রাজগির-নালন্দা-বুদ্ধগয়া– বুদ্ধ তথা বৌদ্ধধর্মের স্মৃতি বিজড়িত এই ভ্রমণ সার্কিট। প্রায় সব ভ্রমণার্থীরা এই সার্কিট অনুসরণ করেন, খুব সময়াভাব না হলে, এই তিনটির কোনও একটি স্থান বাদ পড়ে না।
শুরু করা যাক রাজগির দিয়ে। রাজগির যেতে হলে নামতে হবে বখতিয়ারপুর স্টেশনে। দানাপুর এক্সপ্রেস আমাদের নামিয়ে দিল বখতিয়ারপুর স্টেশনে এক শীতের ভোরে। হাওড়া থেকে মাত্র ঘন্টা আটেকের জার্নি। দূরত্ব ৪৮৬ কিলোমিটার। স্টেশনের বাইরে রয়েছে গাড়ি, ট্রেকারের মেলা– তার একটু দূরে রয়েছে বাসস্ট্যান্ড। বখতিয়ারপুর স্টেশন থেকে রাজগিরের দূরত্ব ৫৫ কিলোমিটার। দল ভারী রয়েছে– পুরো গাড়ি বুকিং করেই যাত্রা শুরু। তার আগে স্টেশনের বাইরে পুরি-তরকারি আর গরম গরম জিলিপির প্রাতরাশ সমাধা করা হয়েছে।
শীতের সকাল, আকাশ মেঘলা, শনশন করে ঠান্ডা হাওয়া বইছে, ঘন্টা দেড়েকের মধ্যেই পৌঁছে গেলাম বিহার পর্যটনের হোটেল তথাগত বিহারে। চারপাশে বাগান, ঘাসের লনে মোড়া এই সুন্দর হোটেলটি।
রাজগির নামটি এসেছে ‘রাজগৃহ’ থেকে। রত্নগিরি তথা গৃধ্রকূট, উদয়গিরি, শোনগিরি ও বৈভাগিরি পাহাড়ে ঘেরা ছিল, খ্রিষ্টপূর্ব ষষ্ঠ শতাব্দীর মগধ সাম্রাজ্যের রাজধানী রাজগৃহ। রাজগির অনেকগুলি নামে পরিচিত– বাসুমতী, বরহাদ্রামাপুর, গিরিরাজ, কুশাগ্রপুর ও রাজগৃহ। এর মধ্যে রাজগৃহ নামটিই বোধহয় সবচেয়ে সুপ্রযুক্ত কারণ বেশ কয়েক শতক ধরে মগধের রাজধানী ও রাজার আবাসস্থল ছিল এই রাজগৃহ।
বুদ্ধের স্মৃতির সঙ্গে রাজগির ওতপ্রোতভাবে জড়িত। বুদ্ধ এখানে বারো বছর অতিবাহিত করেন। গৃধ্রকূট পর্বতের মাথায় তিনি অবস্থান করতেন– ভিক্ষুক রূপে দ্বারে দ্বারে ঘুরতেন, মহানির্বাণের পর তাঁর বাণী প্রচারিত হয়েছে এই রাজগৃহ থেকেই। এই রাজগৃহেই বুদ্ধদেব মহারাজ বিম্বিসারকে দীক্ষা দিয়েছেন, তাঁর শেষ যাত্রার শুরুও এই রাজগৃহ থেকে।
শুধু বুদ্ধদেব নয়, মহাবীর (জৈন তীর্থঙ্কর) তাঁর ৩২ বছরের ধর্মীয় পরিক্রমার মধ্যে ১৪ বছর কাটিয়েছিলেন এই রাজগিরে ও পার্শ্ববর্তী নালন্দায়। বৌদ্ধ ও জৈন ধর্মের নানা গ্রন্থে রাজগিরকে এক সুন্দর, জনবহুল, ঐতিহ্যশালী, ধর্মনগরী হিসাবে বর্ণনা করা হয়েছে।
এবার তা হলে রাজগিরের পথে নামতে হয়। হোটেলের কাছেই বীরায়তন ব্রাহ্মী কলামন্দিরম। ১৯৭৩ সালে প্রতিষ্ঠিত এই সংগ্রহশালা ঘিরে রয়েছে সুসজ্জিত বাগিচা। এই সংগ্রহশালায় রয়েছে ২৪টি
তীর্থংকর, বিশেষত জৈনধর্মের প্রচারক মহাবীরের জীবনকাহিনি বিভিন্ন মডেলের মাধ্যমে প্রদর্শিত হয়েছে। মডেলগুলি যেন ইতিহাসকে জীবন্ত করে তুলেছে। বিশেষ ভাবে আকর্ষণ করল মহাবীরের এক ত্রিমাত্রিক ছবি যার চারপাশে ঘুরলে সব সময়ে যেন মনে হচ্ছে মহাবীরের দৃষ্টি আপনাকে লক্ষ্য করছে। এই কমপ্লেক্সে রয়েছে ‘জ্ঞানাঞ্জলী’ নামের এক লাইব্রেরি যেখানে ২০,০০০ ধর্মীয় পুস্তক পাওয়া যাবে। রয়েছে ‘নেত্রজ্যোতি’– বিনামূল্যে চক্ষু চিকিৎসাকেন্দ্র।
বীরায়তন সংগ্রহশালা থেকে মাত্র ১ কিমি দূরে রাজগিরের বিখ্যাত উষ্ণপ্রস্রবণ। তবে এখানে রয়েছে পরিচ্ছন্নতার অভাব– শীতের দিনে অবেলায় উষ্ণজলের ধারায় আর নিজেকে সিঞ্চিত করা হল না। ধারার গরমজল জমছে কুন্ডে। ব্রহ্মকুন্ডই প্রধান, তাপমাত্রা ৪৫ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেড। অন্যান্য ধারাগুলি– শতধারা, শালীগ্রাম, সপ্তর্ষি, সীতারাম গণেশ ও সূর্যকুন্ড। তবে উষ্ণ ধারা একটু স্পর্শ করলাম ধুয়ে নিলাম হাত-পা। এই উষ্ণপ্রস্রবণ ঘিরে রয়েছে বিভিন্ন দেবদেবীর মন্দির।
উষ্ণপ্রস্রবণ থেকে বেণুবন। এখানে আবার টিকিট কাটতে হল। এই বেণুবন ছিল বাঁশের এক রাজকীয় অরণ্য যা রাজা বিম্বিসার, বুদ্ধকে বসবাসের জন্য দান করেছিলেন। বর্তমানে এটি একটি বিশাল পার্কের রূপ নিয়েছে। একটি বিশাল সরোবরকে ঘিরে রয়েছে রাস্তা। ইতস্তত ছড়ানো লন, বাগান, গাছপালা এক আরণ্যক পরিবেশ সৃষ্টি করেছে। জলের ধারে বেশ বড়ো বুদ্ধমূর্তি। বেণুবন থেকে বেরিয়েই বীরায়তন রোডে রয়েছে বিখ্যাত জাপানি বুদ্ধ মন্দির। উন্মুক্ত মন্দির চত্বরে সাদা মার্বেলের বুদ্ধমূর্তি সম্ভ্রম আদায় করে নেয়, মন্দিরের অন্দরের বুদ্ধমূর্তি অপেক্ষাকৃত ছোটো হলেও কম সুন্দর নয়।
পরের দিন সকাল। রাজগিরে রয়েছে এক বিশেষ পরিবহন– ঘোড়ায় টানা টাঙা। সাদা ধবধবে দুটো ঘোড়ায় টানা এক রাজকীয় টাঙায় আমরা আসীন। রাজগিরের সাইট-সিয়িং আবার আজকে শুরু হল– গাড়িতে নয় টাঙায়। প্রথমে সবচেয়ে দূরবর্তী লক্ষ্যে। গাদ্দী লেক শহর থেকে প্রায় ১৫ কিলোমিটার দূরে। পথে দেখা হল বিম্বিসারের কারাগারের ধবংসাবশেষ– বিশেষ কিছুই নয় প্রায় ৬০ বর্গমিটার জায়গা দু-মিটার চওড়া দেয়াল দিয়ে ঘেরা। খননকার্যে মেঝেতে গাঁথা শেকল আবিষ্কৃত হয় এখানে। ঘোড়া ছুটছে দুলকি-চালে। শহর পেরিয়ে পিচ রাস্তা ছেড়ে এখন লাল মোরামের পথ। রাস্তার দু-পাশে ঝোপজঙ্গল– রাস্তাও শুনসান, কদাচিৎ একটা-দুটো টাঙা চোখে পড়ে।
পৌঁছে গেলাম লেকের ধারে। লেকের নীল জলকে ঘিরে রেখেছে অনুচ্চ পাহাড়ের শ্রেণি। বোটিংয়ের জন্য নৌকা বাঁধা রয়েছে। এই টুরিস্ট স্পটের নির্মাণকাজ এখনও চলছে– তবে এখানে প্রকৃতি মনোহর। গাদ্দী লেক থেকে ফিরে আসি শহরের কেন্দ্রস্থলে। রাজগিরের প্রধান আকর্ষণ বিশ্বশান্তি স্তূপ, তবে তার অবস্থিতি শহরের মধ্যে নয়, যেতে হবে রত্নগিরি পাহাড় চূড়ায়। যাওয়ার ব্যবস্থা রোপওয়ে অথবা খাড়াই পাহাড়ি হাঁটাপথ। রোপওয়ের টিকিটের বেশ লম্বা লাইন। কিছুটা সময় অযথা ব্যয় হল। এই রোপওয়ের কেবল কার বলতে খোলা চেয়ার সামনে লোহার হাতল তারপর দু-পাহাড়ের মাঝে শূন্যে ওড়া, পা ঝুলছে চেয়ার থেকে, নীচে গভীর খাদ। দুপাশে পাথুরে টিলার গায়ে সবুজ অরণ্য। ২২০০ ফুট দীর্ঘ রোপওয়ে চড়া এক চূড়ান্ত রোমাঞ্চকর অভিজ্ঞতা। রোপওয়ে থেকে নেমে সামান্য হেঁটে পাহাড়শীর্ষে বৌদ্ধস্তূপ, শ্বেতশুভ্র স্তূপটি যেন আভিজাত্য ও সৌন্দর্যের প্রতীক। স্তূপের মাথায় সোনালি শিখর– চারপাশে চারটি সোনালি বুদ্ধমূর্তি। বুদ্ধের মৃত্যুর পর রাজগিরে অনুষ্ঠিত হয় প্রথম আন্তর্জাতিক বৌদ্ধ সম্মেলন। এই সম্মেলনের ২৫০০ বর্ষপূর্তি হিসাবে জাপানিজ বুদ্ধিস্ট অ্যাসোসিয়েশন ১৬০ ফুট দীর্ঘ এই স্তূপটি নির্মাণ করেন এই পাহাড়চূড়ায়। কাছেই রয়েছে এক জাপানি বুদ্ধমন্দির। ড্রামের আওয়াজ ও মন্ত্রোচ্চারণে চারদিক সরগরম। পর্বতশীর্ষ থেকে দেখা যায় পাখির চোখে রাজগির। আর বুদ্ধদেবের অতিপ্রিয় গৃধ্রকূট পর্বতশীর্ষ। ফেরার পথে আবার সেই রোমাঞ্চকর রোপওয়ে যাত্রা। যাতায়াতে ১৫ মিনিটের এই যাত্রা হূদয়ের ওপর একটু বাড়তি চাপ ফেলবে এটা নিশ্চিত।
রাজগিরের অনেক দ্রষ্টব্যের পিছনে রয়েছে পৌরাণিক অথবা ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট। মণিয়ার মঠ হল পুরু ইটের তৈরি কুয়ো আকারে স্থাপত্য, তার মাথায় টিনের চালা, বাইরে খাঁজকাটা শূণ্য কুলুঙ্গি, ভেতরে অবশ্য টেরাকোটার অলংকরণ রয়েছে। এই স্থানটি জরাসন্ধের আখড়া হিসাবে চিহ্নিত করা হয়। পরে এক সাধু এসে আশ্রম গড়েন। আর এক কাহিনি এই স্থাপত্য মণি-নাগের মন্দির হিসাবে চিহ্নিত করেছে। কাছেই খোলা জায়গায় মাটির ওপর সমান্তরাল দুটি দৃঢ় দাগকে শ্রীকৃষ্ণ চালিত অর্জুনের রথের চাকার দাগ হিসাবে চিহ্নিত করা হয়েছে।
বিম্বিসারের স্বর্ণভান্ডার বলে যা পরিচিত তা একটি পাথরের দেয়াল। পাথরের গায়ে অনেকগুলি পাণ্ডুলিপি যা এখনও পাঠোদ্ধার করা সম্ভব হয়নি। ব্রিটিশ সরকার কামান দেগে ধনাগারটি ভেঙ্গে ভেতরের ধনসম্পদ উদ্ধার করার চেষ্টা করেছিলেন কিন্তু পারেননি। দেয়ালে ক্ষতচিহ্নটি তারই প্রমাণ। বিম্বিসারের ধনাগারের অদূরেই লম্বা অমসৃণ পাথরে তৈরি ঐতিহাসিক প্রাচীর। অনুমান করা হয় এটি রাজগৃহ দুর্গ বেষ্টন করে ৪০ কিমি ধরে সুরক্ষার জন্য নির্মিত হয়েছিল প্রাক মৌর্যযুগে। এটি তারই স্মৃতিচিহ্ন। এই প্রাচীর মাইক্লোপিয়ান ওয়াল নামে খ্যাত।
মহাবীর তাঁর ৩২ বছর পরিব্রাজক জীবনের মধ্যে ১৪ বছর কাটিয়েছেন এই রাজগিরে। শহরকে ঘিরে রাখা পাহাড়চূড়ায় রয়েছে অনেকগুলি জৈন মন্দির– সাধারণ পর্যটকরা সেখানে কদাচিৎ পা রাখেন। তবে শহরের মধ্যে রয়েছে দিগম্বর ও শ্বেতাম্বর সম্প্রদায়ের দুটি জৈন মন্দির। শ্বেতাম্বর জৈন মন্দিরের ভূগর্ভস্থিত ঘরে শোভিত ১৮,৫০০ আয়না ঘেরা মহাবীরের মার্বেল মূর্তি। অসংখ্য প্রতিবিম্বের মধ্যে নিজেকে হারিয়ে ফেলার জন্য এটি অবশ্য দ্রষ্টব্য।
এইসব নিয়েই রাজগির। দুদিনে মোটামুটি দেখা হয়ে যায় প্রায় সব দ্রষ্টব্য স্থান। পরের দিনের আমাদের পরিকল্পনা নালন্দা ও পাওয়াপুরী। রাজগির থেকে নালন্দা ১৫ কিমি আর নালন্দা থেকে পাওয়াপুরী ১৮ কিমি। তাই রাজগিরে থেকেই এই ভ্রমণ সম্পন্ন করা যাবে।
বর্তমানে নালন্দার খ্যাতি এক প্রাচীন বিশ্ববিদ্যালয়ের ধবংসস্তূপ হিসাবে। বহুবার ধবংস হয়েছে ও পুনর্নির্মিত হয়েছে বিশ্ববিদ্যালয়টি। প্রাচীন যুগের পাঠগৃহ, স্তূপ, থাকার ঘর চৈত্য এখনও বর্তমান। শেষ ধবংসকার্য ঘটে কুতুবুদ্দিন আইবকের সেনাপতি বখতিয়ার খিলজির আক্রমণের ফলে। কয়েক শতাব্দী ধরে এই ধবংসস্তূপ চলে যায় লোকচক্ষুর আড়ালে, রূপ নেয় এক বিশাল ঢিবির। তারপর আলেকজান্ডার কানিংহ্যাম নামের এক ইংরেজ প্রত্নতত্ত্ববিদ নালন্দার ধবংসস্তূপ আবিষ্কার করেন ও খননকার্য চালান। ১৯১৫ থেকে ১৯৩৭ সাল পর্যন্ত আর্কিওলজিকাল সার্ভে অফ ইন্ডিয়ার খননকার্যে এখনও পর্যন্ত আবিষ্কৃত হয়েছে মঠ, স্তূপ, বুদ্ধমূর্তি, ছাত্রাবাস, ক্লাসঘর, মন্দির চৈত্য ইত্যাদি। খননকার্য কিন্তু এখনও সম্পূর্ণ হয়নি।
খননকার্যের ফলে প্রাপ্ত তথ্যাদি থেকে অনুমান করা যায় যে পঞ্চম শতাব্দী থেকে দ্বাদশ শতাব্দী পর্যন্তই ছিল নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্যাপ্তি ও বিস্তৃতি। অনেক পদ্ম বা নালান আছে যে স্থানে তাকেই বলে নালন্দা, আবার পদ্মের আর এক অর্থ জ্ঞান, সে হিসাবে জ্ঞান বিতরণের কেন্দ্র হিসাবেও নালন্দার নামকরণের স্বার্থকতা খুঁজে পাওয়া যায়। বুদ্ধ বহুবার এসেছেন এখানে– তাঁর প্রিয় পাবারিকের আম্রকুঞ্জে। সে সময়ে নালন্দা ছিল আমবন পরে তা হল বৌদ্ধ সন্ন্যাসী ও ভিক্ষুকদের আবাসস্থল। বুদ্ধের সময়ে নালন্দা কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয় হিসাবে গড়ে ওঠেনি। চিনা পরিব্রাজক হিউয়েন সাঙ পাঁচ বছর ধরে নালন্দায় ছাত্র ছিলেন, তাঁর বিবরণীতে জানা যায়, শুধু বৌদ্ধশাস্ত্র নয়, সাহিত্যদর্শন বেদ, ন্যায়, ব্যাকরণ, জ্যোতিষ, রসায়ন, আয়ুর্বেদ সবই ছিল পাঠ্যসূচির অন্তর্ভুক্ত। প্রায় ২০০০ শিক্ষক ও ১০,০০০ ছাত্রের বাস ছিল এই নালন্দায়।
রাজগির থেকে গাড়িতে আধঘন্টার মধ্যেই পৌঁছে গেলাম নালন্দার গেটে। পূর্ব নির্ধারিত গাইডের সঙ্গে যোগাযোগ করে, টিকিট কাউন্টারে টিকিট কেটে এগিয়ে চলি নালন্দার সেই বিখ্যাত ধবংসস্তূপের দিকে। গাইড কৈলাশ পাসওয়ানের ধারাভাষ্য শুনতে শুনতে আমরা এগিয়ে চলি।
নালন্দার মূল প্রবেশদ্বারের অস্তিত্ব আজও আবিষ্কৃত হয়নি। প্রায় ৩২ একর জুড়ে খননকার্য হয়েছে আর তার ফলে লাল ইটের নানা নির্মাণকল্পের আবিষ্কার। কুশান আর পালযুগের নির্মাণকল্পই বেশি। কেন্দ্রীয় পথ দক্ষিণ থেকে উত্তরে, তবে মনাষ্ট্রিগুলির (বিহার) অবস্থিতি পুবদিকে আর চৈত্যগুলির অবস্থান পশ্চিমদিকে।
আমরা চলে এসেছি সম্রাট অশোক নির্মিত প্রধান স্তূপের কাছে। এর আর এক নাম সারিপুত্ত স্তূপ। এক একটি স্তূপের ধবংসাবশেষের ওপর বারবার নির্মাণে আকার ও আয়তন বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে বৌদ্ধস্তূপ যেন হিন্দু মন্দিরে রূপ নিয়েছে। মন্দিরের বাইরে কতকগুলি স্টাকো বা চুনাবালির মূর্তি। কয়েকটি স্তম্ভের ধবংসাবশেষ এখনও দেখা যায়। ওপরের স্তরে একটি বিশাল বুদ্ধমূর্তি ছিল বলে অনুমান করা হয়। উঠে আসি একেবারে ৩১ মিটার উঁচু স্তূপের শীর্ষে, এটাই বোধহয় পাখির চোখে নালন্দা দেখার শ্রেষ্ঠ স্থান। ১ নম্বর চৈত্যে নয়টি স্তরে নির্মাণকার্য হয়েছে। চাতাল, পয়ঃপ্রণালী, সুদৃঢ় পিলারের অস্তিত্ব ধবংসের মধ্যে অনুধাবন করা যায়। বিধবংসী অগ্নিকান্ডের চিহ্ন পোড়া দাগ এখানে বিদ্যমান। মনাস্ট্রিতে ছিল বৌদ্ধ ভিক্ষুকদের জন্য সারি সারি ঘর, চওড়া বারান্দা, বিশাল বুদ্ধমূর্তির পায়ের সামান্য অংশ এখনও রয়েছে। ১(এ) ও ১(বি) মনাস্ট্রি তথা চৈত্যগুলির উত্তরমুখী রয়েছে ইটের তৈরি আঙিনা ও আবাসকক্ষ। ৪নং মনাস্ট্রিতে খননকার্যের ফলে বেরিয়ে এসেছে একাধিক তলবিশিষ্ট স্থাপত্য, ঘর, পোর্টিকো, প্ল্যাটফর্ম। নীচের স্তরে কুমারগুপ্তের সময়ের মুদ্রা পাওয়া গেছে। নির্মাণকাল সম্ভবত ওই সময়েরই।
৫ নং মনাস্ট্রি সাইটে গুপ্তযুগের মুদ্রা পাওয়ার কারণে অনুমান করা যায় নির্মাণকালও ওই সময়ের। এখানেও কক্ষের সঙ্গে ছিল বারান্দা ও সিঁড়ির উপস্থিতি। আরও অন্যান্য সাইটগুলি দেখতে দেখতে এগিয়ে চলা– সেই সময়ে ঘরগুলিতে বিছানার ব্যবহার, স্কাইলাইটের ব্যবহার, ভাঁড়ারের ব্যবস্থা, ফারনেস, জলের কুয়োর উপস্থিতিরও প্রমাণ পাওয়া যায়। ইতিমধ্যে গাইড মহাশয় তার পাওনা নিয়ে প্রস্থান করেছেন, তবে নালন্দাপর্ব মিটতে এখনও অনেকটাই বাকি।
নালন্দা ধবংসস্তূপের ঠিক বিপরীতে রাস্তার ওপারে রয়েছে এক সংগ্রহশালা। ধবংসস্তূপের প্রত্নতাত্ত্বিক খননের ফলে উদ্ধার করা নিদর্শনগুলি দিয়ে এই মিউজিয়াম গড়ে তোলা হয়েছে। তবে স্থানীয় কিছু পুরাতত্ব সামগ্রীও এখানে স্থান পেয়েছে। মিউজিয়ামের চারদিক বাগানে ঘেরা আকর্ষণীয় পরিবেশ। সংগ্রহশালাতে সামগ্রীগুলি বেশিরভাগ পঞ্চম থেকে দ্বাদশ শতাব্দীর সময়কালের। বৌদ্ধ, হিন্দু ও জৈনধর্মের মূর্তি, পাথরের, হাতির দাঁতের, চুনাবালি সামগ্রী, লোহা ব্রোঞ্জ টেরাকোটার সামগ্রী মূর্তি বিভিন্ন গ্যালারিতে সাজানো রয়েছে। বিশেষভাবে দৃষ্টি আকর্ষণ করে বারো হাতের বোধিসত্ত্ব অবলোকিতশ্বর, প্রথম শতকে নির্মিত দুটি বিশাল টেরাকোটা পাত্র, বুদ্ধদেবের উপাস্য তারাদেবী ও প্রজ্ঞা পারমিতার মূর্তি।
নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয় চত্বর থেকে প্রায় ১ কিলোমিটার দূরে হিউয়েন সাঙ মেমোরিয়াল– টিকিট কেটে তবেই প্রবেশাধিকার পাওয়া গেল। স্থাপত্যটি আকারে চীনা প্যাগোডার আকারের ঘিরে রেখেছে সুসজ্জিত বাগান। হলের বাইরে হিউয়েন সাঙের মূর্তি, নীচে পরিব্রাজকের পরিচয়লিপি ও কর্মপরিচয়। বাগানের মধ্যে বিশাল ঘন্টা ও একটি বিশাল পাত্র শোভা পাচ্ছে। হলের অন্দরে সিলিং ও দেয়ালে চিনা শৈলীতে আঁকা বিচিত্র বর্ণের চিত্রাবলী, ফ্লোরে হিউয়েন সাঙের মার্বেল মূর্তি। এই চিনা পরিব্রাজক ষষ্ঠ শতাব্দীতে ভারতে ভ্রমণকালে তাঁর লেখনীতে সেই সময়ের ভারতের রাজনৈতিক ও সামাজিক এক প্রামাণ্য চিত্র রচনা করে গেছেন। এছাড়া তিনি নালন্দায় বেশ কয়েকবছর ছাত্র ও শিক্ষক হিসাবে কাটিয়ে গেছেন। তাঁরই স্মৃতিতে গড়ে উঠেছে এই হিউয়েন সাঙ মেমোরিয়াল হল।
নালন্দা পর্বের পর আমাদের গাড়ি ছুটল পাওয়াপুরীর উদ্দেশ্যে। দুপুর গড়িয়ে বিকেল হতে চলেছে, তবে পাওয়াপুরী খুব দূরে নয় আর তার দ্রষ্টব্যও সীমিত। পাটনা-রাঁচি সড়কের ওপর পাওয়াপুরী। যার আর এক নাম অপাপুরী অর্থাৎ পাপশূণ্য নগরী। পাওয়াপুরী এক জৈন তীর্থক্ষেত্র। এখানে কমল সরোবরের জলমন্দিরটি অবশ্য দ্রষ্টব্য। পদ্মে ভরা বিশাল সরোবরের মাঝে এক দ্বীপ, তারই মধ্যে শ্বেতপাথরের মন্দির। শ্বেতাম্বর সম্প্রদায়ের এই পবিত্র মন্দিরটির প্রবেশপথ সরোবরের ওপর দিয়েই তৈরি হয়েছে। খ্রিষ্টপূর্ব ৪৯০ অব্দে জৈন তীর্থঙ্কর মহাবীর এখানে নির্বাণ লাভ করেন। এখানে মহাবীরের পদচিহ্ন পূজিত হচ্ছে। মন্দিরের ভাস্কর্যও নয়নমনোহর। প্রচলিত গল্পকথা বলে মহাবীরের মৃত্যুর পর তাঁর অন্ত্যেষ্টি থেকে পবিত্র ভষ্ম তুলে নেন ভক্তের দল। ভষ্ম শেষ হলে ভক্তের চাহিদায় তুলে নেওয়া হয় মাটি। মাটি তুলতে তুলতে বেরিয়ে আসে জল, সৃষ্টি হয় এই সরোবরের। বর্তমানে জৈন সংঘ এই মন্দিরটি পরিচালনা করেন। বাজারের মধ্যে আরও দুটি জৈন মন্দির আছে তবে আমাদের আর যাওয়া হয়নি। দিনের আলো নিভে এসেছে। পাওয়াপুরীকে বিদায় জানিয়ে আবার ফিরে চলি রাজগিরের পথে।
রাজগির, নালন্দা ভ্রমণ শেষে এবার আমরা চলেছি বুদ্ধগয়া দর্শনে। রাজগির থেকে বুদ্ধগয়ার দূরত্ব ৮০ কিলোমিটার। গয়ার উপকণ্ঠে এই স্থানে গৌতমবুদ্ধ জীবনের বেশ কয়েকটা বছর অতিবাহিত করেছিলেন। ২৫০০ বছরেরও আগে লুম্বিনিতে শাক্য বংশের রাজপরিবারে বুদ্ধের জন্ম। সকলেই জানেন তখন তার নাম ছিল সিদ্ধার্থ– তিনি গৃহত্যাগ করে সত্য ও জ্ঞানের অন্বেষণে ঘুরতে ঘুরতে এলেন নিরঞ্জনা নদীতীরে উরুবিল্ব গ্রামে। সেখানে পিপুল গাছের নীচে বজ্রশিলায় বসে শুরু করলেন কঠোর তপস্যা– অবশেষে, ৪৯ দিন পরে অর্জন করলেন মহাজ্ঞান। সেই অচেনা উরুবিল্ব গ্রাম আজকের বুদ্ধগয়া, পিপুল বৃক্ষ হয়েছে বোধিবৃক্ষ। এই দিব্যজ্ঞান তিনি লাভ করেন বৈশাখী পূর্ণিমার দিন– এই বৈশাখী পূর্ণিমার নতুন নাম বুদ্ধপূর্ণিমা।
গাড়িতে ঘন্টা দুয়েকের মধ্যে পৌঁছে গেলাম বুদ্ধগয়া শহরে। দেশবিদেশের পর্যটক ও বৌদ্ধ পুণ্যার্থী বুদ্ধগয়ার পথে ঘাটে। এটি এখন এক আন্তর্জাতিক পর্যটন ক্ষেত্র। চিন, জাপান, শ্রীলঙ্কা, বর্মা, তাইওয়ান, কোরিয়া, নেপাল ভুটান প্রভৃতি দেশের পর্যটকদের সমাগম হয় সব চেয়ে বেশি। আমরা প্রথমে যাব মহাবোধি মন্দির দর্শনে। পথের দুধারে অসংখ্য দোকানের সারি, তবে রাস্তাঘাট বেশ পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন। পায়ে পায়ে এগিয়ে চলি মহাবোধি মন্দিরের দিকে। মহাবোধি শব্দের অর্থ মহান জ্ঞান। মন্দির দর্শনের লাইনে দাঁড়িয়ে পড়ি– এ এক আন্তর্জাতিক লাইন। পিরামিড ধর্মী, ১৮০ ফুট উঁচু এই মন্দিরটি দূর থেকেই দেখা যায়– এ এক প্রাচীন হিন্দু স্থাপত্যের অন্যতম নিদর্শন। ঐতিহাসিকদের মতে এই মন্দিরটি ষষ্ঠ শতকের নির্মাণ। যদিও সম্রাট অশোকের সময় ও চতুর্থ শতকে রাজা সমুদ্রগুপ্তের আমলে এর বিভিন্ন স্তর নির্মিত হয়। দ্বাদশ শতকে মুসলমান আমলে এটি ধবংসস্তূপে পরিণত হয়। হিউয়েন সাঙয়ের বিবরণীতে এই মন্দিরের উল্লেখ আছে। ইংরেজ আমলে লর্ড ক্যানিংহ্যামের প্রচেষ্টায় ১৮৭৭ সালে এই মন্দির পুনর্নির্মিত হয়, পরেও অনেকবার সংস্কার হয়েছে।
এগিয়ে চলেছি মন্দিরের দিকে, মহাবোধি মন্দিরের ভিত্তিভূমি ৪৮ বর্গফুট, এরপর পিরামিডের আকারে ধীরে ধীরে সরু হয়ে উঠে গেছে সুউচ্চ শিখরে। মন্দিরের চারকোণে চারটি কারুকার্যমন্ডিত টাওয়ার। রাস্তা থেকে কয়েক ধাপ নীচুতে মন্দিরের মূল চত্বর– বিভিন্ন মুদ্রায় বুদ্ধের মূর্তি, খোদাই করা নানা জাতকের কাহিনি শোভা পাচ্ছে। মন্দিরের অভ্যন্তরে বুদ্ধের মূর্তিটি যেখানে স্থাপিত ঠিক সেই স্থানেই তিনি মহাজ্ঞান লাভ করেছিলেন। চার ফুট উচ্চতার এক পাথরের উপরে সোনালি বুদ্ধমূর্তি আসীন। এই মূর্তিটি ১৮৮০ সালে লর্ড ক্যানিংহাম এখানে বসিয়েছিলেন। মূর্তিটি ব্যাসল্ট পাথরের কালো রঙের, পরবর্তীকালে তা সোনালি পাতের মোড়কে সজ্জিত করা হয়েছিল।
মূল মন্দিরকে পাশে রেখে আরও এগিয়ে গেলে বোধিবৃক্ষ। বৃক্ষটির নীচে পাথরের বেদি বজ্রাসন বা ডায়মন্ড থ্রোন। কথিত আছে এই বজ্রাসন সম্রাট অশোক নির্মাণ করেছিলেন। ১৯৯৩ সালে শ্রীলঙ্কার প্রধানমন্ত্রী, সোনার রেলিং ও সোনার ছাতা শ্রীলঙ্কাবাসীর পক্ষ থেকে দান করেন বজ্রাসন ঘেরা ও মাথার আবরণ হিসাবে। বর্তমান বোধিবৃক্ষটি চতুর্থ প্রজন্মের। বুদ্ধগয়ার মূল গাছটি মারা যাওয়ায় শ্রীলঙ্কার অনুরাধাপুরা থেকে চারা এনে এখানে রোপন করা হয়। মহাবোধি মহাবিহার মন্দিরটির পিছনে দাঁড়িয়ে এই পবিত্র বৃক্ষটি। গাছটির শাখাপ্রশাখায় বিভিন্ন কাপড়ের টুকরো বেঁধে রেখেছেন ভক্তরা মনষ্কামনা পূরণের প্রত্যাশায়। শান্তির বাতাবরণ এই স্থানের আকাশে বাতাসে ছড়িয়ে আছে। বেদিতে রয়েছে নানা রঙের গোলাপের স্তবক ও মাথায় কারুকার্যখচিত আচ্ছাদন। এই চত্বর ঘিরে তীর্থযাত্রী ও পর্যটকরা শান্তিতে বসে কেউ ধ্যানে নিমগ্ন কেউ অনুচ্চ স্বরে ত্রিপিটক পাঠে মগ্ন।
মন্দির পাশ দিয়ে পথটি ছিল বুদ্ধের পরিক্রমণ পথ। পথটি কনকনামা নামে পরিচিত। এই পথটির দৈর্ঘ্য তিপান্ন ফুট, প্রস্থ সাড়ে তিন ফুট এবং উচ্চতা তিন ফুট। সাধনাকালে বুদ্ধের এই পরিক্রমণ পথটি স্মরণীয় করে রাখার জন্য ১৯টি পাথরের তৈরি পদ্ম বসানো হয়। পরে মুসলমান আক্রমণে এগুলি ধবংস হয়। ক্যানিংহাম সাহেবের আমলে ১১টি পদ্ম আবার খননকার্যের ফলে পুনরুদ্ধার করে পুনঃস্থাপিত হয়। বাকিগুলি নির্মাণ করে স্থাপিত হয়েছে। মন্দিরের প্রাঙ্গনের মধ্যে রয়েছে অনিমেষলোচন চৈত্য। তবে এটি পুনর্নির্মিত স্থাপত্য। বোধিজ্ঞান লাভের দ্বিতীয় সপ্তাহে বুদ্ধদেব এক সপ্তাহ এখানে দাঁড়িয়ে অপলক নয়নে বোধিবৃক্ষের দিকে তাকিয়েছিলেন।
মহাবোধি বিহারের চত্বরের মধ্যে নিগ্রোদা বটবৃক্ষ, রাজ্ঞাতনা বৃক্ষ ও রত্নঘর চৈত্য ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য দর্শনীয় বস্তু থাকলেও মহাবোধি বিহারের তুলনায় সেগুলি গুরুত্বে মলিন। হাতে সময় কম তাই এই চত্বর ছেড়ে আমরা এগিয়ে চলি।
কিউরিও দোকান থেকে বুদ্ধগয়া সম্পর্কে তথ্যপুস্তক, উপহার স্মারক হিসাবে কয়েকটি পাথরের বুদ্ধমূর্তি কিনে ফিরে আসি গাড়ির স্ট্যান্ডে। এবার গাড়িতে ঘুরে ঘুরে দেখে নেব তিন কিমি চৌহদ্দির মধ্যে অবস্থিত প্রাচ্যের বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী দেশগুলির মনাস্ট্রিগুলি।
পৃথিবীর যে সব দেশে বৌদ্ধ সম্প্রদায়ভুক্ত মানুষের সংখ্যা যথেষ্ট, সেই সব দেশের কর্তৃপক্ষ এগিয়ে এসেছে এই বুদ্ধগয়ায় মনাস্ট্রি তথা বৌদ্ধ গুম্ফা স্থাপনে। ভারত ছাড়াও এখানে বৌদ্ধগুম্ফা স্থাপনা করেছে মায়ানমার (বর্মা), তিব্বত, বাংলাদেশ, থাইল্যান্ড, জাপান, ভুটান, চিন, ভিয়েতনাম, নেপাল, তাইওয়ান, শ্রীলঙ্কা প্রভৃতি দেশ। এক একটি মনাস্ট্রি তৈরি হয়েছে তাদের নিজস্ব ভাবধারা, রীতি অনুসারিত স্থাপত্যে। সব চেয়ে প্রাচীন বোধহয় মহাবোধি সোসাইটি স্থাপিত মনাস্ট্রিটি (১৮৯১)। এখানে সম্প্রতি স্থাপিত বুদ্ধমূর্তি ও দেয়ালে ফ্রেসকোর কাজ অনবদ্য। নদীর ধারে বর্মার বিহারটি আকারে বেশ বিশাল, রয়েছে দুটি প্রার্থনাকক্ষ ও বুদ্ধমূর্তি।
১৯৩৪ সালে স্থাপিত তিব্বতী বিহারটি জেলুপা মহাযান গোষ্ঠী পরিচালিত বুদ্ধগয়ার অন্যতম বৃহৎ বিহার। বাংলাদেশ বুদ্ধমূর্তিটি পদ্মে আসীন খোলা আকাশের নীচে, থাইল্যান্ডের বিহারে বুদ্ধকে মোহনচূড়ারূপে দেখা যাবে। জাপানি বিহারে বুদ্ধের জীবনকাহিনি দেয়ালচিত্রের মাধ্যমে চিহ্নিত হয়েছে। ভুটানের মনাস্ট্রি অত্যন্ত সুসজ্জিত ও জাঁকজমকপূর্ণ। চিনা মনাস্ট্রিটি প্যাগোডা স্টাইলে নির্মিত, সিলিং ও দেয়ালে চিনা রূপকথার কাহিনি চিত্রিত। নবনির্মিত ভিয়েতনামের বৌদ্ধ মন্দিরটিও আকর্ষণীয়। শহরের শেষ প্রান্তে খোলা আকাশের নীচে প্রতিষ্ঠিত ৮০ ফুট উঁচু দাইবুৎস বুদ্ধমূর্তি। ১৯৮৯ সালে এই বুদ্ধমূর্তিটি উদ্বোধন করেন স্বয়ং দলাই লামা। এখানে বুদ্ধ মূর্তিটির উচ্চতা ৬৪ ফুট, যে– পদ্মাসনে তিনি আসীন সেই পদ্মটি ৬ ফুট ও বেদিটি ১০ ফুট উঁচু।
বুদ্ধগয়ায় রয়েছে একটি পুরাতত্ত্ব বিভাগের সংগ্রহশালা। বুদ্ধগয়া ও আশেপাশের গ্রামে খননকার্যের সময় উদ্ধার করা নানা মূর্তি ও পুরাতাত্ত্বিক সামগ্রী এই সংগ্রহশালায় রয়েছে। সময়াভাবে এই সংগ্রহশালায় আমাদের আর যাওয়া হল না।
এবার ফেরার পথ ধরি। গাড়ির চালক পবন বলতে থাকে, ‘বুদ্ধজয়ন্তীর সময় এখানে চলে আসুন। এটাই এখানে প্রধান উৎসব। অনেক দেশি-বিদেশি টুরিস্ট আসে। সবাই মিলে পদযাত্রা করে দাইবুৎসু বুদ্ধমূর্তি থেকে মহাবোধি মহাবিহার পর্যন্ত যায়। সবাইকে মিঠাই খাওয়ানো হয়।’
বুদ্ধজয়ন্তীর সময় আবার ফিরে আসার আশা জিইয়ে রেখে বুদ্ধগয়ার মায়া এবারের মতো কাটাতে হল!
প্রয়োজনীয় তথ্য
কীভবে যাবেন – হাওড়া থেকে বখতিয়ারপুর জংশন যায় অনেকগুলি ট্রেন– হাওড়া দানাপুর এক্সপ্রেস, তুফান এক্সপ্রেস ইত্যাদি। বখতিয়ারপুর থেকে রাজগির ৫৫ কিমি। বাস-ট্রেকার-রিজার্ভ গাড়ি সবেতেই যাওয়া যাবে।
রাজগির থেকে নালন্দা ১৫ কিমি। নালন্দা থেকে পাওয়াপুরী ১৮ কিমি। রাজগির থেকে সরাসরি পাওয়াপুরী ৩১ কিমি। রাজগির থেকে বুদ্ধগয়া ৮০ কিমি। যাঁরা গয়া থেকে রাজগির যাবেন তাদের গাড়িতে বা বাসে আসতে হবে। দূরত্ব ৬৭ কিমি। গয়া থেকে বুদ্ধগয়ার দূরত্ব ১৩ কিমি।
কোথায় যাবেন – রাজগিরে অনেক হোটেল। বিহার পর্যটনের হোটেল তিনটি– তথাগত বিহার, অজাতশত্রু বিহার, গৌতম বিহার। বুদ্ধগয়ায় থাকার জন্য বিহার পর্যটনের হোটেল সিদ্ধার্থ বিহার ও সুজাতা বিহার ও বুদ্ধবিহার। হাওড়া থেকে সরাসরি গয়া এসে, বুদ্ধগয়া ঘুরে নেওয়া যায়। বিভিন্ন দেশের মনাস্ট্রিগুলিতেও থাকার ব্যবস্থা আছে।
কী দেখবেন – রাজগির ঘোরার জন্য কনডাকটেড টুরের ব্যবস্থা নেই। গাড়ি ভাড়া করে অথবা ঘোড়ায় টানা টাঙায় ঘুরতে হবে। নালন্দায় রাত্রিবাসের প্রয়োজন হয় না। রাজগির থেকে গাড়ি ভাড়া করে ঘুরে আসা যায়।
নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয়ের দর্শনের দর্শনী ৫ টাকা। হিউয়েন সাঙ মেমোরিয়াল-এর দর্শনী ৫ টাকা।