বেলুড় হালেবিদ ঘুরে, কুশলনগর হয়ে কালই এসেছি মাদিকেরি। মাদিকেরি হল কর্ণাটকের দক্ষিণ-পশ্চিমে পশ্চিমঘাট পর্বতমালার এক মালভূমি অঞ্চল। বর্তমানে মাদিকেরি কুর্গ বা কোডাগু রাজ্যের রাজধানী। উচ্চতা ১৫২৫ মিটার। শোনা যায়, পালেরি রাজা মাদিকেরির নামেই এই শহরের নামকরণ। মাদিকেরিতে জড়িয়ে আছে কুর্গের প্রাচীন ইতিহাসের এক গৌরবময় অধ্যায়।

এই শৈলশহর আর-পাঁচটা হিল স্টেশনের মতো অতটা ঘিঞ্জি নয়। পাহাড়ঘেরা স্কটল্যান্ডের প্রকৃতির সঙ্গে এর যথেষ্ট সাদৃশ্য মেলে। তাই একে ভারতের স্কটল্যান্ড বলে অভিহিত করা হয়। যেদিকেই দু’চোখ যায়, চোখ জুড়োনো সবুজের ব্যাপ্তি। শহরের বুক চিরে বয়ে চলেছে কাবেরী নদী।

এই শহরের একটা নিজস্ব গন্ধ আছে। আসলে, এখানে ঘরে ঘরে চকোলেট আর ওয়াইন তৈরি হয়। এছাড়াও এখানকার কফি, মশলা, মধু আর ইউক্যালিপটাস পাতার তেলের যথেষ্ট পরিচিতি রয়েছে। তাই রাস্তার দু’পাশে মেলে প্রচুর মশলার দোকান। কুয়াশা ঢাকা পাহাড়, চিরহরিৎ অরণ্য, নাতিশীতোষ্ণ আবহাওয়া– সবমিলিয়ে এক অনবদ্য শৈলশহর।

ব্রেকফাস্টের পরই বেরিয়ে পড়লাম শহর দর্শনে। প্রথমেই চললাম অ্যাবে ফলস্ দেখতে। শহর ছাড়াতেই পাহাড়ি চড়াই-উৎরাই। রাস্তার দু’পাশে ছায়ামাখা গাছের সারি, আর পাতার ফাঁকে নরম আলোর খেলা। পাহাড়ি ঢালে কফি আর মশলার খেত। ৯ কিমি রাস্তা শেষে পৌঁছোলাম পাহাড়ি এক পরিসরে। সামনেই জঙ্গল ঘেরা অ্যাবে ফলস্ যাওয়ার গেট।

সংলগ্ন পার্কিং জোনে গাড়ি নিয়ে ড্রাইভার এগিয়ে যায়। আমরা উৎরাই পথে নীচে নামতে লাগলাম। সবুজে জড়ানো জঙ্গল, মাঝে পাথুরে সিঁড়ি ধরে অতি সন্তর্পণে নীচে নামতে থাকি। দূর থেকেই শোনা যায় প্রপাতের পতনধবনি। চলতে-চলতে এক বাঁকের মুখে হঠাৎ দেখা হয়ে যায় অ্যাবের সঙ্গে। সামনে সবুজের মাঝে একটা ব্রিজ। আর বাকি ফ্রেমজুড়ে শুধুই জলস্তম্ভ। কাছে যেতেই ফলস্-এর নয়নাভিরাম শোভায় মুগ্ধ হলাম। কাবেরীর একটা উপনদী এখানে বিপুল জলরাশি সমেত ৯০ ফুুট উঁচু থেকে ঝাঁপিয়ে পড়েছে।

শোনা যায়, এই অ্যাবে ফলসের আবিষ্কারক নেরাভনেদা বি নানাইয়া। ভরা বর্ষায় এর চেহারা হয় আরও স্ফীত আরও মনোমুগ্ধকর। ফলসের ধারে রাজারানির বসার প্যাভেলিয়ন। কথিত আছে, এখানে বসে তারা অবসর কাটাতেন। অ্যাবে ফলসের ছোট্ট এই নদীটির ওপর দিয়ে রয়েছে একটি ঝুলন্ত ব্রিজ। ব্রিজের ওপারে পাগাড়ি জঙ্গল, মাঝে কফিগার্ডেন।

নির্জন এই পরিবেশের মধ্যে ফলসের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে জলকুচিতে ভিজতে ভারি রোমান্টিক লাগছিল। সেলফিপ্রেমীদের ভিড়ে, ক্যামেরা নিয়ে অনেক কসরৎ করতে হল। শেষ পর্যন্ত ক্যামেরায় ছবি তুললাম বটে, কিন্তু মনের মেমরি কার্ডে যে ছবি উঠে গেল, সেটা বলে বোঝানো সম্ভব নয়। এই ভালো লাগার জলজঙ্গলের সংসার ছেড়ে যাওয়ার ইচ্ছাটাই যেন তৈরি হচ্ছিল না।

এবার চলেছি মাদিকেরি ফোর্ট। বাসস্ট্যান্ড থেকে অনতিদূরেই এর অবস্থান। থানা পেরিয়ে ডানহাতি পথে একটু আপহিলে মোড় ঘুরতেই চোখে পড়ল দুর্গের ধবংসাবশেষ। ১৬০০ খ্রিস্টাব্দ থেকে কোডাগুর পরাক্রমশালী লিঙ্গায়েত রাজারা এখানে শাসন করে এসেছে। পরবর্তীতে হায়দর আলির সাম্রাজ্য বিস্তারের স্বপ্নে বাধা হয়ে দাঁড়ায় কোডাগুর শাসকরা। হায়দরের মৃত্যুর পর ১৭৮৫ খ্রিস্টাব্দে টিপুর হাতে পরাজয় ঘটে কোডাগু রাজার। পুরাতন রাজার মাটির দুর্গটিকে টিপু পাথর দিয়ে পুননির্মাণ করেন। বছর চারেক পর ব্রিটিশের সাহায্যে নিজের রাজ্য পুনরুদ্ধার করেন রাজা বীর রাজেন্দ্র। শেষে ১৮৩৪ সালে ব্রিটিশদের হস্তগত হয় এই দুর্গ।

ওপরের সমতল চত্বরটিতে প্রথমেই ডানদিকে রয়েছে একটি চার্চ। সংস্কারহীন ছোট্ট এই গীর্জার নাম সেন্ট মার্কস চার্চ। তার মধ্যেই গড়ে উঠেছে এক ছোট্ট মিউজিয়াম। ছোট্ট হলেও বহু নিদর্শন কিন্তু নজর কাড়ে। বাইরে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা পুরাতন বাড়িগুলোতে রয়েছে সরকারি দফতর। আর একটু ভিতরের দিকে আছে একটা পুরানো মন্দির। পরিত্যক্ত প্রাচীরগুলোর ফাঁক দিয়ে উঁকি দিলেই দেখা যায় দূর শহরের অনবদ্য ল্যান্ডস্কেপ। পড়ে থাকা অব্যবহৃৎ ঘরগুলো এখন কালের মন্দিরা হয়ে প্রহর গুনছে। জংলি গাছপালার দঙ্গল তাদের ঘিরে রেখে চেপে ধরছে, না বলা ইতিহাসের টুঁটি।

ফেরার পথে রাজা’স টম্ব দেখাতে, একস্থানে হঠাৎই গাড়িটা দাঁড় করায়। মূল রাস্তা থেকে একটু উপরে উঠতেই চোখে পড়ে এক বড়োসড়ো গেট। গেট পার হতেই চোখ জুড়োনো সবুজের স্নিগ্ধতায় মুগ্ধ হই। সামনেই পাহাড়ি উপত্যকা জুড়ে কেয়ারি করা উদ্যান। পায়ে চলা মোরামপথ চলে গেছে নানান দিকে। সবুজের মাঝে হালকা হলুদের তিনটি সমাধিসৌধ পাশাপাশি দাঁড়িয়ে। ১৯ শতকে তৈরি এই সমাধি সৌধগুলি কুর্গের হিন্দুরাজাদের। প্রতি সৌধশীর্ষে সোনালি গম্বুজ। এছাড়াও এখানে রাজপরিবারের অন্যান্য সদস্যদের সমাধি রয়েছে। মরশুমি ফুলে ভরা উদ্যানটিতে এদিক-ওদিক ঘুরতে খুবই ভালো লাগছিল। এই মনোরম পরিবেশ ছেড়ে ফিরতেই ইচ্ছা করছিল না। সেই মুগ্ধতার আমেজকে সঙ্গে নিয়ে পৌছোলাম ওঙ্কারেশ্বর মন্দিরে।

কর্ণাটকের প্রাচীনমন্দির সমূহের মধ্যে অন্যতম ওঙ্কারেশ্বর শিবের মন্দির। রাজা দ্বিতীয় লিঙ্গরাজেন্দ্র ১৮২০ খ্রিস্টাব্দে এই মন্দির নির্মাণ করেন। শহরের একেবারে মধ্যিখানে এই মন্দিরের অবস্থান। তবে রাজার এলাকা থেকে অনেকটা নীচুতে। চারদিকে সার দিয়ে পাহাড়ের গায়ে রয়েছে বাড়িঘর। সিঁড়ি দিয়ে কিছুটা উঠে মূল মন্দির। মন্দির অভ্যন্তরে ধূপ-ধুনো-কর্পূর-এর মিলিত গন্ধ, ধর্মীয় আবেগকে জাগ্রত করে। নামে শিবমন্দির হলেও, এখানে দেখি শিব ও বিষ্ণুর সহাবস্থান ঘটেছে। কেরল ধাঁচের লাল টালির মন্দিরে গথিক ও মুসলিম স্থাপত্যের আশ্চর্য মিশেল ঘটেছে। মূল মন্দিরকে ঘিরে বর্গক্ষেত্রের চার বাহুর মতো অবস্থানে সার-সার ঘর। মন্দিরের সম্মুখে একটু নীচুতে রয়েছে টলটলে জলের এক সরোবর। কথিত আছে, লিঙ্গ রাজেন্দ্র তার রাজনৈতিক উচ্চাকাঙক্ষা চরিতার্থ করার জন্য এক ধার্মিক নিরীহ ব্রাহ্মণকে হত্যা করেছিলেন। এই ব্রাহ্মণের বিদেহী আত্মা ব্রহ্ম-রাক্ষস হয়ে যথেষ্ট জ্বালাতে শুরু করে রাজাকে। নিজেকে পাপমুক্ত করার জন্যেই রাজা এই শিবমন্দির তৈরির পরিকল্পনা করলেন। কাশীধাম থেকে শিবলিঙ্গ এনে এই মন্দিরে প্রতিষ্ঠা করেন। মন্দিরের নাম রাখা হয় ওঙ্কারেশ্বর। সকাল সাড়ে ছ’টা থেকে বেলা বারোটা এবং বিকেল পাঁচ-টা থেকে রাত আট-টা পর্যন্ত মন্দির খোলা থাকে।

এখন আমরা চলে এলাম, মাদিকেরির অন্যতম শ্রেষ্ঠ আকর্ষণ রাজা’স সিট অঞ্চলে। টিকিট কাউন্টার থেকে টিকিট কেটে ভিতরে প্রবেশ করলাম। সামনে দেখি পাহাড়ের মাথায় একেবারে খাদের কিনারে বেশ

খানিকটা ফাঁকা জায়গা। কর্ণাটক টুরিজম ডেভেলপমেন্ট কর্পোরেশন এই জায়গাটা সুন্দর করে সাজিয়েছে। টয়ট্রেন, রংবাহারি ফুলের বাগান, শিশুদের খেলার জায়গা আর পাহাড়ের বিভিন্ন ধাপে অবস্থিত গ্যালারির মতো বসার জায়গা। সবুজে ঢাকা উদ্যানে মরশুমি ফুলের বাহার দেখতে দেখতে চলেছি। টযট্রেনটা দূরে দাঁড়িয়ে। কচিকাঁচারা ভিড় করেছে সেখানে।

পাহাড়টা এগোতে এগোতে একেবারে সামনে ঢালু হয়ে সটান অতলে নেমে গেছে। এককালে কোডাগু রাজারা এখানে বসেই উপত্যকার পাহাড়ি বনাঞ্চলের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য আর সূর্যাস্তের মায়াবী রূপ দেখতেন। বহু পর্যটক এখানে বসেই প্রকৃতির জীবন্ত ক্যানভাস দেখছেন। দূরে নীল হয়ে আছে সারি সারি পশ্চিমঘাটের শাখা-প্রশাখা। দিগন্তবিস্তৃত সবুজ পাহাড়ের দিকে তাকিয়ে থেকে সময় কখন যে পেরিয়ে যায়, তা টের পাওয়া যায় না।

এদিকে ঘড়ির কাঁটা বেশ কয়েকটা পাক ঘুরে জানান দিচ্ছে, প্রায় ঘন্টা চারেক খরচ হয়ে গেছে দিনের কোটা থেকে। তবে প্রকৃতির অকৃপণ সৌন্দর্যসুধায় মন চাইছিল না হোটেলে ফিরতে। কিন্তু আজই আমাদের ম্যাঙ্গালোর যেতে হবে। তাই রাস্তায় এক রোস্তোরাঁয় মধ্যাহ্নভোজন সেরে চলে এলাম হোটেলে। আর চেক-আউট করে একটা অটো ধরে সোজা বাসস্ট্যান্ডে।

কীভাবে যাবেন

হাওড়া থেকে সরাসরি মাদিকেরি যাওয়ার কোনও ব্যবস্থা নেই। বেঙ্গালুরু অথবা মহীশূর থেকে ব্রেকজার্নি করে যেতে হবে। সড়কপথে বেঙ্গালুরু বা যশোবন্তপুর থেকে ২৬০ কিমি দূরে মাদিকেরি। আর মহীশূর থেকে দূরত্ব ১২০ কিমি। এই পথে বাস যোগাযোগ ভালোই। গাড়ি ভাড়া করেও যেতে পারেন।

কোথায় থাকবেন

মাদিকেরিতে রয়েছে কর্ণাটক রাজ্য পর্যটনের হোটেল ভ্যালি ভিউ। দ্বিশয্যা এসি ও নন-এসি রুম মিলবে ২৪০০ থেকে ৪০০০ টাকার মধ্যে। বেসরকারি হোটেলও আছে। মাদিকেরি পাহাড়ি গ্রামে অনেক হোম-স্টে রয়েছে। ইচ্ছা করলে সেখানেও থাকতে পারেন।

বিকিকিনি

মাদিকেরিতে কিনতে পারেন নানা সুগন্ধি মশলা, হোমমেড চকোলেট, কফি ও সুগন্ধি সাবান।

স্পেশাল খাবার

কুর্গ স্পেশাল বিরিয়ানি, কুর্গের কুড়মপটুও (চালের মন্ড দিয়ে তৈরি) খেয়ে দেখতে পারেন।

সাইট সিয়িং

দিন বাড়িয়ে দেখে নিতে পারেন ৪২ কিমি দূরে থলকাবেরী ও ভাগা মান্দালা, বাইলোকূপে তিব্বতী মনাস্ট্রি, দুব্বারে এলিফ্যান্ট ক্যাম্প ও হ্যারাঙ্গি ড্যাম।

প্রয়োজনীয় তথ্য

আরও জানতে যোগাযোগ করুন কর্ণাটক পর্যটন উন্নয়ন নিগম, ৪৯, সেকেন্ড ফ্লোর, খনিজ ভবন, রেসকোর্স রোড, বেঙ্গালুরু ৫৬০-০০১, ফোন-(০৮০) ২২৩৫ ২৯০১/২৯০২  কলকাতায় যোগাযোগ – ২৪২৪০৬৮২/৫২৮০।

আরো গল্প পড়তে ক্লিক করুন...