চোখের মতো লেন্স হয় না আর মনের মতো মেমরি কার্ড মেলে না। চোখের সেন্সর যার যত বেটার, তার ফ্রেমও তত ওয়াইড। অ্যাপার্চারের হ্যাপা নেই, হোয়াইট ব্যালেন্সের বালাই নেই। শার্টার স্পিড হল চলতি হাওয়ার পন্থি… হাওয়া যেমন দেবে চোখের পাতা তেমন পড়বে। প্রতিটা মানুষের শরীরে এ এক ডিফল্ট ক্যামেরা। এর ভরসাতেই ডিএসএলআরটাকে ব্যাগে পুরলাম।
ভোরের আলো পাইন পাতায় গা ঘষে যখন হিমাচলি পাকদণ্ডিতে নুয়ে পড়েছিল, ঠিক তখন থেকেই ঠায় চলছে। এখন আলোর গায়ে রোদের আগুন। সূর্যটাও সকাল থেকে আশকারা পেয়ে মাথায় চেপে বসেছে। নীলচে সবুজ পীরপাঞ্জাল আর চাপচাপ মেঘমাখা ধৌলাধার তার শৈলমায়ায় ঘিরে রাখলেও, গাড়ির কাচ নামালেই মুখ পুড়ে যাচ্ছে। পাহাড় মানেই ঠান্ডা না কি? বেলা যত বাড়ে তুষার তত গলে। এতক্ষণ পাহাড়টা বেশ বুক চিতিয়েই ছিল। কিন্তু হঠাৎ করেই প্রসারিত বক্ষটা কেমন যেন চুপসে গেল। তবে ওয়াইড অ্যাঙ্গেলে ডেপথ-এ থাকা কালার শেডসগুলো এখন অনেকটা ক্লোজ শটে। হাত বাড়ালেই ছুঁতে পারব।
রংবিরঙ্গি ফুলের জলসার মাঝখান দিয়ে ছুটে চলেছি।
ইতিহাসের শহর ডালহৌসিতে সত্যিই বসন্ত এসে গেছে। ভরাট সবুজকে বুকে জড়িয়ে উঠে যাওয়া খাড়া পাহাড়ের প্রাচীরের গায়ে লাল-হলুদ রং করা কাঠের মনকাড়া স্তম্ভ। অনেকটা আলোর স্তম্ভের মতো। কিন্তু দুপাশে ঝুলন্ত বাক্সে আলোর বদলে উপচে পড়া ফুলেল বনসাই। চড়া রোদে ঝলসে যাওয়া পাকদণ্ডিকে আপন প্রাণের মাধুরী ঢেলে সাজিয়ে রেখেছে।
উৎসব আছে না কি? ড্রাইভারভাইয়ের কাছ থেকে জানলাম কোনও উৎসব নয়। সামনেই বাচ্চাদের স্কুল। তাই স্কুলের আগের ও পরের কিছু রাস্তা এমন করে সাজানো। মনটা শিশু হয়ে গেল চকিতে। সত্যিই তো, মানুষ হবার শুরুর লগ্নে আগে তো প্রকৃতির পাঠ তারপর খাতার পাতায় আঁকিবুঁকি শিক্ষা। নইলে যে সবটাই বৃথা। প্রকৃতির বসন্ত ফুরোলেও মনের বসন্তকে ফুরোতে দিতে নেই। ডিসেম্বর-জানুয়ারিতে ইতিহাসের ডালহৌসি তুষারের সাদা চাদরে নিজেকে ঢেকে নেয়। তখন অন্য মজা। মার্চ থেকে সেপ্টেম্বর ডালহৌসি বেড়াবার আদর্শ মরশুম।
রাত আস্তানা এখানে নয়। সেই ধরমশালাতে। তাই গাড়িটা একটা নিরাপদ জায়গা দেখে থামল। মাটিতে পা রাখতেই ওয়াইড অ্যাঙ্গেলে শহরের প্রাণকেন্দ্র গান্ধি চক। কিন্তু চকে এসে চক্ষু দুখানা যে এমন চড়কগাছে চড়ে বসবে কে জানত? সামনেই ঠাঠা রোদে এলো গায়ে একখানা ফিনফিনে ধুতি জড়িয়ে লাঠি হাতে জাতির জনক এগোবেন বলে ভাবছেন। ব্যস ওইটুকুই। এক পা চলার ক্ষমতাও তাঁর নেই। বর্তমানের এন্তার বৈদ্যুতিক তারে একেবারে আষ্টেপৃষ্ঠে বাঁধা পড়েছেন গান্ধিজি। কোনও মারীচ যেন লক্ষণের ছদ্মবেশে রামের পরম ভক্তকে কালো কালো তারের গণ্ডিতে আটকে রেখেছে। ক্যামেরাবাতিক মনটা নিমেষেই মুষড়ে গেল। সান্ত্বনা খুঁজতে গান্ধিজিকে টপকে পিছনের গির্জাতে। এমন কদর্য চকের গায়ে এক টুকরো রোদ ছিটোনো শান্তিনিকেতন। গাছগাছালির রম্যস্পর্শে মনোরম এই যিশু ও মাতা মেরির ঘরটি ব্রিটিশ আমলের।
ইংরেজরা এখানে এসেছিল ১৮৫৪ তে। সেনাবাহিনী ও সরকারি পদাধিকারিকরা গরমকালের অবসর যাপনের জন্য এখানে এসে সময় কাটাতেন। তখনই এই শহরের পত্তন। ভারতের তৎকালীন গভর্নর লর্ড ডালহৌসির শহর বলে কথা। চেহারার সবখানেই তার ছাপ স্পষ্ট। পায়ে পায়ে ঢুকে পড়ি। শূন্য হাওদামহলের শেষ প্রান্তে রঙিন কাচে মাতা মেরি ও যিশুর ছবি। সামনে প্রার্থনামঞ্চ। সবেমাত্র দু-তিনটে ছবি তুলেছি কি তুলিনি, অমনি কোত্থেকে পিতা যিশুর এক পরমপুত্র তেড়ে এল। ‘দেখতে পাচ্ছেন না ছবি তোলা নিষেধ’… বাপ রে বাপ! সে কী ধমক তার। আমি যেন যিশুর ছবি বেচে কোটিপতি হয়ে যাব! অগত্যা সিক্ত মার্জারের মতো গুটিগুটি পায়ে রাস্তায় লাফিয়ে পড়লাম।
গান্ধি চকে চার্চের দিকে মুখ করে দাঁড়ালে ডানহাতে দুটি পথ। একটি ঊধর্বমুখী কালাটপ স্যাংচুয়ারির দিকে যাচ্ছে। অন্যটি নিম্নমুখী সাতধারা, পঞ্চপুলা। বাঁ-হাতেও দুটি এবং সামনে-পেছনে একটি করে রাস্তা চলে গেছে। সামনের রাস্তাটি কোলাহলের বাজার ছেড়ে নিজের মনে পালিয়েছে একটু নির্জনতার খোঁজে। ছায়ানির্জন আলোমাখা রাস্তা এঁকেবেঁকে সুভাষ বাউলি। চলতে চলতে পথের পাশে সাদা রঙের এক ছোটো জায়গা। সাইনবোর্ডে সুভাষচন্দ্রের সাথে এই জায়গার যোগাযোগ সম্পর্কিত তথ্যাবলি।
কেবলমাত্র বেড়াবার স্থানরূপেই ডালহৌসির খ্যাতি নয়। এখানকার স্থানমাহাত্ম্যের সঙ্গে আবহাওয়ারও এক বড়ো অবদান আছে। শোনা যায়, রোগীদের হাওয়া বদলের আদর্শ জায়গা এটি। সেই সূত্রেই ১৯৩৭ সালে ডা. ধরমবীরার অতিথি হয়ে আরোগ্য লাভের আশায় এখানে আসেন বঙ্গতনয় সুভাষ। ঠিকানা ছিল মেহেরস হোটেলের ১২ নম্বর ঘর। বাস স্ট্যান্ড থেকে ১ কিমি দূরত্বে এখানকার ঝরনার জলে আরোগ্য পান সুভাষচন্দ্র। সেই থেকেই এখানকার নাম সুভাষ বাউলি। ঝরনা নেই। আছে সিমেন্টে বাঁধানো এক আয়তকার ছোট্ট কুণ্ড। সেখানকার জল খাওয়া তো দূরস্থান, একঝলক চোখের দেখা দেখেই পেটটা কেমন মুচড়ে উঠল। তবু কেন জানি না মনে হচ্ছে এখানে যে অনন্ত শান্তি তা বুঝি আর কোথাও নেই। এ আমার ইতিহাসের নস্ট্যালজিয়া নয়, প্রকৃতির প্রতি উদাসী সম্মোহন।
সুভাষ বাউলির রাস্তায় গাড়িটা গড়াতেই ছায়ামাখা ঝিমধরা সবুজের গন্ধ। সিঁড়ি বেয়ে সুভাষ বাউলির মাথায় কিংবা চাতালে উঠতেই দুটো চোখের ফ্রেমজুড়ে হাত নেড়ে অভিবাদন জানাচ্ছে ধৌলাধার, পীরপাঞ্জালের সমুদ্র। ধৌলাধারের পশ্চিমাংশে এই ডালহৌসি। চোখ ফেরানো দায়। নীচের পাকদণ্ডি সাপের চেহারা নিয়েছে। তাকে বেড় দিয়েছে শৈলতরুর দল। তারই ফাঁক দিয়ে অবিন্যস্ত সবুজ-নীল-ঘন নীল পাহাড়ের তরঙ্গমালা। দিগন্তখোলা প্রান্তরে দাঁড়িয়ে পাহাড় দেখা একরকম। সেখানে লুকোচুরির রোমাঞ্চটা নেই। আর ঝিরিঝিরি পল্লবের ফাঁকে ফাঁকে চোরাপলকে পাহাড়ি লাবণ্যে চোখ ভাসানো আরেকরকম। সেখানে আড়ালে লুকিয়ে থাকা প্রতিটি শৃঙ্গকে খুঁজে তার রসাস্বাদন অনবদ্য অভিজ্ঞতা।
এমনি করেই ভেসে গেল কিছুটা সময়। আমাদের ঘিরে কনসার্ট জমাল অচিনপাখির দল। সঙ্গে জঙ্গুলে রোমাঞ্চ। মল রোড শপিং সেন্টার লেখা তোরণের তলা দিয়ে গলে গেলেই ক্যাফে ডালহৌসি। ঘুরতে আসা মানুষজন সকাল কিম্বা বিকেলের জলযোগটা সেখানেই সারে। আবার গাড়ি ছোটানো। গন্তব্য ধরমশালা। তবে তার আগে রাস্তাতেই অজিত সিং রোড ধরে যেতে যেতে সাতধারা, ছোট্ট জনপদ পঞ্চপুলা। রাস্তা বেঁকতেই গাড়িটাকে দাঁড় করিয়ে পাখির চোখে গোটা ডালহৌসিটাকে এক ঝলক দেখে নেওয়া। দঙ্গল বেঁধে নিশিদিন দাঁড়িয়ে থাকা পাহাড়ি জঙ্গলের আড়াল দুহাতে সরিয়ে শহর নয়, এক খণ্ড ইতিহাস উঁকি মেরে আছে। যতই বাকরোটা পাহাড়ের মাথায় চড়ছি তুষারমৌলী হিমালয়ের সৌন্দর্য যেন পরতে পরতে খুলছে। রোদ্দুর সরে যাচ্ছে। পালটে যাচ্ছে চিত্রপট।
উদরপুরে ছুঁচোর নাচন আর সহ্য হচ্ছে না। এখন ভেতো বাঙালির পেট ভরানোর পালা। পৌঁছে গেছি বাকলোহ। এখান থেকেই রাস্তাগুলো একেকটা দিকে ভাগ হয়ে গেছে। অতি সাধারণ এক ধাবায় দ্বিপ্রাহরিক আহার। খাবারও প্রায় শেষের পথে। তবু যা আছে সেটাই এখন অমৃত। এবার ধরমশালার রাস্তা। এখনও ৭৮ কিলোমিটার। বাঁকের পর বাঁক। কখনও পাহাড়ি গাঁয়ের খেতিবাড়ি আবার কখনও নুড়িপাথর ছাপিয়ে চলা খরস্রোতা নদীর পাশ কাটিয়ে ছুটে চলা। একটু একটু করে পৃথিবীর মাটি থেকে আলো তার আগুনরঙা শতরঞ্চি গুটিয়ে নিচ্ছে। ধরমশালার কাছাকাছি আসতেই দুপাশে হলুদ সবুজ নকশিকাঁথার মাঠের মাঝে ধৌলাধারের আগুনঢালা রূপ। দিন ফুরোনোর লালচে চেলি তার সর্বাঙ্গে। পলক ফেলতে মন চাইছে না। ধৌলাধারের পাদদেশেই হিমাচলের ধরমশালার অবস্থান।
শুরু থেকেই ঠিক করেছিলাম শহর থেকে কিছু দূরে রাত কাটাব। সেইমতো লোয়ার ধরমশালা থেকে তিন-চার কিলোমিটার আগে চেক্রতে আমাদের রাতের আস্তানা মিডওয়ে রিসর্ট। সময়টা নভেম্বরের শুরু। ঘরভাড়াতেও ডিসকাউন্ট মিলে গেল। ১২০০ টাকার ঘর ৯০০ টাকায়। রাস্তার ধারে পাহাড়ের কোলে নিরিবিলি ঠিকানা। পাশেই মন্দির। সন্ধে হতেই টংটং ঘণ্টাধবনির সাথে মন্ত্রোচ্চারণ। অসাধারণ পরিবেশ। ঘরের বারান্দায় দাঁড়াতেই চোখে পড়ে আকাশছোঁয়া পাহাড় আর তার বুক চিরে সাদা সিঁথির মতো গাড়িপথ। খানিকটা নীচে নেমে ছুঁতে পারা যাবে ফেলে আসা শৈশবটাকে। মেরি গো রাউন্ড, দোলনা, স্লিপ এবং অবশ্যই কেয়ারি করা সবুজের বাহার। পাশেই বিকেলের পড়ন্ত রোদ গায়ে জড়িয়ে নিশ্চুপ শুয়ে আছে এক নদী। সাদা সাদা নুড়ি-পাথরের পথ পেরিয়ে নীরব চলা তার। কী নাম এই নদীর? হোটেলের লোকটাও গাঁইগুই করে ঘর ছেড়ে বেরিয়ে গেল। আশ্চর্য! এরাও জানে না? পৃথিবীর বুকে এও এক অনাম্নী অঙ্গনা।
হিমকুয়াশার নেশা জমানো আরও একটা সকাল। পাইন-দেওদার-চিরের প্রাচীর দেওয়া পাকদণ্ডি। কাংড়া উপত্যকায় এই ধরমশালা। জেলাসদরও বটে। কাংড়ার রাজা ধরমচাঁদ ১৮৫৫ সালে এই শহরটাকে গড়ে তোলেন। কিন্তু দাপুটে ব্রিটিশের সর্বগ্রাসী মনোভাবের দরুন, রাজা ধরমচাঁদ আজকের পর্যটকদের কাছে ওই নাম না জানা নদীটার মতোই। এখন এটা ব্রিটিশপ্রভুদের নামেই কাটে।
১৮১৫ থেকে ১৯৪৭, এই একশো বত্রিশ বছর ধরে ব্রিটিশদের গড়ে তোলা ৮০ টি হিলস্টেশনের মধ্যে ধরমশালা যে অন্যতম তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। লর্ড এলগিন মহাশয় ধরমশালার প্রেমে হাবুডুবু খেয়ে এখানে একটি গ্রীষ্মাবাস গড়ে তোলার তোড়জোর শুরু করেন। তবে ওই পর্যন্তই। ১৮৬৩ সালে লর্ড এলগিনের মৃত্যুর সঙ্গে-সঙ্গে গ্রীষ্মাবাস পরিকল্পনারও অকালমৃত্যু ঘটে। ধরমশালা শহরের দুটো ভাগ, আপার এবং লোয়ার। মাঝে দূরত্ব ১০ কিলোমিটারের মতো। তবে ৩ কিলোমিটারের একটা চড়াই পথ আছে লোয়ার থেকে আপারে ওঠার। সেটা ট্রেকপথ। তাই সাধারণ মানুষজন সচরাচর সে পথ মাড়ান না। বলাই বাহুল্য, আমিও ওই প্রথম দলের দলি। গ্যাঁট খসিয়ে গাড়ি নিয়ে কে আর চায় পায়ের শুকতলা খসিয়ে অতি রোমাঞ্চিত হতে?
গাড়িটা দিব্যি চলছিল। লোয়ার ধরমশালায় ঢুকতেই অদ্ভূত কাণ্ড! গাড়িতে আছি না কচ্ছপের পিঠে বোঝার উপায় নেই। একে সরু রাস্তা, চড়াই, তার ওপর এদিক-ওদিক বাঁক নিয়েছে। থিকথিক করছে লোক। কোতোয়ালি বাজার ভরে উঠেছে অজস্র দোকানের ভিড়ে। ধীর পদে আঙুলের ফাঁকে ঝোলানো চকমকে মালাগুলো জপতে জপতে তিব্বতীয় লামাদের দল হেঁটে চলেছে। মুখে বিড়বিড়ে মন্ত্রোচ্চারণ। দিনের আলো তাদের সাদা চামড়ায় পিছলে মেরুন বসনে উছলে উঠছে। অনেক লোকের ভিড়ে তারা যেন নক্ষত্রের মতো ঝলমল করছে। লোয়ার ধরমশালাতেই কাংড়া আর্ট মিউজিয়াম। মঙ্গল থেকে শনিবার সকাল ১০টা থেকে বিকেল ৫টা পর্যন্ত খোলা থাকে। কিন্তু আমাদের কপালে সে শিকে ছিঁড়ল না। আজ সোমবার।
নির্বাক থেকে সবাক হয়ে হাই ডেফিনেশনের যুগেও হাওয়া বদলের হদিশ মানেই ম্যাকলয়েডগঞ্জ। আরও আছে। তবে এটা অন্যতম। আমি এখন সেইখানেই। বেশ খানিকটা চড়াই টপকে লোয়ার থেকে আপারে উঠে দলাই লামা মন্দির। এটাই ম্যাকলয়েডগঞ্জ। তবে আগে ভাগসুনাগ মন্দির এবং ভাগসু ঝরনাটা দেখে নেওয়াই সুবিধাজনক। কারণ সেখানে যাবার রাস্তাটা দলাই লামা মন্দির যাবার রাস্তা থেকে বাঁহাতে বেঁকে গেছে। কিন্তু ভিড়ভাট্টার গুঁতোয় ক্ষণিকের ভুলে আগেই দলাই লামা। যাইহোক, পাথর-পুঁতির রঙিন মালা, চামড়ার ব্যাগ, সারে সারে ধাতব বুদ্ধমূর্তি, ঘর সাজাবার হিমাচলি শৌখিন জিনিসের দোকান টপকে গাড়ি রাখবার জায়গা। ঠিক তার সামনেই দলাই লামা টেম্পল।
অনেক ভ্রমণপিপাসুদের কাছেই ধরমশালায় আসার প্রধান কারণ দলাই লামার বাসগৃহটি দেখা। দলাই লামার মন্দির, মার্চ থেকে অক্টোবর মাস পর্যন্ত ভোর ৪টেয় খুলে বন্ধ হয় রাত ১০টায়। নভেম্বর থেকে ফেব্রুয়ারি-র সময়টায় ভোর ৫টায় খোলে আর বন্ধ হয় রাত ৮টায়। শান্তির পথে তিব্বতকে মুক্ত করার জন্য ১৯৮৯ সালে তিনি নোবেল শান্তি পুরস্কারে সম্মানিত হন।
মূল ফটকে প্রবেশ করে নাক বরাবর সোজা গিয়ে ডানহাতে বেঁকতেই কালো মর্মরে তিব্বতী রাষ্ট্রীয় শহিদ স্মারক ফেলে সামনেই অন্দরমহলের সিঁড়ি। কড়া চেকিংয়ের ব্যবস্থা। গোটা ধরমশালা জুড়ে তিব্বতীয় শরণার্থীর ভিড়। নিজেদের দেশ ছেড়ে আজ ওরা পরভুঁয়ের বাসিন্দা। ভারতের অতিথি। অথচ আমাদের মানে প্রতিটি ভারতীয়দেরই প্রবেশের সময়ে মাথা থেকে পা অবধি তুমুল চেকিং করে তবে ছাড়পত্র দেওয়া হচ্ছে। সত্যি বলতে কি, কিছুটা আঁতে লাগলই। কিন্তু ঢুকতেই শান্তির হাওয়া চারিয়ে গেল গোটা শরীর জুড়ে।
কী শান্ত, সৌম্য, ধীরস্থির এখানকার চারপাশ। মানুষগুলো যেন হাঁটছে না, কোনও এক অমোঘের টানে ভেসে চলেছে হাওয়ার মতো, বয়ে যাচ্ছে নদীর মতো। গলার স্বরে শান্ত নদীর কুলকুল ধ্বনি। বিরাট চাতাল শীতলতায় ডুবে আছে। হঠাৎ-হঠাৎ করে মৌনতাকে চুরমার করে ফুঁসে উঠছে একেকটা হাততালির শব্দ। আজব কাণ্ড! কোত্থাও কোনও জলসার নামগন্ধ নেই। সকলেই চোখ বুঁজে কিংবা সাষ্টাঙ্গে প্রণাম করছে। একমনে দেবতা বুদ্ধের দোরের সামনে দেশি-বিদেশির ইচ্ছেকামনা। তাহলে হাততালিটা দিচ্ছে কে? চাতালটার কোণের দিকে লামাদের পাঠের আসর বসেছে। তাঁদেরকে যারা শিক্ষা দিচ্ছে তাঁরাই দেখি নিজেদের ভাষায় কী যেন আওড়ে পটাস-পটাস হাততালি দিচ্ছে। ওঁদের এহেন গূঢ় শিক্ষার অর্থ বোঝার ব্যর্থ চেষ্টা না করে মুখ বাড়ালাম দেবতার ঘরে। দেয়ালে, খিলানে, থামের গায়ে রং ঝলমলে থাংকার শোভা। মাটিতে লাল কার্পেট বিছোনো। ঘরভরা রঙের শামিয়ানার মাঝে সোনার আলোয় জ্বলজ্বল করছেন দেবতা বোধিসত্ত্ব। অর্ধনিমীলিত নয়নযুগলে চোখ রাখলে মন শান্ত হয়। রংবাহারি ধাতুর চালচিত্রে পিঠ ঠেকিয়ে তিনি ধ্যানাসীন।
মন্দিরের মধ্যেই ইচ্ছেখুশির ডানা মেলা যায়। খালি পায়ে যেখানে ইচ্ছে সেখানে যাও। উপরে উঠতেই আরেক শোভা। মাঝখানের ঘরটাকে ঘিরে আছে প্রার্থনা চাকা। ভক্তের মনোবাঞ্ছাপূরণে অনবরত ঘুরেই চলেছে তারা। ঘরের ভিতর সাধনকক্ষ। অবলোকিতেশ্বরের মূর্তি কাচের আবডালে রাখা। সারা ঘরজুড়ে শুধুই চোখ ধাঁধানো বর্ণিল কারুকাজ। পাশের বারান্দায় গিয়ে দাঁড়াতেই ‘আমি কেমন করিয়া জানাব আমার জুড়ালো হূদয় জুড়ালো’! পাহাড়ে পাহাড়ে ঢেউ উঠেছে তখন। সকালের আলোর বন্যাও হার মানছে সেই শৈলতরঙ্গের কাছে। এপাশে একচোখে পুরো ম্যাকলয়েডগঞ্জ শহর। বয়ে চলা প্রাত্যহিক জনজীবনের রংছবি। অন্যপাশে আলো-ছায়ায় প্রকৃতির আদি-অকৃত্রিম পাহাড়িখেলা।
দলাই লামা মন্দির যাবার রাস্তাটি ওয়ান ওয়ে। তাই বেরোবার সময়ে গাড়িগুলো মন্দিরের পিছন দিয়ে উতরাই পথে ঘুরে নেমে আবার চড়াই ধরছে। আবারও ঘিঞ্জি বাজার পেরিয়ে একই রাস্তা। গাড়িটা এক জায়গায় এসে থেমে যাবে। বাকিটা হাঁটাপথ। খুব সামান্যই। চলে আসা ভাগসুনাগ মন্দিরে। লাল-সাদা প্রবেশতোরণ পেরিয়ে মন্দির। তবে মন্দিরে ওঠার আগেই চোখ চলে যাবে সামনের জলাশয়টিতে। লোকে বলে উষ্ণ জলের প্রস্রবণ। তবে উষ্ণতার নামমাত্র তো নজরে এল না। ছেলেপুলেরা ইচ্ছেমতো ঝাঁপ দিয়ে সাঁতরে স্নান করছে সেখানে। চতুর্বাহু নারায়ণ জলাশয়ের পাশে বসে একমনে অভয় দান করে চলেছেন উচ্ছ্বসিত সাঁতারুদের। পাশেই গণেশের পাথরমূর্তি। গদা কাঁধে বজরংবলিও রয়েছেন দিব্যি। এবার মন্দিরের গর্ভগৃহ। দেবতার নীলঘরে গুপ্ত কোনও মাইকে অনবরত বেজে চলেছে ওম নমঃ শিবায়। নীলকণ্ঠ মহাদেবের প্রস্তরমূর্তির পাশটিতে পূজারি মানুষটি বসে ভক্তদের পুজো গ্রহণ করছেন। দ্বাপরযুগে দৈত্যরাজ ভাগসু ও সর্পরাজ নাগ এই মন্দিরের প্রতিষ্ঠাতা। গর্ভঘরের পাশের চত্বরে গিয়ে দাঁড়ালে কাছে-দূরের ধৌলাধারের শোভা, সঙ্গে সবুজ র্যাপারে মোড়া পাহাড়পুরীটাকে দারুণ লাগে। সাদা রঙের একচুড়ো মন্দিরটি বেশ সাদামাটা। তবে পর্যটকের মন ভরিয়ে দেবে মন্দিরসংলগ্ন পাহাড়-প্রকৃতি।
মন্দিরের প্রস্রবণকে পাশ কাটিয়ে গেলেই ভাগসু ঝরনা যাবার রাস্তা। নদীছোঁয়া বিপুল খাদের পাশে পাহাড় কেটে রেলিং ঘেরা বাঁধানো রাস্তা হয়েছে ঝরনার কাছে যাবার। মন্দিরে দাঁড়িয়েই দর্শন মেলে জলপ্রপাতটির। মনে হবে যেন সামান্য পথ। কিন্তু আসলে মন্দির থেকে ঝরনার দূরত্ব প্রায় ২ কিলোমিটার। দুপাশে সবুজের ঠাসবুনোটের বুক উজিয়ে উচ্ছল সে ধারার রূপই অন্যরকম। হিমাচলের এই এক মজা। শহর যতই ঘিঞ্জি হোক, আঁকেবাঁকে ঠিক কোথাও না কোথাও লুকিয়ে থাকবে মায়াবী নিসর্গের হাতছানি। ম্যাকলয়েডগঞ্জ থেকে ফরসিথগঞ্জের দিকে গেলে দেওদার জঙ্গলের মাঝে দেখা মেলে সেন্ট জনস চার্চ। জঙ্গুলে ঝিঁঝিঁ আর অপার্থিব নৈঃশব্দ্যের আলিঙ্গনে কেমন একটা ছমছমে হাওয়া খেয়ে যায় সারা শরীরে।
এরপর ডাল লেকের দুরন্ত রাস্তা। যতই পাহাড়ে উঠছি ততই যেন দেওদার-ওক-পাইনের সারি আমাদেরকে জাপটে ধরছে। গাড়ির কাচ ছুঁয়ে যাচ্ছে পথজোড়া আলো-ছায়ার বায়োস্কোপ। এখানকার ডাল লেকে কাশ্মীরি শিকারা নেই। টলটলে জলে ভেসে চলে না ফুলের জলসা। দেওদার জঙ্গলের ছায়া পড়ে লেকের স্থির নীল জল এখানে সবুজ। কয়েকটি সোনালি মাছ ইতিউতি খেলে বেড়াচ্ছে। সম্ভবত ভ্রমণের ছাত্রবন্ধুর পাতাতেই পড়েছি, এই লেকের জলে স্নান করলে না কি কৈলাস ও মানস সরোবরের পুণ্যি মেলে। কিন্তু ওহে বন্ধুসকল, এই ভ্রমণবন্ধুর একটি কথা মানুন, এই ১৭৭৫ মিটার উঁচুতে এসে প্রাকৃতিক সৌন্দর্যেই মন ভোলান। ভুলেও পুণ্যের লোভ করবেন না। লেকের পাশেই শিবমন্দির।
ধরমশালার স্বর্গটাকে ছোঁব বলেই ডাল লেকের রাস্তাতে আসা। কিন্তু সে কোথায়? স্থানীয় একজন বললেন, এই রাস্তায় আরও খানিকটা উঠলে তবেই নাড্ডি পৌঁছোনো সম্ভব। সাত হাজার ফুট উঁচুতে সত্যিই একটুকরো স্বর্গ যেন। কাঠফাটা রোদেও বেশ একটা নিঝুম-নিঝুম ভাব। চারপাশ ঘিরে কাঁধ ছুঁয়ে আছে ধৌলাধার আর পীরপঞ্জাল। পাখির চোখে কাংড়া ভ্যালি। কানের কাছে আকাশ আর সদ্য ফুরোনো শরতের ছেঁড়া ছেঁড়া মেঘ। টেলিস্কোপে চোখ রাখলে দূরের পাহাড় হাতের তালুতে। পয়সা লাগে না। নিসর্গের কোলেই গজিয়ে উঠেছে কয়েকটা সৌন্দর্যপিপাসু ভ্রামণিকদের রাত-আস্তানা। তাদেরই মাঝখান দিয়ে একটা সরু রাস্তা উঠে গেছে আরও ওপরে। কিন্তু আর তো কিছু নেই। বাকিটা জুড়ে অতলান্ত খাদ, পাহাড় আর আকাশের ঠিকানা। রাস্তাটা হয়তো দিকশূন্যপুরের নিশানা!
কীভাবে যাবেনঃ হাওড়া থেকে ট্রেনপথে চাক্বিব্যাংক কিংবা পাঠানকোট পৌঁছোতে হবে। সেখান থেকে গাড়িপথে ৮৮ কিলোমিটার দূরে ধরমশালা। গাড়ি আগে থেকে বুক করে রাখাই ভালো।
কোথায় থাকবেনঃ ডালহৌসিতে হিমাচল পর্যটনের হোটেল গীতাঞ্জলি (২৪২১৫৫) ও হোটেল মণিমহেশ (২৪২৭৯৩)। খাজিয়ারে হিমাচল পর্যটনের হোটেল দেওদার (২৩৬৩৩৩)। দুটো জায়গাতেই অজস্র বেসরকারি হোটেল আছে। ঘরভাড়া ৬০০-১,৫০০ টাকা।
ডালহৌসি এসটিডি কোডঃ ০১৮৯৯।