রওনা দিয়েছি চেন্নাই থেকে তাঞ্জোরের উদ্দেশ্যে। রকফোর্ট এক্সপ্রেস চেন্নাইয়ের এগমোর স্টেশন থেকে রাত সাড়ে দশটায় ছেড়ে, পরদিন সকাল সাড়ে ছ’টায় আমাদের তাঞ্জোর পৌঁছে দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়ে রওনা হল।
তাঞ্জোর পৌঁছেই প্রথমে ফ্রেশ হওয়া ও প্রাতরাশ সারার পালা। তারপর চললাম তাঞ্জোর প্যালেস দেখতে। আর্কিওলজিক্যাল সার্ভে দ্বারা সংরক্ষিত মিউজিয়াম দেখতে দেখতে যেন ইতিহাসের সরণি বেয়ে হাঁটলাম। ব্রোঞ্জ নির্মিত প্রচুর নটরাজমূর্তি শোভা পায় এই মিউজিয়ামে। এই সংগ্রহশালা যেন নিজেই একটি শিল্পকীর্তি। একেবারে উপর পর্যন্ত পৌঁছোতে সিঁড়ি দিয়ে প্রায় ছ’তলা উঠতে হয়। আর উপরে পৌঁছে পাখির চোখে ধরা দেয় গোটা শহরটা।
শুধু বাংলা থেকেই নয়, বহু মানুষ বেঙ্গালুরু থেকেও বেড়াতে আসেন তাঞ্জোর-কুম্বাকোনম। ৩ রাত ৪ দিনের ছুটি কাটানোর একেবারে উপযুক্ত স্থান। ইতিহাস ও সংস্কৃতির গাঁটছড়া এই স্থানমাহাত্ম্য বাড়িয়ে দিয়েছে। কুম্বাকোনম বস্তুত চোল সাম্রাজ্যের রাজধানী ছিল। ফলে এক সময় প্রচুর মন্দির গড়ে ওঠে এ অঞ্চলে। তার মধ্যে বৃহদেশ্বর মন্দির, একাধিক নবগ্রহ মন্দির, উপ্পালিপ্পন মন্দির ও দারাসুরমের ঐরাবতেশ্বরম অন্যতম। আরও দেখার আছে টেম্পল অফ সেক্রেড রিভারস কুম্বাকোনম, সর্বেশ্বরণ মন্দির ও স্বামীমালাই স্থিত মুরুগান মন্দির। দেখতে ভুলবেন না তাঞ্জোর পেন্টিং-সমৃদ্ধ আর্ট গ্যালারি। এগুলোর প্রিন্ট তুলনামূলকভাবে কম দামে ওখান থেকে কিনতে পারেন প্রিয়জনদের দেওয়ার জন্য। ফেরার পথে অনেকেই একই সঙ্গে তিরুচিও ঘুরে নেন, মাত্রই ২-৩ ঘন্টার গাড়িপথ।
তাঞ্জোরের মন্দির চোল রাজারা শুধুমাত্র দেবদেবী প্রতিষ্ঠা করার জন্যই গড়ে তোলেননি, বস্তুত এগুলি সংগীত-নৃত্য-শিল্প-স্থাপত্যের একেকটি অপরূপ নিদর্শন। এখনও এই সংস্কৃতির নিদর্শনগুলি খোদিত রয়েছে মন্দিরগাত্রে।
বৃহদেশ্বর মন্দিরটি স্থাপনা করেন রাজা রাজা চোল। তাঁর পুত্র রাজেন্দ্র চোল, ভারতের উত্তর প্রান্ত পর্যন্ত অর্থাৎ গঙ্গার কোল ছুঁয়ে থাকা রাজ্যগুলি জয় করার পর স্থাপনা করেন গঙ্গাইকোন্ডা চোলাপুরম। তাঁর পৌত্র রাজা রাজা (দ্বিতীয়) নির্মাণ করেন দারাসুরমের বিখ্যাত মন্দির। এই তিন প্রজন্মের স্থাপত্য কীর্তি নিয়েই আজকের তাঞ্জোর। পরবর্তীকালে অবশ্য এই অঞ্চলে পান্ডেয়, নায়ক ও মহারাজা সাম্রাজ্যেও তৈরি হয় বেশ কিছু মন্দির।
বৃহদেশ্বর মন্দিরের কারুকাজ মুগ্ধ করবে যে-কোনও শিল্প রসিককেই। মন্দির প্রাঙ্গণে একটি বিশাল নন্দী মূর্তি। মন্দিরের ভিতরে বৃহদেশ্বর শিব। মন্দির প্রাঙ্গণে বেশ কিছু ছোটো মন্দিরে কার্তিকেয়, ছয় মুখ বিশিষ্ট শিব ছাড়া অন্যান্য মূর্তির অবস্থান। চোখ ভরে দেখে নিন মন্দিরের কারুকার্য।
তাঞ্জোর গেলে তাঞ্জোর পেন্টিংস সংগ্রহ করতে ভুলবেন না। রাংতা, সেমিপ্রেশাস স্টোনস্ বসানো এই সব শিল্পকলা পাবেন থেরকু ভিধির সরস্বতী মহল নামের বিপণিতে।
তাঞ্জোর থেকে ত্রিচি অর্থাৎ তিরুচেরাপল্লি যারা ঘুরে নিতে চান, তাদেরও অজস্র মন্দির দর্শনের সুযোগ ঘটবে। রয়েছে ত্রিচির রক ফোর্ট টেম্পল।৪০০টি সিঁড়ি ভেঙে উঠে এক অপূর্ব ভিউ পাবেন। আরও দেখে নিন রঙ্গনাথস্বামী মন্দির। এটি দশম শতাব্দীতে নির্মিত এক বিষ্ণু মন্দির। মন্দিরটির গায়েও অপূর্ব ভাস্কর্য খচিত রয়েছে। এই মন্দির সফর অচিরেই আপনার মন ভরিয়ে দেবে।