আমাদের ১৩ জনের দলটি যখন সরাইঘাট এক্সপ্রেসে গুয়াহাটি পৌঁছোল সকাল ১০টা নাগাদ, তখনও জানতাম না ‘১৩’ এতটা ‘লাকি’ এবং এতটা ‘আনলাকি’ সংখ্যা হতে পারে। রিটায়ারিং রুমে স্নান সেরে চা খেয়ে ফ্রেশ হলাম কিন্তু ২-টোর বাসে সিট নেই, অতএব ৬-টার বাসে রওনা হতে হবে। কী আর করা অগত্যা বাসস্ট্যান্ডের ওয়েটিং রুমে বসে থাকা। তখন তো জানি না আরও কত বসে থাকা আছে কপালে। অবশেষে প্রতীক্ষিত সময় এল, বাসে ওঠা হল।
ঠিক ৬-টায় বাস ছাড়ল। তখন আঁধার নেমেছে আকাশে। তাছাড়া মেঘও দখল নিয়েছে সেখানে। পূর্ণিমার রাত হওয়া সত্ত্বেও চাঁদ হারিয়ে গেছে মেঘ নগরীতে। সাড়ে ন-টা নাগাদ একটা ধাবার সামনে বাস থামল। আমরা নৈশভোজে বসলাম, কিন্তু খাদ্যদ্রব্য মুখে তোলার মতো নয়। জায়গাটির নাম জাখলবান্ধা। এখানে প্রচুর নারকেল বিক্রি হচ্ছে, বাসওয়ালারা অনেক নারকেল কিনলেন। তারপর সেগুলি বাসের মাথায় তোলা হল। ১০টা নাগাদ আবার বাস ছাড়ল। সবে চোখ লেগেছে, বাস গেল দাঁড়িয়ে– ঘড়িতে তখন সাড়ে এগারোটা। শোনা গেল পথে কী যেন গোলমাল হয়েছে। বাস থেকে নামলাম পূর্ণচাঁদের আশায়। কিন্তু চাঁদ তখনও নিখোঁজ।
আধো ঘুমে আধো জাগরণে রাত তিনটে নাগাদ আবার বাস চলল। ঘুমিয়ে পড়েছি, হঠাৎ বাস থেমে গেল। সামনের পথে নাকি কারফিউ চলছে। ঘড়িতে ৪-টে, ভোরের আলো ফুটি-ফুটি, বাস থেকে নেমে দেখি বাস-লরি-গাড়ির বিশাল লাইন। জায়গাটির নাম রংগাজার্স। ব্যাপার খানিক জানা গেল। অসমের দুটো ট্রাইবের মধ্যে মারামারি হয়েছে। তাই কারফিউ জারি হয়েছে। অতএব এখন দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ধৈর্যের পরীক্ষা দেওয়া।
যাইহোক, এখানে একটা দোকানে পুরি-তরকারি আর চা খাওয়া হল। তারপর ১০টা নাগাদ বাস ছাড়ল। পথের দুধারে শুধু সবুজের আন্তরিকতা, চা বাগানের সবুজ, তারপর শুরু হল নরম সবুজ শষ্যখেত। খেত শেষ হতে শুরু হল অরণ্য। গভীর বন– কার্বিআংলং। কিছুদূর যাবার পর পথের ওপর একটা বোর্ডে দেখলাম লেখা আছে ‘গরম পানি’। শুনলাম এখানে হট স্প্রিং আছে। আর কিছুটা এগিয়ে আবার দাঁড়িয়ে গেল বাস। আমরা মানসিক ভাবে এবার সত্যিই ভেঙে পড়লাম। কী জানি কি হয়। অবশেষে প্রায় ঘন্টা খানেক পর বাস ছাড়ল। খানিকক্ষণ চলার পর দেখলাম একটা নদীর ধারে খুন হওয়া মৃতদেহগুলির, পুলিশ পাহারায় সৎকার করা হচ্ছে। মনটা খুব খারাপ হয়ে গেল, মানুষের হিংসার বলি আর কত হবে কে জানে! যাই হোক, পথে আর বাস থামেনি।
১২টা নাগাদ ডিমাপুর পৌঁছোলাম। বেশ বড়ো শহর। শহর ছাড়িয়ে আবার সবুজ চিরে পথ, ভালো লাগছে এই পথ চলা। ১টা নাগাদ এক জায়গায় থামা হল লাঞ্চের জন্য। হোটেলের নাম মণিপুর রাইস হোটেল। মাছটা খুব সুস্বাদু ছিল। আবার চলা, ৪টে নাগাদ নাগাল্যান্ডের রাজধানী কোহিমায় পৌঁছোলাম। পাহাড়ের ওপর বেশ বড়ো শহর। হঠাৎ মেঘের দখলে চলে গেল আকাশ আর সঙ্গে সঙ্গে আঁধার ঘনাল। রাত্রি ৭-্৩০ মিঃ নাগাদ মণিপুরের রাজধানী ইম্ফলে পৌঁছোলাম।
ডিম্বাকৃতি এই উপত্যকার আয়তন প্রায় ২,২৫০ বর্গ কিমি। বিশ্বের অন্যতম প্রাকৃতিক বিস্ময় এই উপত্যকা। অনেকে বলেন পূর্ব ভারতের সুইজারল্যান্ড হল মণিপুর। সত্যিই মণিপুরের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য অতুলনীয়। দীর্ঘকাল ধরে স্বাধীন ছিল এই রাজ্য। ১৮৯১ সালে ব্রিটিশের হাতে শেষ স্বাধীন রাজা টিকেন্দ্রজিতের ফাঁসির পর, মণিপুর ব্রিটিশের দখলে চলে যায়। মণিপুরি নৃত্য আজ ভারত ছাড়িয়ে আবিশ্ব নৃত্য রসিকদের মনোরঞ্জন করে চলেছে। বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ এই নৃত্যধারাকে নিজের রচিত নৃত্যনাট্যে ব্যবহার করেছেন। আর সারা পৃথিবীর খেলাধূলার দরবারে পোলো খেলাটিও উপহার দিয়েছে এই মণিপুর।
ইম্ফলে টাম্ফা হোটেলে ওঠা হল। তারপর ঘর পেয়ে হাতমুখ ধুয়ে নৈশভোজ সারতে একটা দোকানে গেলাম। না, কোনও কিছু মুখে দেওয়া গেল না। ফিরে এসে ক্লান্ত দেহকে বিছানায় ফেলে দেওয়া।
পরের দিন সাড়ে পাঁচটায় বিছানা ত্যাগ। ৫ টাকা দিয়ে এক বালতি গরম জল পাওয়া গেল। দু’দিন পর স্নান সেরে, তৈরি হওয়া। তারপর তিন বন্ধুতে মিলে কাছাকাছি একটু প্রাতর্ভ্রমণ সেরে এলাম। ৮-টা নাগাদ ব্রেকফাস্ট সেরে ৯টার সময় দুটো মারুতি ভ্যানে চেপে আমাদের দল রওনা হল উত্তর-পূর্ব ভারতের বৃহত্তম লেক ‘লোকতাক’-এর উদ্দেশ্যে। শহর ছাড়াতেই সবুজের মাখামাখি। পথের দুধারে ইউক্যালিপটাস গাছের সারি আমাদের গার্ড অব অনার জানাল। তরুবীথি ছাড়িয়ে কচি ধানের নরম সবুজ আর পাকা ধানের হলুদ মিলেমিশে দিগন্ত বিস্তৃত খেত। আকাশ নিবিড় নীল, তাতে সাদা মেঘের কারুকাজ। খেত পেরিয়ে টিলা পাহাড়ের সারি। অসাধারণ লাগছে এই পথচলা। এইবার আমাদের পথের বাঁদিকে পড়ল ইম্ফলের এয়ারপোর্ট, পড়ল বিষ্ণুপুর (২৭ কিমি) তারপর ফুবালা (৪০ কিমি) হয়ে পৌঁছে গেলাম লোকতাক লেকের কাছে। গাড়ি থেকে যখন নামলাম তখন ঘড়িতে সাড়ে এগারোটা বাজে। লেকের পূর্ণরূপ দেখতে সেন্দ্রা দ্বীপের টিলার ওপর ভিউপয়েন্টে উঠলাম। দু-চোখ ভরে দেখলাম দিগন্ত প্রসারিত জলরাশি আর তার উপর গোলাকৃতি ভাসমান দ্বীপরাজি। নীল আকাশ আর সাদা মেঘ জলে ছবি আঁকছে। আশ্চর্য সুন্দর লাগছে। লেকের জলে ভাসমান দ্বীপের ওপরে নির্মিত রেস্টুেরেন্টে বসে চা খেতে খেতে চারিদিকের মনোরম দৃশ্য চোখ কেড়ে নিল। এত ভালো লাগছিল যে ভাষায় বর্ণনা করা যায় না। লেকের ওপর ভাসমান বুললামজো ন্যাশনাল পার্ক বলা হয়, যেখানে নাচুনে হরিণের বাস। কিন্তু এখন সেখানে যেতে দেওয়া হয় না। এই পার্কের খ্যাতি বিশ্বজোড়া।
এবার যাওয়া হল মৈরাং-এর আইএনএ মিউজিয়াম দেখতে। নেতাজির মূর্তি এবং সেই ঐতিহাসিক বেদি যেখানে ১৯৪৪ সালে ১৪ এপ্রিল পরাধীন ভারতের মাটিতে প্রথম জাতীয় পতাকা উত্তোলন করে আজাদ হিন্দ বাহিনী। মিউজিয়ামে আইএনএ এবং নেতাজির নানা ছবি, তাঁর ব্যবহৃৎ কিছু জিনিস, যুদ্ধে ব্যবহৃৎ কিছু গুলি-বন্দুক-ছোরা প্রভৃতি অস্ত্রশস্ত্র সাজানো রয়েছে। মিউজিয়াম দেখা শেষ করে, মৈরাং শহরের কাছেই বনদেবতা যানজিং-এর মন্দির দেখতে গেলাম। মণিপুরের লোকগাথার অমর দুই চরিত্র খাম্বা ও থেইরিকে নিয়ে রচিত প্রেমগীতি আর নৃত্যশৈলীর উৎপত্তি এই মৈরাং থেকে।
এবার গন্তব্য বিষ্ণুপুর। এখানকার থানার পাশ দিয়ে রাস্তা চলে গেছে ১৪৬৭-এ নির্মিত প্রাচীন বিষ্ণুমন্দিরের দিকে। মন্দির দর্শন করলাম, সুন্দর মন্দির স্থাপত্য কিন্তু দেবতা দর্শন হল না। কারণ মন্দিরের দ্বার ততক্ষণে বন্ধ হয়ে গেছে। এবার দেখা হলো লৌকিপাত ইকোপার্ক এবং সামনে বিষ্ণুপুরের ডিসি-র অফিস। জায়গাটি খুব সুন্দর। এরপর পথে পড়ল ‘ইন্ডিয়ান পিস মেমোরিয়াল’। নামকল বাজার ছাড়িয়ে দেখা যায় এই স্মৃতিসৌধটি যা জাপানি সহযোগিতায় নির্মিত হয়েছে, দ্বিতীয় মহাযুদ্ধে নিহত সৈনিকদের স্মৃতির উদ্দেশ্যে। পথে আসতে আসতে দেখলাম একদল সাদা ধুতি পরা ও সাদা চাদর গায়ে লোক, বাস থেকে নেমে একটি বাড়ির দিকে সদলবলে যাচ্ছে, মনে হল বরযাত্রী। দেখে বেশ ভালো লাগল।
এবার এয়ারপোর্ট রোডের উপর ইসকন মন্দির দেখতে গেলাম। মন্দির নির্মাণ এখন সম্পূর্ণ হয়নি। যেটুকু দেখলাম খুব সুন্দর স্থাপত্যই নির্মিত হচ্ছে। রাধা গোবিন্দর বিগ্রহ অপরূপ সুন্দর। সব দেখা শেষ করে ৫টার সময় পথের একটা দোকানে কফি খেয়ে হোটেলে ফিরলাম। কারণ সন্ধ্যার পর এখানে কেউ বাইরে বার হয় না।
পরের দিন ভোর ৫টার মধ্যেই উঠে পড়লাম। গরমজলও পাওয়া গেল। অতএব স্নান সেরে তৈরি হয়ে হাঁটতে বেরিয়ে পড়লাম। প্রধান সড়ক ছেড়ে অপ্রশস্ত পথ ধরলাম। চোখে পড়ল পর্বতারোহণ সংস্থার শিক্ষাকেন্দ্র, যুব আবাস। তারপর খোমান লামপাক স্টেডিয়ামের বিশাল কম্পাউন্ডের প্রাচীর ধরে পরিক্রমা করলাম, প্রায় ৫-৬ কিলোমিটার পথ। গেটের কাছে এসে দেখলাম অনেক ছেলেমেয়ে শরীরচর্চা ও সাইক্লিং করছে। কাছেই একটি সুন্দর চার্চ দেখলাম আর দেখা হল একটি রাধাগোবিন্দ জীউয়ের প্রাচীন মন্দির। রাধাগোবিন্দের মূর্তি দুটি অপরূপ। তারপর ইম্ফল নদীর ধার ধরে খানিক হেঁটে, নদীর উপর কাঠের সাঁকো পেরিয়ে হোটেল মুখো। তাড়াতাড়ি ব্রেকফাস্ট সেরে অটোতে ওঠা হল। শহরের দ্রষ্টব্য দেখার অভিলাষে। প্রথমেই যাওয়া হল গোবিন্দজির মন্দির। এটি মণিপুরের বিখ্যাত মন্দির। মন্দিরের বিশাল প্রাঙ্গন। প্রাচীন তো বটেই, স্থাপত্যও খুব সুন্দর। সর্বত্র, একটি শুচি-স্নিগ্ধতা বিরাজ করছে। রাধাগোবিন্দজির মূর্তি অনুপম মাধুর্যে ভরা। পাশের মন্দিরে জগন্নাথ, বলরাম, সুভদ্রাদেবীর মূর্তি বিরাজ করছে। এখানকার দেবতার নৈবেদ্য দেবার ব্যবস্থাটি বেশ অভিনব। কলাপাতাকে গোল করে কেটে তার চারপাশেও পাতাকে কেটে ডিজাইন করে ফল মিষ্টি দেওয়া হয়। ফলও সুন্দর করে কাটা, তার সঙ্গে টাটকা দুটি চাঁপা ও একটি জবাফুল। সত্যিই প্রসাদ পেয়ে মন, মাধুর্যের স্পর্শে ভরে উঠল।
মন্দিরের সামনে মণিপুরি শৈলীতে নির্মিত বিশাল বাঁশের কাজের নাটমণ্ডপ, শুধু ঐতিহ্যবাহী নয়, অসাধারণ এর শিল্পশ্রী। গোলাপি মেখলা আর সাদা চাদরে সজ্জিত মণিপুরি মহিলারা বসে আছেন মন্দিরের চাতালে। চারিদিকে পবিত্রময় শান্তি বিরাজ করছে। মন্দির প্রাঙ্গনের মধ্যেই বিশাল উঁচু ঘন্টাঘর। আর দেখলাম রাধাকুণ্ড, শ্যামকুণ্ড, গোপেশ্বর মহাদেব মন্দির। সবই মন্দিরের প্রাঙ্গনের মধ্যেই। মন্দির দেখে মন পূর্ণ হয়ে উঠল। মণিপুরিরা বেশির ভাগই গোবিন্দজির ভক্ত অর্থাৎ বৈষ্ণব সম্প্রদায়ের লোক।
মন্দিরের কাছেই মণিপুর রাজপ্রাসাদ। সে রাজাও নেই, সেই রমরমাও নেই। তবু ভালো লাগল রাজাদের স্মৃতি বিজড়িত এই প্রাচীন রাজপ্রাসাদ দেখতে। ভিতরে প্রবেশের অনুমতি নেই, সামনে থেকে দেখেই ফিরতে হল। এবার গেলাম মহাবলী মন্দির দেখতে। হনুমানজির প্রাচীন মন্দির। মূর্তিটি শুধু সুন্দরই নয় খুব অভিনব, মন্দিরের স্থাপত্য শৈলীও সুন্দর। তবে মন্দিরঅঙ্গন বানরে পূর্ণ। চলাফেলা করতে একটু যেন ভয় পাচ্ছিলাম বানরের জন্য।
এরপর যাওয়া হল মণিপুর স্টেট মিউজিয়াম দেখতে। প্রাণীতত্ত্ব, ছবি, পোশাক, মণিপুরিদের নানা স্ট্যাচু। তাছাড়াও মণিপুরি জীবনযাত্রার প্রয়োজনীয় নানান সংগ্রহ। মিউজিয়ামের সামনেই একটি পার্কের মধ্যে শেষ স্বাধীন রাজা টিকেন্দ্রজিতের স্মৃতিসৌধ। এইখানেই নাকি তাঁকে ফাঁসি দেওয়া হয়েছিল। এরপর দেখলাম ঐতিহাসিক কাংলা ফোর্ট। টিকেন্দ্রজিৎকে ক্ষমতাচ্যুত করে একদা যার দখল নেয় ইংরেজরা। স্বাধীনতার পর অসম রাইফেলস্-এর হাতে যায় এই কেল্লা। মনোরমার ঘটনার পর অসম রাইফেলস্কে উচ্ছেদ করা হয় এখান থেকে। আজও চিত্রাঙ্গদার দেশের বীর রমণীদের প্রতিবাদ যথাযথ মূল্য পায়।
এবার যাওয়া হল খৈরম্বন্ধ বাজারে। শুরু হল প্রবল বৃষ্টি। বিশাল বাজারে নানা রকমের পণ্যসামগ্রী কিন্তু দেখা সম্ভব হল না। বৃষ্টির জন্য ফিরে আসতে বাধ্য হলাম হোটেলে। দুপুরে লাঞ্চ করে এখানকার ওয়ার সিমেট্রি দেখতে গেলাম। এখানকার রাস্তাঘাটের অবস্থা বড়োই শোচনীয়। বৃষ্টি পড়ে জলে কাদায় করুণ দশা। যাই হোক, হোটেলের কাছেই, হেঁটেই পৌঁছে গেলাম। সবুজ লনে শুয়ে আছে সবুজ প্রাণগুলি। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের বলি, বেশির ভাগের বয়সই চ্প্ত-এর নীচে। মানুষের অমানবিকতায় লজ্জা মিশ্রিত দুঃখবোধে মন বিষণ্ণ হল। সত্যিই, মানুষের কলঙ্ক এই যুদ্ধবৃত্তি, থামবে কি কখনও? একে মেঘে ঢাকা আকাশ, তায় ভারতের একেবারে পূর্বপ্রান্ত, তাড়াতাড়ি অন্ধকার নেমে এল। ফেরা হল হোটেলে।
পরদিন বাসে করে নাগাল্যান্ডের রাজধানী কোহিমায় যাওয়া হবে। সকাল সকাল বাস ছাড়ল, কিন্তু কিছুদূর গিয়েই বাস থেমে গেল। বাসের ড্রাইভার আর হেল্পার নাকি এখন খাওয়াদাওয়া করবে। ঘন্টা খানেকের ওপরে লাগিয়ে দিল। আবার খানিক চলা, তারপর বাস আবার থামল, আমরা লাঞ্চ করলাম। কিছুক্ষণ চলার পর হঠাৎ বাস থেমে গেল, কী ব্যাপার– না, খারাপ হয়েছে। আবার এক ঘন্টা। এই ভাবে অনেক সময় নষ্ট হল। প্রায় সাড়ে চারটে নাগাদ কোহিমায় পৌঁছোলাম। সামান্যক্ষণের মধ্যেই সন্ধ্যা নেমে এল আর সঙ্গে সঙ্গে এখানকার দোকানপাটও সব বন্ধ হয়ে গেল। আমাদের এখানকার হোটেলটি বেশ ভালো। ঘরগুলি বেশ বড়ো, পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন। খাবারদাবারও বেশ ভালো। নাম হলিডে ইন। ঘরের জানালা দিয়ে বাইরের দিকে তাকিয়ে চমক লাগানো মুগ্ধতায় শুধু চেয়ে রইলাম, পাহাড়ি কোহিমা তখন আলোর মালায় সেজে উঠেছে।
পরের দিন ভোরে উঠে তৈরি হওয়া গেল। কোহিমার পথে প্রাতর্ভ্রমণে বার হলাম। পাহাড়ি পথে চারিদিকের বৃষ্টিধোয়া সবুজের আন্তরিকতায় পথ চলতে খুব ভালো লাগছিল। এখানে প্রচুর চার্চ এবং চার্চগুলি বেশ দর্শনীয়। কিছুক্ষণ হাঁটার পর মধ্যে অনেকগুলি চার্চ দেখলাম। নাগারা বেশির ভাগই খ্রিস্টান ধর্মাবলম্বী। হোটেলে ফিরে দেখি সবাই তৈরি হয়ে গেছেন। তাড়াতাড়ি ডাইনিং হলে গিয়ে ব্রেকফাস্ট সারলাম। তারপর দুটো সুমো ভাড়া করে প্রথমে যাওয়া হল এখানকার নিউ সেক্রেটারিয়েট ভবন দেখতে। কিছুক্ষণের মধ্যেই পৌঁছে গেলাম সেখানে। ওয়েল গার্ডেড জায়গা। কিছুদূর থেকে দেখা হল। এর কাছেই নাগা নেতা ফিজোর সমাধি। সেটিও দেখা হল।
এরপর যাওয়া হল এখানকার ওয়ার সিমেট্রি দেখতে। শান্ত পরিবেশ বাতাসে বিষণ্ণতার প্রলেপ, বিমর্ষ মনে ফিরে আসা। এরপর যাওয়া হল এখানকার জু দেখতে। জু-তে দুটি মিথুন আর একটি গাউর দেখলাম। তারপর যাওয়া হলো এখানকার রোমান ক্যাথিড্রাল দেখতে। বিশাল গির্জা, অভিনব স্থাপত্য। এবার লাঞ্চের জন্য একটা দোকানে দাঁড়ানো হল। লাঞ্চের পর যাওয়া হল কিসামা গ্রামে নাগাদের কুটিরের নানা ধরনের মডেল দেখতে। এখানে একটা নাগাদের মডেল গ্রাম করা হয়েছে। একটা টিলার ওপরে নাগাদের নানা ডিজাইনের কুটিরের সারি। অভিনব দর্শন কুটিরশ্রেণি। আমরা ঘুরে ঘুরে সব দেখলাম। আজ ওদের উৎসব, তাই অনেকেই এসেছেন এখানে পিকনিক করতে। বিরিয়ানির সুগন্ধে বাতাস ম-ম করছে। ক্রমে গোধূলিলগনে মেঘে আকাশ ঢাকল। আমরাও হোটেলমুখো হলাম।
পরের দিন ভোরবেলাতেই উঠে পড়লাম। স্নান সেরে তৈরি হওয়া গেল। তারপর ব্রেকফাস্ট সেরে নাগা গ্রাম ওখার উদ্দেশে রওনা হলাম। পথের দু-ধারের দৃশ্য চক্ষু কাড়া। কখনও বনভূমি, কখনও খেতের সবুজের ছয়লাপ। কখনও গ্রাম, গঞ্জ, মাঝে মাঝে মানুষজনের দেখা পাওয়া যাচ্ছে। তবে খুব কম। প্রায় ১২টা নাগাদ ওখানে পৌঁছোলাম।
আকাশ ঘন মেঘে ঢাকা। ভালোই বৃষ্টি হচ্ছে। তবুও গাড়ি থেকে নামা হল ছাতা মাথায় দিয়ে। সত্যিই বড়ো মনোরম দৃশ্য। পাহাড়ের ওপর থেকে নীচে অবধি কাঁচাপাকা ধানখেতের বর্ণবৈচিত্র্য। পাহাড়ের গায়ে গ্রামের ঘরবাড়ি, সব মিলিয়ে নিমেষহারা সৌন্দর্যের সৃষ্টি করেছে। আমরা অপলক মুগ্ধতায় অনেকক্ষণ তাকিয়ে রইলাম। বৃষ্টি না হলে এখানে বেশ খানিকক্ষণ বসে থাকলে ভালো লাগত। কিন্তু কপালমন্দ, তা হবার নয়, আমরা একটা দোকানে (বাড়ির মধ্যেই দোকান) লাঞ্চের অর্ডার দিলাম, ভাত ডাল আর ডিমের ঝোল। তারপর গেলাম এখানকার প্রাচীন চার্চ দেখতে, বেশ বড়ো চার্চ এবং স্থাপত্যও খুব সুন্দর। ফিরে এসে লাঞ্চ খাওয়া হল। অপূর্ব রান্না হয়েছে। হোটেল মালিকের বাচ্চা দুটি খুব উৎসাহ এবং আন্তরিকতার সঙ্গে আমাদের পরিবেশন করে খাওয়াল। দেশি ডিম, দারুন স্বাদ। দোকানের মালিক এবং তাঁর পরিবার আমাদের এমনভাবে বিদায় জানালেন যেন আমরা তাঁদের আত্মীয়। আন্তরিক ব্যবহারে মুগ্ধ হলাম।
পথে আমরা একটি নাগা রিসর্ট দেখলাম। জায়গাটির প্রাকৃতিক সৌন্দর্য মন কাড়ে। সারি সারি নাগা কুটিরের সার, ভিতরে আধুনিক ব্যবস্থা। নানা রঙের ফুলে সাজানো বাগান। আমরা মুগ্ধ হয়ে গেলাম। পশ্চিম আকাশে শুরু হল রঙের বন্যা। অস্তরাগের সে এক অনন্যসাধারণ মোহময়ী বর্ণালি। পলকহারা চেয়ে থাকা– ভাষায় বর্ণনা করা যায় না এই দৃশ্যের রূপমাধুরী, শুধু অন্তরের উপলব্ধি। ক্রমে আধাঁর নামে। দূর থেকে দেখা যায় কোহিমার আলো। আরও খানিক এগিয়ে কোহিমার আলোর চুম্কি পরা নববধূ সাজ দেখতে দেখতে পৌঁছে গেলাম হোটেলে।
পরের দিন সকালে গাড়িতে করে আমরা ডিমাপুরে এলাম। পথের দুধারের দৃশ্য অতি মনোরম, সবুজ স্নিগ্ধতায় ভরা। লাঞ্চ সেরে আমরা ট্রেনে উঠলাম। গৌহাটিতে একটি হোটেলে রাত কাটিয়ে পরের দিন ভোরে কামরূপ এক্সপ্রেস ধরা হল। শেষ হল আমাদের সফর। মণিপুর নাগাল্যান্ডের অনুপম সৌন্দর্যের সঙ্গে, মনে রয়ে গেল ওখা গ্রামের সেই হোটেলের বাচ্চাদের হাসিমাখা কচিমুখের অকৃত্রিম আপ্যায়ন। যাত্রা শুরুর আনলাকি থার্টিন শেষে লাকি হয়ে উঠল।