রাত ৯-৪০ মিনিটে কলকাতা-ডিব্রুগড় ট্রেনে উঠে পড়লাম লাগেজপত্তর নিয়ে। আমাদের এবারের ডেস্টিনেশন পূর্ব সিকিমের ‘সিল্করুট’ বা রেশমপথ। ট্রেন নৈহাটি ছাড়তেই আলুপরোটা আর টম্যাটো-সস সহ ডিনার সেরে যে যার নির্দিষ্ট সিটে। পরদিন নিউজলপাইগুড়ি-তে পৌঁছোতে প্রায় ২ঘন্টা লেট। ততক্ষণে আমাদের নিতে হাজির ড্রাইভার ধীরাজ তামাং। আর দেরি না করে লাগেজ গুছিয়ে চলা শুরু। সিল্করুটের পথে জুলুকে যাওয়ার আগে আমরা একদিন থাকব পেডং শহরের মাথায়, পাহাড়ের কোলে সবুজে ছাওয়া নতুনভাবে গড়ে ওঠা অফবিট স্পট সিলারি গাঁওতে।
মহানন্দা স্যাংচুয়ারির মাঝখান দিয়ে দ্রুতগতিতে ছুটে চলল গাড়ি। করোনেশন ব্রিজ, সেবক ব্রিজকে পাশ কাটিয়ে দাঁড়ালাম একটি রেস্তোরাঁয় ব্রেকফাস্ট করতে। বেশ সাজানো গোছানো খাবার হোটেল। সবধরনের খাবার পরিবেশন করা হয় এখানে।
ব্রেকফাস্ট করে গাড়ি চলল তিস্তা বাজারের দিকে। হঠাৎ-ই রাস্তার পাশ দিয়ে বয়ে চলা তিস্তা নদী সঙ্গী হল আমাদের। কালিম্পং হয়ে আলগাড়া থেকে পেডং-এর দিকে যেতে যেতে দেখা পেলাম ধাপচাষের নক্সা আঁকা পাহাড় আর ছোটো ছোটো জনবসতির। পেডং বাজারের কিছুটা আগে গাড়ি বাঁক নিল বাঁদিকের রাস্তায়। রাস্তাটি পাহাড়ের গা বেয়ে সোজা চলেছে সিলারি গাঁওতে। মাত্র চার কিলোমিটার পথ। এখানে এসে মনে হল আমরা যেন প্রকৃতির নিজস্ব এয়ার কন্ডিশনিং ব্যবস্থায় প্রবেশ করলাম। প্রত্যেকে গায়ে চাপালাম হালকা শীতবস্ত্র। এই চার কিমি পাথর বিছানো পথে পাহাড়ের গা বেয়ে জঙ্গলের ছায়াঘন পরিবেশে দুলতে দুলতে এগিয়ে চলেছি ক্রমশ উপরের দিকে। থামলাম সাইলেন্ট ভ্যালি দেখতে।
জায়গাটি একেবারে নিশ্চুপ, শান্ত প্রকৃতির। বিশাল বিশাল পাইনগাছগুলো একটি জায়গায় গায়ে গা লাগিয়ে দাঁড়িয়ে। ড্রাইভার বলল– এটাই সাইলেন্ট ভ্যালি, অপূর্ব লাগে দেখতে। অবশেষে প্রায় ৬০০০ ফুট উচ্চতায় উঠে পৌঁছোলাম সিলারি গাঁওতে। আজ আমরা এখানেই নাইট স্টে করব।
হিমালয়ের কোলে সবুজ অরণ্যে ঘেরা নীল আকাশের নীচে শ্বেতশুভ্র কাঞ্চনজঙঘা প্রায় সব সিজনে হাতছানি দেয় এই সিলারি গাঁও থেকে। অসাধারণ ছবির মতো সুন্দর এই গ্রাম রোমান্টিকতায় ভরা। মাত্র ২৫-৩০ ঘর বসতির নিরিবিলি এই গ্রামে দিনভর শোনা যায় হাজারো প্রজাতির পাখির কিচিরমিচির। পাখির অপূর্ব এই কলকাকলি পর্যটকদের মন ভরিয়ে দেবে। সিলারি গাঁও-তে আমাদের থাকার জায়গা হেভেন ভ্যালিতে। এখানে থাকার ব্যবস্থা খুব সুন্দর। সবই হোম স্টে। লাঞ্চ সেরে পায়ে হেঁটে একটু ঘুরে নেওয়া। পাহাড়ের গায়ে জঙ্গলের মধ্য দিয়ে সরু ভাঙাচোরা ট্রেকিং পথে ক্রমশ উপরে উঠতে হয়। প্রায় মিনিট ৩০ হেঁটে পৌঁছে গেলাম রামিতেদাড়া ভিউ পয়েন্টে। পাহাড়ি সৌন্দর্যে মুগ্ধ হয়ে চারপাশের দৃশ্য ক্যামেরাবন্দি করতে থাকলাম আমরা। শুধু এই ভিউ পয়েন্ট থেকেই তিস্তা নদী আর কাঞ্চনজঙঘাকে একই ফ্রেমে ধরা যায়। এখানকার সূর্যাস্ত এককথায় অসাধারণ।
সন্ধ্যা হতেই শীতের হাওয়ার দাপট বেড়ে গেল। এই মে মাসের শেষে জ্যাকেট, টুপি, মাফলার গায়ে দিতে হচ্ছে– ভাবতেই রোমাঞ্চ লাগছে। আঁধার যেন সিলারির বুকে ঝপ্ করে নেমে এল। তাড়াতাড়ি ঘরে ঢুকে এলাম সকলে। গরম গরম-পকোড়া সহ কফি খেতে খেতে শুরু হল আড্ডা। রাত সাড়ে আটটায় রুটি, সবজি, চিকেনকারি দিয়ে জমিয়ে ডিনার সারলাম সকলে। কিছুক্ষণ ঘোরাফেরা করে সোজা খাটে জোড়া কম্বলের তলায়। পরদিন সকালেই আমরা রওনা দেব জুলুকের উদ্দেশ্যে।
চা-খেয়ে স্নান সেরে সকলে প্রস্তুত। জুলুক থেকে আমাদেরকে নিতে গাড়ি নিয়ে চলে এসেছে ড্রাইভার কাম গাইড কর্মা শেরপা। আরও তিনদিন ও আমাদের সঙ্গে থাকবে আর ঘোরাবে। পেশায় কর্মরত মিলিটারি ড্রাইভার। নিজের ছুটিতে এইভাবে গাড়ি ভাড়া খাটায় আর নিজে ড্রাইভিং এবং গাইডের কাজ করে থাকে। সকাল সকাল ব্রেকফাস্ট সেরে রওনা হলাম জুলুকের উদ্দেশে। ফিরতি পথে ওই ড্যান্সিং রোড ধরে এগিয়ে গেলাম। পেডং থেকে সোজা রাস্তায় পেট্রোল পাম্প থেকে গাড়িতে তেল ফুলট্যাঙ্ক করে নিয়ে কিছুদূর গিয়ে দাঁড়াতে হল ঋষিখোলার চেকপোস্টে।
ঋষিখোলার (খোলা মানে নদী) ওপর বিশাল ব্রিজ। নীচে বয়ে চলেছে সরু ঋষি নদীর জলধারা। বর্ষার সময় এই নদীর রূপই বদলে যায়। এখানে চেকপোস্টে আইডি কার্ডের জেরক্স কপি জমা করে প্রবেশ করলাম সিকিমে। ঋষিখোলা থেকে প্রকৃতি যেন আরও ঘন সবুজে জমাট হতে লাগল। পথ চলতে চলতে মাঝেমধ্যেই থামতে হচ্ছিল পাহাড়ি প্রকৃতির বৈচিত্র্যময় রূপ ক্যামেরাবন্দী করতে। পাহাড়ের গায়ে পাইন, ফার, ওক, বার্চ, ম্যাপেল, শিমুল, সহ এক প্রজাতির অপূর্ব দেখতে বাঁশগাছের ঘন বনে ঢাকা ছায়াপথ ধরে চলতে চলতে পেছনে সরে যাচ্ছে ছোটো ছোটো জনপদ।
এপথে ১৯ কিলোমিটার চলা শেষে পৌঁছোলাম রংলীতে। বেশ ছিমছাম, সুন্দর সাজানো, ছোট্ট শহর। দোকান, বাজার, হোটেল, রেস্তোরাঁ সবকিছু একসঙ্গে জুড়ে আছে এখানে। আলপিন থেকে এলিফ্যান্ট সবরকমের জিনিস মিলবে। গাড়ি এসে দাঁড়াল স্ট্যান্ডে। পারমিট করাতে হবে এখান থেকে। এক কপি পাসপোর্ট ছবি আর আইডি কার্ডের কপি দিয়ে ফর্ম ফিল-আপ করে জমা করতে হয় ইমিগ্রেশন অফিসে। তবে জমা দিয়ে পারমিট করিয়ে আনে গাড়ির ড্রাইভার নিজে। অফিস খোলা থাকে সকাল ১০টা থেকে ৩-৩০পর্যন্ত। এই ক্ষণিকের বিরতিতে হালকা স্ন্যাক্স, কোল্ডড্রিংক্স খেলাম সকলে। এপ্রসঙ্গে উল্লেখ্য যে, সিল্করুট যাত্রায় রংলীর পর আর কোনও বড়ো জনপদ মিলবে না। তাই প্রয়োজনীয় যা কিছু দরকার, এখান থেকেই কিনতে হবে।
বেলা প্রায় একটার সময় ড্রাইভার শেরপা পারমিট করিয়ে নিয়ে আনল। শুরু করলাম যাত্রা। ঘন ছায়াপথে বাঁক খেতে খেতে গাড়ি চলল পাহাড়ি চড়াই-এর দিকে। দূরে পাহাড়ের সবুজ প্রকৃতির মাঝে চোখে পড়ল ধাপচাষের জ্যামিতিক নক্সা আর রংবেরঙের বাহারি ফুল। ১০ কিলোমিটার পথ অতিক্রম করে এসে দাঁড়ালাম লিংথাম চেকপোস্টে। জুলুকে প্রবেশের জন্য অনুমতি মিলবে এখানে পারমিট পরীক্ষা করার পর। কিছুক্ষণের মধ্যে আমাদের অনুমতি দেওয়া হল জুলুকে যাওয়ার। চলতে চলতে হঠাৎ রাস্তার পাশে দেখতে পেলাম একটা বেশ লম্বা আকৃতির ঝরনাকে। নাম ‘কিউখোলা ফল্স’।
উঁচু উঁচু পাথরের মধ্যে দিয়ে দুধসাদা জলধারা দুরন্ত গতিতে পড়ছে নীচে। সবুজের বুক চিরে সাদা জলধারার নেমে আসা দেখে সকলে নেমে পড়লাম গাড়ি থেকে। সটান দলবল-সহ চলে গেলাম ঝরনার কাছে। এই অপূর্ব সুন্দর ঝরনাধারার সামনে নিজেকে ধরে রাখতে একে একে ফোটোশেসন চলল বেশ কিছুক্ষণ ধরে। আমাদের দলের শিশুসদস্য ছোট্ট ঋষি, জলধারা দেখে আনন্দে আত্মহারা হয়ে সোজা চলে এসেছে পাথরের মধ্যে দিয়ে বয়ে আসা জলের ধারে। আপনমনে ছোটো ছোটো নুড়ি কুড়িয়ে ছুড়ে ফেলতে লাগল ঝরনায়। হঠাৎ-ই সম্বিত ফিরল ড্রাইভারের ডাকে– ‘দুপুর গড়িয়ে এল তাড়াতাড়ি চলুন!’
আর একমুহূর্ত দেরি না করে উঠে পড়লাম গাড়িতে। দেখতে দেখতে পৌঁছোলাম এক শান্ত, নির্জন ছোট্ট জনপদ পদমচেন-এ। হিমালয়ের পাদদেশে ৭০০০ ফুট উচ্চতায় ঘন জঙ্গল ঘেরা নাতিশীতোষ্ণ আবহাওয়ার এই জায়গাকে লোয়ার জুলুকও বলা হয়। শহরটা মিলিটারিদের নিয়ন্ত্রণাধীন। ছোটো ছোটো দোকান, মিলিটারি হাসপাতাল, হোটেলও রয়েছে। পর্যটকরা ইচ্ছা করলে এখানেও রাত্রিবাস করতে পারেন। এখান থেকে আরও ৮ কিলোমিটার চড়াই পথ গেলে জুলুক। পথ চলতে চলতে কিছুক্ষণের মধ্যে চারপাশের পরিবেশে পরিবর্তন ঘটল। ঘন কুয়াশার মতো সারি সারি মেঘে ঢেকে যেতে লাগল। হিমেল হাওয়া আমাদের গাড়ির জানলা দিয়ে ঢুকে শরীর ছুঁয়ে গেল বেশ কয়েকবার। প্রত্যেকে গায়ে জড়িয়ে নিলাম মোটা শীতবস্ত্র। দূরের পাহাড়ের গায়ে ক্রমশ ভিড় জমাতে লাগল সাদা-কালো মেঘেদের দল। ড্রাইভার কর্মা গাড়ির স্টিয়ারিং ধীরে ধীরে একবার এদিক একবার ওদিক করতে লাগল অতিসন্তর্পণে।
জুলুকে প্রবেশ করতে করতে সমগ্র জুলুকের আকাশ, পাহাড় ঘিরে ধরল মেঘবালিকারা। এ যেন মেঘমুলুকের দেশে এসে পড়লাম। গাড়ি এসে দাঁড়াল জুলুকের একমাত্র থাকার জায়গা দিলমায়া রিট্রিটের দোরগোড়ায়। ঘড়িতে তখন বেলা ৩-৪০ মিনিট। এখানে থাকার ও খাওয়ার সমস্ত বন্দোবস্ত করে ছিলেন এই হোমস্টের মালিক গোপাল প্রধান। হাসিমুখে স্বাগত জানালো আমাদের। তার আপ্যায়ন ও আতিথেয়তা দেখে মুগ্ধ হতে হয়।
জুলুক সম্পর্কে একটা ছোট্ট তথ্য জানিয়ে রাখি প্রথমেই। ৯৫০০ ফুট উচ্চতায় হিমালয়ের সবুজ পর্বতশ্রেণির কোল ঘেঁষে সম্প্রতি গড়ে উঠেছে পূর্ব সিকিমের সিল্করুটের প্রবেশদ্বার এই জুলুক। মাত্র ১৫০ ঘর নেপালির বসতি। জনসংখ্যা ৬০০ জনের মতো। একদিকে কাঞ্চনজঙঘার সাদা বরফ ঢাকা পর্বতচূড়া-সহ হিমালয়ের বিভিন্ন পর্বতশিখর বিরাজ করছে, আর অন্যদিকে সবুজের মিছিলে হারিয়ে যাওয়া ছোটো ছোটো টিন ও কাঠের তৈরি ঘরবাড়ি সমেত জুলুকের গ্রাম। নভেম্বর-ডিসেম্বর মাসে সমগ্র জুলুক তুষারে ঢাকা পড়ে যায়। শুধু যেন বরফের সাম্রাজ্য। গাছপালা, ঘরবাড়ি পাহাড়চূড়া সবেতেই বরফ। অনিন্দ্যসুন্দর প্রাকৃতিক দৃশ্য। উপর থেকে দেখলে মনে হয় যেন কোনও চিত্রশিল্পী রংতুলি দিয়ে এঁকে দিয়েছে প্রকৃতির গায়ে তার ক্যানভাস। অপরূপ শোভায় শোভিত জুলুকের পরিবেশ। পাহাড়ের মাথায় জলপাই রঙের সেনাছাউনি। ধাপচাষের জ্যামিতিক নক্সা, আর হলুদ পতাকায় মোড়া মন্দির আরও আকর্ষণীয় করে তুলেছে জুলুককে।
হোমস্টের ঘরে লাগেজ নামিয়ে রেখে হাতমুখ ধুয়ে লাঞ্চ সারলাম। ততক্ষণে সূর্য্যিমামা পাটে যেতে বসেছে। খাওয়া শেষে ক্যামেরা সঙ্গে নিয়ে বেরিয়ে পড়লাম সুন্দরী জুলুকের রূপরস আহরণ করতে। পায়ে হেঁটে পাথর বিছানে রাস্তায় একটু উপরের দিকে এলে দেখা যায় বালাসুর সানসেট পয়েন্ট। আমি আর আমার দুই সঙ্গী পৌঁছে গেলাম এই পয়েন্টে। হঠাৎ যেন পাহাড়ের গা থেকে ভেসে বেড়ানো মেঘেরা সরে গিয়ে অভ্যর্থনা জানাল। ধীরে ধীরে আকাশ পরিষ্কার হতে থাকল। চোখের সামনে ধরা দিল কাঞ্চনজঙঘার বরফঢাকা পর্বতচূড়ায় সূর্যের আবির খেলা। হলুদ থেকে কমলা আর কমলা থেকে লাল হয়ে সারা পাহাড়চূড়ায় যেন আগুন ধরতে লাগল। অসাধারণ সেই দৃশ্য। চোখে না দেখলে ভাষায় বর্ণনা করা সম্ভব নয়। জুলুকের আঙিনায় দাঁড়িয়ে এই নয়নজুড়ানো দৃশ্য উপভোগ করা এককথায় আসাধারণ।
সানসেট দেখে ফেরার পথে দেখা একদল কচিকাঁচার সাথে। সরল সাদাসিধে স্বভাবের এই শিশুগুলোর মুখে সবসময় হাসি লেগে থাকে। দেখা হতেই হাত নাড়ে, কেউ কেউ আবার হাত বাড়িয়ে মিঠাই চাইল। পকেটে তখন কোনও লজেন্স ছিল না, অগত্যা কিছু টাকা হাতে ধরিয়ে দিলাম। খুব খুশি হয়ে ‘থ্যাংক ইউ’, বলে ছুটে চলে গেল। সন্ধে নেমে আসছে দেখে পা চালালাম খুব দ্রুত। রাস্তার ধারে পাথরের ওপর বেশ কয়েকটি সুন্দর ছোট্ট চেহারার পাখিরও দেখা মিলে গেল। পক্ষীবিশারদ নই বলে নাম বলতে পারলাম না। হিমালয়ের পাহাড়ী চড়াই হতে পারে। এরকম বিভিন্ন প্রজাতির পাখি পাওয়া যায় জুলুকের গাছগাছালিতে।
সকলে মিলে আড্ডায় বসলাম ছবির মতো সুন্দর দোতালা হোমস্টের ঘরে। কেয়ারটেকার সুরাজ ঘরে এসে দিয়ে গেল থালাভরা গরম গরম ভেজপকোড়া আর চা। বাইরে যেন নিশ্চুপ হয়ে দাঁড়িয়ে কালোপাহাড়। শুধু শোনা যাচ্ছে বিট্টুর (এখানকার পোষা কুকুর) ডাক। বাইরে ঠান্ডা বাতাস বইছে। রাত বাড়তেই তাপমাত্রার পারদ ক্রমশ কমতে থাকে। রাত ৮-৩০ বাজতে না বাজতেই রাতের খাবার সেরে নেওয়ার জন্য অনুরোধ করল। অগত্যা আড্ডা ছেড়ে বাধ্য হলাম ডাইনিং হলে যেতে। এখানে ডাইনিং হলে খাবার সময় যে যার দলকে সঙ্গে নিয়ে একসঙ্গে বসে খেতে হয়। ওরা সকলের খাবার একসঙ্গে পরিবেশন করে। রাতের খাবারে মেনু হল চিকেন কারি, আলুভাজা আর রুটি। বেশ তৃপ্তি সহকারে রসনাতৃপ্তি করে ঘরে এসে সোজা লেপের তলায়। ততক্ষণে বৃষ্টি শুরু হয়েছে। টিনের চালে বৃষ্টির সিম্ফনিতে ঘুমটা বেশ ভালোই হল। কিন্তু ভোর চারটের সময় সূর্যোদয় দেখতে যাওয়া হল না বৃষ্টির জন্য।
ভোরবেলায় যখন ঘুম ভাঙল তখন পাহাড়ের ঘুম ভাঙেনি। সাদা পেঁজা তুলোর মতো মেঘবালিকারা পাহাড়ের গায়ে জড়িয়ে আছে আষ্টেপৃষ্ঠে। আমাদের হোস্ট বেড-টি দিয়ে গেল ভোর ৫-৩০ মিনিটে। গরম চায়ে চুমুক দিতে দিতে ঝুলবারান্দায় এসে দাঁড়ালাম। গত রাতে ভালোই বৃষ্টি হয়েছে তাই সূর্যের দেখা পেলাম না। বৃষ্টি হওয়াতে এখান থেকে লুং থুং সানরাইজ ভিউ পয়েন্টে (প্রায় ১২৫০০ ফুট উচ্চতায়) যাওয়া হল না সূর্যোদয় দেখার জন্য। সকালে তাই আমরা জুলুক সাইট সিয়িং-এ যাওয়া ঠিক হল। ব্রেকফাস্ট সেরে সকলে প্রস্তুত। ড্রাইভার কাম গাইড কর্মা শেরপা এসে হাজির। সামান্য কিছু শুকনো খাবার আর জল সঙ্গে নিয়ে বেরিয়ে পড়লাম প্রকৃতির সৌন্দর্য উপভোগ করতে।
গাড়ি বাঁক ঘুরতেই এসে পড়লাম ঐতিহাসিক প্রসিদ্ধ সিল্করুটে। ইতিহাসের কিংবদন্তির আলোছায়ায় ঘেরা ৭০০০ মাইল দীর্ঘ রেশমপথ সিকিমের সীমান্তজুড়ে বিস্তৃত ছিল চিন থেকে ভূমধ্যসাগরীয় অঞ্চলে। একসময় জেলেপ-লা, নাথু-লা, কুপুপ, নাথান, জুলুক, অরিটার হয়ে চিনারা এই পথে সিল্ক নিয়ে আসত কালিম্পং পর্যন্ত। তারপর সেগুলো ছড়িয়ে পড়ত সারা ভারতে। প্রায় ২০ দিন ধরে ইয়াকের পিঠে চেপে তারা আসত বাণিজ্য করতে। পুরো ব্যাবসাটা দেখাশোনা করত ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি। আর সেই থেকে এ রাস্তার নাম সিল্করুট।
আমরা জুলুকের নয়নাভিরাম প্রকৃতির মাঝখান দিয়ে সিল্করুট ধরে ক্রমশ পাক খেতে খেতে উপরে উঠছি। ১০ কিলোমিটার পাকদন্ডি পেরিয়ে দাঁড়ালাম থাম্ভি ভিউ পয়েন্টে। এখান থেকে সপরিবারে কাঞ্চনজঙঘা, পান্ডিম, কাবরু এবং হিমালয়ের বরফঢাকা পর্বতশিখরগুলো একদিকে দেখা যায় আর অন্যদিকে মনভোলানো ভুলভুলাইয়ার দেখা মেলে। চোখ জুড়িয়ে যায় এ দৃশ্য দেখে। রেশমপথের রাস্তাগুলো পাহাড়ের বাঁকে কোথায় যে হারিয়ে যাচ্ছে তা উপর থেকে খুঁজে পাওয়া যায় না। তাই তার এইরকম নাম। নীচে পাহাড়গুলোর গায়ে জড়িয়ে রয়েছে বিশাল ময়াল সাপের প্যাঁচানো দেহের মতো রেশমপথ। নীচ থেকে মেঘেদের দল ক্রমশ উঠে আসছে উপরের পাহাড়ে। থাম্ভি থেকে হেয়ারপিন সংকুল ৯৮টি রাস্তা আর শ্বেতশুভ্র কাঞ্চনজঙঘার দৃশ্য জুলুককে আরও আকর্ষণীয় করে তুলেছে। দেখতে দেখতে কালো মেঘে ঢাকা পড়লাম। আবার পরক্ষণেই পরিষ্কার হয়ে উঠল। এই মেঘরোদ্দুরের লুকোচুরি খেলার সাক্ষি হয়ে রইলাম।
এই অপরূপ প্রাকৃতিক শোভায় খানিকটা বিভোর হয়ে পড়েছিলাম। সম্বিত ফিরল শেরপাজির ডাকে। আমাদের আরও উপরে উঠতে হবে। ঝটপট করে চড়ে বসলাম গাড়িতে। আরও চড়াইপথ ভেঙে ৬ কিলোমিটার যাওয়ার পর থামলাম ‘লুং থুং সানরাইজ ভিউ পয়েন্ট’ নামক জায়গায়। এখানে প্রায় সকল পর্যটক ভোররাতে সূর্যোদয় দেখতে আসে জুলুকে বেড়াতে এলে। আবহাওয়া পরিষ্কার থাকলে এখান থেকে সূর্যোদয় এক কথায় অসাধারণ। এখানে দাঁড়িয়ে চোখের সামনে দেখা যায় একদিকে ভুটানের সীমান্ত আর ১৮০ ডিগ্রি কোণে ছড়ানো কাঞ্চনজঙঘার ধবল রূপ। দাঁড়িয়ে থেকে শুধু তারিয়ে তারিয়ে উপভোগ করা।
হঠাৎ আমাদেরই এক সঙ্গীর ডাকে পিছন ফিরে তাকালাম। তিনি ততক্ষণে ঠিক পিছনের পাহাড়ের ঢালে উঠে পড়েছেন ফুল তুলতে। পাহাড়ের গা জুড়ে ভরে রয়েছে লাল রোডোডেনড্রন ফুলে। এই জনমানবশূণ্য পাহাড়ের গায়ে মনে হয় কেউ ফুলের বাগান সাজিয়ে রেখেছে। প্রকৃতির কি অদ্ভুত খেলা! রেশমপথে যেতে যেতে এই রকম ফুলে ভরা বাগান দেখতে পারা এক অসাধারণ সুন্দর অভিজ্ঞতা। এখান থেকে বেশ কিছুটা এগিয়ে লুং থুং সেনাছাউনি দেখে আবার ফিরে এলাম জুলুকে।
সবে গাড়ি থেকে নেমেছি, দেখা পেলাম হিমালয়ান মোনাল পাখির। দ্রুত উড়ে গেল এক পাহাড় থেকে অন্য পাহাড়ের জঙ্গলে। দেখতে অনেকটা আমাদের ময়ূরের মতো। নীল রঙের পালকে ঢাকা দেহ, গলায় হলুদ রেখা আর মাথায় বড়ো লাল রঙের ঝুঁটি। বিকেলের দিকে হাঁটতে হাঁটতে দেখা হল একদল পাখির সাথে। হিমালয়ের কোলে দুর্লভ প্রজাতির পাখির সন্ধান মেলে প্রায়ই।
আজ আমাদের মায়াবী জুলুকে থাকার শেষ দিন। তাই যেন পাহাড়ের মুখগুলোও ভারাক্রান্ত। লাইন দিয়ে যুদ্ধের সেনাদের মতো ধীরে ধীরে মেঘেদের দল ভিড় করতে থাকে সমগ্র জুলুকের গায়ে। আমাদের সকলের মনও আজ বিষাদময়। নীল আকাশের নীচে সবুজ সহ্যদ্রিঘেরা এই জুলুকের আকর্ষণে বার বার ছুটে যেতে মন চায়। তবে হাতে সময় নিয়ে আসলে এখান থেকে ঘুরে আসা যায় লুং থুং নাথান হয়ে কুপুপে। জুলুক থেকে নাথান হয়ে টুকলা ভ্যালির পাশ দিয়ে ওল্ড বাবা মন্দির দেখে পৌঁছানো যায় কুপুপে। ১৪০০ ফুট উচ্চতার কুপুপে পৌঁছে দেখা যায় বিখ্যাত এলিফ্যান্ট লেকটিকে। আমাদের অবশ্য সে সুযোগ নেই তাই। আমরা ভারাক্রান্ত মনে স্বপ্নের জুলুকের স্মৃতি বহন করে ফিরে চললাম বাস্তবের আঙিনায় কর্মময় জীবনে।
প্রয়োজনীয় তথ্য
কীভাবে যাবেনঃ
কলকাতা থেকে ট্রেনে বা বাসে শিলিগুড়ি অথবা এনজেপি স্টেশন। ওখান থেকে জুলুকের গাড়ি ভাড়া করে যাওয়া যায়। জুলুক পর্যন্ত সরাসরি কোনও বাস সার্ভিস নেই। তাই গাড়ি ভাড়া করে আসতে হবে। দিনপ্রতি ভাড়া পড়বে ২৫০০-৩০০০ টাকা।
কোথায় থাকবেনঃ
জুলুকের থাকার উত্তম ব্যবস্থা করে থাকেন গোপাল প্রধান অথবা সুরজ প্রধান, তাদের হোমস্টে দিলমায়া হোমস্টে-তে। এখানে সবই হোমস্টে, কোনও হোটেল পাবেন না এখানে। জনপ্রতি, দিনপ্রতি খরচ ৮৫০-৯০০ টাকা।
কখন যাবেনঃ
বেড়ানোর আদর্শ সময় অক্টোবর-নভেম্বর মাস। এছাড়া বর্ষাকাল বাদে এপ্রিল থেকে মে মাসেও যেতে পারেন।
এখানে থাকা ও খাওয়ার সব ব্যবস্থা একসঙ্গে করা হয়।
শীতবস্ত্র সঙ্গে রাখবেন। বাচ্চা সঙ্গে থাকলে বাচ্চার খাবার সঙ্গে রাখবেন।
জুলুক ভ্রমণের জন্য ২ কপি পাসপোর্ট ছবি এবং আই ডি কার্ডের ফোটোকপি ও ওরিজিনাল সঙ্গে রাখবেন।