ভারত সরকারের স্ট্যাটিস্টিকাল ডিপার্টমেন্ট সম্প্রতি একটি অভাবনীয় তথ্য পরিবেশন করেছে। এই তথ্যের বিষয় হল প্রতিদিন গৃহকোণে কে কতটা সময় অতিবাহিত করেন। এতে ২০১৯-এর একটি সমীক্ষা অনুযায়ী দেখা যাচ্ছে, ১,৩৮,৭৯৯টি পরিবারে মহিলারা গড়ে ২৯৯ মিনিট প্রতিদিন ঘরের কাজে ব্যয় করেন, যার কোনও মূল্যায়ন হয় না। তুলনায় পুরুষরা ৯৭ মিনিট ব্যয় করেন, রান্না করা, পরিষ্কার করা বা কাপড়জামা ধোওয়ার মতো গৃহকর্মে।

একই ভাবে মহিলারা পরিবারের দেখাশোনায় ব্যয় করেন দিনপ্রতি ১৩৪ মিনিট। পুরুষরা ৭৬ মিনিট। টাইম ইউজ ইন ইন্ডিয়া নামক এই রিপোর্ট এখন আদালতে ইনশিয়োরেন্স ক্লেম-এর মতো বিষয়ে কাজে লাগছে। অ্যাক্সিডেন্ট-এর ঘটনায় বা স্ত্রী বিয়োগের ক্ষেত্রে থার্ড পার্টি ইনশিয়োরেন্স ক্লেম না দেওয়ার বিষয়গুলিতে নিয়ন্ত্রণ আনা সম্ভব হয়েছে এর ফলে।

আসলে আমাদের সমাজ মহিলাদের দাসী ভাবতেই শিখিয়েছে। সভ্যতার বিকাশ যখন হয়নি, তখনও কিন্তু নারী-পুরুষ সমান সমান শ্রমদান করতেন, নিত্যদিনের খাদ্য সংগ্রহ করার কাজে। সভ্যতা আমাদের শ্রমবিভাজন শিখিয়েছে। কিন্তু নারী-পুরুষ যদি একই সংসারে থাকেন, তাহলে লিঙ্গ বিশেষে এই শ্রমদানে অসামঞ্জস্য কেন থাকবে? এখানে কে মালিক আর কে গোলাম?

এই বৈষম্য আমাদের দেশের মহিলাদের যুগ যুগ ধরে সহ্য করতে হচ্ছে। মা থেকে তার কন্যা সন্তানে হস্তান্তরিত হয় এই বৈষম্যের ভাবনা। পতিসেবা করা এবং সংসারের যাবতীয় পরিশ্রম সামলানোর শিক্ষা, যা মেয়েরা গ্রহণ করে পারম্পরিক ভাবে, তাতে সমাজ তার জন্য পুরুষের তুলনায় অনেক নীচের একটা আসন নির্দিষ্ট করে দেয়।

আমাদের ধর্মগ্রন্থের শিক্ষাটাতেই গলদ রয়েছে। সেখানে নারীকে পাপযোনি হিসাবে অভিহিত করা হয়েছে। ঋতুস্রাবের প্রক্রিয়াকে ব্রাহ্মণ হত্যার ফল হিসাবে গণ্য করা হয়েছে। স্বামী অকালে প্রাণ হারালে তাকেও স্ত্রীয়ের কর্মফল হিসাবে গণ্য করে সমাজ। জ্যান্ত পুড়িয়ে দেওয়ার ঘটনা পর্যন্ত নির্বিচারে ঘটে চলে এই সমাজে। অথচ আজকের দিনেও পুরুষদের তুলনায় সংসারে মেযোই শ্রম দেয় বেশি।

পুরুষরাই বাইরে বেরিয়ে অর্থ উপার্জন করার ক্ষমতা রাখেন এই তর্কও অবান্তর। মহিলারা দিনের ১,৪৪০ মিনিটের মধ্যে ৪৩৩ মিনিট ঘরের কাজ সামলে পুরুষদের মতো উপার্জন করে আনারও ক্ষমতা রাখেন। কিন্তু সেইখানে অন্তরায় হয়েছেন পুরুষরাই।

পরপুরুষের সঙ্গে মেলামেশার সুযোগ যাতে না পায় গৃহিণী, সেটাও ছিল তাকে ঘরে আটকে রাখার একটা উদ্দেশ্য। বুরখা ও পর্দার ব্যবস্থা আসলে তাকে শৃঙ্খলিত রাখার অন্য নাম। তাকে বেশি লেখাপড়া শেখানোই হয় না, পাছে সে নিজের যোগ্যতা প্রমাণ করে ফেলে।

ভারতের অধিকাংশ মহিলাকেই পূজাপাঠে মনোনিবেশ করতে বাধ্য করা হয়। তাদের চিন্তা ভাবনাকে খর্ব করে ব্যস্ত রাখার এটাই প্রধান উপায়। ভারতের ৩৬ কোটি নারীই বেকার বলে দেখা গেছে, জনগণনার রিপোর্ট-এ। অর্থাৎ তাদের ভিখারি, পতিতা, কয়েদিদের দলে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। জনগণনা পার্লামেন্ট-এর অনুসারে হয়। অর্থাৎ ৩৬ কোটি মহিলাকে (২০০১-এর রিপোর্ট অনুযায়ী) কর্মহীন বলে উল্লেখ করা হয়েছে, কারণ সংসদে এখনও পুরুষদেরই আধিপত্য।

মহিলারা, কোনও অফিস কাছারি, বা কলকারখানায় কাজে যুক্ত হলে, পরিবার ও বাচ্চাদের দেখাশোনা হয় না এমন একটা চলতি ধারণাকে কায়েম করা হয়েছে। অথচ গৃহকর্মের জন্য সে স্বামীর থেকে একটা পয়সাও পায় না, যদিও শ্রমমূল্য তার দাবি করা উচিত। তাদের দুবেলা খাবার দেওয়ার মধ্যেই গৃহকর্তার দায়িত্ব ফুরিয়ে যায়। এটা মানসিকতার প্রশ্ন এবং মানবিকতারও। হিন্দুরাষ্ট্রে মহিলাদের কোনও সম্মানের আসন কায়েম হওয়া অসম্ভব। কারণ আমরা ওই পরম্পরাতেই বিশ্বাসী যে পুরুষ নারীর তুলনায় অনেক সম্মানের আসনে আসীন।

আরো গল্প পড়তে ক্লিক করুন...