মাতৃত্ব– এই ছোট্ট শব্দটির মধ্যে লুকিয়ে আছে অনেক আবেগ-অনুভূতি। শুধু স্বামী-স্ত্রী-ই নয়, পরিবারের সবাই, এমনকী আত্মীয়-বন্ধুরাও অপেক্ষায় থাকেন নতুন অতিথির জন্য। কিন্তু নানারকম প্রতিবন্ধকতার কারণে আজকাল সন্তানসুখ থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন অনেকেই। এর ফলে সামাজিক, পারিবারিক, এমনকী ব্যক্তিগত ভাবেও হীনম্মন্যতার শিকার হওয়াটাও অস্বাভাবিক নয়। কিন্তু বন্ধ্যাত্বের সমস্যায় বাড়ি বসে মানসিক অবসাদে ভোগা তো বোকামো। তাই কাটিয়ে উঠুন আড়ষ্টতা। চিকিৎসকের দ্বারস্থ হয়ে, আধুনিক চিকিৎসাবিজ্ঞানের সুযোগ নিয়ে সন্তানসুখ লাভ করুন। তবে মনে রাখবেন, বন্ধ্যাত্ব-মুক্তির জন্য সঠিক সময়ে সঠিক চিকিৎসা নেওয়ার প্রয়োজন আছে। এ প্রসঙ্গে ডা. ইন্দ্রাণী লোধ পরিবেশন করলেন কিছু গুরুত্বপূর্ণ তথ্য।

ভুল ধারণা

অনেকের ধারণা আছে যে, সন্তানহীনতা থেকে মুক্তির একমাত্র উপায় হল টেস্ট টিউব বেবি। কিন্তু এটা একেবারেই ভুল ধারণা। বন্ধ্যাত্বের চিকিৎসা করা হয় ধাপে-ধাপে।

প্রথম ধাপ – যখন কোনও দম্পতি বন্ধ্যাত্বের সমস্যা নিয়ে চিকিৎসকদের কাছে যান, তখন প্রথমে তাদের পারিবারিক হিস্ট্রি নেওয়া হয়। যেমন– স্বামী-স্ত্রীর বয়স, কতদিন বিয়ে হয়েছে, কতদিন তারা সন্তানধারণের চেষ্টা করছেন, যৌনমিলনে সমস্যা আছে কিনা ইত্যাদি। এছাড়া, স্ত্রীর নিয়মিত পিরিয়ড হয় কিনা এবং পিরিয়ডের ব্যথা হয় কিনা। সেইসঙ্গে, উচ্চতা অনুসারে স্ত্রীর শরীরের ওজন (বডি মাস ইন্ডেক্স বা বিএমআই), পাস্ট মেডিকেল এবং পাস্ট সার্জিক্যাল হিস্ট্রিও নেওয়া হয়। আগে কোনও প্রেগন্যান্সি এসেছিল কিনা কিংবা গর্ভপাত হয়েছিল কিনা সেই বিষয়েও তথ্য দিতে হয় পেশেন্টকে।

দ্বিতীয় ধাপ – স্বামী এবং স্ত্রী উভয়েরই শারীরিক পরীক্ষা করা হয়। এরমধ্যে ওজন, পাল্স রেট, রক্তচাপ, তলপেট পরীক্ষা এবং ট্রান্স ভ্যাজাইনাল সোনোগ্রাফি বা টিভিএস। অর্থাৎ সাধারণ শারীরিক পরীক্ষায় যা ধরা যায় না, সেটাই টিভিএস-এর মাধ্যমে ডায়গনোসিস করা সম্ভব। টিভিএস-এর দ্বারা জরায়ুর আকৃতি, টিউমার, ওভারির সিস্ট, চকোলেট সিস্ট, পলিসিস্টিক ওভারি সিনড্রোম বা পিসিওএস সবই সঠিকভাবে নির্ধারণ করা সম্ভব।

তৃতীয় ধাপ – এই ধাপে স্বামীর শুক্রাণু পরীক্ষা করা হয়। এই পরীক্ষার জন্য অন্ততপক্ষে তিন দিন ধূমপান, মদ্যপান পরিহার করতে হবে। তবে শুধু স্বামীর শুক্রাণু পরীক্ষাই নয়, স্বামী-স্ত্রী দু’জনেরই রক্ত পরীক্ষাও করা হয়। স্বামীর এইচবি, টিসি, ডিসি, ব্লাড গ্রুপ, সুগার, থাইরয়েড (টিএসএইচ), হিমোগ্লোবিন ইলেক্ট্রোফোরেরিস (থ্যালাসেমিয়া টেস্ট) প্রভৃতি রক্ত পরীক্ষা করতে হবে। আর স্ত্রীর এইচবি, টিসি, ডিসি, সুগার, থাইরয়েড (টিএসএইচ), প্রোল্যাক্টিন, থ্যালাসেমিয়া টেস্ট, ব্লাড গ্রুপ প্রভৃতি টেস্ট করা হয়। তবে শুধু এইসব রক্ত পরীক্ষাই নয়, এর সঙ্গে করতে হবে এএমএইচ (অ্যান্টি মুলেরিয়ান হরমোন) পরীক্ষা। এই বিশেষ রক্ত পরীক্ষা আসলে স্ত্রীর সন্তানধারণের ক্ষমতার সূচক। এএমএইচ ২.০ বা তার বেশি থাকলে সফলতার সম্ভাবনা বেশি থাকে।

চতুর্থ ধাপ – তৃতীয় ধাপ পর্যন্ত যেসব পরীক্ষার কথা বলা হল, সেইসব পরীক্ষার রেজাল্ট যদি ভালো হয় তাহলে পরবর্তী পর্যায়ে দম্পতিকে কিছু ভিটামিন দেওয়া হয়। এই ভিটামিনগুলির মধ্যে রয়েছে ফলিক অ্যাসিড, ভিটামিন ডি, জিংক, সেলেনিয়াম ইত্যাদি। এই ধরনের ভিটামিন্স কমপক্ষে তিনমাস খেতে হয়। ভিটামিন খাওয়া চলাকালীন স্ত্রীর ফ্যালোপিয়ান টিউব টেস্ট করে নিতে হবে। এই টিউব মেয়েদের তলপেটে জরায়ুর দূইদিকে একটি করে দুটি থাকে। এই টিউব আসলে সরু নালিকা, যার মধ্যে দিয়ে ডিম্বাণু ও শুক্রাণুর মিলন ঘটে। গর্ভধারণের জন্য দুটি নালিকার মধ্যে অন্তত একটি নালিকা খোলা থাকা জরুরি। এই টিউব তিনভাবে টেস্ট করা যায়। (১) এক্স-রে করে। যাকে বলে এইচএসজি (হিস্টো সালপিনগোগ্রাফি)। (২) আলট্রাসাউন্ড দিয়ে। যাকে বলে এসএসজি (সোনো সালপিনগোগ্রাফি)। (৩) মাইক্রোসার্জারি করে। যাকে বলা হয় এলডিটি (ল্যাপারোস্কোপি ডাই টেস্ট)। এটি রোগীকে অজ্ঞান করে করা হয়। কিন্তু এইচএসজি বা এসএসজি করার সময় অজ্ঞান করার প্রয়োজন হয় না।

পঞ্চম ধাপ – সব রিপোর্ট ঠিক থাকলে ডিম্বাণু প্রস্ফুটনের জন্য ওষুধ বা ইনজেকশন ব্যবহার করা হয়। এগুলি হরমোন ওষুধ এবং সাধারণত ঋতুপর্বের (মেন্সট্রুয়াল পিরিয়ড) দ্বিতীয় বা তৃতীয় দিন থেকে প্রয়োগ করা হয়। এগ-ট্র্যাকিং বা ডিম্বাণু প্রস্ফুটন টিভিএস (ট্রান্স ভ্যাজাইনাল সোনোগ্রাফি) ফলিকুলোমেট্রি দ্বারা করা হয়। এর জন্য স্ত্রীকে একদিন অন্তর টিভিএস করাতে হয়। ডিম্বাণু ১৮ থেকে ২০ মিলিমিটার সাইজ হলে এইচসিজি ইনজেকশন প্রয়োগ করে তাকে ফোটানো হয়। এভাবে চিকিৎসা করলে গর্ভধারণের সম্ভাবনা তিন থেকে চারগুণ বৃদ্ধি পায়।

·ষষ্ঠ ধাপ – উল্লিখিত (পঞ্চম ধাপ পর্যন্ত) চিকিৎসাতেও যদি সুফল না মেলে, তাহলে আইইউআই-এর (ইন্ট্রা ইউটেরাইন ইনসেমিনেশন) শরণাপন্ন হতে হবে। আইইউআই পদ্ধতিতে পুরুষের শুক্রাণুকে স্পার্ম প্রিপারেশন টেকনিক দ্বারা তৈরি করে, স্ত্রীকে এইচসিজি ইনজেকশন প্রয়োগ করার ৩৬ থেকে ৪০ ঘণ্টার মধ্যে জরায়ুর ভিতরে ওই স্পার্ম প্রবেশ করাতে হয়। এই পদ্ধতিতে গর্ভধারণের সম্ভাবনা আরও কয়েকগুণ বেড়ে যায়।

সপ্তম ধাপ – তিন-চার বার আইইউআই করেও যদি সাফল্য না আসে অথবা দুটি ফ্যালোপিয়ান টিউব-ই যদি ব্লক থাকে, তাহলে আইভিএফ (ইনভিট্রো ফার্টিলাইজেশন) বা টেস্ট টিউব বেবি করাতে হবে।

আইভিএফ কখন এবং কেন

  •  স্বামীর স্পার্ম কাউন্ট যদি কম অথবা শূন্য থাকে
  •   স্ত্রীর ডিম্বাণু যদি তৈরি না হয় অথবা অনিয়মিত পিরিয়ড হয়
  •   পলিসিস্টিক ওভারিজ-এ সন্তানহীনতা
  •  এন্ডোমেট্রিওসিস চিকিৎসার পর বন্ধ্যাত্ব
  •   পিরিয়ড বন্ধ হয়ে গেলে (মেনোপজ)
  •   জরায়ু কিংবা ওভারিতে টিবি (টিউবারকিউলোসিস) থাকলে
  •   দুই থেকে তিনবার মিসক্যারেজ হয়ে থাকলে
  •   ফ্যালোপিয়ান টিউব-এ ব্লকেজ থাকলে
  •    তিন-চার বার আইইউআই করেও সুফল না পেলে
  •    প্রথম সন্তানের পর দ্বিতীয় সন্তান আসতে দেরি হলে
  •    লাইগেশন বা বন্ধ্যাত্বকরণের পরেও সন্তান চাইলে
  •    হিস্টেরেক্টমির পরও সন্তান চাইলে
  •    স্বামী যদি দূরে থাকে (স্পার্ম ফ্রিজিং)
  •    অবিবাহিত মহিলা এবং পুরুষ যদি সন্তান চান
  •     স্বামী অথবা স্ত্রীর যদি কোনও জেনেটিক সমস্যা থাকে৷·
আরো গল্প পড়তে ক্লিক করুন...