বর্ষার মরশুম। এই সময়ের আবহাওয়ায় কি আর বিশ্বাস আছে! এই রোদ, এই বৃষ্টি। সকালে গুমোট গরম তো বিকেলে ঝমঝমিয়ে বৃষ্টি। তার উপর বাতাসে আর্দ্রতার দাপট তো রয়েইছে।
বর্ষাকালে বাতাসে থাকা বাড়তি আর্দ্রতার কারণে প্রচন্ড পরিমাণে ঘাম হয়। চ্যাটচেটে ভাব থাকে। ফলে বাতাসে ভেসে বেড়ানো ধুলো, নোংরা সহজে ত্বকে জমা হয়।
চাঁদিফাটা গরম থেকে বৃষ্টি স্বস্তি এনে দেয় ঠিকই, কিন্তু একই সঙ্গে ত্বকের জন্য বয়ে আনে একাধিক সমস্যা। তীব্র গরমে গায়ে অনেকেরই র্যাশ হয়। যার রেশ বর্ষাতেও থেকে যায়। এই সময় মূল চিন্তার কারণ ফাংগাল ইনফেকশন। বৃষ্টিতে ভেজা শরীর কার্যত ফাংগাল ইনফেকশন-কে আমন্ত্রণ জানায়। ফলস্বরূপ চুলকানি হতে শুরু করে। ত্বকে বিভিন্ন জায়গায় গোল গোল লাল প্যাচেস তৈরি হয়। কুঁচকি, হাতের নীচে, মহিলাদের ব্রেস্ট-এর চারিদিকের চামড়ায় ভাঁজ পড়ে। কিছুক্ষেত্রে খসখসে ভাবও চলে আসে। শুধু ত্বকেই নয় এই সংক্রমণ মাথার স্ক্যাল্পেও ছড়িয়ে পড়ে। ফলে এইসময় ইচিং থেকে শুরু করে চুল পড়ে যাওয়া, কোনওটাই অস্বাভাবিক নয়।
সমস্যা যেমন আছে, তেমনই রয়েছে সমাধানের উপায়ও। আপনি যদি স্বাস্থ্য সচেতন হন, তাহলে কিছু সাবধানতা অবলম্বন করলেই বর্ষার সময় ত্বকজনিত সমস্যা অনেকাংশেই কাটিয়ে উঠতে পারবেন।
সতর্কতার সাতকাহন
প্রচুর জল পান করুন
শরীরে যেন জলের অভাব না ঘটে, তা নিশ্চিত করতে হবে। হার্বাল টি, মরশুমি বিভিন্ন ফলের রস দারুণ লাভদায়ক। তেষ্টা পাক বা না পাক প্রচুর জল পান করুন। প্রতিদিন অন্তত ১০-১২ গ্লাস জল পান করুন। অতিরিক্ত ঘাম ঝরে যাওয়ার জন্য যেমন ডি-হাইড্রেশনে ভুগতে হবে না, তেমনই ত্বকের শুকনো ভাবও দূর হবে।
স্কিন অ্যালার্জি
স্কিন অ্যালার্জির পক্ষে বৃষ্টি ক্ষতিকারক। ঘরবাড়ি যথাসম্ভব পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রাখুন। এয়ার ফ্রেশনার্স অথবা কেমিক্যালযুক্ত এরোসোলস ব্যবহার এড়িয়ে চলুন।
সানস্ক্রিন
মেঘলা আকাশ। রোদের তেজ কম ভেবে, অনেকেই সানস্ক্রিন লাগান না, যা ত্বকের জন্য মোটেই সঠিক পদক্ষেপ নয়। এতে ত্বক ক্ষতিগ্রস্ত হয়। রোদের তেজ বা গরম কম হলেও, সূর্যের আল্ট্রা ভায়োলেট রশ্মি কিন্তু রয়েছে, যার থেকে ত্বককে বাঁচাতে বর্ষার মরশুমেও সানস্ক্রিন ব্যবহার বন্ধ করবেন না। বাইরে বেরোলে ছাতা ব্যবহার করুন।
মেক-আপ
মেক-আপের সময় যদি ফাউন্ডেশন লাগাতেই হয়, তাহলে তা যেন খুব হালকা হয়। পারলে এড়িয়ে চলুন। ফেস পাউডার লাগালে ক্ষতি নেই। আই লাইনার এমন হবে, যেন তা বৃষ্টিতে ভিজে গেলে মুছে না যায়।
পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা
অতিরিক্ত ঘামের কারণে শরীরে ময়লা জমে দুর্গন্ধ তৈরি হয়। ফলে জীবাণু সংক্রমণের সম্ভাবনা থেকে যায়। তাই ত্বককে সুস্থ ও উজ্জ্বল রাখতে বেশ কিছু পদক্ষেপ জরুরি–
১) বৃষ্টিতে ভিজলে সবার আগে পরিষ্কার জল দিয়ে মুখ, গা-হাত-পা ধুয়ে নিন
২) সাবানের পরিবর্তে বডিওয়াশ, ফেসওয়াশ ব্যবহার করতে পারেন। প্রয়োজনে স্ক্রাবারও ব্যবহার করতে পারেন, তবে দিনে একবারের বেশি নয়
৩) পাউডার ব্যবহার করলে দিনের শেষে তা পরিষ্কার করে নিন
৪) রাতে শোবার সময় ক্লিনজিং, টোনিং, ময়েশ্চারাইজিং রুটিন বজায় রাখুন
ফাংগাল ইনফেকশন
বর্ষার দিনে ফাংগাল ইনফেকশন পুরোপুরি এড়িয়ে যাওয়া কঠিন। অফিসের কাজেই হোক কিংবা বাড়ির কাজে বেরিয়ে হঠাৎই মাঝপথে কাকভেজা। দীর্ঘক্ষণ সেই ভিজে পোশাকে থাকা, ফাংগাল ইনফেকশনের মূল কারণ। শুধু তাই নয়, এইসময় জামাকাপড়ও ঠিকমতো শুকোয় না। কাপড় পরার আগে ঠিকঠাক শুকিয়েছে কী না তা নিশ্চিত হয়ে নিন। ফাংগাল ইনফেকশনের শুরুতেই প্রতিরোধক পাউডার ব্যবহার করুন।
পায়ের যত্ন
সঠিক জুতো পরার পরও পায়ে সংক্রমণের আশঙ্কা থাকে। বর্ষার জুতো, ব্যাকটেরিয়া ও
ফাংগাল ইনফেকশন থেকে আপনাকে রক্ষা করবে, এমন ভাবনা অবান্তর। বর্ষায় ভিজে জুতো থেকে সংক্রমণ ছড়ায়। এমনকী প্লাস্টিকের জুতো পরলেও তা হতে পারে। সোজা ভাষায় পুরোপুরি প্রতিরোধ সম্ভব নয়। খোলামেলা জুতো, যেটি পরলে পা আলো-বাতাসের সংস্পর্শে আসে, তেমন জুতোই সহায়ক। এতে কিছুটা হলেও ফাংগাসের ইনফেকশন কমে। অ্যান্টি ফাংগাল পাউডার বা ট্যালকম পাউডার ব্যবহার করতে পারেন পায়ের পাতাতে।
চুলের যত্ন
বৃষ্টিতে ভেজার কারণে চুলের গোড়া ভীষণভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয় এই সময়। ইচিং হতে থাকে এবং চুলপড়ার আধিক্যও বেড়ে যায় অনেক। তাছাড়া চ্যাটচেটে আর রুক্ষ হয়ে যাওয়াটাও নতুন কিছু নয়। এসবের হাত থেকে বাঁচতে প্রতিদিন ভালো করে চুল ধুয়ে নিন। একদিন অন্তর শ্যাম্পু করুন। প্রয়োজনে মাসে দুটো স্পাও করাতে পারেন। এতে চুলপড়ার মতো বড়ো সমস্যা থেকে কিছুটা হলেও রেহাই পাবেন।
ত্বকের ঘরোয়া যত্ন
১) দই শুধু উপর থেকেই নয়, ত্বকের ভিতরের ক্ষয়ক্ষতির মেরামতির জন্যও আদর্শ। এককাপ দইয়ের সঙ্গে শসা, বেসন ও টম্যাটোর রস মিশিয়ে প্যাক বানিয়ে মুখে, গলায়, ঘাড়ে ভালোভাবে লাগান। আধঘণ্টা রেখে হালকা গরমজলে ধুয়ে ফেলুন। শুধু দইও লাগাতে পারেন
২) অ্যালোভেরা জেলের সঙ্গে অল্প লেবুর রস মিশিয়ে মাসাজ করলে ভীষণ উপকার পাবেন
৩) ত্বকের যত্নে হলুদও অত্যন্ত কার্যকর। এককাপ কাঁচা দুধের সঙ্গে আধ চামচ হলুদ, একচামচ লেবুর রস মিশিয়ে তা ব্যবহার করতে পারেন
৪) মুলতানি মাটি, চন্দনের গুঁড়ো, কাগজিলেবুর রস, সর তোলা দুধ একত্রে মিশিয়ে মুখে লাগিয়ে রাখতে পারেন
৫) র্যাশের জন্য হলুদ, নিমপাতাও দারুণ উপযোগী
চুলের জন্য ঘরোয়া প্যাক
১) পাকা কলা, আমলকীর রস, মধু ও মেথি মিশিয়ে প্যাক তৈরি করুন। এতে চুলের গোড়া মজবুত হবে
২) অ্যালোভেরা মাথা ঠান্ডা রাখে। চুল পড়াও রোধ করে। অ্যালোভেরা কিছুক্ষণ লাগিয়ে রেখে ধুয়ে ফেলুন
৩) ত্রিফলার সঙ্গে মেথিগুঁড়ো আর ঘৃতকুমারীর রস মেশানো প্যাক বর্ষার জন্য দারুণ উপকারী।
গ্রীষ্ম হোক বা বর্ষা, সুষম ও পুষ্টিকর খাবার ত্বক ও চুলের জন্য ভীষণ জরুরি। মাছ মাংসের তুলনায় সবুজ শাকসবজি বেশি কার্যকর। শাকসবজি থেকে পাওয়া ভিটামিন, প্রোটিন ত্বককে ক্ষতিগ্রস্ত হওয়া থেকে রক্ষা করে। পরিমিত ফাইবার, প্রোটিন ও ভিটামিন ত্বককে সুস্থ রাখে।
বিশেষজ্ঞের টিপস
এই ঋতুর জন্য জরুরি পরামর্শ দিচ্ছেন ‘লাবণ্য বিউটি ক্লিনিক অ্যান্ড পার্লার’-এর কর্ণধার, বিউটি এক্সপার্ট নিবেদিতা সরকার।
১) পরিচ্ছন্নতার উপর বেশি গুরুত্ব দেওয়া উচিত
২) এমন ফেসওয়াশ বা বডিওয়াশ ব্যবহার করুন, যাতে নিম, তুলসী, অ্যালোভেরা ইত্যাদি অ্যাকটিভ ইনগ্রেডিয়েন্টস্ থাকে
৩) বাইরে থেকে ফিরে হাত-পা-মুখ ধোওয়ার সচেতনতা অত্যন্ত প্রয়োজন। তবে সারাবছর যারা প্রাত্যহিক ভাবে নিজের ত্বক ও চুলের যত্ন নেন, পরিবর্তনে তাদের বিশেষ সমস্যা হতে দেখা যায় না
৪) অভিজ্ঞ বিউটি কনসালট্যান্টদের সান্নিধ্যে থেকে সারাবছর নিজেকে সুন্দর রাখুন, যাতে প্রতিটা ঋতুর আনন্দ উপভোগ করতে পারেন
৫) সপ্তাহে অন্তত ৩-৪ দিন শ্যাম্পু করা উচিত। তবে শ্যাম্পু বাছবেন চুলের টেক্সচার এবং সমস্যা অনুযায়ী।