সকাল সাড়ে সাতটায় চড়ে বসলাম জিপ-এ। যেতে হবে তালুকা। সেখান থেকেই ট্রেক-এর শুরু। তালুকার পর ৫-৬ কিমি গাছের ছায়ায় ছায়ায় পথ গিয়েছে সুপিন নদীর সঙ্গে মিতালি পাতাতে পাতাতে। গোবিন্দ পশুবিহার জাতীয় উদ্যানের বুক চিরে পথ। পাইন, চিনার, ওক, অচেনা গাছ-গাছালি, মস, ফার্ন আর রংবেরঙের পাখি ও প্রজাপতির মেলা। দমছুট হয়ে যাওয়ার আগেই একটি টি-ব্রেক। তারপর আবার পথচলা।
প্রথম দিনের গন্তব্য তালুকা থেকে ওসলা। সুপিন নদীকে সঙ্গী করে নদীর খাত বরাবর যে-পথ শুরু হয়েছিল তা ক্রমশ খাড়াই হতে থাকে। কখনও পথ কাটে ছোটো ছোটো ঝরনার ধারা, কখনও পাথর টপকে চড়াই ভাঙ্গা। ১০ কিমি হাঁটার পর যখন বেশ ক্লান্ত, গাইড জানায় লাঞ্চ-ব্রেক নেওয়ার সময় হয়েছে। প্রায় জনপ্রাণীহীন জঙ্গলের পথের বাঁকে হঠাৎই উঁকি মারে একটা ছোট্ট চালাঘর। চা, নুডল্স, ওমলেট নিয়ে শতত ব্যস্ত হয়ে ওঠে দোকানদার।
লাঞ্চ সেরে আবার হাঁটা। হঠাৎই কয়েকঘর বসতির আভাস পেয়ে মন চঞ্চল হয়ে ওঠে– ওই বুঝি আমাদের বহু আকাঙ্খিত ওসলা। কিন্তু হতাশ হতে হয় জেনে যে ওটা ওসলা নয়, অন্য একটি ছোট্ট গ্রাম, নাম গাংগার। প্রকৃতির ক্যানভাসে তখন হঠাৎই দৃশ্য বদল। পথের ক্লান্তি দূর করে বন্দরপুঁছ পাহাড় শ্রেণির অফুরান সৌন্দর্য।
চারটে বাজতে না বাজতেই আকাশ ভেঙে বৃষ্টি। সঙ্গে চটপটিয়ে শিল। রেইনকোট চড়িয়ে কোনওক্রমে এগোতে থাকি। গালে সুচের মতো এসে বিঁধতে থাকে বরফকুচি। এভাবেই একসময় দেখা মেলে ওসলার। বেশ খানিকটা চড়াই ভেঙে পাথুরে পথ পেরিয়ে পৌঁছোনো গেল ওসলার রাত্রিবাসের গন্তব্যে।
সাকুল্যে ত্রিশ ঘর মানুষের বাস ওসলায়। তারই মধ্যে একটি বাড়িতে ব্যবস্থা হয়েছে আমাদের হোম স্টে-র। উষ্ণ কম্বলের আলিঙ্গনে, কাঠের বাড়িতে রাত্রিবাস যে কত আরামপ্রদ হতে পারে– তা এই ওসলায় না এলে জানা যেত না। আশপাশে সবই কাঠের বাড়ি। একটু বর্ধিষ্ণু পরিবারের বাড়িতে সুন্দর নকশা তোলা কাঠের উপর। একটি মন্দির রয়েছে যা দুর্যোধনের মন্দির বলে উল্লিখিত হলেও, বর্তমানে সেখানে সোমেশ্বর মহাদেব পূজিত হন। সভ্যতার যতই অগ্রগতি হোক, ওসলায় এলে মনে হয় সময় যেন থমকে দাঁড়িয়েই আছে– এতটাই বাহুল্যবর্জিত এই গ্রাম।
পরদিন যাত্রা শুরু হর কি দুনের উদ্দেশে। এই পথে গাছপালা তেমন নেই। রুক্ষ পাথুরে প্রান্তর আর সরু পথের বেশিটাই চড়াই। গুজ্জররা ভেড়ার পাল নিয়ে চরাতে এসেছে এদিক ওদিক। পথ আটকায় স্থানীয় ছেলেমেয়েরা, চকোলেটের আশায়। দুপুর পেরোতেই হঠাৎ শিলাবৃষ্টি শুরু হল। হাঁটতে হাঁটতে বুকে চাপ ধরে। তারপর একটা গ্লেসিয়ার পেরিয়ে হঠাৎ-ই খানিকটা সমতল বুগিয়াল। সামনেই চোখ ঝলসে দেওয়া রূপ নিয়ে ধরা দেয় স্বর্গারোহিণী এবং হর কি দুন। পাশাপাশি দুই শৃঙ্গ পাশ দিয়ে প্রবাহিত জৌনধার গ্লেসিয়ার। পাহাড়ের পাদদেশে বরফের গালিচা। প্রচন্ড হাওয়ায় যেন পাঁজরে ধাক্বা লাগে। জিএমভিএন-এর একটি কুটির ও বন দফতরের একটি কুটির ছাড়া থাকার অন্য কোনও ব্যবস্থা নেই হর কি দুন-এ। হর কি দুন-এর সৌন্দর্য পথের ক্লান্তি নিমেষে ভুলিয়ে দেয়। কিন্তু এখনই টেন্ট পিচ করা দরকার। আকাশে আবার কালো মেঘের আঁকিবুকি। বৃষ্টি নামল বলে।