বর্তমানে মানুষের জীবনযাত্রায় একটা বিরাট পরিবর্তন এসেছে। প্রত্যেকেই কমবেশি নানারকম সমস্যায় জর্জরিত। তাই বাড়ছে ডিপ্রেশন। তাছাড়া, আমাদের দৈনন্দিন খাদ্যতালিকায় ঢুকে পড়েছে হটডগ, চাউমিন ইত্যাদি ফাস্ট ফুড। এরসঙ্গে যোগ হয়েছে টিভি, কম্পিউটারের মতো যন্ত্রের প্রভাব। অনেকেই, বিশেষ করে শিশুরা, দিনের বেশিরভাগ সময় কাটাচ্ছে টিভি দেখে, কম্পিউটারে গেম খেলে ও ফাস্ট ফুড খেয়ে। ফলে, বাচ্চা থেকে বুড়ো সবাইকেই ডায়াবেটিসের সমস্যা সহ্য করতে হচ্ছে। তবে কলকাতা, দিল্লি, মুম্বাই, লখনউ প্রভৃতি শহরের চেয়ে গ্রামীণ এলাকায় এই অসুখের প্রভাব কম।
বর্তমানে পশ্চিমবঙ্গ-সহ সারা দেশেই এই অসুখের শিকার হওয়া মানুষের সংখ্যা প্রায় সাড়ে তিন কোটি। ২০২৫ সালের মধ্যে এই সংখ্যা ৬ কোটির বেশি হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। আমাদের খাদ্যাভ্যাস ও জীবনযাত্রা অনিয়ন্ত্রিতভাবে চলতে থাকলে এটা ঘটা স্বাভাবিক।
ভারতীয় খাদ্যাভ্যাসে, যে-খাবারই হোক, সবেতেই কিছু না কিছু খাদ্যগুণ থাকে, যাতে শরীরের পুষ্টি মেলে। পশ্চিমবঙ্গে প্রাত্যহিকভাবে করলা, নিমপাতা থেকে শুরু করে নানান ধরনের শাক অর্থাৎ পাতাযুক্ত তরিতরকারি খাদ্যতালিকায় থাকে। কিন্তু আজকাল এখানেও ফাস্ট ফুড অর্থাৎ বাড়ির বাইরের খাদ্য গ্রহণ করার প্রচলন খুব বেড়ে গেছে। চিকিৎসকরা তাই শিশুদের মধ্যে ডায়াবেটিস রোগ নিয়ে খুবই চিন্তিত।
মানসিক চাপ
মা-বাবার মাধ্যমে শুরু হওয়া র্যাটরেস, বাচ্চাদের ক্ষতি করে চলেছে। তাদের উপর পড়াশোনার চাপ এতটাই বাড়িয়ে দেওয়া হয়েছে যে, তাদের শৈশব নষ্ট হয়ে গেছে। বইখাতা যেন তাদের জীবনে এক অভিশাপ হয়ে দাঁড়িয়েছে। ডাক্তারের মতে, এই মানসিক চাপেই শিশুদের মধ্যে ডায়াবেটিস রোগ দেখা যাচ্ছে। বিগত কয়েক বছর ধরে শুধু কলকাতায় নয়, সব বড়ো শহরেই কংক্রিট-এর জঙ্গল বাড়ছে ও সবুজ কমছে। অনেক এলাকায় ফাঁকা মাঠময়দানের অভাব রয়েছে। ফুটবলের রাজধানী কলকাতাতেও, ছোটোদের দেখা যায় রাস্তা ও অলিগলিতে ক্রিকেট খেলতে। ছুটির দিনগুলোতে, বন্ধের দিনে এই ধরনের খেলা বেশি হয়। পার্কের সংখ্যা ক্রমশ কমছে। তাই শিশুদের খেলার জায়গা খুবই কম। এছাড়া টিভি, কম্পিউটার গেম্স ইত্যাদির জন্য তারা আরও অলস হয়ে গেছে। বডি মুভমেন্ট শিশুদের সুস্থতার একটি বড়ো কারণ। অথচ আজকাল তার সুযোগ কমে গেছে। এরফলেই বাচ্চাদের মধ্যেও ডায়াবেটিস রোগের প্রকোপ বাড়ছে।
ডা. শুভংকর চৌধুরীর মতে, ডায়াবেটিস প্রধানত টাইপ-১ ও টাইপ-২ ধরনের হয়ে থাকে। ইনসুলিনের মাত্রা কমে যাওয়ার ফলে টাইপ-১ ডায়াবেটিস হয়। খাদ্যাভ্যাসে পরিবর্তন, কম খেলাধুলো ও অত্যধিক মনের চাপ এনে দেয় টাইপ-২ ধরনের ডায়াবেটিস। এই রোগের শিকার যারা হচ্ছেন, যাদের বয়স কম, তাদের ৬০ শতাংশই টাইপ-২-এর রোগী।
অবস্থাটা এবার এমন হয়েছে যে, টাইপ-১-এর রোগীদের বিয়েটাই একটা সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে। বিশেষ করে মহিলাদের জন্য সমস্যাটা গুরুতর। এই অসুখ সম্বন্ধে সচেতনতা না থাকায়, এটাকে একটা অভিশাপ বলে মনে করা হচ্ছে। এই ধরনের রোগীর সঙ্গে বৈবাহিক সম্বন্ধে বেশিরভাগ মানুষই রাজি হচ্ছে না। এই পরিস্থিতি কেবল পশ্চিমবঙ্গে নয়, সারা দেশেই। সম্প্রতি দিল্লিতে ডায়াবেটিস রিসার্চ সেন্টার থেকে এক সমীক্ষা করা হয়েছে। সমীক্ষার বিষয় ছিল, ‘ম্যাট্রিমোনিয়াল অ্যান্ড স্যোশাল প্রবলেম্স ফেস্ড বাই টাইপ-ওয়ান ডায়াবেটিক ইন ইন্ডিয়া’। সেখানে সেন্টারের অধ্যক্ষ ডা. অশোক ঝিংগন তাঁর বক্তৃতায় বলেন, টাইপ-১-এর বেশিরভাগ রোগী বিয়ে করতে গিয়ে বাধার সম্মুখীন হচ্ছেন। কারণ আমাদের সমাজ এবিষয়ে সচেতন নয় যে, ডায়াবেটিস রোগ থাকা বাবা বা মায়ের সন্তান স্বাভাবিক ও সুস্থই হয়ে থাকে। টাইপ-১ ডায়াবেটিস একটি মারক রোগ নয়। বস্তুত এনিয়ে গবেষণা এখনও চলছে। সাধারণভাবে অবশ্য চিকিৎসকরা এর বিরোধী মতই প্রকাশ করে থাকেন। নামকরা সার্জন ডা. অরূপ বন্দ্যোপাধ্যায় জানিয়েছেন যে, আজকাল সুস্থ দম্পতিদের শিশু সন্তানের অনেকসময়ই ডায়াবেটিস হতে দেখা যায়। কিন্তু বাবা বা মা যে-কোনও একজন যদি বিয়ের আগে ডায়াবেটিসে আক্রান্ত হয়ে থাকেন, তবে তাঁদের সন্তানের এই রোগের শিকার হওয়ার সম্ভবনা শতকরা ১০০ ভাগ হয়ে যায়। ডায়াবেটিস একটি জিনগঠিত অসুখ।
আবার ডা. অভিজিৎ তরফদারের বক্তব্য কিছুটা ভিন্ন। তিনি জানালেন, ‘বংশগত কারণে ডায়াবেটিস হতেও পারে আবার নাও পারে। দেখা গেছে বাবা কিংবা মায়ের এই রোগ রয়েছে কিন্তু তারা যদি সঠিক চিকিৎসা ও খাদ্যাভাসে সচেতন না হন, তাহলে সন্তান ডায়াবেটিক হয়েই জন্মাবে।
আসলে এই রোগের শিকার হওয়া ব্যক্তিদের শরীরে ইনসুলিনের মাত্রা কমে যায়। এতে রক্তে শর্করার মাত্রা নিয়ন্ত্রণ করা যায় না। তাই রোগীদের নিয়মিতভাবে ইনসুলিন নিতে হয়। সেইসঙ্গে নিয়মিতভাবে ব্লাডসুগারের মাত্রাও পরীক্ষা করাতে হয়। এই মাত্রা সঠিক থাকলে সন্তানের কোনও ক্ষতি হয় না। রোগী স্বাভাবিক জীবনযাপন করতে পারেন। তবে এখনও পর্যন্ত, পরীক্ষায় দেখা গেছে যে, ডায়াবেটিস টাইপ-১-এর রোগীদের মধ্যে মাত্র ৭.৫ শতাংশ দাম্পত্য জীবনে সুখী। ৯২.৫ শতাংশের মধ্যে কোনও না কোনও বিবাহোত্তর সমস্যা পাওয়া গেছে। সামাজিকভাবে এটা খুবই নিরাশাজনক।
দরকার শারীরিক পরিশ্রম
ডা. আশিষ বসু জানান, ‘অতীতে তাঁর বিভাগের রোগীদের মধ্যে মাত্র ৬-১০ শতাংশ শিশু থাকত। বর্তমানে এই সংখ্যা ১৫ শতাংশ বেড়ে গেছে। উত্তরোত্তর এই বৃদ্ধি হয়েই চলেছে। আজকাল শিশুরা টিভি ও কম্পিউটারের সামনে সময় কাটানোর ফলে, তাদের মস্তিষ্ক সক্রিয় থাকে ঠিকই কিন্তু শারীরিক পরিশ্রম একদমই হয় না। এছাড়া আজকের জীবনযাত্রায় তাদের উপর প্রচুর মানসিক চাপ পড়ছে। এই জন্য তারা ডায়াবেটিক হয়ে পড়ছে। ইদানীং সদ্যজাত শিশুদেরও ডায়াবেটিক হতে দেখা যাচ্ছে। ডায়াবেটিক গর্ভবতী মহিলাদের থেকে তাদের শিশুদের মধ্যে সংক্রমণ ঘটতে দেখা যাচ্ছে। কিছু ক্ষেত্রে দেখা যায় গর্ভকালীনই মহিলারা ডায়াবেটিস-এর শিকার হয়ে পড়েন।
এই আলোচনায় সাব্যস্ত হয়েছে যে, চোখ বুজে পশ্চিমি জীবনযাত্রা পালন করার জন্য পশ্চিমবঙ্গ তথা সারা দেশে এই রোগ ছড়িয়ে পড়ছে। তাই এবিষয়ে আরও সজাগ হওয়া উচিত।
সতর্কতা
- ডায়াবেটিস-এ আক্রান্ত হলে কিডনি, হার্ট, নার্ভাস সিস্টেম প্রভৃতির উপর ক্ষতিকারক প্রভাব পড়ে। তাছাড়া একবার ডায়াবেটিস-এ আক্রান্ত হলে চিকিৎসার মাধ্যমেও পুরোপুরি সমস্যামুক্ত হওয়া যায় না। তাই বর্জন করতে হবে ফাস্ট ফুড। সকালে ঘুম থেকে উঠে সবুজ ঘাসের উপর খালি পায়ে হাঁটতে হবে এবং শরীরচর্চাও করতে হবে নিয়মিত। সেইসঙ্গে রক্তে শর্করার মাত্রা পরীক্ষা করতে হবে মাঝেমধ্যে এবং চিকিৎসকের পরামর্শ মতো ওষুধও সেবন করে যেতে হবে।
- ভিটামিন বি, সি, ই এবং ডি-যুক্ত খাবার খেতে হবে বেশি পরিমাণে। সেইসঙ্গে ফাইবারজাতীয় খাবারও রাখতে হবে খাদ্য তালিকায়। কোলেস্টেরল বাড়াতে পারে এমন খাবার বন্ধ করতে হবে।
- ডায়াবেটিস-এর হাত থেকে রক্ষা পেতে হলে ঘাম ঝরানো পরিশ্রম করা চাই প্রতিদিন।
- ব্লাড প্রেসার এবং কোলেস্টেরল স্বাভাবিক রাখতে হবে এবং নিয়মিত পরীক্ষা করতে হবে।
- রক্তে শর্করার মাত্রা কমাতে পারে এমন শাক-সবজি খেতে হবে নিয়মিত।
- বডি ওয়েট স্বাভাবিক রাখুন এবং মানসিক চাপমুক্ত থাকার চেষ্টা করুন।