অন্তরভেদী, ভবানী আইল্যান্ড, লকনাভরম—অন্ধ্রের এই তিনটি নতুন টুরিস্ট স্পট দেখার আমন্ত্রণ এল। আমন্ত্রণ জানাল অন্ধ্রপ্রদেশের পর্যটন দফতর। তাই, ‘উঠল বাই তো অন্ধ্র যাই’-এর ঘটনা ঘটল। দিন-দুয়েকের মধ্যেই লাগেজ রেডি। তৎকালে ট্রেনের টিকিটের ব্যবস্থা করে দিলেন এপি টুরিজ্যম-এর অফিসার সৌগত সাহা। শালিমার স্টেশন থেকে বিকেল চারটে-পাঁচের সেকেন্দ্রাবাদ এসি এক্সপ্রেস ধরে রওনা দিলাম রাজামুন্দ্রির উদ্দেশে।
ষোলো ঘন্টা জার্নি শেষে সকাল আটটা পাঁচে নামলাম রাজামুন্দ্রি স্টেশনে। বিশাখাপত্তনম থেকে ট্রেনে মাত্র দু-ঘন্টার ব্যবধানে এই স্টেশনটির অবস্থান। স্টেশনের বাইরে ভিডিয়ো কোচ বাস নিয়ে আমাদের জন্য অপেক্ষা করছিলেন এপি টুরিজ্যমের জিএম মনোহরজি।
বাসেই সারলাম ব্রেকফাস্ট। কিছুক্ষণ বাদেই বাস এসে থামল ডিন্ডি-র কোকোনাট কান্ট্রি রিসর্ট-এ। অসংখ্য নারকেলগাছ বেষ্টিত ছায়া সুনিবিড় এই রিসর্ট-এ পা রাখামাত্রই ডাবের জল পরিবেশন করে তৃপ্ত করলেন রিসর্ট কর্মীরা।
সুইমিং পুল-এ স্নান এবং হরিথা রেস্তোরাঁয় মধ্যাহ্নভোজ সেরেই বেরিয়ে পড়লাম অন্তরভেদী বিচ এবং টেম্পল দর্শনের উদ্দেশ্যে। বড়ো রাস্তা ছেড়ে বাস চলল প্রত্যন্ত গ্রামের পথ ধরে। নারকেল পাতায় ছাওয়া বাড়ি আর বাড়ির উঠোনে জমা করা শতসহস্র নারকেলের স্তূপকে দুদিকে রেখে, এগিয়ে চলল বাস। মুগ্ধ করল সেই গ্রাম্য আবহ। ঘন্টা দুয়েক এই আবহে কাটানোর পর মন্দির দর্শন করিয়ে বাস এসে থামল অন্তরভেদী সমুদ্রসৈকতে। সমুদ্রের অসীম জলের দিকে চোখ রাখতেই আবছা দেখা গেল জাহাজের মাস্তুল। সৈকতের অদূরে অর্ধেক ডুবে থাকা এক প্রাসাদোপম বাড়ির অংশবিশেষও নজরে এল। বালিয়াড়িতে তখন অবশ্য চোখে পড়ল অন্য দৃশ্য। জেলেরা দল বেঁধে শুকনো জাল গুটিয়ে পরের দিনের মাছ ধরার প্রস্তুতি নিচ্ছে। সূর্য তখন অস্তগামী।
তারই অগ্নিভ আভা সমুদ্রের জলে পড়ে ফুটিয়ে তুলেছে অপরূপ দৃশ্য। গোধূলির সেই নরম আলো গায়ে মেখে, নিরালা সমুদ্রসৈকতে ঘুরে বেড়ালাম কয়েকঘন্টা।
রাতে হরিথা রেস্তোরাঁতেই ছিল আহারের ব্যবস্থা। ইন্ডিয়ান, সাউথ ইন্ডিয়ান, চাইনিজ সবরকম খাবারই ছিল বুফেতে। খাওয়ার পর সিদ্ধান্ত হল, রাতেই যাব বিজয়ওয়াড়ার ভবানী আইল্যান্ড-এ। কৃষ্ণা নদীর বুকে লঞ্চ ভাসিয়ে মধ্যরাতে পৌঁছালাম দ্বীপে। রাতে দ্বীপের সৌন্দর্য উপভোগ করতে না পারলেও, এক অদ্ভুত রোমাঞ্চ অনুভব করেছি।
সকালে ঘুম ভাঙতেই চটজলদি বিছানা ছাড়লাম। রাতে দ্বীপের সৌন্দর্যদর্শন করতে না-পারার আক্ষেপ কাটানোর উদ্দেশ্যেই এলাম বাড়ির বারান্দায়। বারান্দা থেকে ভবানী দ্বীপের প্রকৃতি অনেকটাই দৃশ্যমান। চোখ-ক্যামেরা প্যান করতেই দেখি, রোমাঞ্চকর ল্যান্ডস্কেপ। কৃষ্ণা নদী বৃত্তাকারে ঘিরে রেখেছে দ্বীপটিকে। নদী জলে টইটম্বুর। দ্বীপ বেষ্টিত ঘন সবুজ গাছগাছালিতে। গাছে-গাছে পাখিদের কলকাকলি। কাঠবেড়ালি ছুটে বেড়াচ্ছে গাছের ডালে-ডালে। এখানে-ওখানে রং ছড়িয়েছে বুনো ফুল। আর সেই লাল, সাদা, হলুদরঙা ফুলে-ফুলে বহুবর্ণ প্রজাপতি উড়ে বেড়াচ্ছে। হালকা হাওয়ায় দোল খাচ্ছে গাছের পাতা। নির্জন দ্বীপ, জলীয় ঠান্ডা হাওয়া, ফুলের সুগন্ধ আর পাখির কলকাকলি মিলেমিশে সে এক অদ্ভুত কাব্যিক-আবহ। এসবের মধ্যেই চা-পান পর্ব শেষ হল।
দ্বীপে বিদ্যুতের ব্যবস্থা আছে। তাই স্নানের জন্য গরমজল পেতে অসুবিধা হয়নি। স্নান সেরে রেস্তোরাঁয় দক্ষিণী খাবার খেয়ে ঘুরে দেখলাম দ্বীপের এ প্রান্ত থেকে ও প্রান্তে। দ্বীপে প্রচুর গাছদোলনা ছাড়াও চোখে পড়ল অ্যাডভেঞ্চার পার্ক। অন্ধ্রপ্রদেশ পর্যটন দফতরের কর্মকর্তারা জানালেন, কেউ চাইলে ভবানী দ্বীপে না থেকেও, দ্বীপ ভ্রমণের আনন্দ উপভোগ করতে পারবেন। লঞ্চ-এ যাতায়াত এবং দ্বীপের অ্যাডভেঞ্চার পার্ক-এ বিনোদনের জন্য মাথাপিছু খরচ করতে হবে ২৫ টাকা। যাইহোক, দুপুরের ভোজন-পর্বটাও ছিল দারুণ উপভোগ্য। কৃষ্ণা নদীতে লঞ্চ-এ ভাসতে-ভাসতে গরমাগরম খাবারের স্বাদ নিলাম আমরা। অবশ্য এই পর্বের আগে, দ্বীপের অনতিদূরে পাহাড়চূড়ায় অবস্থিত শিব-দুর্গার স্বর্ণমন্দির দর্শন করে নিয়েছিলাম।
আরও একটা রাত ভবানী দ্বীপে কাটানোর ইচ্ছে ছিল, কিন্তু শেডিউল-এ না থাকায় ইচ্ছেপূরণ হল না। তাই দুপুর দুটো নাগাদ ভবানী দ্বীপের মায়া কাটালাম।
পরের গন্তব্য– লকনাভরম। ভবানী আইল্যান্ড থেকে আশি কিলোমিটার বাস জার্নি। যাওয়ার পথে পাথরের গায়ে কারুকার্যময় প্রখ্যাত দুই মন্দির রামাপ্পা এবং থাউজেন্ড পিলারস দেখার আনন্দ নিলাম। মন্দির চত্বরের বাইরে এসে জিভ-কে তৃপ্ত করলাম গরম কফি আর চিলি ভুট্টা দিয়ে। সেদ্ধ ভুট্টা, তেল, পেঁয়াজ, টম্যাটো এবং কাঁচালংকা দিয়ে ভাজা সুস্বাদু এই পদটি মাত্র দশ টাকায় পাওয়া যায় এই অঞ্চলে। কারণ, রাস্তার দুদিকে ভুট্টার খেতে ভরা। অবশ্য শুধু ভুট্টার খেতই নয়, লকনাভরম যাওয়ার পথে প্রচুর কাপাস তুলোর খেতও চোখে পড়েছে। ফল ফেটে তুলো বেরিয়ে সাদা ফুলে ভরা বাগিচার মতো হয়ে রয়েছে বিস্তীর্ণ অঞ্চল। আর যেখানে তুলোর খেত শেষ হয়েছে, সেখান থেকেই মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে সারিসারি তালগাছ এবং সেই গাছগুলি থেকে রস সংগ্রহের জন্য বাঁধা রয়েছে ছোটো কলসি। মুগ্ধ হয়ে এসব দেখতে দেখতেই আমাদের বাস ঢুকে পড়েছে শাল-সেগুনের জঙ্গলে।
অন্তত পনেরো কিলোমিটার ওই শুনশান জঙ্গলের বুক চিরে সন্ধে নাগাদ বাস এসে থামল লকনাভরম ফরেস্ট বাংলোর গেটের সামনে। চারিদিকে ঘন জঙ্গল আর বিশালাকার জলাশয়কে সঙ্গী করেই গড়ে উঠেছে এই পর্যটন আবাসটি।
সুন্দর সাজানো গেট দিয়ে ঢোকার সময় অদ্ভুত অভিজ্ঞতা হল। আদিবাসী দুই রমণী চন্দনের ফোঁটা আর গাঁদা ফুলের মালা পরিয়ে স্বাগত জানালেন। এই নিয়ে আমরা নিজেদের মধ্যে হাসাহাসি করতেই গেটম্যান জানাল, অতিথিদের প্রাথমিক অভ্যর্থনার এটাই নাকি স্থানীয় রীতি। যাইহোক, গেট পেরিয়েই পা রাখলাম সাসপেনশন ব্রিজে। বিশাল জলাধারের উপর লোহার দড়ি দিয়ে ঝোলানো প্রায় দুশো মিটার দৈর্ঘের দোদুল্যমান কাঠের ব্রিজ ধরে হেঁটে পৌঁছোলাম ফরেস্ট বাংলোয়। হাঁটাপথে অন্ধকার দূর করেছিল হ্যারিকেনের আলো। যদিও চাঁদের আলোর কাছে সে আলো বড়ো ফিকে মনে হয়েছে। কিন্তু সব মিলে তৈরি হয়েছিল গা-ছম্ছম্ এক মায়াবি পরিবেশ। আর সেই পরিবেশেই ঝিঁ-ঝিঁ পোকার ডাক শুনতে শুনতে সারলাম নৈশভোজ এবং নৈশভোজের পরে কুয়াশা গায়ে মেখে বাংলোর ছাদে দাঁড়িয়ে অনুভব করেছি অদ্ভুত রোমাঞ্চ।
এমন সুন্দর জায়গায় পরের দিনটাও কাটল বেশ আনন্দে। জঙ্গলে ঘুরে বেড়ানো ছাড়াও, জলাধারে ছিপ ফেলে মাছ ধরার দৃশ্যও উপভোগ করলাম তারিয়ে তারিয়ে।
এবার ফেরার পালা। থুড়ি, মন খারাপের শুরু। তবে বিদায়বেলায় আমাদের সঙ্গে সৌজন্য সাক্ষাৎ করতে এসে, এপি-র টুরিজ্যম সেক্রেটারি চন্দ্রিমা খান আবার যাওয়ার আমন্ত্রণ জানিয়ে মনের ভার খানিকটা লাঘব করলেন।