এই ভর সন্ধেবেলায় হঠাৎ বাবুর ঘরে ডাক পড়ল কেন ভেবে পেল না দেবু। সন্ধের গা ঢাকা অন্ধকারে ত্রিপলের ছাউনি দেওয়া লরি থেকে ষোলো বস্তা চিনি আর আট টিন সরষের তেল সবে গুনে গেঁথে ঢুকিয়েছে গোডাউনে, এমন সময় দিনুদা এল, ‘এই দেবা– বাবুর সঙ্গে দেখা করিস একবার।’
সরষের তেলের টিন গুনতিতে ব্যস্ত দেবু ঘাড় না ফিরিয়ে জিজ্ঞেস করল, ‘বাবু কোথায়?’
‘গদিতে।’ এটুকু বলেই পিছন ফিরল দিনুদা। এমনিতেই কম কথার মানুষ। তবু ঝড়াং করে পিছন ফিরতে মনটা ‘কু’ গাইল দেবুর। চট্ করে গোনাগুনতির কাজটা ভোম্বলকে বুঝিয়ে দিয়ে সঙ্গ নিল দিনুদার। হাজার হোক বাবুর খাস লোক বলে কথা!
‘কী ব্যাপার দিন্দা?’
‘কী ব্যাপার– আমি কোথ্থেকে জানব? কত্তাবাবুর কথা তো জানিস!’ উত্তর আরও ভাসাভাসা করে দিনুদা এগিয়ে গেল চত্বর ছেড়ে।
গদি বলতে গোডাউন চত্বর-এর এমুড়ো ওমুড়ো ছড়িয়ে ছিটিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা খানদশেক লরি আর ম্যাটাডোর ভ্যানের ফাঁকফোকর দিয়ে দেখতে পাওয়া যাচ্ছে যে ব্রিটিশ আমলের অ্যাসবেস্টস শেড দেওয়া ঘরটি তার কথাই বোঝাচ্ছে। দেখতে তেমন আহামরি না হলে কী হয়– ওই ঘরটিই এই আমোদঘাটার সামন্তবাড়ির প্রাণভোমরা। এখান থেকেই নকুল সামন্ত’র মাকড়সার জাল বিস্তার। ওদিকে কাশ্মীর, পঞ্জাব, হরিয়ানা, দিল্লি থেকে শুরু করে এদিকে অন্ধ্রপ্রদেশ, ওড়িশা, ঝাড়খণ্ড আর পাশের রাজ্য বিহার পর্যন্ত বাবুর সাম্রাজ্য ছড়ানো। সেই ঘরে ডাক পড়েছে দেবুর। বুক একটু ধড়াস ধড়াস তো করবেই।
ঘরে ঢোকবার আগে দরজার কাচে নিজের ধুলোমাখা চেহারাটা একবার জরিপ করে নিল তাই। অন্ধকার মাখামাখি হয়ে কাচের গায়ে নিজেকে পরিষ্কার দেখতে পেল না। পাশে এখন কেউ নেই দেবুর। থাকলে নির্ঘাত বুকের ধুকপুকুনি শুনতে পেত।
একটু ইতস্তত করে কাচের দরজাটা আলগা হাতে ঠেলল। ভেতরে পা রাখতে ঠান্ডা এক ছোঁয়া পেল শরীরে। ঘরে মিহি করে এসি চলছে।
ধোপদুরস্ত ধুতি-পাঞ্জাবিতে বাবুর দুধসাদা গায়ের রং খোলতাই হয়েছে খুব। ঠিক মাঝবয়েসি এক রাজা যেন। মাথার কোঁকড়ানো চুল পরিপাটি করে আঁচড়ানো। ডান আর বাঁ-হাতের আঙুলগুলোয় রংবেরঙের পাথর বসানো আংটি। সোনার ঘড়িতে ঘরের আলো চমকায়। মুখে অনবরত চিবিয়ে চলা সুগন্ধি পান। গন্ধে ঘর ম’ ম’ করছে।
একটা তাকিয়ায় কনুই রেখে মোবাইল কানে চেপে কার সঙ্গে বাবু কথা বলে চলেছে নীচুগলায়। দেবুকে ঘরের মধ্যে ঢুকতে দেখে আঙুলের ইশারায় বসতে বলল সামনের নীচু বেঞ্চটায়। শরীরের অস্বস্তি চেপে সাবধানে বসল দেবু। সামনে শুধু ওর নয়, ওরই মতো অন্তত একশো লোকের দণ্ডমুণ্ডের কর্তা– আমোদঘাটার মুকুটহীন সম্রাট নকুল সামন্ত। বিনবিন করে কপালে ঘাম ফুটছে এই এসির ঠান্ডাতেও, টের পেল দেবু।
ঘরে এখন কেবল দু’জন। প্রথমে একটু ভয়ই করছিল। কে জানে কীসের জন্য এমন জরুরি তলব। দু’একদিনের মধ্যে বেফাঁস কিছু করে ফেলেছে কিনা মনে করবার চেষ্টা করল প্রাণপণে। কথায় বলে, বাবুর চোখ আর বাঘের চোখ!
এমন সময় কত্তাবাবুর নীচুগলায় বলা কথাগুলো শুনতে পেল, ‘গোডাউনের কাজকম্ম কেমন চলছে দেবু?’
টাকরার কাছে শুকিয়ে আসছিল যেন। চেষ্টা করে বলতে পারল, ‘আজ্ঞে ভালোই। এই তো আমোদপুরের লরি আনলোডিং হচ্ছিল!’
নাকের সামনে থেকে মাছি তাড়ানোর মতো ভঙ্গি করে বাবু থামিয়ে দিল ওকে, ‘জানি-জানি। সেজন্যে ডাকিনি তোকে!’ তবে কীসের জন্যে এই অসময়ে ডাক? দমবন্ধ হয়ে আসছিল দেবুর। আজ ঘাড়ে মুণ্ডু নিয়ে ফিরতে পারলে হয়। নকুল সামন্ত মনে হয় মানুষের মন পড়তে পারে। পাশে রাখা ঠান্ডা জলের বোতলটা হাত বাড়িয়ে ওর দিকে এগিয়ে দিয়ে বলল, ‘একটা কাজ করতে হবে দেবা!’
‘আজ্ঞে বলুন!’ গলা রীতিমতো কাঁপছিল ওর। হাতের বোতলটাও।
‘ব্যাপারটা কিন্তু খুব গোপনীয়!’ ফিসফিসে গলায় বলা বাবুর কথাগুলো কানের কাছে হিম হয়ে এল কেমন।
‘কেউ জানবে না আজ্ঞে!’ জলে ভেজানো গলায় বাবুকে আশ্বস্ত করবার চেষ্টা করল দেবু।
‘ঠিক বলছিস?’ সামন্তকত্তার গলায় আশঙ্কা আর উৎকণ্ঠার মিশেল।
‘আজ্ঞে ঠিক।’ একটু জোরের সঙ্গে বলল দেবু।
‘তবে এদিকে আয়।’ তাকিয়া ছেড়ে সোজা হয়ে বসল কত্তা। দেবুও বেঞ্চ ছেড়ে ফরাসের একধারে উঠে এল। পাঁচ বছর চাকরি করছে বাবুর এখানে। কোনওদিন এমন করে সামন্তবাবুর কাছটিতে বসতে পারবে ভাবেনি দেবু।
আরও মিনিট কুড়ি পার করে যখন কত্তার কাছ থেকে ছাড়া পেল তখন দেবুর বুকপকেটে দুটো একশো টাকার নোট। কড়কড়ে। দোমড়ানো মোচড়ানোর কোনও সিন নেই। একেবারে বাবুরই মতো ঝকঝকে। ফিট। যা শুনেছে সব মনে মনে রাখবার দাম। পরে আরও পাওয়া যাবে। নকুল সামন্ত ফালতু বকোয়াস করে না। ভূতগ্রস্ত মানুষের মতো এলোমেলো পায়ে গদিঘর থেকে নিজের ডেরার দিকে চলল দেবু ওরফে দেবিদাস পুরকাইত। আজ, এই এখন থেকে পরীক্ষা শুরু হল ওর।
দুই
‘দিন যায়, রাত না ফুরায়।’ ছেলেবেলায় দেখা কৃষ্ণযাত্রায় বিরহিণী রাধার গানের বাণী যেন অক্ষরে অক্ষরে মিলে যাচ্ছে রিখিয়ার জীবনে। মাঝে মাঝে একলা ঘরে সাজপোশাক ছেড়ে সামন্তবাড়ির বউমা দেয়ালজোড়া বেলজিয়াম কাচের আয়নার সামনে দাঁড়ায়। একেবারে একা।
নিজের অপ্সরা-শরীরের যেখানে যে অঙ্গ-প্রত্যঙ্গগুলি দেবার সেগুলিকে নিপুণহাতে যিনি তৈরি করে পাঠিয়েছেন, তাঁকে ধন্যবাদ দেবার পাশাপাশি নানাভাবে অভিসম্পাতও দেয় রিখিয়া। কী দরকার ছিল ভগবানের ওকে এত সুন্দর করে গড়ে তোলবার! মাথায় প্রপাতের মতো একঢাল চুল, টানাটানা চোখ, সুগোল দুটি স্তন এবং সুশোভন শ্রোণিদেশ– এসব কী কাজে লাগল ভগবান?
যে-মানুষটার কোনও ক্ষমতা-ই নেই, সেই মানুষটা বিছানার সঙ্গী হয়ে আছে এই সত্যটা অনেক দাম দিয়ে বুঝতে হল রিখিয়াকে। নিশ্চুপ পড়ে থেকে সামন্তবাড়ির একমাত্র উত্তরাধিকারী দীপেনের আঁচড় কামড় সহ্য করতে করতে গোটা বছর ধরে এই অভিজ্ঞতা অর্জন করতে হল রিখিয়াকে।
গরিব বাবার একমাত্র মেয়ে। তায় যথেষ্ট সুন্দরী। কলেজের ক্লাস শুরু করতে না করতেই উঠেপড়ে লেগেছিল অচিনপুরের কৃষ্ণদাস বৈরাগ্য। খোঁজ খোঁজ করতে করতে কোনওমতে আমোদঘাটার ডাকসাইটে ব্যবসায়ী নকুল সামন্তর নজরে মেয়েকে এনে ফেলা হতেই, বাবা হাত তুলে সোজা হরিদ্বারের পথে। মেয়ে ভাসল কি ডুবল পিছু ফিরে আর দেখার প্রয়োজন মনে করল না। শুধু বড়ো সামন্ত’র অঢেল পয়সা, রঙিন আলোর রোশনাই, গ্রামসুদ্ধ লোক খাওয়ানো আর মেয়ের সর্বাঙ্গ মুড়ে দেওয়া গয়না দেখেই সিদ্ধান্ত নিয়ে নিল, এ বিয়ে সুখের না হয়েই যায় না। হায়– এত সহজেই যদি সব সুখ কেনা যেত বাবা!
অনেক দুঃখে মনের অসুখ মনেই চেপে রাখে রিখিয়া। সব ছেড়ে যে-মানুষটা ওকে সুখী মনে করে অনেক দূরে সরে গেছে, সেই বাবার উপরও কোনও অভিমান রাখেনি। শুধু একটাই প্রশ্ন মাঝে মাঝে বিব্রত করে রিখিয়াকে, মা বেঁচে থাকলেও এতটাই নির্লিপ্ত থাকতে পারত বাবা? কে জানে, হয়তো পারত।
গত বৈশাখে ওর বিয়ের পর থেকে এবছর অঘ্রাণ পর্যন্ত মাত্র দুবার ফোন করেছে বাবা। হাসি হাসি মুখে নিজের কাল্পনিক সৌভাগ্যের কিছুটা হলেও সত্যি খবর পৌঁছে দিয়েছে রিখিয়া। ফোনের ওপারে মানুষটা স্বস্তির নিশ্বাস ফেলে বলেছে, ‘সব তোর কপাল মা! নইলে নকুল সামন্তর ছেলের সঙ্গে বিয়ে– হয়!’
হাসি বজায় রাখবার চেষ্টা করতে করতেই রিখিয়া বলেছে, ‘সত্যি বাবা– সবই আমার কপাল। সঙ্গে তোমার আশীর্বাদও ছিল তো!’
মানুষটা কী বুঝল কে জানে। কৃষ্ণনাম করতে করতেই ফোন রেখে দিয়েছিল। সেই শেষ। ইচ্ছা করেই আর রং মিলন্তির খেলায় নামেনি ও। এ বছর বৈশাখ পার হয়ে অঘ্রাণ আসতে এত দেরি হল কেন নিজের মনেই সে প্রশ্ন করে মাঝে মাঝে। বিশাল ফ্রেঞ্চ উইনডোর ধারে একলা দাঁড়িয়ে বিধুর প্রকৃতির কাছে জানতে চায় রিখিয়া, ‘ও অঘ্রাণ– অচিনপুরের মাঠে কি ধান পেকেছে এখন? ঝরতি পড়তি ধানের শিষ এখনও কি আগের মতো তুলে নিয়ে গর্তে ঢোকে মেঠো ইঁদুর? বলো না ও অঘ্রাণ, এখনও কি বাসস্ট্যান্ডের পাশে ‘সত্যনারায়ণ টকিজ’-এর অন্ধকার হলে পাশাপাশি বসে পরস্পরের শরীরের ওম-এ উত্তাপ খুঁজে নিতে থাকে সুদর্শন, দেবিকা, সৌভিক কিংবা দয়াময়ীর মতো আমার বন্ধুরা– আগেকারই মতো?
ও অঘ্রাণ, তুমি কি বলতে পারো একটা শূন্য কলশির সঙ্গে ঘর করতে হলে মেয়েদের আরও কত কী মেনে নিতে হয়? অথচ কলশিটা বিশ্বাসই করতে চায় না তার শূন্যতা। এরপর কী করবার থাকে আর?’
প্রশ্নের পর প্রশ্ন ভাসে বাতাসে। উত্তর আসে না। চেষ্টা করতে করতে হাল ছেড়ে দেয় রিখিয়া। সামন্তবাড়িতে শাঁখ বাজল। শাশুড়ি-মা সন্ধে দিলেন। খাটের উপর হারমোনিয়ামের সামনে এসে বসল রিখিয়া। মনের আগল খুলে দিল গানের সুরে, বাণীর নির্যাসে, ‘আমায় অনেক দিয়েছ নাথ।’ শাশুড়ি-মা’র পায়ের শব্দ ঘরের দরজার বাইরে এসে থামল।
তিন
বিকেলের পড়ন্ত রোদের এক আলাদা মায়া আছে। একটু পরেই পাটে বসতে চলেছেন সূর্যদেব। হিমের আঁশমাখা সেই রোদ একটু একটু করে গায়ে মাথায় মেখে নিলে একধরনের আমেজ আসে শরীরে। বাঁধের উপর দাঁড়িয়ে সেই রোদের আমেজ নিচ্ছিল সায়ন।
একসময় দামোদর ছিল গোটা রাজ্যের দুঃখ। দুঃস্বপ্নের নদ। এখন বললে লোকে হাসবে। নদের খাত জুড়ে বালি আর বালি। লরির পর লরি দাঁড়িয়ে। সেই বালি তুলে নিয়ে বাজারে ঢেলে দিয়ে আসবে। তৈরি হবে আকাশচাটা ফ্ল্যাটবাড়ি। আশ্চর্য এক লেনদেনের সম্পর্ক যেন। তুমি দেবে আর আমি নেব। অথবা উলটোটা। বাঁধের একপাশে বটগাছের কোল ঘেঁষে তৈরি হয়েছে চায়ের দোকানটি। সেটি বেশ পরিচ্ছন্ন দেখে একপলকেই পছন্দ হয়ে গেল সায়নের। ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজের হোস্টেল হলেও যথেষ্ট পরিচ্ছন্ন ওদের রোজের থাকা-খাওয়ার পরিবেশ। সেই অভ্যাস বাইরেও। চায়ের দোকানি উনোনে আঁচ দিয়েছিল। ধোঁয়া কুণ্ডলি পাকিয়ে পাকিয়ে এলাকা ছাড়া হয়ে নদীগর্ভের দিকে। গরম চায়ের আহ্বানে এই বাঁধের দিকের দোকানটিতে। নাহলে আমোদঘাটায় চায়ের দোকানের কমতি নেই। তবে রিখিয়ার এসএমএস অনুযায়ী লোকালয় থেকে যতটা সম্ভব দূরে থাকাই ভালো। আপাতত সেই চেষ্টাতেই সায়ন।
‘এখানে কাদের বাড়ি এসেছেন?’
বাঁধের পাশের মাঠটিতে ছেলেদের ব্যাটিং, বোলিং আর ফিল্ডিং দেখতে দেখতে এতই মগ্ন হয়ে পড়েছিল সায়ন যে, প্রশ্নটা শুনতেই ভুল হয়ে গেল প্রথমে। দ্বিতীয়বার আবার জিজ্ঞেস করতে তবে শুনতে পেল।
ঘাড় ঘুরিয়ে সাদা প্যান্ট শার্টের সঙ্গে মাথায় কাউন্টি ক্যাপ চাপানো ভদ্রলোককে দেখতে পেল সায়ন। ঝোঁকের মাথায় বাঁধের দিকটায় চলে এসেছে বটে কিন্তু এমন একটা সমস্যা যে হতে পারে সেটা ভেবে দেখেনি। অথচ পরিষ্কার নির্দেশ আছে কোনওমতেই সামন্তবাড়ির নাম নেওয়া চলবে না।
অগত্যা আমতা আমতা করে বলল, ‘এই চা খেতে আর কী!’ সম্ভবত এমন উত্তর প্রত্যাশা করেনি কাউন্টি ক্যাপ। তাই সংক্ষিপ্ত প্রতিক্রিয়া হল ‘অহ্!’
একটু থেমে আবার জিজ্ঞেস করল লোকটা, ‘থাকেন কোথায়?’
এতো মহা ফ্যাসাদ হল। টুকটুক করে খুঁটিনাটি সব জানতে চাইছে। তাড়াতাড়ি ধরি মাছ না ছুঁই পানি গোছের একটা জবাব দিল সায়ন, ‘কলকাতা!’
কাউন্টি পরা লোকটা বেশ খানিকক্ষণ হাঁ করে ওর দিকে তাকিয়ে রইল। বোধহয় সায়নের মাথার ঠিক – বেঠিকত্ব নিয়ে সন্দেহ হল। ট্রাউজারের পকেট থেকে রুমাল বার করে মুখ মুছতে মুছতে মাঠের দিক থেকে চোখ ফিরিয়ে এনে সায়নকে ভালো করে মেপে নিয়ে বলল, ‘ধান্দা যে অন্যকিছু আছে সেটা বুঝলাম। সেজন্যেই এমন ভাসানো জবাব। ঠিক হ্যায়, আমিও কালো ঘোষ। এত সহজে আমার চোখকে ফাঁকি দিতে পারা যাবে না।’
কথা বলতে বলতে নিজের বড়াই করা লোকটার স্বভাব বুঝতে ঠিকই পারল সায়ন। কিন্তু এখনই লোকটির থেকে দূরত্ব তৈরি করতে না পারলে ওর সমূহ বিপদ। এটুকু বুঝতে দেরি হল না মোটেই।
রিখিয়ার জরুরি এসএমএস পাবার পর ওর মনে হয়েছিল এসব বড়োলোকের বাড়ির বউয়ের খামখেয়ালিপনা ছাড়া কিছু নয়। সঙ্গে সতর্কবার্তা সামন্তবাড়ির কেউ কোনও অবস্থাতেই যেন জানতে না পারেন সায়নের ধারণাটাকেই পোক্ত করেছিল শুধু। কিন্তু এখানে এই আমোদঘাটায় এসে রিখিয়ার সঙ্গে বারদুয়েক মোবাইলে কথা বলবার পর সেই ধারণাটা ভেঙে চৌচির হয়ে গেছে।
‘বিনোদিনী গার্লস উচ্চমাধ্যমিক বিদ্যালয়’- এর চৌকাঠ টপকে অচিনপুর মহাবিদ্যালয়ে পা দেওয়া সদ্য যুবতি রিখিয়া নামের মেয়েটি যে ভিতরে ভিতরে এতখানি দুঃসাহসী হয়েছে, মনটাকে করেছে ইস্পাতের মতো দৃঢ়- সেকথা জেনে এখন নিজেরই কেমন ভয় ভয় লাগছে সায়নের।
অথচ বিয়ের রাতে সব বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডা দিতে দিতে এমন একটা পরিস্থিতি যে তৈরি হতে পারে, স্বপ্নেও ভাবতে পারেনি কেউ। দিব্যি সকলের সঙ্গে হেসে হেসে কথা বলেছে মেরুন-রঙা বেনারসি আর আগাপাশতলা গয়নার অ্যাড-এর মতো কনের থ্রোন-এ বসে থাকা পরিটি। কই, কোথাও তো কোনও সিঁদুরে মেঘ নজরে পড়েনি। বরং বরের রাজপুত্তুরের মতো চেহারা নিয়ে দেবিকা আর দয়াময়ীরা যখন ঠাট্টা তামাশা করেছে, তখনও লজ্জায় মুখ নামিয়ে নিয়েছিল রিখিয়া। সেটাও নজর এড়ায়নি ওদের। অথচ এক বছরের একটু বেশি সময়ের মধ্যে সবকিছু পালটে যায় কী করে। এ এক আশ্চর্য রহস্য!
সে রহস্য যাই হোক। এখন এই ভদ্রলোককে অবিলম্বে পাশ কাটানো দরকার। না হলে সব বরবাদ হতে সময় লাগবে না বিশেষ। মাথায় একটা প্ল্যান আসতে সেটারই প্রয়োগ শুরু করে দিল সায়ন।
‘ছেলেগুলি কিন্তু দারুণ!’
‘মানে?’ ঘাবড়ে যেয়ে ভদ্রলোক চোখ তুললেন ওর দিকে।
‘মানে বুঝলেন না? প্রত্যেকেই দারুণ প্লেয়ার!’ বিশদ হল সায়ন।
‘বলছেন?’ প্রশংসায় আপ্লুত হয়ে পড়েছেন ভদ্রলোক বুঝতে ভুল হল না ওর।
‘বলব না মানে–! মাঠের দিকে যে তাকাবে সে-ই বলবে। ওয়েল ডিসিপ্লিন্ড!’
কালো ঘোষ এতক্ষণে হাতে চাঁদ পেল যেন।
‘এই– লাখ কথার এক কথা বলেছেন! আরে বাব্বা– ডিসিপ্লিন না থাকলে চলবে কেন? নিজের হাতে তৈরি করেছি মশাই এদের! ফি বছর এখান থেকেই তিন-চারজন ডিস্ট্রিক্ট টিমে–!’
ভদ্রলোককে আর বাড়তে দেওয়া উচিত নয়। মাঠের একেবারে দূরতম প্রান্তে প্রায় নদীর কাছাকাছি লং অন-এ ফিল্ডিংরত ছোকরাকে দেখিয়ে বলল, ‘কেবল ওই যে ছেলেটিকে ফিল্ডিং করতে দেখছেন– ওই ছোকরার নড়াচড়া বেশ স্লো। দেখুন-দেখুন!’ সায়নের পাশে এসে চোখের উপর হাত এনে ছোকরাকে ভালো করে লক্ষ করল কালো ঘোষ। তারপর সায়নের দিকে ফিরে বলল, ‘গুরু লোক ভাই আপনি! ঠিকই ধরেছেন। ও ব্যাটা হিরন্ময়– চিরকালের ফ্ল্যাটফুটেড!’
কথা বলতে বলতে মাঠের দূরতম প্রান্তে নদীর কাছাকাছি যাবার জন্যে হাঁটা দিলেন ভদ্রলোক।
মনে মনে হিরন্ময় নামের ছেলেটির কাছে ক্ষমা চেয়ে নিল সায়ন, ‘ক্ষমা করিস ভাই। এছাড়া আর উপায় ছিল না আমার। এখন আমায় অন্য একজনকে সময় দিতে হবে।’ চায়ের দোকানি ততক্ষণে চা-এর কাপ হাতে ডাকাডাকি শুরু করে দিয়েছে। নদীর বুক থেকে হামাগুড়ি দিয়ে ততক্ষণে কাকের ডানায় অন্ধকার উঠে আসছে।
চার
নেহাত দেবার কপাল খারাপ তাই। নইলে এসব পরের বউয়ের ওপর নজরদারি করবার লোক-ই নয় ও। তার সঙ্গে স্বয়ং বড়ো সামন্তর কথাও মাথায় রাখতে হচ্ছে।
দেবার প্রাণভোমরা বাপঠাকুরদার ভিটেটুকু পর্যন্ত হাতফেরতা হতে হতে এখন বড়ো সামন্তর হেফাজতে। কোন কুক্ষণে মোদোমাতাল বাপটা টিপছাপ দিয়ে ওকে রাস্তায় বসিয়ে রেখে গেছে এমন করে ,কিছুই জানা নেই। আসল সত্যিটুকু জানে শুধু নকুলবাবু। সামন্তগুষ্টির এখনকার চাঁই। সে যে মুখ ফুটে বলবে, সে গুড়ে বালি।
ঝ্যাঁটা মারো, জুতোপেটা করো অমন মদখেকো বাপকে। নেশার জন্যে যে কিনা ছেলে-বউয়ের কথা ভাবে না। কোথায় থাকবে, কীভাবে থাকবে ভাবনা নেই। শুধু নিজের নেশার বস্তুটি চাই। নেশার ঘোরে মা-র গায়ে বাবার হাত তোলা ছায়া ছায়া মনে পড়ে দেবার। তারপর তো এক বর্ষায় মা বর ছেড়ে, ছেলেকে ছেড়ে দূর আকাশের বাসিন্দা হয়ে গেল। দেবু তখন এগারো কি বারো। সেই শুরু সামন্তর তাঁবেদারি। চলছে তো চলছেই। দিনের পর দিন, মাসের পর মাস। বছরের পর বছর। দেবুর মুখে রা’টি নেই। যদি বাবুর মতিগতি ফেরে। যদি কোনওদিন দেয়ালের চোরা কুঠুরি থেকে ঈশ্বর বিশ্বম্ভর পুরকাইতের নামের বাড়ির দলিল দেবুর দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বাবু বলে, ‘এই দেবা– এটা নিয়ে যা!’
আরও কিছুক্ষণ হয়তো চলত চিন্তার নদীতে দেবিদাসের সাঁতার, যদি না জঙ্গলের বাইরে ঘাসজমিতে উতলমাতাল ঝড় উঠত। ঘাসবনে দুটি ছায়াশরীরের তুমুল ওলটপালট। কেউ কাউকে যেন ছাড়তেই চায় না। চকাস্ চকাস্ শব্দ। সব, সবই ঘটে চলেছে মাত্র কয়েকহাত দূরে। অথচ শব্দ করবার উপায় নেই। এমনকী পায়ের গোছে বিছুটি পাতার ঘষা লেগে জ্বলছে বেশ। তবু হাত পা নট্ নড়নচড়ন। পাছে নড়াচড়ার এই চক্বরে ধরা পড়ে যায় ওর গোয়েন্দাগিরি।
বাবুর কড়া নির্দেশ বউদিমণি কোথায় যাচ্ছে, কী করছে সব খবর দিতে হবে। এদিকে একজোড়া শরীরের হাঁসফাঁস করা শ্বাসপ্রশ্বাসের শব্দ। বউদিমণির মুখে সুখের একটানা ‘উঁ’ ‘উঁ’ শব্দ। এসব কীসের ঠিকই বোঝে দেবু। আর বোঝে বলেই ওর যন্ত্রণা বেশি। বিয়ের পর মেয়েমানুষ কীসে সুখী হয় সবচেয়ে বেশি, তা কি বাবু জানে না?ওর মতো উদ্গান্ডু বোঝে আর আমোদঘাটার বেতাজ বাদশা নকুল সামন্ত বোঝে না এটা বিশ্বাস করে না দেবু।
সামন্তদের আড়তের দেড়তলায় আট ফুট বাই দশ ফুট যে -খুপরি ঘরটায় এতদিন থেকে এল দেবু, মাঝে মাঝে একলা সময়ে সেই ঘরটাই কেমন অচেনা মনে হয়। যেন গিলে খেতে আসে রাক্ষুসে হাঁ করে। অনেক রাতে নিজের চেনা শরীরের মধ্যে অচেনা এক শরীর জেগে উঠলে কেমন হন্যে হয়ে ওঠে দেবু। হাত বাড়িয়ে সরু বিছানায় পাশে কোনও জ্যান্ত শরীরের স্পর্শ পেতে চায়। ঘুম ভেঙে সেই ‘অন্য’ আর একজনের মুখোমুখি হয়। প্রশ্ন করে নিজেকে, ‘তোর কীসের এত জ্বালারে দেবা? গড়িয়ে গড়িয়ে বছরগুলো তো কাটালি এখন আর মাত্র ক’টা বছর কাটিয়ে দিলেই তো–!’ প্রশ্নটার ঝুঁটি ধরে ঝাঁকুনি দেয় আদত দেবা, ‘কী বললি হতচ্ছাড়া! এ জ্বলন কীসের তা যদি জানতিস!’ হাজার বোঝালেও বুঝতে চায় না শরীরের মধ্যে জেগে ওঠা অবুঝ অথচ তেজিয়ান সেই ঘোড়া। ঘাসে ঢাকা মাঠে দৌড় শুরু করবার জন্যে ছটফট করতে থাকে।
বাধ্য হয়ে বাকি রাতটুকু উপুড় হয়ে শুয়ে থেকে নিজেকে সামলাবার চেষ্টা করে যায়। বড্ড কষ্ট হতে থাকে তখন। গোটা শরীর যেন তেতে আগুন হয়ে ওঠে। জঙ্গলের মধ্যে মশার কামড় কিংবা বিছুটি লেগে যে জ্বলন তার চেয়েও ভয়ংকরতর এক জ্বলুনিতে জ্বলতে থাকে দেবু।
বড়ো কত্তা যতই ওকে নতুনবউদির ওপর নজর রাখবার কথা বলুক, এসব কথা দেবা কখনও জানাবে না। মেয়েমানুষের জ্বলন বলে কথা! যদি ঘরের ওষুধে না সারে তাহলে তো বাইরের ডাক্তার ডাকতেই হয়। এর মধ্যে কোনও দোষ দেখতে পায় না দেবু। ক্ষমতা থাকলে ছোটোকত্তা দীপুবাবুকে সামলে নিক বড়োবাবু। তা নয়– যত্তোসব!
আস্তে আস্তে নতুনবউদির কথা ভেবে মনটা নরম হয়ে এল খুব। আহারে, কতই-বা বয়স! কত স্বপ্ন নিয়ে সোয়ামির ঘর করতে এসেছিল গরিবের ঘর থেকে। পয়সার জোরে আর যা-ই হোক মন তো কিনতে পারেনি কত্তা!
ততক্ষণে ঘাসবনে ঝড় থেমেছে। আকাশে চাঁদ না থাকলেও দেবুর সামনে তখন বনজ্যোৎস্না। দুটি তৃপ্ত হৃদয় অস্ফুটে তাদের মনের কথা বলে। সবটা না হলেও সেই কথার টুকরোটাকরা পাখনা মেলে উড়ে আসতে থাকে কানে।
‘এভাবে কতদিন চালাবে বলো রিখি?’
চট্ করে একথার জবাব দেওয়া মুশকিল। নতুনবউদিও অনেক সময় নিয়ে বলল, ‘দেখি কতদিন চালানো যায়।’
‘ব্যাপারটা তোমার পক্ষে খুব রিস্কি হয়ে যাবে না তো?’
‘হলে হবে। পরোয়া করি না। বাড়ির কথা এরা জানাজানি হতে দেবে ভেবেছ!’
নতুনবউদির ভয়হীন গলা শুনে চমকে উঠল দেবু। মেয়ের সাহসকে পেন্নাম জানাতে হয়! এ তো দেখছি বাঘের ঘরে ঘোগের বাসা! ‘জানাজানি হলে কী হতে পারে ভেবে দেখেছ?’ ছেলেটির গলায় অজানা আশঙ্কা।
‘কী আবার হবে– শূলে চড়াবে নয়তো ফাঁসি। তবু এই নিত্য যমযন্ত্রণার চেয়ে ঢের ভালো হবে!’ প্রায় কান্নাজড়ানো গলায় বউদিমণির জবাব শুনতে শুনতে জঙ্গলে একহাত জিভ কাটল দেবু। এসব কি বলছ গো বউদি! তোমার দুখ্যু আমি বুঝি। হাজার প্রশ্নেও আমার মুখ থেকে একটি কথাও বেরোবে না আর– দেখে নিয়ো! পাশাপাশি পড়ে থাকা দুটি ছায়াশরীর আবার মুহূর্তের অবকাশে এক হয়ে যায়। জঙ্গলের মধ্যে মানুষপ্রমাণ শর গাছ। তার মধ্যে এক নিঃশব্দপ্রায় দেবতা। দুটি চোখ মুদে। স্বর্গীয় এক দৃশ্যের মধ্যে ডুব দিয়েছে। ঘাসবন থেকে আর একবার চকাস্ করে ভেসে আসা শব্দ শুনল দেবু। অদ্ভুত এক তৃপ্তির হাসি ফুটে উঠল ওর ঠোঁটে। ঘরছাড়া, দিকহারানো একটি ছেলে এবং একটি মেয়ে বিপদ মাথায় নিয়ে কেমন করে বাঁচতে হয় শিখিয়ে দিয়ে গেল যেন।
জামাকাপড় পরে নেবার ঘসঘস আওয়াজ হল। আবছা অন্ধকারে চুড়ির রিনরিন। আরও একটু পরে নতুন বউদির গলা শুনতে পেল, ‘আবার কবে দেখা হবে– জানিয়ে দিয়ো!’
ছেলেটির গলা স্বপ্নালু মানুষের মতো শোনায়, ‘পরের বার কবিতা সংকলনটা নিয়ে আসব।’
‘সত্যি?’ বউদিমনির গলায় চাপা উচ্ছ্বাস।
‘সত্যি! ওটাতো তোমাকেই উৎসর্গ করেছি রিখি!’
এমন জটিল বাংলা শব্দ ‘উৎসর্গ’ বাবার জন্মে শোনেনি দেবু। তবু আবার এক চকাস্ শব্দ ওকে বুঝিয়ে দিল সেটা ভালো কিছুই হবে।
কতক্ষণ আবেশে বুঁদ হয়েছিল খেয়াল ছিল না দেবুর। সম্বিত ফিরল যখন অদ্ভুত এক সুগন্ধ ছড়িয়ে বউদিমণি চলে গেল মাঠ ফাঁকা করে। ওকে উতলমাতাল করে রেখে।
আবিষ্টের মতো দুটি হাত কপালে ছোঁয়াল দেবু। আহা গো বউদিমণি, তোমার কষ্ট আর কেউ না বুঝুক এই ছাই-ফেলতে ভাঙা কুলো দেবা বোঝে। তুমি সব্বোসুখি হও গো। প্রাণ থাকতে আমি তোমার সুখের রাস্তায় কাঁটা হয়ে দাঁড়াব না কখনও!
শরগাছের বন ছেড়ে বেশ কয়েক পা এগিয়ে এসেছে দেবিদাস, এমন সময় মোবাইলে আলো জ্বলে উঠল। স্বয়ং বড়োকত্তা। খুব সন্তর্পণে কথা বলতে লাগল দুজন।
‘কী রে, সব ঠিক আছে?’
‘হুঁ।’ উত্তর সংক্ষিপ্ত করল দেবু।
‘বউমা?’
‘এই তো আট চক্বর শেষ করে মাঠ থেকে বাড়ির দিকে গেল।’ যতদূর সম্ভব গলা স্বাভাবিক রেখে উত্তর দিল দেবু ওরফে দেবিদাস পুরকাইত।
সামন্তবাড়ির লক্ষ্মী সহায় থাকলে ওর ভাগ্য ফিরতেও দেরি হবার কথা নয়। চাই কি, বসতবাড়িটার হাতবদলও হয়ে যেতে পারে। খুশি খুশি মুখে ফোনশুদ্ধ দুটি হাত আকাশে বসে থাকা অথচ এখনও অদেখা মানুষ নাকি দেবতাটির উদ্দেশে, এবার তুলল দেবু।