বাইরের তাপমাত্রা ৭ ডিগ্রিতে নেমে গেছে। প্রচণ্ড বৃষ্টি আর ঝোড়ো হাওয়া। পাশাং-এর বাড়ির ছাদের ঘরে বসে দেখছি কয়েকটা ফ্ল্যাগ এত জোরে জোরে হাওয়ায় উড়ছে যেন মনে হচ্ছে বাইরে প্রলয় চলছে, ঘরে বসে তার কিছুটা আন্দাজ করতে পারছি মাত্র। এত ঠান্ডাতেও প্রচণ্ড ঘামছি। গলার ভিতরটা শুকিয়ে আসছে। কম্বল সরিয়ে হতভম্বের মতো চেয়ে আছি পাশাংয়ের দিকে।
গতকাল এসে পৌঁছেছি লেপচাজগৎ-এ।
৬৮০০ ফুট উঁচুতে পৌঁছে গেছি। গাড়িটা শিলিগুড়ি থেকে দার্জিলিং যাবার রাস্তায় ঘুম থেকে একটা বাঁক নিয়ে এগোল। এই রাস্তাটাই নাকি মিরিক চলে যাচ্ছে। ঘুম পেরোতেই সেই সবুজ প্রকৃতি। গাড়ির এক পাশে পাহাড় আর অন্য পাশে খাদ। প্রতি বাঁকেই ঘুরে যাচ্ছে হিসেবটা। ৮ কিলোমিটার পথ পেরিয়ে পৌঁছে গেলাম লেপচাজগৎ। পাহাড় আর পাইনের জঙ্গল ঘেরা ছোট্ট একটা পাহাড়ি গ্রাম। ঠিক যেন স্বপ্নের মতো।
সকালে ব্রেকফাস্ট-এ ওয়াই-ওয়াই খেতে দিল। খাওয়া শেষে বেরিয়ে পড়লাম ভিউ পয়েন্ট দেখতে। গ্রামের বাড়িঘরের মাঝখান দিয়ে চলে গেছে একটা সরু এবড়োখেবড়ো রাস্তা। গ্রামের রাস্তায় হাঁস মুরগি ঘোরা-ফেরা করছে। লংকা, আচার শুকোতে দেওয়া। একটু এগোতেই দেখতে পেলাম বড়ো বড়ো পাইন গাছের সারি। সাদা রঙের বুদ্ধিস্ট ফ্ল্যাগগুলো পতপত করে হাওয়ায় উড়ছে। হঠাৎ মনে মনে ভাবলাম এই গ্রামে শান্তির বাণী ছড়িয়ে দিয়ে তা কি শহরের অলিগলিতে কি আদৌ পৌঁছোচ্ছে? নাকি দুরত্বটা বড্ড বেশি?
ভিউ পয়েন্টে পৌঁছে দেখি চারিধারটা একধরনের বুনো সাদা ফুলে ভর্তি। ঝাঁকে ঝাঁকে মুক্তো একসাথে। যেন মনে হচ্ছে মুক্তোর চাষ হয়েছে। নীচে পাহাড়ি গ্রাম, আকাঁবাঁকা নদীপথ বারবার মেঘে ঢেকে যাচ্ছে। নীচের দিকে তাকিয়ে দেখলাম একটা বেশ ঘিঞ্জি শহর। পাশাং বলল, ওটা দার্জিলিং।
আমরা উঠেছি কাঞ্চনকন্যা হোমস্টেতে। পাশাং তামাং আর তার পরিবারের বাড়ি। দুই ছেলে, এক মেয়ে, স্ত্রী, বৃদ্ধা মা-কে নিয়ে সংসার পাশাংয়ের। মধ্যবয়সি পাশাংয়ের ব্যবহার বারবার মুগ্ধ করে।
পাশাংয়ের কাছেই শুনছিলাম মাত্র ৪০ ঘর মানুষের বাস এখানে। বেশিরভাগই তামাং, দু এক ঘর রাই, আর ছেত্রী। একটা গল্প বলছিল পাশাং, বহু আগে এখানে শুধু লেপচা জনজাতির মানুষের বাস ছিল। সেই থেকেই নাকি লেপচাজগৎ নামটা এসেছে।
ফেরার পথে একটা জঙ্গলের কথা বলছিল পাশাং। আমি বললাম যাব।
ঠিক হল দুপুরে খাওয়ার পর মনোজ আমাদের নিয়ে যাবে জঙ্গলের মধ্যে ঘুম রক দেখতে। পাশাংয়ের বড়ো ছেলে মনোজ তামাং। ও এখন কলকাতায় থেকে ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ছে। আমাদের বেশ বন্ধুত্ব হয়ে গেল। ওর কাছেই শুনছিলাম কাছের শহর বলতে সুকিয়া, দার্জিলিং, মিরিক, কার্শিয়াংয়ের সাথে লেপচাজগৎ-এর যোগাযোগ ব্যবস্থা বেশ ভালো। এখান থেকে কাজ করতে, পড়াশোনা করতে ওই শহরগুলোতেই যেতে হয়। স্নানে যাওয়ার আগে একবার এসে দাঁড়িয়েছি ছাদের রেলিংয়ের ধারে। একটা পাকা রাস্তা একেবেঁকে মিলিয়ে যাচ্ছে। রাস্তার দু-ধার ঘেঁষে পাইনের জঙ্গল। আর দেখলাম থেকে থেকেই হঠাৎ কোথা থেকে গোছা গোছা মেঘ ভিড় করে আসছে গাছের মাথায়। আবার হঠাৎ উধাও হয়ে চারিধার ঝকঝকে। পরিযায়ী পাখির দল যেমন ভিড় করে গাছের মাথায়, আবার উড়ে যায় অন্য গাছে, ঠিক তেমনিই মনে হচ্ছিল।
ভীষণ ঠান্ডা লাগছে। এত ঠান্ডা যে জল হাতে ধরলেই মনে হচ্ছে আঙুল কেটে যাচ্ছে। স্নান করব না করব না ভাবছি, দেখি গরমজলের বালতি নিয়ে হাজির পাশাং।
বাঁধাকপির সবজি, মুসুরির ডাল, ডিমের ডালনা, পাঁপড় ভাজা দিয়ে পেট ভরে দুপুরের খাবার খেলাম।
ক্যামেরা নিয়ে নীচে এসে দেখি ততক্ষণে মনোজ একটা লাঠি আর কুকরি নিয়ে রেডি। আমি জানতে চাইলাম এটা দিয়ে কি হবে?
ও বলল, “জঙ্গল হ্যায় না, সাফ করতে করতে ঘুস না পড়তা হ্যায়।”
দুপাশে পাইনের জঙ্গল মাঝের চওড়া পাকা রাস্তা ধরে আমরা এগোচ্ছি। দূর থেকে একটা লম্বা ছেলেকে দেখে আমি বলে উঠলাম, ‘আরে ফুটবলার রুড গুলিট না!’
আমার কথায় স্বভাব শান্ত মনোজ হেসে ফেলে বলল, ‘ও মেরা ছোটা ভাই বিনোদ হ্যায়।’
আমরা দুজনেই খুব হাসলাম। সত্যি পাহাড়ের ছেলেমেয়েরা জন্মগত স্টাইলিশ, এ আমার বরাবরের ঈর্ষা। এক দেড় কিলোমিটার রাস্তা।
হেঁটে পৌঁছে গেলাম জঙ্গলের রাস্তায়। চারিদিকে কুয়াশায় ঢেকে গেছে। পাইনের জঙ্গলে যেন অন্ধকার নেমে এসেছে।
আমার মনে হল যে, কোন-ও ভৌতিক সিনেমার আদর্শ শুটিং স্পট। মনোজ আগে আগে আমরা ওর পিছন পিছন। কাঁটাঝোপঝাড় থেকে বেশ বড়ো বড়ো শ্যাওলাধরা গাছের জঙ্গল। একটা গাছে দেখলাম লাল রঙের বুনো স্ট্রবেরি হয়ে আছে। এমন এমন ফুল, পাতা যা কোনওদিন চোখেই দেখিনি। আর আছে আকাশছোঁয়া পাইন গাছ। মেঘগুলো গাছের মাথায় পাখির মতো এসে বসেছে।
‘আঃ! উফ!’
কাঁটার খোঁচায় জ্যাকেটটা ছিঁড়েই গেল। মনোজ যতটা পারছে ডাল কাটতে কাটতে হাঁটছে। একটা জায়গায় গিয়ে থামতে হল। দুটো পা একসাথে ফেলে এগোনোর উপায় নেই। তার উপর আবার আগের দিন বৃষ্টি হয়েছে, তাই মাটি ভেজা। যেকোনও সময় পা স্লিপ করতে পারে। একটা সরু গাছকে ভর করে এক এক পা দিয়ে মনোজের দেখানো পথ দিয়ে এগিয়ে যাচ্ছি। বুনো ফুলের গন্ধে চারিপাশটা ম ম করছে। নানা রঙের প্রজাপতি উড়ে বেড়াচ্ছে। মানুষের এই পথে একদমই যাতায়াত নেই। তাই মাটির উপরে কোনও রাস্তা তৈরি হয়নি বা কাদায় পায়ের ছাপও পাওয়া যাচ্ছে না। এমনকী মাকড়সার জালগুলোও ছিঁড়ে ছিঁড়ে এগোতে হচ্ছে।
এক সময় একটা বিশাল গোলাকার পাথরের সামনে এসে দাঁড়ালাম। এটাই ঘুম রক। দেখে ভালো লাগল যে এখনও এখানে কেউ নিজের নাম বা প্রেমিকার নাম খোদাই করেনি। নইলে কোনও স্মৃতিসৌধ হোক বা পার্কের বেঞ্চ, খোদাইচিত্র দেখে দেখে লজ্জাবোধ হয়।
মনোজের কাছেই শুনলাম আরেকটু এগোলেই একটা ভিউ পয়েন্ট আছে, তার আর একটু উপরে আছে ব্রিটিশ আমলের একটা হাওয়ামহল। এদিকে চারিদিক মেঘ আর কুয়াশাতে ঢেকে গেছে। কতটা যেতে পারব জানি না। ভিউ পয়েন্ট পর্যন্ত পৌছানো গেল। বহু পুরোনো লোহার রেলিং দিয়ে ঘেরা একটা জায়গা। এখন যদিও জায়গাটা খুবই অপরিচ্ছন্ন। আগাছায় ভরে গেছে। লোহার রেলিং-এ মরচে ধরেছে। মনোজ বলল, ‘ব্রিটিশও কা ফেভারিট প্লেস থা।’
আমার একবার মনে হল যেন এখানে কোনও এক শুভ্রবসন সুন্দরী বিদেশিনী অপেক্ষা করতেন তার লেপচা প্রেমিক পুরুষের জন্য। অপূর্ব সুন্দর একটা জায়গা, যেখান থেকে অনেকটা দূর পর্যন্ত দেখা যায় দূরের পাহাড়, নদী।
আমার কল্পনায় জল ঢেলে মনোজের পরামর্শে ফেরার পথে পা বাড়ালাম। আসলে যে-কোনও সময় বৃষ্টি নামবে। ঘন অন্ধকার হয়ে আসছে। হাওয়ামহল দেখা হল না।
মন খারাপ নিয়ে নেমে এলাম। ফেরার পথে মোড়ের দোকানে কফি আর মোমো খেয়ে দুঃখটা একটু পুশিয়ে নিলাম।
মনের মধ্যে একটা আপশোশ কাজ করছে। কি জানি কি ইতিহাস লুকিয়ে আছে হাওয়ামহলের গায়ে। বৃষ্টি নেমেছিল খুব, আর হাওয়াও দিচ্ছিল খুব জোরে। এখন আবার সব পরিষ্কার ঝকঝক করছে। রোদের ঝিলিকও দেখা দিয়েছে।
আমি ভাবলাম এই সুযোগ। মনোজকে নিয়ে হাওয়ামহলটা ঘুরেই আসি। কাল আর সময় হবে না। ঘর থেকে নীচে এসে মনোজের খোঁজ করলাম। বিনীতা বলল, ও বাজারে গেছে। আমার আবার মনটা খারাপ হয়ে গেল। এদিকে সন্ধে হয়ে গেলে আর যাওয়া যাবে না। তাই নিজেই একটা লাঠি নিয়ে জঙ্গলের পথে পা বাড়ালাম।
কিছুক্ষণ আগের বৃষ্টিটাতে মাটি আরও পিছল হয়ে গেছে। স্যাঁতসেঁতে জঙ্গল দিয়ে এগিয়ে যাচ্ছি। ভয় ভয় করছে। কাজটা ঠিক হল তো। ঝড়ে দেখলাম কিছু গাছ ভেঙে পড়েছে। বাঘের ভয় না থাকলেও লেপার্ড-এর ভয় আছে। একবার ভাবলাম ফিরে আসি। পিছন ফিরে তাকাতেই প্রাণপাখি উড়ে গেল। একি রাস্তা কোথায়? চারিদিকে ঘন জঙ্গলের মাঝে আমি একা। সামনে পিছনে কোনও রাস্তাই নেই। কিন্তু কীভাবে সম্ভব। আমার স্পষ্ট মনে আছে, এই পথেই মনোজ নিয়ে এসেছিল। ভয়ে হাত পা ঠান্ডা হয়ে গেছে। হাত ঘড়িতে দেখলাম পাঁচটা পনেরো। এক্ষুণি আঁধার নামবে। আমি কী করব এখন?
লাঠি দিয়ে গাছপালা ঠেলে এগোনোর চেষ্টা করলাম। কাঁটার খোঁচাতে হাত পা ছড়ে গেল। রক্ত ঝরছে চিৎকার করছি প্রাণপণ। কিন্তু একেই জনবিরল জায়গা তাতে ঘন জঙ্গল, কে আসবে। আজ মৃত্যুর মুখোমুখি। কান্না আর অসহায়তা ছাড়া আমার সামনে পিছনে কোনও পথই নেই।
প্রচণ্ড একটা ঝাঁকুনি।
ধড়মড় করে উঠে বসেছি। এই প্রচণ্ড ঠান্ডাতেও দরদর করে ঘামছি।
সেই এসে ঘুমিয়ে পড়েছি। বৃষ্টি এখনও থামেনি। স্বপ্ন দেখে এমন চিৎকার জুড়েছি যে পাশাং ছুটে এসেছে নীচ থেকে।
ঘড়ি দেখলাম রাত আটটা। রুদ্ধশ্বাস তিন ঘন্টা মৃত্যুর মুখোমুখি। হোক না স্বপ্ন। তবুও খুব ক্লান্ত, বিধ্বস্ত লাগছে নিজেকে।
পরদিন ভোর চারটে নাগাদ দরজার কড়া নাড়ার আওয়াজে ঘুম ভেঙে গেল। পাশাং বলল, আকাশ পরিষ্কার, সূর্যোদয় দেখতে হলে এখনই বেরোতে হবে।
কোনওরকমে জ্যাকেট, মাফলার পরে ক্যামেরা নিয়ে অন্ধকারের মধ্যেই হাঁটা দিলাম। ভিউ পয়েন্ট থেকে কাঞ্চনজঙঘা খুব কাছাকাছি পরিষ্কার দেখা যায় শুনেছি। প্রায় এক কিলোমিটার পথ। পৌঁছে দেখি কয়েকজন আগেই চলে এসেছেন। ক্যামেরা হাতে অপেক্ষা করছে সবাই। এতবার দেখেছি, তবু আবার দেখার আশ মেটে না। আকাশের রং বদলাচ্ছে। ধূসর, গোলাপি, লাল, কমলা আর সব শেষে নীল। দূরে কখনও সোনালি আবার কখনো রুপোলি আভা দেখা যাচ্ছে। একটু একটু করে পরিষ্কার হচ্ছে আকাশ। কী অপূর্ব সেই দৃশ্য। একদিকের পাহাড়ে সূর্য উঠছে আর অন্য দিকের বরফের পাহাড়ে সেই আলো পড়ে ঝলমল করে উঠছে। নীল আকাশের মাঝে ভেসে উঠেছে রুপালি কাঞ্চনজঙঘা।
আরে এতদিন শুনেছি, আজ প্রথমবার দেখলাম পূর্ণাবয়ব শায়িত বুদ্ধ। সত্যি কী আশ্চর্য! মাথা, নাক, মুখ, শরীর, পা– সত্যি কেউ যেন শুয়ে আছে। তিনি বুদ্ধদেব কিনা জানা নেই। তবে এত শান্ত, সমাহিত ভঙ্গি কার হতে পারে। মনে হচ্ছে কেউ যেন দোয়াতে করে নীল কালি আকাশের গায়ে ঢেলে দিয়েছে, আর তার মাঝেই শুয়ে আছেন শ্বেতশুভ্রবসন কোনও এক যোগী পুরুষ, স্লিপিং বুদ্ধা।
ক্যামেরার লেন্স বন্ধ করেছি বহুক্ষণ। ভিউ পয়েন্ট ফাঁকা। চেয়ে আছি অসীমতার দিকে। আর বুদ্ধের বাণী লেখা সেই সাদা পতাকাগুলো উড়ছে। সেই হাওয়া ছুঁয়ে যাচ্ছে শরীর মন।
কাল রাতে যে অসহ্য মানসিক যন্ত্রণা, মৃত্যুভয় তাড়া করেছিল, আজ সব ভ্যানিশ হয়ে গেছে।
– বুদ্ধং শরণং গচ্ছামি।
কীভাবে যাবেন
শিলিগুড়ি থেকে শেয়ার গাড়িতে ঘুম। সেখান থেকে গাড়িতে লেপচাজগৎ মাত্র ৭ কিলোমিটার।
অথবা শিলিগুড়ি থেকে সরাসরি গাড়ি নিয়ে লেপচাজগৎ। দূরত্ব ৬৮ কিলোমিটার।
কোথায় থাকবেন
পশ্চিমবঙ্গ সরকারের ফরেস্ট বাংলো আছে। বুকিং কলকাতা WBFDC অফিস। এছাড়া কিছু প্রাইভেট হোম স্টে আছে।