আকাশে মেঘ জমেছে। সূর্য এখন আর তেমন চোখ রাঙাবার সুযোগ পাচ্ছে না। মেঘেরা ম্লান করে দিচ্ছে সূর্যের দাপট। খানিক পরে শুরু হল মেঘের গর্জন আর বিদ্যুতের ঝলকানি। হঠাৎই ঝমঝমিয়ে বৃষ্টি নামল। থামল কলরব। থমকে গেল ব্যস্ততা। ঘরমুখোরা ব্যস্ত হয়ে পড়ল বাড়ি ফেরার জন্য। এমনই এক বৃষ্টির আবহে বনান্ত আর বনানী রয়েছে ভিক্টোরিয়া উদ্যানে। মুখোমুখি বসেছিল ওরা। ফেসবুক-এর মাধ্যমে যোগাযোগের পর এই প্রথম ওরা মুখোমুখি হয়েছিল পরস্পরের। বন্ধুত্বের উষ্ণতা Romance উপভোগ করতে করতে কখন যে ঝমঝমিয়ে বৃষ্টি নেমেছে, তা টের পায়নি।

শেষপর্যন্ত যখন ওরা ভিক্টোরিয়ার পূর্বদিকের গেট দিয়ে আকাদেমি অফ ফাইন আর্টস-এর ছাদের তলায় এসে দাঁড়াল, তখন ওদের শরীর বেয়ে নেমে আসছে বৃষ্টির আনন্দধারা। এমন সময় বেজে উঠল বনানীর মুঠোফোন। আর্জেন্ট কাজ আছে, এক্ষুনি বাড়ি ফিরতে হবে। বৃষ্টি তখন কিছুটা কমেছে। বনানী আরও কিছুটা সময় বনান্তর সঙ্গে কাটাতে চাইলেও, ভেজা জামাকাপড় আর আর্জেন্ট কাজের জন্য বিদায় নিতেই হল বনান্তর কাছ থেকে। বনানীকে ট্যাক্সিতে তুলে দেওয়ার পর বনান্ত বলেছিল, যদি ‘জ্বর’ আসে তাহলে ফোন করবে।

সত্যিই ‘জ্বর’ এসেছিল বনানীর। Romance – এর জ্বর। তাই পরের দিন দূরভাষে কাঁপা গলায় থেমে থেমে বনানী বলেছিল বনান্তকে, ‘আমি তোমায় ভালোবেসে ফেলেছি।’ এভাবেই বনান্ত-বনানীর ভালোবাসার সাক্ষী হয়ে রয়েছে এক বৃষ্টিমুখর দিন। এ কোনও গল্প-কথা নয়, এক ঘরোয়া আড্ডায় বনান্ত-বনানী শেয়ার করেছিল তাদের প্রেমের স্মৃতি।

তবে শুধু বনান্ত-বনানীর সম্পর্ক গড়তে বৃষ্টি অগ্রণী ভূমিকা নিয়েছিল এমন নয়, বৃষ্টি সবারই মনে কমবেশি প্রভাব ফেলে। আষাঢ়-শ্রাবণে তাই মন বশে থাকে না রোমান্টিক মানুষ মাত্রেরই। এই সময় বৃষ্টির আনন্দধারা ভিজিয়ে নরম করে দেয় মনকে। গরমের অস্বস্তি কাটিয়ে শরীর জুড়ে তাই নেমে আসে প্রশান্তির পরশ। কোনও দিন যে কবিতার ‘ক’ লেখেনি, সেও বৃষ্টির আবহে হয়ে ওঠে প্রেমিক-কবি। যেমন হয়েছিল বনানী। ফেসবুক-এর প্রাইভেট মেসেজ বক্স-এ বনান্তকে নিয়ে লিখেছিল একটি দারুণ কবিতা। ‘তুমি নও অনন্ত, নও দিগন্ত, তুমি বনের শেষের সবুজ বলয়– বনানীর বনান্ত। একটু আদর পাওয়ার আশায় বসেই থাকো আমার পাশে, তুমি আমি উড়ব এবার বৃষ্টিঝরা এক আকাশে।’

যুগে-যুগে বৃষ্টির আবহে গড়ে ওঠে এমন অনেক প্রেম কাহিনি। কেউ-কেউ বন্ধুবান্ধবদের কাছে তা শেয়ার করে, অনেকে হয়তো করে না।

তবে সুখী দম্পতি প্রণয়-শ্রাবণী অকপটে জানিয়েছে তাদের বিবাহপূর্ব প্রেম-পর্বের ঘটনা। কিছুদিন প্রেম করার পর কোনও এক কারণে প্রণয়ের সঙ্গে মনোমালিন্য হয়েছিল শ্রাবণীর। বলা যায়, অনেকটা দূরত্ব তৈরি হয়ে গিয়েছিল দু’জনের মধ্যে কিন্তু হঠাৎই শ্রাবণের ধারা এসে ধুয়েমুছে দিয়েছিল ওদের মনোমালিন্য এবং দূরত্ব সরিয়ে একাত্ম করেছিল ওদের মন ও শরীরকে। ঝড়বৃষ্টির এক সন্ধেবেলা, অফিস থেকে ফেরার পথে বাস-ট্রাম না পেয়ে শ্রাবণী বিপর্যস্ত অবস্থায় দাঁড়িয়েছিল বাসস্ট্যান্ড-এ। ওই পথেই অফিস থেকে গাড়ি করে ফিরছিল প্রণয়। শ্রাবণীকে ওইভাবে একা দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে গাড়ি থামিয়ে প্রণয় ওর গাড়িতে ওঠার অনুরোধ করে শ্রাবণীকে। শ্রাবণী প্রথমে অভিমানে ‘না’ করলেও, কী ভেবে যেন উঠে পড়েছিল প্রণয়ের গাড়িতে। বসেছিল প্রণয়ের পাশে। শুধু তাই নয়, প্রণয়ের বাড়িতে গিয়ে ভেজা শাড়ি চেঞ্জ করে প্রণয়ের কেনা নতুন সালোয়ার পরে বাড়ি ফিরতে চেয়েছিল শ্রাবণী কিন্তু অবিরাম বৃষ্টি আর অনিচ্ছার কারণে সে রাতে আর বাড়ি ফেরা হয়নি। মান-অভিমান ভুলে, প্রণয়ের ফাঁকা বাড়িতে প্রণয়কে একান্তভাবে পাওয়া উদ্বেল করে তুলেছিল শ্রাবণীকে। ওদের মন আর শরীরের এতটাই উন্মাদনা ছিল যে, পরের দিনই ওরা সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছিল আইনি বিয়ের (ম্যারেজ রেজেস্ট্রি)। আর সেই থেকে আজও ওদের রোমান্স-এ এতটুকুও ভাটা পড়েনি। সুযোগ পেলে আজও ওরা বৃষ্টিতে ভেজে, শরীরে-মনে গভীরভাবে অনুভব করতে চায় সেই বৃষ্টিমুখর নিরালা রাতের প্রতিটি মুহূর্তকে।

এভাবেই বৃষ্টির হাত ধরে প্রেম আসে চুপি-চুপি। প্রভাবিত করে শরীর, মন আর জীবনকে। বৃষ্টিকে পাথেয় করে লেখা হয় কতশত কবিতা, গল্প, গান। তৈরি হয় সিনেমা। মাটির সোঁদা গন্ধ, আলো-আঁধারি পরিবেশ কিংবা বর্ষার রাতে ব্যাঙ আর ঝিঁঝিঁপোকার ডাক– সব মিলে তৈরি হয় অদ্ভুত এক প্রেমময় পরিবেশ। প্রেমিক-প্রেমিকার হৃদয় ব্যাকুল হয়। কেউ চান ভালোবাসার মানুষের হাত ধরাধরি করে বৃষ্টিতে ভিজতে, কেউ চান উদ্যানের নিরালা পরিবেশে এক ছাতার তলায় বসে ঘনিষ্ট হতে। কেউ আবার বৃষ্টি উপভোগ করতে মনের মানুষের হাত ধরে অবসর যাপন করেন পাহাড়, জঙ্গল কিংবা সামুদ্রিক পরিবেশে।

আসলে বর্ষার আবহে এ সবই প্রেমের মহিমা। তবে বৃষ্টি মানেই যে মধুর প্রেম এমন নয় নিশ্চয়ই, বৃষ্টির আবহে বিরহ-বিচ্ছেদের স্মৃতিও নীরবে ঝরায় অশ্রু। যেমন ঘটেছিল খরাজ-স্মৃতিকার জীবনে। একই অফিসের কর্মী ছিল ওরা। রূপে নয়, খরাজের গুণে মুগ্ধ ছিল স্মৃতিকা কিন্তু মুখ ফুটে বলতে পারেনি। এক বৃষ্টিমুখর সন্ধে, মনের ইচ্ছেপূরণ করে দিয়েছিল স্মৃতিকার। প্রচণ্ড বৃষ্টিতে ট্রেন ধরতে স্টেশনে যাওয়ার অসুবিধার অজুহাত দেখিয়ে খরাজকে একসঙ্গে ট্যাক্সিতে বাড়ি ফেরার অনুরোধ করেছিল স্মৃতিকা। একই পাড়ায় থাকার কারণে, খরাজও স্মৃতিকার সিদ্ধান্তকে স্বাগত জানিয়েছিল। তারপর ঝড়বৃষ্টির ওই সন্ধেতে ট্যাক্সিতে টানা একঘন্টার যাত্রাপথে স্মৃতিকা অকপটে তার ভালোবাসা ব্যক্ত করেছিল খরাজকে। খরাজও সম্মান-সম্মতি না জানিয়ে পারেনি। এরপর খরাজ-স্মৃতিকার উষ্ণ প্রেমের মুহূর্তগুলোর সাক্ষী হয়ে আছে কলকাতার বহু উদ্যান, রেস্তোরাঁ আর প্রেক্ষাগৃহ। কিন্তু খরাজের জীবনে সেসব এখন ধূসর স্মৃতি। কারণ দুরারোগ্য ব্যাধি ছিনিয়ে নিয়েছে স্মৃতিকার জীবন। খরাজ তবুও আঁকড়ে আছে স্মৃতিকার স্মৃতি। কিন্তু যখন ঝমঝমিয়ে বৃষ্টি নামে, খরাজ তখন দুঃখ-স্মৃতি ভুলে গিয়ে আলিঙ্গন করার চেষ্টা করে সুখ-স্মৃতিকে। তখন তার শুধু মনে হয়, স্মৃতিকাকে হারানোর বেদনা ধুয়েমুছে দিতেই যেন এই বৃষ্টিপাত।

অতএব, Romance – এর আনন্দ কিংবা বিরহ-বিচ্ছেদের স্মৃতি রোমন্থন– সবই বৃষ্টির আবহে হৃদয় আলোড়িত করে। তাই-তো সংবেদনশীল মানুষমাত্রেই স্বীকার করবেন, প্রেমের বর্ষসেরা ঋতু– ‘বর্ষা’।

আরো গল্প পড়তে ক্লিক করুন...