অর্থের সঠিক মূল্য এবং সঞ্চয়ের গুরুত্ব যদি শুরু থেকেই বুঝে নেওয়া যায়, তাহলে সঠিক দিশায় পথ চলা অনেক সহজ হয়ে যায়। বাচ্চা যদি শৈশব থেকেই মিতব্যয়ী হয় এবং সঞ্চয় করার গুরুত্ব বুঝতে শিখে যায়, তাহলে ভবিষ্যৎ জীবনে যে-কোনও পরিস্থিতির মুখোমুখি হতে সমস্যা বোধ করবে না।

অভিভাবকদের দাযিত্ব হচ্ছে, সন্তানকে ছোটো থেকেই সাধারণ অভ্যাসগুলো করানো, যাতে তার ভবিষ্যৎ সুরক্ষিত হতে পারে। সঞ্চয়ের গুরুত্ব একবার বুঝতে পারলেই অর্থের সঠিক মূল্য বোঝাটা অনেক সহজ হবে। এর ফলে যথেচ্ছ খরচা করার অভ্যাসেও একটা পরিবর্তন অবশ্যই আসবে। কীভাবে নিজের সন্তানকে তৈরি করবেন, সে বিষয়ে আলোকপাত করার চেষ্টা করা হল।

অর্থের সঠিক মূল্য বোঝান

মূল্যস্ফীতির অবস্থা যখন সারা বিশ্বজুড়ে তখন দরকার হচ্ছে বাচ্চারও অর্থের মূল্য বুঝতে শেখাটা। বাচ্চাকে শৈশব থেকেই বোঝাতে হবে, অর্থ উপার্জনের জন্য আপনি সারাদিন অনেক পরিশ্রম করেন। ওকে এটাও বোঝাবার চেষ্টা করুন, তার চাহিদা পূরণ করার জন্য আপনাকে টাকা জমাতে হয় এবং এই টাকা উপার্জন করা অত সহজ নয়। রীতিমতো পরিশ্রম করতে হয় অর্থ উপার্জন করতে হলে। এটাও বোঝানো দরকার আজেবাজে খরচা করতে থাকলে ধারের বোঝা মাথার উপর চাপতে পারে।

বাচ্চার সব চাহিদা পূরণ করবেন না

সব অভিভাবকেরাই ভালোবাসার খাতিরে বাচ্চার সব সাধ-আহ্লাদ পূরণ করতে চান। কিন্তু যদি বাচ্চাকে অনুশাসন শেখাতে চান এবং কষ্টের অর্জিত অর্থের মূল্য বোঝাতে ইচ্ছুক থাকেন, তাহলে তার ছোটো বড়ো চাহিদাগুলো সঙ্গে সঙ্গে পূরণ করে, বাচ্চার ভবিষ্যৎ নষ্ট করবেন না। কারণ আপনার সব ইচ্ছা সঙ্গে সঙ্গে পূরণ করে দেওয়ার অভ্যাসই বাচ্চাকে ভবিষ্যতে মুশকিলে ফেলতে পারে। বাচ্চা জেদি, অনুশাসনবিহীন হয়ে উঠতে পারে।

নিজের প্রয়োজনকে বশে রাখতে না পারার কারণে তার মধ্যে অপরাধপ্রবণতা গুরুত্ব পেতে পারে এবং সে অপরাধ জগতের সঙ্গে নিজেকে জড়িয়ে ফেলতে পারে। তাই ছোটো থেকেই বাচ্চাকে সত্যিকারের প্রযোজন এবং বিলাসিতার মধ্যে পার্থক্য বোঝাবার চেষ্টা করুন। কোন জিনিসটার জন্য খরচা করতেই হবে এবং কোন খরচটা এড়ানো যেতে পারে, সেটা শৈশব থেকেই বোঝানো জরুরি। তবে একবারে সবকিছু বোঝাবার চেষ্টা না করে ধীরে ধীরে বোঝান।

বাচ্চাকে পিগি ব্যাংক কিনে দিন

বাড়িতে অতিথির যাওয়া-আসা লেগেই থাকে। বেশিরভাগ সময়ে তারা চলে যাবার আগে বাচ্চার হাতে কিছু টাকা দিয়ে যান। এছাড়াও বাড়িতে ঠাকুমা, ঠাকুরদা, কাকা, পিসিরা থাকলে তারাও মাঝেমধ্যে বাচ্চার হাতে কিছু কিছু টাকা দেন। তাছাড়া মা-বাবার কাছ থেকেও হাত খরচা পায় বাচ্চা। এর পুরোটাই আপনার সন্তান খরচ করে ফেলছে, নাকি কিছুটা সঞ্চয় করছে? যদি সঞ্চয় করে জানবেন তার ভবিষ্যৎ সুরক্ষিত। কিন্তু যদি পুরো টাকাটাই ফুর্তি-আনন্দ করতে এবং পছন্দসই জিনিস কিনে খরচা করে ফেলে, তাহলে ভবিষ্যতে বিপদের মুখে পড়ার সম্ভাবনা রয়েছে। আপনাকে প্রথম থেকেই শেখাতে হবে ওই অর্থের মধ্যে কিছুটা খরচ করলেও, বাকিটা জমানো দরকার।

সঞ্চয়ের পথে বাচ্চাকে আকর্ষিত করতে তাকে সুন্দর আকষর্ণীয় দেখতে পিগি ব্যাংক কিনে দিন। কার্টুন বাচ্চারা ভালোবাসে, তাই কার্টুনের আকৃতিরও পিগি ব্যাংক-ও তাকে কিনে দিতে পারেন। পিগি ব্যাংকে টাকা ফেলতে আরম্ভ করলে, সঞ্চয়ের অভ্যাস নিজে থেকেই বিকশিত হবে।

ব্যাংক অ্যাকাউন্ট খুলে দিন

সঞ্চয়ের অভ্যাস তৈরি হলে বাচ্চার কী লাভ হবে, সেটা বাচ্চাকে বোঝান। ওকে বলুন প্রতি মাসে কিছু কিছু জমানো টাকায় বড়ো কিছু ইনভেস্টমেন্ট করতে পারবে ভবিষ্যতে। ব্যাংকে নিয়ে গিয়ে ওর নামে অ্যাকাউন্ট খুলে দিন কারণ ব্যাংকে আজকাল এই সুবিধা রয়েছে। ব্যাংকের খাতায় নিজের নামে টাকা জমা করতে শেখান বাচ্চাকে। ওকে শেখান বর্তমানে অল্প অল্প করে জমানো টাকায়, ভবিষ্যতে কোনও বড়ো প্রযোজন মেটাতে পারবে।

অপ্রযোজনীয় খরচ করার লোকসান বুঝিয়ে বলুন

বাচ্চারা অনেক সময় জিনিস নষ্ট করে। যেমন পেনসিল একটু ছোটো হলেই ডাস্টবিনে ফেলে দেয় বা খাতার পাতা ছিঁড়ে ফেলে। আঁকিবুঁকি কেটে খাতার পাতা নষ্ট করে। দু-তিন পাতা লিখে বাকি খাতা ফেলে দেয়। বাচ্চাকে বলুন গাছ কেটে কাগজ তৈরি হয় সুতরাং পাতা নষ্ট করা মানে, আর একটা নতুন গাছ কাটবার প্রস্তুতি নেওয়া। গাছ আমাদের অক্সিজেন দেয় সুতরাং গাছের বেঁচে থাকা খুব দরকার।

এছাড়াও বিস্কুট, চকোলেট, কোল্ড ড্রিংক, পিৎজা-বার্গার ইত্যাদি খাওয়ার জেদ বাচ্চারা করেই যেটার জন্য বাড়ির খরচার বাজেট বেড়ে যায়। ফাস্টফুড খাওয়ার জন্য বাচ্চাদের শরীর স্বাস্থ্যও খারাপ হয়। স্থূলতা এবং ওবেসিটির শিকার হয় তারা। চাইলেই পাবে এমন অভ্যাসে তারা অভ্যস্ত হয়ে ওঠে। সুতরাং তাদের বোঝানো দরকার এই ধরনের অভ্যাস ত্যাগ করতে হবে। নয়তো তাদের জেদ পূরণ করতে গেলে বাড়ির বয়স্ক ব্যক্তিদের ওষুধের টাকায়, বাড়ির পোষ্যটির খাবারে টান পড়তে পারে।

বাচ্চারা এটা সহজেই বুঝবে কারণ তারা বাড়িতে দাদু, ঠাকুমা এবং পোষ্যের প্রতি খুবই সংবেদনশীল হয়। এর ফলে নিজে থেকেই মিতব্যয়ী হয়ে উঠতে পারে এবং সঞ্চয় করার ইচ্ছা মনের মধ্যে জাগতে পারে।

বাড়ির বাজেট বানানোর সময় বাচ্চাকেও শামিল করুন। বাড়ির বাজেট যখন বানাচ্ছেন তখন বাচ্চারও মতামত নিতে ভুলবেন না।

টাকা-পয়সার চিন্তা, অসুবিধা, আত্মীয়স্বজন বন্ধুবান্ধবকে দেওয়া-নেওয়া ইত্যাদি বিষয়গুলি বাচ্চার কাছে গোপন রাখবার চেষ্টা করা উচিত নয়। কিছুদিন পর থেকেই বাচ্চাও আপনার অবস্থার একটা মোটামুটি ছবি মনের মধ্যে এঁকে নিতে পারবে এবং ধীরে ধীরে দেখবেন আপনার বাচ্চা অকারণ খরচ করা ছেড়ে দিয়েছে এবং সঞ্চয় করার মানসিকতা তার মধ্যে বিকশিত হচ্ছে।

বাচ্চার সঞ্চয় থেকে তাকে প্রযোজনীয় জিনিস কিনে দিন

আপনার সন্তান হয়তো বিশেষ কোনও জিনিসের জন্য কিছুদিন ধরে আপনাকে বলছে যেমন, পড়ার টেবিল-চেয়ার হতে পারে, টেবিল ল্যাম্প বা ভিডিও গেম্স-ও হতে পারে। এগুলোর যে-কোনওটা তার সঞ্চয় করা অর্থ থেকেই ওকে কিনে দিন। এতে বাচ্চার সঞ্চয়ের প্রতি উৎসাহ বাড়বে। আপনার কিনে দেওয়া জিনিসের প্রতিও আপনার বাচ্চার যত্ন বাড়বে।

বাচ্চাকে ক্রিয়েটিভ বানান

বাড়ির পুরোনো জিনিসপত্র দিয়ে প্রযোজনীয় কোনও জিনিস বানানো শেখান। খালি কাচের শিশি দিয়ে পেন স্ট্যান্ড অথবা আইসক্রিমের স্টিক দিয়ে ল্যাম্পশেড ইত্যাদি ক্রাফ্ট বানানো ওকে শেখাতে পারেন। এতে বাচ্চার ক্রিয়েটিভিটি বাড়বে এবং ছোটো থেকেই সব জিনিসকেই গুরুত্ব দিতে শিখবে। এতে আপনারও অকারণ খরচা বাড়বে না।

হাতখরচ কমানো

প্রতি মাসে বাচ্চাকে হাতখরচ দেওয়া ছাড়াও তাকে হাতখরচ কমাতে উৎসাহিত করুন। এছাড়াও বাচ্চা বাড়ির কোনও কাজ করে দিলে বা ছোটো ভাই-বোনকে হোমওয়ার্ক করতে সাহায্য করলে অথবা নিজের ঘর পরিষ্কার করলে, উপহার হিসেবে তাকে কিছু টাকা দিন। সেই টাকা তাকে পিগি ব্যাংক-এ ফেলতে তাকে উৎসাহিত করুন। কাজের বদলে হাতে টাকা পেলে বাচ্চা আনন্দ পায়। তখন পরিশ্রমের গুরুত্ব এবং টাকার মূল্য বুঝতে পারে।

সঞ্চয়ের জন্য পুরস্কার দিন

সঞ্চয় করা আপনার সন্তান শিখে গেলে তাকে পুরস্কৃত করা জরুরি। আপনার কথামতো যদি ওই অঙ্কের মূল্যরাশি জমা করে ফেলতে পারে, তাকে বাহবা দিন, পুরস্কৃত করুন। নতুন পোশাক কিনে দিন বা তার পছন্দের খাবার কিনে দিন আপনার সাধ্যমতো। বাচ্চা যতটা জমিয়েছে সেই সমপরিমাণ অর্থ আপনিও তার অ্যাকাউন্টে জমা করে দিন। এতে বাচ্চার উৎসাহ বাড়বে এবং আরও বেশি সঞ্চয়ের লক্ষ্যে বাচ্চা এগিয়ে আসবে।

 

আরো গল্প পড়তে ক্লিক করুন...