সন্তান সব দম্পতিদেরই কাম্য। তবে বাচ্চাকে মানুষ করতে করতেই মা-বাবা উপলব্ধি করতে পারেন কাজটা খুব একটা সহজ নয়। পৃথিবীতে নতুন আসা ছোট্ট শিশুটিকে প্রথমেই পারিপার্শ্বিক পরিবেশের সঙ্গে মানিয়ে চলতে হয়। মায়ের সুরক্ষা বেষ্টিত গর্ভ ছেড়ে রোগজীবাণু ভরা পৃথিবীর বাতাসে শ্বাস নিতে শিখতে হয়। তাই শিশুকে লড়াই করতে হয় নানা শারীরিক সমস্যার সঙ্গে। শিশুর নাক দিয়ে সমানে জল পড়া, জ্বর, কাশি, পেটের সমস্যা, কান ব্যথা ইত্যাদি শারীরিক সমস্যা শিশুর মা-বাবাকেও চিন্তিত এবং উদ্বেগব্যাকুল করে তোলে। সুতরাং সন্তানের জন্যে, মা-বাবার দেওয়া সবথেকে মূল্যবান উপহার হতে পারে, শিশুর রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতাকে বাড়িয়ে তোলার শক্তি।
ইংরেজিতে ‘ইমিউনিটি’ শব্দটির সঙ্গে সকলেরই পরিচয় আছে। বড়ো, ছোটো উভয়ের মধ্যেই ইমিউনিটি অর্থাৎ রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা স্বাভাবিক ভাবেই থাকে। শরীরে প্রতিটি কোশ, টিস্যু এবং শরীরের অভ্যন্তরীণ যন্ত্রবিশেষ শরীরে ইমিউনিটি ক্ষমতা তৈরি করে বাইরের জীবাণুর সঙ্গে শরীরকে লড়াই করার ক্ষমতার জোগান দেয়। ফলে শরীরও সুস্থ থাকে। এই কারণেই আমাদের চারপাশে কোটি কোটি রোগের জীবাণু থাকা সত্ত্বেও আমরা কখনও-সখনও অসুস্থ হই।
জন্মের সময় শিশু অল্প হলেও, নিজস্ব ইমিউন ক্ষমতা নিয়ে জন্মায়। মায়ের গর্ভে থাকার সময়েই, শিশুর শরীরে মায়ের থেকে অ্যান্টিবডিস তৈরি হয় যা ভবিষ্যতে শিশুর জন্মাবার পরেই তাকে পারিপার্শ্বিক রোগ-জীবাণু থেকে লড়বার শক্তি জোগায়। এই ক্ষমতা আরও শক্তিশালী হয় মায়ের দুধে। মায়ের দুধ ছাড়াও গরুর দুধও শিশুর শরীরের সার্বিক স্বাস্থ্যের খেয়াল রাখে।
শিশুর জন্মের এক বছর পর্যন্ত তার শরীরের নিজস্ব অ্যান্টিবডিগুলি তাকে অনেকটা সুরক্ষিত রাখতে সাহায্য করে কিন্তু সময়ের সঙ্গে সঙ্গে এগুলির ক্ষমতা কমতে শুরু করে। শিশুর শরীর এরপর ধীরে-ধীরে নিজস্ব অ্যান্টিবডি তৈরি করে ইমিউন ক্ষমতাকে বাড়িয়ে তুলতে থাকে কিন্তু এটা অনেক সময়সাপেক্ষ ব্যাপার। অ্যান্টিবডি তৈরি হতে যতটা সময় লাগতে থাকে, ওই সময়ের মধ্যে শিশুর বারবার বিভিন্ন অসুখে আক্রান্ত হওয়ার প্রবণতা দেখা যায়। তবে একটু চেষ্টা করলে এই সমস্যা অনেকটা কমিয়ে ফেলা সম্ভব।
১) মাতৃদুগ্ধ শিশুর ইমিউনিটি বাড়িয়ে তুলতে সাহায্য করে – সাধারণত ৬ মাস থেকে ১ বছর পর্যন্ত শিশু মাতৃদুগ্ধ পান করে। তখন অনেক রকম অসুস্থতার হাত থেকেই সে সুরক্ষিত থাকে এবং জীবনের পরের দিকেও নানারকম সংক্রমণ এবং অ্যালার্জির হাত থেকেও সে বাঁচতে সক্ষম হয়। শিশুর জন্মের পরেই ৪-৫ দিন যে হলুদ রঙের মাতৃদুগ্ধ শিশু পান করে, তাকে কোলোসট্রাম বলা হয়। এটি অ্যান্টিবডিতে পরিপূর্ণ এবং প্রত্যেক শিশুর জন্যেই এটি অত্যন্ত প্রয়োজনীয়। ৬ মাস যদি শিশু মাতৃদুগ্ধ পান করে তাহলে রোগজীবাণুর হাত থেকে সে অনেকবেশি সুরক্ষিত থাকে যতদিন পর্যন্ত তার নিজের শরীর অ্যান্টিবডি তৈরি করতে সক্ষম না হচ্ছে।
২) শিশুর ডায়েটে সমতা বজায় রাখতে হবে – ডায়েটের মাধ্যমে সবরকম পুষ্টিকর তত্ত্ব যাতে শিশুর শরীরে প্রবেশ করে সে বিষয়ে খেয়াল রাখা প্রয়োজন। ব্যালেন্সড ডায়েট শিশুর ইমিউন প্রক্রিয়াকে সঠিক ভাবে সক্রিয় রাখতে সক্ষম। জিংক এবং আয়রনের মতো খনিজদ্রব্যের সঙ্গে অ্যান্টিঅক্সিডেন্টস-এর মতো জিনিসেরও প্রয়োজন, শিশুর শরীরের ইমিউন সিস্টেম-কে সক্রিয় রাখতে।
কার্বোহাইড্রেটস, প্রোটিন, ডাল, আনস্যাচুরেটেড ফ্যাটস, টাটকা ফল, সবুজ শাকসবজি, বাদাম, দই ইত্যাদি শিশুর ডায়েটে থাকা আবশ্যক। প্রসেস করা প্যাকেটের খাবার শিশুকে না-খাওয়াবারই চেষ্টা করবেন।
৩) পানীয় শিশুর ইমিউন কোশগ্রন্থিগুলিকে ডি-হাইড্রেটেড হতে দেয় না – শরীরের প্রত্যেকটি কোশগ্রন্থি জল পেলে ঠিকঠাক কাজ করতে সক্ষম হয়। ইমিউন কোশগ্রন্থিগুলি তার থেকে আলাদা নয়। জল, শরীরে জমে থাকা টক্সিনস এবং বর্জ্যপদার্থ, যেগুলি শরীরকে প্রয়োজনমতো কাজ করতে দেয় না ফলে ইমিউন সিস্টেমেরও কার্যক্ষমতা কমাতে শুরু করে, সেগুলি শরীর থেকে বাইরে বার করে দিতে সাহায্য করে। যে-কোনও রং, গন্ধ এবং স্বাদ ছাড়াই জল খাবার অভ্যাস বাচ্চাদের মধ্যে গড়ে তুলতে হবে। জলের প্রতি বাচ্চাদের ভালোবাসা এতটাই বাড়িয়ে তুলতে হবে যাতে ভবিষ্যতে, দোকানের বোতলবন্দি মিষ্টি পানীয়ের প্রতি তাদের অত্যাধিক দুর্বলতা গড়ে উঠতে না-পারে।
৪) পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন পরিবেশ ইমিউন সিস্টেমকে খোলা হাওয়ায় নিঃশ্বাস নিতে সাহায্য করে – ইমিউন সিস্টেমের কোশগ্রন্থিগুলি দূষণমুক্ত পরিবেশে পরিষ্কার খোলা বাতাসে শ্বাস নেওয়ার জন্যে সবসময় ব্যাকুল থাকে। অবশ্য এখন অভিভাবকেরা অনেক বেশি সচেতন এবং সবসময় তাদের চেষ্টা থাকে যতটা কম দূষণমূক্ত পরিবেশে তাদের সন্তানেরা বড়ো হয়। এখন এয়ারকন্ডিশন ঘরেই বাচ্চারা বেশিরভাগ বড়ো হয়ে ওঠে।
৫) সব রকমের শারীরিক ব্যায়াম ইমিউন সিস্টেমের কার্যক্ষমতা অক্ষত রাখে – নিয়মিত ব্যায়াম ইমিউন সিস্টেমের কোশগ্রন্থির সংখ্যা বাড়াবার সঙ্গে সঙ্গে তার কার্যক্ষমতা বাড়িয়ে তুলতেও সাহায্য করে। ফলত শিশুদের অসুস্থ হওয়ার সম্ভাবনা কমে যায়। যত রকমের শারীরিক ব্যায়াম বাচ্চাদের করানো যায়, তার সবগুলোই মা-বাবার উচিত নিজেদের সন্তানদের করানো।
৬) স্ট্রেস ইমিউনিটির মাত্রা কম করে – আজকাল বাচ্চারা স্কুলের কাজ, এক্সট্রা কারিকুলার অ্যাকটিভিটি, নিজেদের জামাকাপড়, লুক্স, নিজেদের কাছে কী জিনিস আছে আর কী নেই– এইসব নিয়ে সবসময়ই টেনশন, স্ট্রেসে থাকে। এর সঙ্গে যোগ হয় অভিভাবকদের নিজেদের স্ট্রেসপূর্ণ জীবন। অতিরিক্ত স্ট্রেস, ইমিউন ক্ষমতাকে হ্রাস করে। স্ট্রেস বেড়ে গেলে রক্তে কর্টিসোলের মাত্রা বেড়ে যায়, ফলে ‘টি’ এবং ‘বি’ কোশের মতো ইমিউন কোশগ্রন্থিগুলির সংখ্যা কমতে শুরু করে।
৭) অতিরিক্ত স্যানিটাইজেশন, জীবাণুর সঙ্গে ইমিউনিটিকেও কম করে দেয় – সন্তানকে সুস্থ রাখতে অনেক অভিভাবকই পরিবেশকে অতিরিক্ত পরিষ্কার রাখার পরিকল্পনা করেন। এর ফলে বাচ্চাদের ইমিউনিটি শক্তি কমে যায়।
৮) ওষুধের অপব্যবহার ইমিউনিটি ক্ষমতা কমিয়ে দেয় – সন্তান অসুস্থ হলে, মা-বাবার চিন্তার কারণ হয়ে পড়ে। তখন ওষুধ-ই যে একমাত্র ভরসা এবং সামান্যতম অসুস্থতাতেও অ্যান্টিবায়োটিকের ব্যবহার করতে হবে, এমনটাই বেশিরভাগ অভিভাবকদেরই মনের ধারণা। আর যেহেতু ওষুধের দোকানে গেলেই সহজে ওই ওষুধগুলি পাওয়া যায়, তাই সন্তানের অসুখ হলেই পরীক্ষা না করিয়েই এই ওষুধগুলির ব্যবহার অনেকেই করে থাকেন। অপ্রয়োজনে ব্যবহার করার ফলে প্রয়োজনে তখন আর ওই ওষুধে কাজ হয় না এবং শিশুর ইমিউনিটি ক্ষমতাও নষ্ট হয়ে যায়।
৯) ইমিউনিটি বজায় রাখতে হাত ধোওয়ার অভ্যাস করাতে হবে – সাধারণ অসুস্থতা রোধ করতে হাত ধোওয়ার অভ্যাস খুব ভালো। ছোটো থেকেই বাচ্চাদের শেখানো উচিত হাত ধোওয়ার প্রয়োজনীয়তা এবং সঠিক হাত ধোওয়ার নিয়ম। সময়ে সময়ে হাত ধুলে, রোগের জীবাণুর কোথাও লুকিয়ে থাকার সম্ভাবনা থাকবে না ফলে রোগের সম্ভাবনাও কমে যাবে।
১০) ভালো ঘুমের প্রয়োজন – শরীরকে ঠিকমতো পরিচালনা করবার জন্য ঘুমের প্রয়োজন। শরীরের মধ্যেই পড়ে ইমিউন ক্ষমতাও। ঘুম কম হলে ইমিউন কোশগ্রন্থি তৈরি হওয়া কমে যায়। সহজে শিশু সংক্রমণের শিকার হয়। দুঃখের বিষয়, আমাদের বর্তমানে স্ট্রেসপূর্ণ জীবনে ঘুমের পরিমাণ কমে যাওয়াতে ইমিউনিটি শক্তি আর আগের মতো শক্তিশালী থাকছে না।
১১) টিকাকরণ প্রক্রিয়ার সুফল রোগের সম্ভাবনা কমিয়ে দেয় – অনেক মারাত্মক রোগ এখন টিকার সাহায্যে রোধ করা সম্ভব। আগে শিক্ষার অভাবে মা-বাবারা বাচ্চাদের প্রয়োজনীয় টিকাকরণ করাতেন না, ফলে প্রভূত রোগের শিকার হতো বহু শিশু। এখন শিক্ষার সম্প্রসারণে অভিভাবকদের মধ্যে চেতনার উদ্রেক হওয়াতে অধিকাংশ মা-বাবাই তাদের সন্তানদের টিকাকরণ করান, ফলে শিশুরা আগের মতো আর কঠিন রোগে অতটা আক্রান্ত হয় না। এই সহজ পদ্ধতিগুলির মাধ্যমে শিশুর ইমিউনিটি ক্ষমতা বাড়িয়ে তুলুন।