ট্রেকিংয়ের নাম শুনেই মনটা ভালো হয়ে উঠল। একঘেয়ে জীবন থেকে বেরিয়ে প্রকৃতির সান্নিধ্যে ক’টা দিন কাটবে- এর চেয়ে ভালো দিনযাপন আর কী-ই বা হতে পারে। পরিকল্পনামাফিক তাই লালকুঁয়া এক্সপ্রেস-এ যাত্রা শুরু হল। নির্দিষ্ট সময়ের যাত্রাপথ পেরিয়ে এসে নামলাম লালকুঁয়া স্টেশনে।
ওহো, এবারের গন্তব্যের নামই তো বলা হয়নি আপনাদের! বস্তুত এই দফায় চলেছি উত্তরাখণ্ড। আরও বিশদে বললে এটি কুমায়ুন হিমালয়ের অন্তর্গত একটা দিক। বাগেশ্বর, ভারারি হয়ে গোগিনা গ্রাম। এখান থেকেই পদব্রজে পৌঁছোব নামিক বুগিয়াল এবং থল-টপ৷ বস্তুত আরও উচ্চতায় মানিক গ্লেসিয়ার অবধি যাওয়া যায়৷ কিন্তু আমাদের মতো আনাড়ি ট্রেকার-এর পক্ষে সেটা একটা দুরূহ কাজ৷আমাদের ইচ্ছে পাহাড়ের কোলে কিছুটা পথ হেঁটে যাওয়া৷ প্রকৃতির আলিঙ্গনে খানিক নির্জনবাস৷ লালকুঁয়া স্টেশনের বাইরেই আমাদের গাড়ি অপেক্ষা করছিল। মালপত্র তুলে শরীরটাকে এলিয়ে দিই গাড়ির সিটে। পাহাড়ি জনপদ, হিমালয়ের বনস্থলি, দেখতে দেখতে ঘন্টা সাতেকের মধ্যে পৌঁছে যাই বাগেশ্বর। এখানে লাঞ্চ-এর বিরতি। রাজমা-চাউল, আচার, স্যালাড আর পাঁপড় দিয়ে আহার সেরে, এরপর আবার গাড়িতে সওয়ার হই। গন্তব্য ভারারি।
এই ভারারি থেকেই কিছুটা এগোলে রাস্তা গিয়েছে সং হয়ে খড়কিয়ার দিকে। পিণ্ডারি, সুন্দরডুংগা রুটে যারা ট্রেক করতে আসেন, এই পথ তাদের জন্য। আমাদের পথ অন্য দিকে। শ্যামা, লেতি, রাতেরকোটির মতো ছোটো ছোটো কুমায়ুনি গ্রাম পেরিয়ে, আরও ঘন্টা তিনেক সফর শেষে পৌঁছোই গোগিনা গ্রামে।
শেষের দিকের রাস্তা বেশ খারাপ ছিল। তাই বসে একটু হাত-পা ছাড়াই। তারপর জিজ্ঞেস করে করে পৌঁছে যাই আমাদের নির্দিষ্ট হোমস্টে-র দিকে। গোটা গ্রামে এই একটিই হোমস্টে, চালান নেগিজি। সাধারণ থাকা-খাওয়ার ব্যবস্থা।
সন্ধের মুখে আমাদের জন্য চায়ের ব্যবস্থা করেছিলেন নেগিজি, তারই মধ্যে প্রবেশ করল আমাদের গাইড। তার সঙ্গে প্ল্যান প্রোগ্রাম সেরে, রাতের খাবার খেয়ে নিয়ে বিশ্রাম করতে চলে গেলাম। কারণ পরের দিন থেকেই শুরু আমাদের হাঁটাহাঁটি।
সকালে মালপত্র খচ্চরের পিঠে চাপিয়ে দেওয়ার পর, আলু পরোটা দিয়ে প্রাতরাশ সেরে আমরা রওনা দিলাম। কয়েক ঘর মানুষের বাস এই গোগিনায়। গম, ভুট্টা, আলুর খেত পেরিয়ে ক্রমশ পাহাড়ি পথের পাকদণ্ডি শুরু হল। নীচে বহমান রামগঙ্গা। এই রামগঙ্গাই শাখা বিস্তার করে চলেছে কুমায়ুনের নানা জায়গা দিয়ে৷
গ্রাম পেরিয়ে নদীর ধারে এসে একটা ছোটো পুল পেরোলাম। সবুজ গাছপালা আর সকালের স্নিগ্ধ বাতাস মনে অনাবিল আনন্দের সঞ্চার করছিল। আরও কিছুটা হেঁটে গিয়ে এবার নদীর উপর, একটা বড়ো ঝোলাপুল বা হ্যাঙ্গিং ব্রিজ পড়ল। সেটা পেরোতেই শুরু হল চড়াই ভাঙা। ঘরবারি, শস্যক্ষেত্র পেরিয়ে একসময় এসে পৌঁছোই নামিক গ্রামে৷
নামিক ছোটো গ্রাম হলেও এখানে বিদ্যুৎ রয়েছে। কিছু দোকানপাট ছেড়ে এগিয়ে একটা শিবমন্দির। তারই পাশে জলধারা। সেই মাঠেই তাঁবু ফেলে আজ রাতের আস্তানা তৈরি হল। দিগন্ত বিস্তৃত তুষারশৃঙ্গে রোদ ছায়ার খেলা দেখতে দেখতে কখন যেন সন্ধ্যা নেমে আসে। পাহাড়ে আলো থাকে প্রায় ৭টা অবধি ৷ দিনের শেষ আলোটুকু মিলিয়ে যাওয়ার আগেই, ৮-টার মধ্যে ডিনার সারা হয়ে যায়। পরের দিনের জন্য টুকিটাকি প্রস্তুতি সেরে ঘুমিয়ে পড়ি টেন্ট-এ। খুব নিরবিচ্ছিন্ন ঘুম কিন্তু হয় না৷ বাইরে শিতল হাওয়ার কারণে বেশ কাঁপন ধরে শরীরে৷ শেষে স্লিপিং ব্যাগ-এ ঢুকতে বাধ্য হই৷
পরের দিন ভোর ভোর উঠি আকাশে সূর্যোদয়ের রঙের খেলা দেখব বলে৷ কিন্তু আজ আকাশ মেঘলা৷ কুয়াশার চাদরে মোড়া চারদিক৷ তাই সময় নষ্ট না করে তৈরি হয়ে নিই৷আজকের গন্তব্য থল-টপ। হাঁটা প্রায় ৯ কিমি। প্রাতরাশ সেরে বেরিয়ে পড়ি সকলে৷
ওক গাছে ঢাকা জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে পথ চলেছে। জঙ্গল যত ঘন হয়, তত রডোডেন্ড্রন গাছের আধিক্য চোখে পড়ে। চারদিকে লালে লাল হয়ে আছে ফুলে। এবার এসে পড়ি একটা বুগিয়ালে, যেখান থেকে ঘাড় উঁচু করলে দেখা যাচ্ছে আমাদের গন্তব্য থল। চারপাশের অনাবিল শান্তি আর নিরবতা৷ কি অপার সুন্দর প্রকৃতি৷ এরই মাঝে দেখা পাই নামিক শৃঙ্গের৷ শুধু এই অপার আনন্দের লোভেই তো আসা৷ হাঁটার গতি বাড়াই৷
বুগিয়াল পেরোতেই পাথুরে চড়াই শুরু হল। জায়গায় জায়গায় বেশ খাড়া। আঁকাবাঁকা পথ ক্রমশ উপরের দিকে উঠেছে। ৬০-৬৫ ডিগ্রি খাড়া চড়াইয়ের নীচে একটা রিজ-এর মাথায় এসে পৌঁছোলাম অবশেষে। এর দুদিকেই ঢাল। ঢালের উপর বরফের স্তর। এখানেই রয়েছে মোটামুটি রাতের আস্তানার মতো একটা গেস্ট হাউস। সামনে যতদূর চোখ যায় ধূ ধূ তুষার প্রান্তর। এ যেন এক স্বর্গভূমিতে এসে পড়েছি৷একটা চাট্টানের উপর বসে দেখতে থাকি সেই অপরূপ নিসর্গ৷
লাঞ্চে খিচুড়ি আর ডিমের অমলেট খেয়ে জায়গাটা একটু ঘুরে দেখতে গেলাম। বরফে ঢাকা পাহাড়শ্রেণি। আরও উপরে উঠলে চিপু-টপ ও রণথন অঞ্চল। যারা নামিক হিমবাহ অবধি ট্রেক করেন, এই পথেই তাদের যেতে হয়। এখন সে পথ বরফে মোড়া৷ পিছনে ফেলে এসেছি নামিক বুগিয়াল, যা উপর থেকে মনোরম দেখাচ্ছে।
এ সত্যিই যেন বরফের রাজ্যে এসে পড়েছি। কনকনে ঠান্ডা। এই বরফ ঘোড়া চলার পক্ষেও অসম্ভব। বরফে ঢেকে পথ এতটাই বিপজ্জনক হয়ে রয়েছে যে, যে-কোনও সময় পা পিছলে যেতে পারে। অপূর্ব হিমালয়ে প্রকৃতির মাঝে এই বরফ রাজ্যে এসে যে,কী স্বর্গীয় অভিজ্ঞতা হল, তা লিখে জানাবার নয়! আরও একটি দিন থল-এ থেকে, আমরা ফিরতি পথ ধরব। তাই যতক্ষণ রয়েছি, রূপসুধা পান করছি প্রকৃতির।