অন্ধ্রপ্রদেশের উত্তরাংশে খাম্মাম জেলা। এই জেলার উত্তরে ছত্তিশগড় রাজ্য, পশ্চিমে ওয়ারাঙ্গল জেলা, দক্ষিণে নালগোন্দা, কৃষ্ণা জেলা আর পূর্বে পশ্চিম ও পূর্ব গোদাবরী জেলাদ্বয়। তবে খাম্মাম জেলা বর্তমানে আর অন্ধ্রপ্রদেশ রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত নয়। বর্তমানে এটি তেলেঙ্গানা রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত। পর্যটন মানচিত্রে খাম্মাম স্থান না পেলেও এই জেলার প্রাকৃতিক আকর্ষণে, অনন্য মন্দির স্থাপত্যের উৎকর্ষে বা প্রাচীন প্রত্নতাত্ত্বিক সমারোহে অথবা ঐতিহাসিক দুর্গ প্রাকার দর্শনে স্থানটি অতুলনীয়। একজন উৎসুক পর্যটক যে যে আকর্ষণে দেশ ভ্রমণ করেন, তার প্রায় সবটাই মজুদ রয়েছে এই জেলার কোনে কোনে। অন্ধ্রপ্রদেশ পর্যটন দফতর একটা ভালো কাজ করেছে তা হল, জেলাভিত্তিক প্রচার পুস্তিকার মাধ্যমে রাজ্যের পর্যটন আকর্ষণের বিবরণ মানুষের কাছে পৌঁছে দিচ্ছে। প্রচার পুস্তিকার অর্থমূল্য নেই আর বিলিব্যবস্থায় নেই কোনও কার্পণ্য। ফলে সাধারণ মানুষের হাতেও চলে যাচ্ছে পর্যটন আকর্ষণের কেন্দ্রগুলির বিবরণ। এভাবেই আমার হাতে একদিন এল খাম্মাম জেলার এক প্রচারপুস্তিকা। মনে হল ভালোই হল, সময় সুযোগ পেলে ঘুরে নেওয়া যাবে জায়গাগুলি।

বেশ বড়ো জেলা খাম্মাম। সাধারণ পর্যটকের কাছে এক-দুদিনে সব জায়গা দেখা সম্ভব নয়। আর দ্রষ্টব্য রয়েছে জেলার বিভিন্ন প্রান্তে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে। শুরু করা যাক খাম্মাম শহর দিয়েই। জেলা শহর খাম্মাম। রাস্তাঘাট বেশ ভালোই। সারা শহর জুড়ে নানা নির্মাণকার্য চলছে। ব্যক্তিগত বাড়িঘর ছাড়াও এখানে অনেকগুলি পাবলিক স্কুলকলেজ গড়ে উঠছে। যদিও অধিকাংশই শহরের উপকণ্ঠে। দোকান বাজার শহর জুড়ে, চালু স্কুলকলেজও রয়েছে বেশ কয়েকটি। শহরের মধ্যে রয়েছে দুটি প্রধান দ্রষ্টব্য। প্রথমটি হল স্তম্ভদ্রী লক্ষ্মীনরসিংহ স্বামী দেবস্থানম্। একটি টিলার মাথায় লক্ষ্মী-নরসিংহ দেবের মন্দির। এই মন্দিরের গায়েই মন্দিরের জন্মকাহিনি বর্ণনা করা রয়েছে। সেই কাহিনি বলে এই পাহাড়ের মাথায় মৌদগৌল্য মহামুনি তপস্যা করছিলেন, তাঁর সঙ্গে ছিল তাঁর অনুগামী ভক্তের দল। তখনই আবির্ভূত হন নরসিংহ দেবতা সঙ্গে লক্ষ্মী দেবী। যেহেতু দেবতা স্তম্ভ ভেদ করে আবির্ভূত হয়েছিলেন তাই এই স্থানের নাম স্তম্ভদ্রী। পরবর্তী সময়ে তা পরিবর্তিত হয়ে হল খাম্মাম মেট্রু যা কালক্রমে হল খাম্মাম।

ষোড়শ শতকে এই অঞ্চলের রাজা প্রতাপ রুদ্র এই মন্দির নির্মাণ করেন। এই মন্দিরে সকাল থেকেই ভক্ত ও পুণ্যার্থীর ভিড়। মন্দির শীর্ষ থেকে খাম্মাম শহরের পাখির চোখে ধরা দৃশ্য দেখা যায়। মন্দির থেকে সামান্য দূরে এক ছোট্ট সুন্দর পার্ক, সেখানে ফুল গাছ, জলের ফোয়ারা, বিশ্রাম করার বেঞ্চ সবই রয়েছে।

মন্দির দর্শন সেরে এবার আমরা চলেছি খাম্মাম শহরের প্রাচীনতম স্থাপত্য দর্শনে। কাকতীয় বংশের রাজত্বকালে ৯৫০ সালে এই খাম্মামে নির্মিত হয় এক বিশাল পাথরের দুর্গ। কাকতীয় রাজত্বের অবসানের পর ১৫১২ সালে কুতুবশাহী রাজত্বের দখলে যায় এই দুর্গ। এর পরে সপ্তদশ শতকে সুলতান আসফ জাহি এই দুর্গ দখল করেন। গ্রানাইট পাথরে নির্মিত এই দুর্গ একেবারে খাম্মাম শহরের কেন্দ্রস্থলে অবস্থিত। সিঁড়ি ভেঙে উপরে উঠতে থাকি, দুর্গের শীর্ষে। প্রাচীর দিয়ে ঘেরা এই দুর্গ প্রায় পুরোপুরি অটুট রয়েছে। তবে দুর্গের অন্দরে এই পাথুরে দেয়াল ছাদ পাঁচিল সিঁড়ি ছাড়া আর কিছুই নেই। দর্শনীয় বলতে এই মাথা উঁচু পাথুরে স্থাপত্যটুকু। দুর্গ শীর্ষ থেকে খাম্মাম শহরের বুকে সূর্যাস্ত দেখার সৌভাগ্য হল।

খাম্মাম শহরের পরিধি খুব বড়ো নয়, শহর থেকে বেরোলেই গ্রাম – চাষবাস। তবে অজপাড়াগাঁ নয়, বেশির ভাগই পাকা বাড়ি। আর প্রধান চাষ বলতে তুলো আর ধান। প্রায়ই তুলো বোঝাই বস্তা নিয়ে ট্রাক ছুটে যাচ্ছে এ দৃশ্য দেখা যায়। লাললংকার চাষও হচ্ছে অনেক এলাকা জুড়ে। এখানে খাদ্যতালিকায় লাললংকার উপস্থিতি প্রায় সব সময়েই। এখানে মাটির রং কালচে, পরিভাষায় যাকে বলে ‘ব্ল্যাক কটন সয়েল’– তুলো চাষের বিশেষ উপযোগী। ভুট্টার খেতও রয়েছে। মাঠের মধ্যে বা বাড়ির উঠোনে ভুট্টা শুকানোর দৃশ্য প্রায়ই দেখা যায়।

খাম্মাম জেলার একেবারে পশ্চিমপ্রান্তে আর এক দ্রষ্টব্য ‘কুসুমানচি’, শহর থেকে প্রায় ২০ কিমি দূরে। অতি প্রাচীন মন্দির এই কুসুমানচি– সেই কাকতীয় যুগের নির্মাণ। এই মন্দিরে রয়েছে তিন মিটার দীর্ঘ শিবলিঙ্গ, যার ব্যাস প্রায় ৪ মিটার। কাছাকাছি রয়েছে আর এক দ্রষ্টব্যস্থান, খাম্মাম থেকে ২১ কিমি দূরে নেলাকোন্ডাপল্লী। এই স্থানের রয়েছে বিশেষ ঐতিহাসিক গুরুত্ব। প্রায় ১০০ একর ঘিরে রাখা হয়েছে, মাটির দেয়াল দিয়ে। এখানে প্রত্নতাত্ত্বিক খননকার্যের ফলে পাওয়া গেছে বৌদ্ধ বিহারের ধবংসাবশেষ। প্রকৃতপক্ষে অন্ধ্রপ্রদেশে বুদ্ধের জীবদ্দশাতেই বৌদ্ধ ধর্মের প্রসার ও প্রচার হয়েছিল। খ্রিষ্টপূর্ব ষষ্ঠ শতাব্দীতে এই তেলুগু রাজ্যে বৌদ্ধধর্মের প্রসার শুরু হলেও, সম্রাট অশোকের রাজত্বকালে (খ্রিষ্টপূর্ব ৩য় শতাব্দী) তা রাজশক্তির সহায়তায় এই অঞ্চলের প্রধান এক ধর্ম হিসাবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। সারা অন্ধ্র জুড়ে ৫২টি সাইটে বৌদ্ধধর্ম সম্পর্কিত কর্মকাণ্ডের পরিচয় পাওয়া গেছে। তার মধ্যে এই নেলাকোন্ডাপল্লী অন্যতম। এই নেলাকোণ্ডাপল্লীতে খননকার্যের ফলে পাওয়া গেছে ইটের তৈরি বিহার, জলের কূপ, মহাস্তূপ, টেরাকোটার নানা মূর্তি, বুদ্ধের একটি ব্রোঞ্জ মূর্তি, লাইমস্টোন পাথরে অলংকৃত স্তূপের একটি ক্ষুদ্র সংস্করণ ইত্যাদি। ঐতিহাসিকরা মনে করেন এইসব বৌদ্ধ স্থাপত্য ও ক্রিয়াকাণ্ড তৃতীয় ও চতুর্থ শতাব্দীর সময়কালের। এই অঞ্চলের আর এক খ্যাতির কারণ পুরাণের কিছু গল্পকথা। সেই বিশ্বাস অনুযায়ী এই অঞ্চলে পান্ডবেরা তাদের ১২ বছরের বনবাস পর্ব শেষ করে এক বছর অজ্ঞাতবাস করেছিলেন।

খাম্মাম শহরের পূর্বদিকে ২৫ কিমি দূরে ওয়াইরা অঞ্চল। প্রধান সড়ক থেকে বাঁদিকে আরও ৩ কিমি এগিয়ে ওয়াইরা লেক। গাড়ি পৌঁছে যায় এই লেকের তীরে। প্রকৃতপক্ষে এই লেক হল এক বিশাল জলাধার। এই জলাধার থেকে জল পরিশ্রুত করে ২৩টি গ্রামে সরবরাহ করার ব্যবস্থা রয়েছে। গ্রীষ্মের এক বিকেলে আমরা পৌঁছে যাই এই লেকের তীরে। এই লেককে পর্যটক-আকর্ষণ হিসাবে গড়ে তোলার প্রচেষ্টা চলছে। লেকের তীরে ছোট্ট এক লজ বর্তমানে পরিত্যক্ত ভাঙাচোরা অবস্থায় রয়েছে তবে অদূর ভবিষ্যতে হয়তো আবার গড়ে উঠবে নতুন রূপে তার ইঙ্গিত পাওয়া যায় পর্যটনের প্রচার পুস্তিকায়। বর্তমানে যা রয়েছে তাও কম আকর্ষণীয় নয়। লেকের কিনারা ধরে ধাপে ধাপে বাগান ও লন করে সৌন্দর্যায়নের ব্যবস্থা রয়েছে। লাল টালি বসানো পথে সিঁড়ি উঠে গেছে এক ছোট্ট টিলার মাথায়। সেখানে রোদ, বৃষ্টি থেকে রক্ষার জন্য মাথার ছাদও রয়েছে। এখান থেকে লেকের দৃশ্য মুগ্ধ চোখে চেয়ে থাকতে হয়। লেককে বেষ্টন করে রয়েছে হালকা জঙ্গল আর দূরে টিলার উপস্থিতি। বোটিং-এর ব্যবস্থাও রয়েছে। তবে এখন শুধু প্যাডল বোট। চারজনের বসার ব্যবস্থা রয়েছে বোটে।

লেকের জলে ভেসে পড়লাম। লেকের প্রান্তে পাথরের বোল্ডার মুখ বাড়িয়ে রয়েছে জল থেকে। সেখানে বসেছে পাখির মেলা, অধিকাংশই বক জাতীয় পাখি। অন্যান্য পাখিও রয়েছে। কাছাকাছি যেতেই সব উড়ে গেল। তবে তাদের দু-এক জনকে ক্যামেরার ফ্রেমে বন্দি করে রাখতে পারলাম। ফিরে আসি জলাধারের বোটস্ট্যান্ডে। পশ্চিম দিগন্তে সূর্য ঢলে পড়েছে। উঠে আসি সিঁড়ি ভেঙ্গে সেই ছোট্ট টিলাটার মাথায়। এখান থেকে সূর্যাস্ত দেখা বড়োই মোহময়। বিকেলের চা-পর্ব এখানেই সমাধা করা গেল। সঙ্গে ফ্লাস্কে চা-কফি, বোতলে কোল্ড ড্রিঙ্ক, প্যাকেটে বিস্কুট-চানাচুর, সবকিছুর ব্যবস্থাই করা ছিল।

খাম্মামের বিভিন্ন প্রান্তে নারকেল গাছের প্রাচুর্য। দোকানে দোকানে ডাবের স্তূপ চোখে পড়ে। চাইলে কেটে প্লাস্টিকের বোতলে ডাবের জল ভরে দেয়, ফলে সঙ্গে সঙ্গে তা পান করতে না পারলেও চলবে– ধীরে সুস্থে পরেও খাওয়া যাবে। এ অঞ্চলে বড়ো কোনও কারখানা এখনও চোখে পড়েনি। তবে ছোটোখাটো কারখানার মধ্যে পাথরের কারখানাই প্রধান। কাঁচা মাল একেবারে হাতের কাছেই রয়েছে। এই গ্রানাইট কারখানাগুলি বিভিন্ন নিকটবর্তী টিলা, পাহাড় থেকে বড়ো বড়ো বোল্ডার সংগ্রহ করে বিভিন্ন মাপে কেটে টুকরো করে সাইজ করে পালিশ করে বাজারে যোগান দেয়। এই ধরনের কারখানার সংখ্যা অনেক এবং শহরের সীমা পেরোলেই রাস্তার দু-পাশে দেখা যায়। এছাড়া অনেক ইটের ভাটা গড়ে উঠেছে এইসব আধা-গ্রাম আধা-শহর অঞ্চলে। এই অঞ্চল বাংলার মতো নরম মাটির দেশ নয়। প্রায়শই দেখা যায় মাটি ফুঁড়ে পাথরের মাথা বেরিয়ে আছে। অনেক ক্ষেত্রেই এখানে উপরের পাথরের আস্তরণ সরিয়ে তবেই মাটি পেতে হয় আবার কখনও পাতলা মাটির আস্তরণের নীচে রয়েছে পাথরের স্তর।

ওয়াইরা থেকে আরও ২৫ কিমি পূবে অর্থাৎ খাম্মাম শহর থেকে প্রায় ৫০ কিমি দূরে কাল্লুর গ্রাম। এখানে একদিন কাজের শেষে দুপুর গড়িয়ে বিকেল হয়ে গেছে। হঠাৎই খেয়াল হল প্রচারপুস্তিকায় কোল্লুরে এক বিখ্যাত মন্দিরের উল্লেখ আছে। ঠিক তাই, এখানে রয়েছে প্রাচীন ভেনুগোপালস্বামী অর্থাৎ কৃষ্ণ মন্দির। সঙ্গের স্থানীয় কর্মচারীর সাহায্যে মন্দির খুঁজে পাওয়া গেল। এই মন্দিরের বয়স প্রায় ৪০০ বছর। রানি রুদ্রমা দেবী এটি নির্মাণ করান। মন্দির বেশ বড়ো। মন্দিরের গায়ে কারুকার্য ও মুর্তিটিও সুন্দর। আমরা যখন পৌঁছলাম তখন বৈকালিক পূজার্চনার ব্যবস্থা চলছে।

প্রচারপুস্তিকায় এই মন্দিরের কাছেপিঠে এক প্রাচীন শিবমন্দিরের উল্লেখ রয়েছে। তবে স্থানীয় মানুষ এই মন্দিরের সঠিক অবস্থিতি সম্পর্কে কিছু বলতে পারল না। তবে আমার সঙ্গী কর্মচারি অবশ্য জানাল এক শিব মন্দিরের কথা সে জানে, তবে তা দশ-বারো মাইল দূরে। হাতে সময় রয়েছে, সূর্যদেব এখনও দৃশ্যমান, সঙ্গে গাড়ি রয়েছে– আমরা সেই প্রাচীন মন্দিরের খোঁজে বেরিয়ে পড়লাম। এ রাস্তা-ও রাস্তা কোনও রাস্তাই আমার চেনা নয়, তবে আমরা যে লোকালয় থেকে দূরে সরে যাচ্ছি তা বোঝা গেল। চলেছি জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে, মাঝে মাঝে আদিবাসী গ্রাম, দূরে টিলার সারি, সূর্য পশ্চিম দিগন্তে ধীরে ধীরে ঢলে পড়ছে। জঙ্গল পাতলা হয়ে যাচ্ছে– আবার এক আদিবাসী গ্রাম– ঘিরে রয়েছে আমবাগান। হাজার হাজার আম গাছ, আম ঝুলছে ডালে ডালে– কিছু পাকা কিছু কাঁচা। ছোটো ছোটো পাথরের ঢিবি পথের ধারে-কাছে আর দূরে টিলার সারি।

প্রায় ঘণ্টাখানেক আমরা পথ চলেছি– অন্তত কুড়ি পঁচিশ কিমি তো হবেই। গ্রামের রাস্তাও কিন্তু পাকা– বেশ ভালো। অবশেষে জঙ্গলের ধারে শিবমন্দিরের খোঁজ পাওয়া গেল। অনেকটা জায়গা জুড়ে মন্দির চত্বর– পাশেই আদিবাসী গ্রাম। মন্দিরের নাম নীলাদ্রি শিবমন্দির। মন্দিরের চত্বরে বিশাল এক শিবলিঙ্গ আর মহাদেবের মুখমণ্ডলের মূর্তি। তবে শিবমন্দির তালাবন্ধ। এক গ্রামবাসী ছুটল পূজারির কাছে, তার কাছেই চাবি। আশেপাশে একটু ঘুরে দেখি, যতক্ষণ না মন্দিরের চাবি আসে। মন্দিরের ঠিক পিছনেই একটা সরু নালা এসে মিশেছে এক ছোট্ট জলাশয়ে। মন্দির ও তার চত্বরটি রাস্তা থেকে অনেকটা উঁচু।

ইতিমধ্যে মন্দিরের পূজারি উপস্থিত চাবিসহ। প্রবেশ করি এক রহস্যময় আলো-আন্ধারি গর্ভগৃহে। বৈদ্যুতিক সংযোগ রয়েছে মন্দিরের অভ্যন্তরে তবে তখন বোধহয় কারেন্ট নেই, টর্চের আলোয় দর্শন হল শিবলিঙ্গ। পূজারি পূজার আয়োজন শুরু করার উদ্যোগ নিচ্ছেন, আমরা প্রণাম করে বেরিয়ে এলাম। সূর্য তখন ডুবে গেছে।

ইচ্ছে হল এবার ফিরি। কিন্তু আমার অতি উৎসাহী পথপ্রদর্শক এবার আমাকে আরও এক বিখ্যাত মন্দির দর্শনে নিয়ে চলল। অন্ধকার হয়ে গেছে তবে আকাশে চাঁদ উঠেছে। জ্যোৎস্নায় জঙ্গলের পথ যেন আরও রহস্যময়। আরও প্রায় আধ ঘণ্টায় পৌঁছে গেলাম আর এক প্রাচীন মন্দিরে। ৭০০ বছরের প্রাচীন এই ভেঙ্কটেশ্বরস্বামী মন্দির, আন্নাপুরেদ্দিপল্লী গ্রামে। মন্দিরের পূজারি আমাদের সাদর আমন্ত্রণ জানিয়ে মন্দিরের ভেতরে নিয়ে গেলেন। খাম্মাম শহর থেকে ৭৫ কিমি দূরের এই মন্দির কাকতীয় বংশের রাজত্বকালে নির্মিত হয়েছিল। তবে বর্তমানে তার পুননির্মিত রূপ আমাদের সামনে। ঘুরে ঘুরে দেখি মন্দিরের স্থাপত্য, মূর্তি, দেয়াল ও পিলারের সুন্দর অলংকরণ। মন্দিরে সন্ধ্যা আরতির পর আমাদের ভোগ-প্রসাদ দিলেন সেই পূজারি।

অন্ধ্রপ্রদেশ তথা তেলেঙ্গানা সত্যিই মন্দিরময়। খাম্মাম থেকে বিজয়ওয়াড়ার পথে জামালপুরমের বিখ্যাত ভেঙ্কটেশ্বরস্বামী মন্দির। খাম্মাম শহর থেকে প্রায় ৮৫ কিমি দূরে এই মন্দিরের অবস্থান। বিশ্বাস করা হয় এই মন্দিরটি প্রায় হাজার বছর পুরোনো। একটি টিলার মাথায় এই মন্দির। বেশ ভিড় মন্দিরে, শুনলাম প্রতি শনিবার আরও ভিড় হয়। এই মন্দির দর্শন ও পূজায় আকাঙক্ষাপূরণ হয়– এই বিশ্বাস স্থানীয় মানুষের। সেটাই হয়তো ভিড়ের প্রধান কারণ। সামনে বিশাল তোরণ পেরিয়ে তারপর অনেকগুলি সিঁড়ি ভেঙে তবে মূল মন্দিরে প্রবেশ। এই মন্দিরের আর এক নাম তেলেঙ্গানা চিনা তিরুপতি। দেখা হল এক নববিবাহিত তরুণ-তরুণীর সঙ্গে। তাদের বিবাহ এই মন্দিরেই সম্পন্ন হয়েছে। মন্দিরের দেবতাকে প্রণাম জানিয়ে এবার ফেরার পথ ধরি।

খাম্মাম যে শুধু মন্দির আর স্থাপত্য বা ঐতিহাসিক নির্দশনে ভরা তা নয়, খাম্মাম প্রকৃতির অনন্য সৌন্দর্যে স্নেহধন্য। গোদাবরী নদী এই জেলার মধ্যে দিয়ে ২০০ কিমি পথ অতিক্রম করেছে, তার সঙ্গে রয়েছে গভীর অরণ্যের উপস্থিতি সেখানে বন্যপ্রাণীর দেখাও মিলে যেতে পারে। প্রাকৃতিক বা কৃত্রিম সরোবর ছড়িয়ে রয়েছে জেলার বিভিন্ন প্রান্তে। দণ্ডকারণ্য রেঞ্জের পাহাড়ের সারিও তার অনন্য প্রাকৃতিক দৃশ্যাবলী এখানের আর-এক সম্পদ।

এবারে কর্মসূত্রে যেতে হবে খাম্মাম জেলার উত্তরাংশে ভদ্রাচলমে। প্রকৃতি ও বিখ্যাত মন্দিরের কারণে ভদ্রাচলম পর্যটক মহলেও বেশ খ্যাত। খাম্মাম শহর থেকে সড়কপথে ১২০ কিমি দু’ঘণ্টার পথ। আর হায়দরাবাদ থেকে সড়কপথে ২৭৫ কিমি। আবার হায়দরাবাদ থেকে ট্রেনে (হায়দরাবাদ-বিজয়ওয়াড়া  লাইনে) খাম্মাম পৌঁছে সড়কপথে বাকি পথটা চলে আসা যাবে। ভদ্রাচলমের প্রধান খ্যাতি সীতারামস্বামী মন্দিরের কারণে। ভদ্রাচলমে পৌঁছে প্রথমেই যাই এই মন্দিরের দোরগোড়ায়।

দক্ষিণভারতে গোদাবরী নদীকে অত্যন্ত পবিত্র বলে মান্য করা হয়, যেমন আমরা গঙ্গাকে উত্তর ও পূর্ব ভারতে মান্য করি। গোদাবরী নদীর সূচনা মহারাষ্ট্রের নাসিকে, সেখান থেকে ১৫০০ কিমি প্রবাহিত হয়ে অন্ধ্রের রাজমুন্দ্রী হয়ে সাগরে পড়েছে। সেই প্রবাহপথে পড়ে এই ভদ্রাচলম। গোদাবরী নদীর তীরে একটি ছোটো টিলার ওপরে এই সীতারামস্বামী মন্দিরের অবস্থিতি। এই মন্দিরে প্রবেশের জন্য লম্বা লাইন। আমাদের অবশ্য ভিআইপি খাতিরে আর লাইনে দাঁড়াতে হয়নি।

এই মন্দিরে শ্রীরামচন্দ্রের মূর্তির সঙ্গে অন্য রামমন্দিরে শ্রীরামচন্দ্রের মূর্তির সঙ্গে অনেকটাই তফাত রয়েছে। সাধারণত রামচন্দ্রের মূর্তিতে দুটি হাত দেখানো হয়, তবে এই মন্দিরের মূর্তিতে তিনি চতুর্ভুজ রাম হিসাবে আবির্ভূত অর্থাৎ তাঁর এখানে চারটি হাত। এখানে তাঁর হাতে রয়েছে শঙ্খ, চক্র, তির ও ধনুক। শঙ্খ ও চক্র সাধারণত দেবতা বিষ্ণুর সঙ্গে সম্পর্কিত, এখানে তা শ্রীরামচন্দ্রের হাতে। সীতা তাঁর বাম পায়ের উপর উপবিষ্ট, পাশে লক্ষ্মণ দণ্ডায়মান। এই মন্দিরে ভরত ও শত্রুঘ্নের কোনও মূর্তি নেই, সঙ্গত কারণে। এই ভদ্রাচলমের মন্দিরে যে-মূর্তি পূজিত হয়, সেটি সূচনা করে রামচন্দ্রের বনবাসের সময়– অর্থাৎ রাবণ কর্তৃক সীতা অপহরণের ঠিক আগে।

এই মন্দির অতি প্রাচীন। এই মন্দির সম্পর্কে নানা কাহিনি প্রচলিত আছে। রামনবমী রামচন্দ্রের জন্মদিন হিসাবে পালিত হয়। তবে অন্ধ্রে রামচন্দ্রের জন্মদিন ছাড়াও সীতার সঙ্গে রামের বিবাহ-বার্ষিকী হিসাবেও পালিত হয় ওই দিন। এই রাজ্যের সব রাম মন্দিরে হয় এই কল্যাণ উৎসব আর সবচেয়ে জাঁকজমক হয় এই ভদ্রাচলমের মন্দিরে। এখানে বিবাহের সমস্ত নিয়মকানুন মেনে সীতা ও রামচন্দ্রের মূর্তির বিবাহ উৎসব উদ্যাপন করা হয় জাঁকজমক, বেদমন্ত্র পাঠ, ঘণ্টাধবনি সহযোগে– সব মিলিয়ে উৎসব মঞ্চ আমোদিত হয়। রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী, রাজ্যপাল সহ মন্ত্রীমণ্ডলীর সদস্যরাও উপস্থিত হন রামনবমীর এই অনুষ্ঠানে।

এবার আসি মন্দির সম্পর্কে গল্পকথা প্রসঙ্গে। রামনবমী সহ বিশেষ অনুষ্ঠানে মূল্যবান অলংকারে সজ্জিত করা হয় মূর্তিদ্বয়কে। এই অলংকার সম্পর্কেই এই গল্পকথা। সপ্তদশ শতকে আব্দুল হাসান কুতুব শাহের রাজত্বকালে এই অঞ্চলে কাঞ্চরলা গোপান্না নামে এক তহশিলদার কাজ করতেন। তিনি ছিলেন রামভক্ত– তাই তিনি ভক্ত রামদাস নামে পরিচিত ছিলেন। তিনি করের টাকায় এই রামমন্দিরের সৌন্দর্যায়ন ও বহুমূল্য অলংকার সংগ্রহ করেছিলেন। এই সংবাদ পেয়ে সুলতান গোপান্না তথা ভক্তরামদাসকে গোলকোন্ডা দুর্গের কারাগারে আবদ্ধ করেন। পরবর্তী সময়ে সুলতান কুতুব শাহ স্বপ্নে দেখেন যে রামচন্দ্র ও লক্ষ্মণ জানাচ্ছেন যে রামদাস ছয় লক্ষ টাকা নিজের কাজে নয় মন্দিরের সমৃদ্ধিতে ব্যয় করেছেন। তৎক্ষণাৎ সুলতান রামদাসকে মুক্ত করেন ও মন্দিরে মণি-মুক্তার উপঢৌকন পাঠান। বর্তমান কালে রাজ্যের সরকার এই মন্দিরের প্রধান সাহায্যকর্তা।

মন্দির দর্শন শেষে এবার মন্দির শীর্ষ (ছাদ) থেকে ভদ্রাচলম অঞ্চলকে পাখির চোখে দেখি। বাড়িঘর, গোদাবরী নদী তার অববাহিকা, সবুজ ধানখেত সবই এক ঝলকে দেখা যায়।

এবার আমাদের গন্তব্য পর্ণশালা। ভদ্রাচলম থেকে উত্তরমুখী আরও ৩৬ কিমি। এবার রাস্তা কিন্তু প্রায় জনহীন, যানবাহনের সংখ্যাও খুব কম। মাঝে মাঝে একটি দুটি গ্রাম আবার মাইলের পর মাইল জনহীন প্রান্তর– চাষের খেতও নেই। দূরে সবুজ পাহাড়ের সারি আর রাস্তার দুপাশে পোড়ো জমি, কখনও গাছপালা, কখনও ন্যাড়া আর মাঝে মাঝে জমির মধ্যে উঁকি মারছে পাথরের ঢিবি। রাস্তা যেহেতু ফাঁকা তাই ৪০ মিনিটের মধ্যেই পৌঁছে গেলাম পর্ণশালা গ্রামের কাছে। এবার মূল রাস্তা থেকে বাঁহাতে বেঁকে গ্রামের অভিমুখে। ছবির মতো গ্রাম পর্ণশালা। লোককথা অনুযায়ী শ্রীরামচন্দ্র এই গ্রামে ১৪ বছরের বনবাসপর্ব কাটিয়েছিলেন। গোদাবরী নদী এই গ্রামের পাশ দিয়ে বয়ে চলেছে। তার পাশেই মন্দির। এই প্রত্যন্ত গ্রামেও কিন্তু দর্শনার্থীর সংখ্যা কম নয়। মন্দিরের ধারেই মডেলের মাধ্যমে রামায়ণের নানা উল্লেখ্য ঘটনা প্রদর্শিত। কখনও দেখানো হয়েছে পর্ণকুটিরে দেবী সীতাকে প্রলুব্ধ করছে সোনার হরিণ (মারিচ) আবার কখনও রাম-সীতা-লক্ষ্মণ এক কুটিরের আঙ্গিনায়, কখনও বা মারিচ বধ করছেন রামচন্দ্র। কথিত আছে, রামচন্দ্র মারিচকে এই পর্ণশালায় বধ করেছিলেন।

নদীর ঘাটে নৌকা বাঁধা, নদীর জলে অনেক নৌকা ভেসেও বেড়াচ্ছে। অনেক পুন্যার্থী এমনকী সাধু-সন্তের দল নদীর ঘাটে স্নান করছে। পর্ণশালা গ্রামের আর-এক প্রান্তে নানা রঙের পাথরের খাঁজের মধ্যে দিয়ে জলের শীর্ণ প্রবাহ বয়ে চলেছে। এখানেও সীতা দেবীর মূর্তি রয়েছে, তার সিঁদুরলেপা পাথরের ওপর পদচিহ্ন পূজা পাচ্ছে আবার সাদা পাথরের ধারে কালো পাথরের ব্যান্ডকে সীতাদেবীর শাড়ির পাড় হিসাবে বর্ণনা করেও প্রণামী সংগ্রহ করা হচ্ছে। তারই একপাশে গাছের ছায়াতে বেশ পিকনিকের পরিবেশে খাওয়াদাওয়া চলছে।

ভদ্রাচলমের কাছে-পিঠে আর-এক দর্শণীয় স্থান কিন্নেরাসানি স্যাংচুয়ারি। ভদ্রাচলম থেকে দক্ষিণে ৩৫ কিমি দূরে এই স্যাংচুয়ারির প্রবেশপথ। খাম্মাম জেলার দণ্ডকারণ্য অরণ্যের যে-অংশ অর্ন্তভুক্ত, সেই অরণ্যের এক কোণে এই স্যাংচুয়ারি। এই অরণ্যভূমির পাশ দিয়ে গোদাবরী নদী প্রবাহিত হয়েছে আর এই অরণ্যকে দ্বিখণ্ডিত করেছে কিন্নেরাসানি নদী। এই নদী গিয়ে পড়েছে গোদাবরীতে। এই কিন্নেরাসানিতে এখনও রয়েছে আদিম অরণ্য। ৬৩৪ বর্গ কিমি এলাকা জুড়ে এই অরণ্যভূমিতে বাঘ, হরিণ, গৌর (বাইসন), পাইথন প্রভৃতি বন্যপ্রাণী দেখা যায়। কিন্নেরাসানি নদীকে বাঁধ দিয়ে তৈরি হয়েছে জলাধার– গ্রীষ্মের সময় এই জলাধারের জল সেচের কাজে ব্যবহূত হয়।

গাড়ি স্যাংচুয়ারির প্রবেশপথ পেরিয়ে থামল ডিয়ার পার্কের সামনে। লোহার জাল দিয়ে ঘেরা ডিয়ার পার্ক– রয়েছে অসংখ্য হরিণ তাদের মধ্যে শিংওয়ালা হরিণের সংখ্যাও নগন্য নয়। জালের ফাঁকফোকরে ক্যামেরা গলিয়ে হরিণের ছবি তোলা হল। গাছ পাতা বাড়িয়ে দিলে একেবারে জালের কাছে চলে এসে হরিণ পাতা খেয়ে যায়। একটু এগিয়েই কাচের তৈরি গ্লাস গেস্টহাউস। এরপর পায়ে হেঁটে এগিয়ে চলি জলাধারের পাশ দিয়ে বাঁধের রাস্তা ধরে।

বাঁদিকে জলাধার, তার মাঝে জঙ্গল ভরা দ্বীপ আরও দূরে গভীর জঙ্গলের ইঙ্গিত। ডান হাতে কিন্নেরাসানি ড্যাম। দূরে ন্যাড়া টিলার সারি। সূর্য এখন অনেকটাই নদীর ও বাঁধের জলের দিকে হেলে পড়েছে– সোনালি আর কালো জলের মেলামেশা যেন আলো-আধারির এক অনন্য উদাহরণ। সেই জলে ডিঙি বেয়ে মাছের সন্ধানে চলেছে কোনও জেলে। পথে এক ছোট্ট টিলার মাথায় পরিত্যক্ত ওয়াচ-টাওয়ার। শুকনো ডালপালা ঘিরে রেখেছে টাওয়ারটিকে। সন্ধ্যা নেমে আসছে কিন্নেরাসানির বুকে। অনেকটা পথ এগিয়ে এসেছি বাঁধের পথ ধরে, এবার তো ফেরার পথ ধরতে হবে।

ভদ্রাচলমের বিস্তীর্ণ অঞ্চল জুড়ে রয়েছে জঙ্গল, কখনও ঘন কখনও বা হালকা। আর তার সমান্তরাল ভাবে রয়েছে কয়লাখনি অঞ্চল। সিংগারেনি কোলফিল্ডের এক চালু খাদানে একদিন মাটির নীচে কালো হিরের (কয়লা) নিষ্কাশন দেখতে হাজির হলাম।

সিংগারেনি কোলিয়ারিতে ‘ওপেন কাস্ট’ ও ‘মেকানাইজড মাইনিং’ উভয়ই চালু রয়েছে। অনুমতি নিয়ে, বন্ড সই করে তবেই কোলিয়ারির মাইনের গভীরে প্রবেশ করলাম। তার আগে উপযুক্ত জ্যাকেট, মাথায় হেলমেট, কোমরে টর্চে সজ্জিত হয়ে লিফটে চড়ে পাতালে প্রবেশ। বর্তমানে কয়লা নিষ্কাশনের কাজ অনেকটাই স্বয়ংক্রিয় পদ্ধতিতে হয়। কয়লাখনির শ্রমিকের কাজের ধারা অনেকটাই পরিবর্তিত হয়েছে। লিফট থেকে নেমে সেই স্বল্পালোকিত খাদানের মধ্যে অনেকটা পথ পায়ে হেঁটে গেলাম। এই সেক্টরে কয়লা নিষ্কাশনের কাজ প্রায় সম্পূর্ণ তাই যেতে হবে আর এক সেক্টরে। কয়লাখনিতে ২৪ ঘণ্টা কাজ চলে। এখানে দিনরাতের কোনও প্রভেদ করা যাবে না। চলমান ট্রলিতে লাগানো রয়েছে সারি সারি চেয়ার, তারই একটিতে উঠে পড়লাম গাইডের নির্দেশমতো। আমার গাইডও আর একটি চলমান চেয়ারে উঠে পড়ল। ট্রলি চলতে লাগল, আলো অন্ধকারে কয়লা, খনির এক রহস্যময় রূপ। সুড়ঙ্গ পথ সবই যেন একইরকম। মিনিট দশেক এইভাবে চলার পর লাফিয়ে নেমে পড়লাম গাইডের নির্দেশে। চেয়ার তার আপন গতিতে ঘুরতে লাগল। এবারে সামান্য হেঁটে সুড়ঙ্গ পথে কোমরে বাঁধা বেল্টের সঙ্গে টর্চ ব্যবহার করে, মাথার হেলমেট সামলে বর্তমান মাইনিং অঞ্চলে প্রবেশ করলাম। এখানে যন্ত্রের সাহায্যে কয়লা নিষ্কাশন চলছে। সেখানে কিছুক্ষণ কাটিয়ে একইভাবে একই পথে ফেরা, লিফটে চেপে আবার বেরিয়ে আসি খনির বাইরে। ৪০০ ফুট গভীরতা থেকে বেরিয়ে এসে মেলে যেন মুক্তির নিশ্বাস।

ভদ্রাচলম থেকে গোদাবরী নদীবক্ষে ‘ক্রুইজ’ হল অনন্য অভিজ্ঞতা। এই ক্রুইজের পুরো পথ হল ভদ্রাচলম থেকে রাজমুন্দ্রী পর্যন্ত ১২০ কিমি জলপথ। পথে পড়ে পাপি হিলস্ তথা পাপিকোন্ডলমের পাহাড় ও জঙ্গল। এই জলপথ অতিক্রম করতে সময় লাগে মোটামুটি ১২ ঘণ্টা। তবে অল্প দূরত্বের ক্রুইজেও সামিল হওয়া যায়। অন্ধ্রপ্রদেশ পর্যটনের সাহায্যে এই ক্রুইজগুলি পরিচালিত হয়, প্রাইভেট সংস্থাও এখন এই জনপ্রিয় ক্রুইজের অংশিদার। তবে লঞ্চ ভদ্রাচলম বা রাজমুন্দ্রী থেকে সরাসরি চলাচল করে না, ভদ্রাচলম থেকে ৮০ কিমি দূরবর্তী গোছাভরম ঘাট থেকে যায় পুরুষোত্তম পট্টনম ঘাট পর্যন্ত। পুরুষোত্তম পট্টনম আবার রাজমুন্দ্রী থেকে ৩৫ কিমি দূরে। তবে খাম্মাম জেলা পর্যটন থেকে পোছাভরম থেকে পেরেন্টাপল্লী, এই ২৫ কিমি জলপথে ক্রুইজের একটি প্যাকেজ চালু করেছে।

খাম্মাম জেলা প্রশাসন আমাদের জন্য এই গোদাবরী নদীবক্ষে পোছাভরম থেকে পেরেন্টাপল্লী ক্রুইজের ব্যবস্থা করেছিলেন। ভদ্রাচলমের আইটিসি গেস্টহাউসে রাত কাটিয়ে বেরিয়ে পড়েছি পোছাভরমের উদ্দেশে। পথ বেশ বৈচিত্রময়, রাজ্য সড়ক চলে গেছে সোজা ছত্তিশগড়ের অভিমুখে। সে পথে কিছুটা এগিয়ে তারপর ডানদিকে অর্থাৎ পুবদিকে গাড়ি চলল। পথে পড়ে আদিবাসী গ্রাম, মাঝে মাঝে জঙ্গল, খোলা মাঠ, চাষের ক্ষেত, পতিত জমি, দূরে ঝাপসা পাহাড়ের সারি। পেরিয়ে আসি গোদাবরী ও শবরী নদীর সঙ্গম। তার ওপরে সেতু পেরিয়ে আবার ছুট। গাছপালা জঙ্গলের ফাঁক দিয়ে মাঝে মাঝে গোদাবরী নদীর প্রবাহ দেখা যাচ্ছে।

অবশেষে পৌঁছে গেলাম পোছাভরম। এটিকে জেটি না বলে ঘাট বলাই ভালো। অনেকগুলি লঞ্চ এখানে দাঁড়িয়ে রয়েছে ক্রুইজের জন্য। দলে দলে মানুষও আসছে তাদের নির্ধারিত লঞ্চে ওঠার জন্য। আমাদের লঞ্চে উঠে পড়লাম। দোতলা লঞ্চ, একতলা শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত, দোতলা সাধারণ। লঞ্চ ছেড়ে দিল বেলা ১১টা নাগাদ। নদীপথে লঞ্চ চলতে লাগল পুবদিকে। নদীর দুপাশে ছোটো-বড়ো পাহাড়, কখনও তা ন্যাড়া আবার কখনও জঙ্গলে ঢাকা। নদী বেশ চওড়া, দু’পাশের ওই পাহাড়গুলি পূর্বঘাট পর্বতমালার অন্তর্গত। মাঝে মাঝে এই পাহাড়ি জঙ্গলের মধ্যে গ্রাম, নদীর ধার কখনও বা খাড়াই উঠে গেছে আবার কখনও মোলায়েম বালির উপকূল। বালির উপকূলে নৌকা বাঁধা। আদিবাসী গ্রামের পুরুষেরা অধিকাংশই মাছ ধরার জীবিকা অবলম্বন করে। তারা জেলে ডিঙি নিয়ে বেরিয়ে পড়েছে। নদীতে মাঝে মাঝে বাঁক।

ইতিমধ্যে এক রাউন্ড চা-কফি, ঠান্ডা পানীয় ও চিকেন পকোড়া বিলি করা হয়েছে। মাইকে তেলুগু গানের সিডি বাজছে উচ্চস্বরে। দূরের পাহাড় কাছে এগিয়ে আসছে হু-হু করে হাওয়া দিচ্ছে। আজ মেঘলা তাই এসি ঘরের পরিমণ্ডলের বাইরে থাকতেই ভালো লাগছে। আর ডেকে বেরিয়েই তো ছবি তুলতে হচ্ছে। নদীর এক তীরে বালির হলুদ রঙের চড়া আর অন্য পারে খাড়াই সবুজ জঙ্গলে ঢাকা টিলা পাহাড়। নদীর একদিকে আবার সিনেমার শুটিং হচ্ছে, সেখানে বেশ কয়েকটি লঞ্চ ভিড় জমিয়েছে।

প্রায় ঘণ্টাদুয়েক লঞ্চ যাত্রার পর পৌঁছে গেলাম পেরেন্টাপল্লী। এখন আমরা পাপিকোন্ডালু বনাঞ্চলের মধ্যে ঢুকে পড়েছি। পেরেন্টাপল্লীতে লঞ্চ থামল, এখানে আধঘণ্টার বিরতি। নেমে গ্রামের পথ ধরি, এখন মেঘ কেটে রোদের তেজ বেড়েছে। মিনিট দশেক হেঁটে পৌঁছে গেলাম এক শিব মন্দিরে। মন্দিরে প্রাচীন শিবলিঙ্গ। পাশে রামকৃষ্ণ পরমহংসদেবের মন্দির। এটি পুরোপুরি আদিবাসী গ্রাম। পথের ধারেই মেয়েরা বাঁশের তৈরি জিনিসপত্র বিক্রি করছে। নজরে পড়ল প্রেক্ষাপটে বাঁশের জঙ্গল– এসব জিনিসের কাঁচামাল মজুদ। আবার ফিরে আসি ফেরিঘাটে। নজরে আসে ঘাটের ধারে এক বিশাল প্রাচীন বটবৃক্ষ।

লঞ্চ ছাড়ে আর মিনিট দশেক এগিয়ে নদীর বাঁদিকের তীরে বালির চড়া, সেখানেও ছোটো-বড়ো অনেকগুলি লঞ্চ, নৌকা অপেক্ষমান। তীরের একটু ভেতরে সারি সারি কটেজ রয়েছে। অর্থাৎ এখানে রাত্রিবাস করা যায়। দুদিনের ক্রুইজে এখানে রাত্রিবাসের ব্যবস্থা হয়। জায়গাটি ‘কোল্লারু ব্যাম্বু হাট’ নামে পরিচিত। লঞ্চ এখানেও অল্প সময়ের জন্য থামল। তীরে নেমে বালির ওপর একটু পায়চারি করি। প্রকৃতিকে খুব কাছ থেকে পাওয়া যায় এখানে– নদীর নীল জল, সবুজ পাহাড়ের সারি, হলুদ বালির চর, নদীতে রংচঙে লঞ্চ তার সঙ্গে ধূসর জেলে ডিঙির আনাগোনা– সব মিলে এক বিশাল ক্যানভাসে প্রাকৃতিক কোলাজ। লঞ্চের হর্ন বাজছে। আবার লঞ্চে ওঠার সংকেত।

এবার লাঞ্চ টাইম, ভাত-সম্বর-পাঁপড়-চিকেন-আচার-দই-পায়েসের আয়োজন। এবার লঞ্চ মুখ ঘুরিয়ে ফেরার পথ ধরল– ঘণ্টা দেড়েকের মধ্যে ফিরে আসি পোছাভরমের লঞ্চ ঘাটে।

ভদ্রাচলম থেকে ফিরে আসি খাম্মাম শহরে। কালকে বিকেলেই ফিরে যাব কলকাতায়। পরদিন সকালে চলে আসি শহর থেকে ৩০ কিমি দূরে পালের লেকে। এটিও পানীয় জল সরবরাহ কেন্দ্র। লেক পেরিয়ে পাহাড়ি টিলার হাতছানি। এখানে সৌন্দর্যায়নের কাজ শীঘ্রই শুরু হবে– তারই প্রতিক্ষায় যেন প্রকৃতিদেবী অপেক্ষারত। হঠাৎই এক গোলাপি রঙের বক একেবারে জলের ধারে পোজ দিয়ে দাঁড়াল, যেন বলতে চায় যাওয়ার আগে আমার ছবিটা তুলে নাও মন-ক্যামেরায়।

প্রয়োজনীয় তথ্য

(১) খাম্মাম শহর হায়দরাবাদ থেকে সড়কপথে ২০০ কিমি।

(২) হাওড়া থেকে হায়দরাবাদ। সেকেন্দ্রাবাদ যাওয়ার জন্য ১২৭০৩ ফলকনামা এক্সপ্রেস, ১৮৬৪৫ ইস্ট কোস্ট এক্সপ্রেস সুবিধাজনক।

(৩) খাম্মাম জেলা পর্যটনের কোনও প্যাকেজের ব্যবস্থা নেই, নিজের ব্যবস্থাতেই ঘুরতে হবে। দ্রষ্টব্য স্থানগুলি জেলার নানাদিকে ছড়ানো। তবে অবশ্যই ভদ্রাচলম (গোদাবরীতে ক্রুইজ-সহ) পর্ণশালা, কিন্নেরসানি স্যাংচুয়ারি, নেলাকোন্ডাপল্লী, তেলেঙ্গানা চিনা তিরুপতি মন্দির আর শহরের মধ্যে ফোর্ট ও মন্দির দেখে নেওয়া উচিত।

(৪) খাম্মামে কোনও সরকারি হোটেল নেই। প্রাইভেট হোটেলের মধ্যে হোটেল সিন্ধু, হোটেল কৃষ্ণা সিকোয়েল রিসর্ট। ভদ্রাচলমে অন্ধ্রপ্রদেশ পর্যটনের পুন্যামী হরিথা হোটেল রয়েছে। কিন্নেরসানি স্যাংচুয়ারিতে থাকতে হলে সিঙ্গারেনি কোলিয়ারির গেস্টহাউস অথবা ফরেস্ট রেস্ট হাউসে থাকতে হবে।

(৫) অন্ধ্রপ্রদেশ পর্যটনের সহায়তায় ভদ্রাচলম থেকে পেরেন্টাপল্লী (পাপি হিলস্-সহ) গোদাবরী নদীতে ক্রুইজের ব্যবস্থা করেছে জেলা পর্যটন বিভাগ। তবে লঞ্চ ছাড়বে পোছাভরম বোট স্টেশন থেকে। ভাড়া লাঞ্চ সহ ৪০০ টাকা, যোগাযোগ ৯৪৪০১৫৬৪২০, ৯৮৪৮০৯৭৭১২। যাত্রার অন্তত একদিন আগে ক্রুইজের টিকিটের জন্য যোগাযোগ করুন।

সীতারাম ট্রাভেল এজেন্সি

ফোন – ০৮৭৪৩ ২৩১১১৮

ক্রুইজের সেরা সময় আগস্ট থেকে ফেব্রুয়ারি।

 

আরো গল্প পড়তে ক্লিক করুন...