথা বলে, মিনতি করেছে স্বামী এবং ছেলেদের, ওর সঙ্গে শপিং-এ যাওয়ার জন্য ততদিন ওর কথার কেউ গুরুত্বই দেয়নি। এখন সামান্য ঘুরপথ বেছে নিতেই ধীরে ধীরে নিজেদের দায়িত্ব নেওয়ার চেষ্টাটা ওরা অন্তত শুরু করেছে।

ক্লান্ত হয়ে শপিং থেকে বাড়ি ঢুকতেই দেবযানী লক্ষ্য করল ডিনার টেবিলে রাতের খাবার গরম করে রাখা আছে। মনে মনে খুশি হল। গৌরব মা-কে দেখে পড়াশোনা ছেড়ে উঠে এসে ওদের হাত থেকে জিনিসপত্রগুলো নিয়ে সোফায় রাখল। ভাইকে ডেকে দু’গেলাস জল নিয়ে আসতে বলল। মা-বাবার ক্লান্ত মুখের দিকে তাকিয়ে বলল, ‘আমি জানতাম এতক্ষণ শপিং করে তোমরা ক্লান্ত হয়ে পড়বে। স্কুল থেকে এসে মা-র লিখে যাওয়া চিরকুটটা দেখে বুঝছিলাম তোমরা শপিং-এর জন্য গেছ। মা, আমি ফ্রিজ থেকে সব খাবার বার করে আভেনে গরম করে রেখে দিয়েছি। তোমাকে এখন আর কিছু করতে হবে না। হাত-মুখ ধুয়ে তুমি-বাবা খেতে বসে যাও।’ দেবযানী অবাক হল। আজ আর বাবা-ছেলের মধ্যে চোখ চাওয়াচাওয়ি হল না। এক ধাক্বায় গৌরব অনেকটা বড়ো হয়ে গেছে বলেই মনে হল দেবযানীর। বাড়ির দায়িত্ব অনেকটাই নিজে থেকেই নিয়ে নিয়েছে মায়ের কাঁধের বোঝা লাঘব করার জন্য।

সঠিক লক্ষ্যে তিরভেদ করতে পেরেছে দেবযানী। যতটা পরিবর্তন স্বামী এবং সন্তানের মধ্যে ও দেখতে চেয়েছিল তার থেকে অনেক বেশি-ই দেখার সৌভাগ্য ওর এই একদিনে হয়েছে।

দীপের বিয়েতে যাওয়ার আগে শ্বেতকেতুকে সুটকেস-এ গোছগাছ করতে দেখে দেবযানী নিজের গাম্ভীর্যের লাগাম একটু আলগা করে, কোনও কিছুরই অতিরিক্ত বাড়াবাড়ি মনের মতো ফলাফল দিতে পারে না সেটা দেবযানী জানে। নরম গলায় শ্বেতকেতুকে কাজ থেকে বিরত করার চেষ্টায় বলে, ‘এবার রাখো। অনেক গুছিয়েছ বাকিটা আমি করে দেব। তোমরা নিজেরা কী জামাকাপড় বিয়েতে পরবে আর নিয়ে যাবে সেটা ঠিক করে নিয়েছ, এটাই আমার জন্য যথেষ্ট। কোথাও যাওয়ার আগে এতটা সাহায্য পেলেও আমার কষ্ট কমে।’

দেবযানী নিজের মনেই হাসে। লোহা গরম থাকতে থাকতে তখনই আঘাত করে মনের মতো আকার দেওয়াটা কতটা দরকার সেটার তাৎপর্য আজ নিজের পরিবারের উপর দিয়ে পরীক্ষা করেই দেবযানী বেশ টের পেল। কোথায় যেন একটা ছন্দপতন ঘটে গিয়েছিল। আজ ঠিক সুর লাগাতে পেরে হঠাৎই সংসারটা যেন ঝলমলিয়ে উঠল।

আরো গল্প পড়তে ক্লিক করুন...