পাহাড়ে একটা চালু কথা আছে, ডাক না এলে পৌঁছোনো যায় না। আমাদের মণিমহেশ যাওয়ার ডাকটা বোধহয় তেমন আকস্মিকভাবেই এসেছিল। যদিও দলটা বড়ো করার চেষ্টা করেছিলাম আমরা, কিন্তু কোনও অজানা দৈব কারণে হয়তো ‘ডাক’ সবার এল না এবং অনেকেই শেষ মুহূর্তে ট্রেক-এর কষ্ট থেকে পরিত্রাণ চাইলেন।
অতএব পথে নামলাম আমরা, চারজনের ছোট্ট দল। দীর্ঘ ট্রেন যাত্রার শেষে হাওড়া থেকে পাঠানকোট পৌঁছোলাম। হিমাচল হিমালয়ের তোরণদ্বার বলা চলে পাঠানকোটকে। গাড়িতে ঘন্টা ছয়েকের যাত্রা শেষে চাম্বা হয়ে পৌঁছোলাম ভারমৌর। মণিমহেশ যাওয়ার পথে রাত কাটাবার মোটামুটি ভদ্রস্থ জায়গা এই ভারমৌর-এই মেলে। পরদিন ভোরে আমাদের ট্রেক শুরু হবে হাডসার থেকে। হাডসার, ভারমৌর থেকে গাড়িতে এক ঘন্টার পথ। পায়ে হাঁটা পথ গেছে হাডসার থেকে গৌরীকুণ্ড হয়ে মণিমহেশের দিকে।
হাডসার থেকে গৌরীকুণ্ড ১৩ কিলোমিটার পথ। তাই ভালো হয় একদিনে পুরো ট্রেকটা না করে, ধনচোতে টেন্ট করা। জন্মাষ্টমীর সময় মণিমহেশ যাত্রা উপলক্ষ্যে প্রচুর তীর্থযাত্রী আসেন এই পথে। সেই সময় বেশ কিছু অস্থায়ী ধাবা, ভান্ডারা চলে পূণ্যার্থীদের জন্য। বাকি সময় এপথ শুনসান পড়ে থাকে পথিকের অপেক্ষায়।
ভোর-ভোর যাত্রা শুরু করলেও প্রথমেই হাডসারের পথ না ধরে, আমরা মনস্থ করলাম ভারমৌরের চৌরাসি মন্দিরটি দেখে নেওয়ার। মূলত শিবমন্দির হলেও এখানে খোদিত আছে চুরাশিটি বিগ্রহ। একটি ধর্মরাজ মন্দিরও রয়েছে। আর হিমালয়ের এই অংশে ভীষণভাবে পূজিত হন কার্তিক।
মন্দির দর্শন সেরে পথ ধরলাম হাডসারের। মণিমহেশ বস্তুত একটি হাই অল্টিটিউট লেক, যা ৪০০০ মিটার উচ্চতায় অবস্থিত। শিব পূজিত হন এখানে। পাঁচটি কৈলাসের অন্যতম হল মণিমহেশ। সেই অপূর্ব নিসর্গের শরিক হতে চলেছি আমরা। অক্টোবরের শেষেও আমাদের মতো অযাচিত পর্যটকের জন্য কিছু সংস্থান হয়েই যাবে, এই আশায়।
২২৮০ মিটার উচ্চতায় হাডসার থেকে হাঁটা শুরু হতেই প্রথম আধঘন্টা বেশ চটপট পার হয়ে গেল। অপূর্ব একটি পাহাড়ি নদী আমাদের সঙ্গে। পাইন, দেওদার গাছের ছায়া ছায়া পথ। প্রচুর পাখি ও প্রজাপতির দেখা পেতে লাগলাম অচিরেই। মাথা তুলতেই চোখে পড়ে সেই শৈলশুভ্র মণিমহেশ।
মাঝে মাঝে একটু হালকা স্ন্যাক্স আর ছবি তোলার বিরতি নিয়ে আবার হাঁটা শুরু করি। ঘন্টা পাঁচেক হেঁটে অবশেষে পৌঁছোই ধনচো। এখানে পাপ্পু টি-স্টলে চা আর ম্যাগি পাওয়া গেল। টেন্ট পিচ করলাম। আজ এটাই আমাদের রাতের আস্তানা।
পরদিন সকালে আলু পরোটা প্রাতরাশ করে আবার শুরু হল হাঁটা। এবার লক্ষ্য গৌরীকুণ্ড। যেখান থেকে মাত্র এক কিমি দূরেই মণিমহেশ। সকালের রোদ্দুরে হিমশৈল চোখ ঝলসে দিচ্ছে যেন। ধনচো থেকে পথ কিছুটা রুক্ষ এবং পাথুরে। গাছও কমে আসছে ক্রমশ হাই অল্টিটিউটের কারণে। গ্লেসিয়ারের বরফগলা জল ছোটো ঝরনার মতো করে পথ কেটেছে এখানে ওখানে।
হাতে লাঠি নিয়ে চড়াই ভাঙতে হচ্ছে। বুকে চাপ ধরছে অক্সিজেনের অপ্রতুলতার কারণে। কিন্তু মন ভরিয়ে দিচ্ছে আশপাশের সৌন্দর্য। মণিমহেশ কৈলাশের অবর্ণনীয় রূপ দেখতে দেখতে এগোচ্ছি এক অমোঘ টানে। কোথাও কোথাও পাহাড়ি ছাগল, ভেড়া নিয়ে চলেছে গাদ্দিরা। শেষের কয়েক কিলোমিটার একেবারে পাথরের বোল্ডার টপকে হাঁটা। কিন্তু সেখান থেকেই চোখে পড়ছে গৌরীকুণ্ডের লাল নিশান।
গন্তব্যে পৌঁছোতে দুপুর গড়াল। আমাদের জন্যই যেন অপেক্ষমান ক্ষেমরাজজির তাঁবু। ওঁর দয়াতেই গরম গরম রাজমা-চাওয়াল জুটে গেল চনচনে খিদের সময়ে। অদ্ভুত জীবন ক্ষেমরাজজির। এপ্রিল থেকে অক্টোবর অবধি উনি ওখানেই থাকেন। বরফ গলা শুরু হতেই তিনি পদার্পণ করেন আর শীতের কামড় শুরু হয় যখন অক্টোবরের শেষ থেকে, সবাই চলে যাওয়ার পর তিনি নেমে আসেন ধনচোতে। যাত্রার সময়ে প্রত্যেক তীর্থযাত্রীর দেখভালের দায়িত্ব নিজেই কাঁধে তুলে নেন।
সন্ধে নামতে বাবার ধুনি ঘিরে শুনছিলাম তাঁর নানা অভিজ্ঞতার কথা। রাত গভীর হতে ঠান্ডাও বাড়ল ক্রমশ। আকাশের সলমা চুমকির শোভা ছেড়ে যে যার তাঁবুতে আশ্রয় নিলাম।
সকালে উঠে এক অবর্ণনীয় শোভা দেখলাম। রাতে এক প্রস্থ বরফ পড়েছে। ফলে চারপাশ সাদা। এক কিমি পথ পেরোলেই মণিমহেশ। চোখের সামনেই তার উদ্ভাসিত রূপ। পৌঁছোনোর পর মণিমহেশ হ্রদের রূপ মুগ্ধ করে দিল। বরফ জলে হাত ছোঁয়ালাম। ঘন্টা খানেক ওই বাকরুদ্ধ করা রূপ দেখে ফেরার পথ ধরলাম। পেছনে তখনও তুষার শৃঙ্গের উপর রোদের আলপনা দিচ্ছে সূর্যদেব।