আমাদের ১৩ জনের দলটি যখন সরাইঘাট এক্সপ্রেসে গুয়াহাটি পৌঁছোল সকাল ১০টা নাগাদ, তখনও জানতাম না ‘১৩’ এতটা ‘লাকি’ এবং এতটা ‘আনলাকি’ সংখ্যা হতে পারে। রিটায়ারিং রুমে স্নান সেরে চা খেয়ে ফ্রেশ হলাম কিন্তু ২-টোর বাসে সিট নেই, অতএব ৬-টার বাসে রওনা হতে হবে। কী আর করা অগত্যা বাসস্ট্যান্ডের ওয়েটিং রুমে বসে থাকা। তখন তো জানি না আরও কত বসে থাকা আছে কপালে। অবশেষে প্রতীক্ষিত সময় এল, বাসে ওঠা হল।
ঠিক ৬-টায় বাস ছাড়ল। তখন আঁধার নেমেছে আকাশে। তাছাড়া মেঘও দখল নিয়েছে সেখানে। পূর্ণিমার রাত হওয়া সত্ত্বেও চাঁদ হারিয়ে গেছে মেঘ নগরীতে। সাড়ে ন-টা নাগাদ একটা ধাবার সামনে বাস থামল। আমরা নৈশভোজে বসলাম, কিন্তু খাদ্যদ্রব্য মুখে তোলার মতো নয়। জায়গাটির নাম জাখলবান্ধা। এখানে প্রচুর নারকেল বিক্রি হচ্ছে, বাসওয়ালারা অনেক নারকেল কিনলেন। তারপর সেগুলি বাসের মাথায় তোলা হল। ১০টা নাগাদ আবার বাস ছাড়ল। সবে চোখ লেগেছে, বাস গেল দাঁড়িয়ে– ঘড়িতে তখন সাড়ে এগারোটা। শোনা গেল পথে কী যেন গোলমাল হয়েছে। বাস থেকে নামলাম পূর্ণচাঁদের আশায়। কিন্তু চাঁদ তখনও নিখোঁজ।
আধো ঘুমে আধো জাগরণে রাত তিনটে নাগাদ আবার বাস চলল। ঘুমিয়ে পড়েছি, হঠাৎ বাস থেমে গেল। সামনের পথে নাকি কারফিউ চলছে। ঘড়িতে ৪-টে, ভোরের আলো ফুটি-ফুটি, বাস থেকে নেমে দেখি বাস-লরি-গাড়ির বিশাল লাইন। জায়গাটির নাম রংগাজার্স। ব্যাপার খানিক জানা গেল। অসমের দুটো ট্রাইবের মধ্যে মারামারি হয়েছে। তাই কারফিউ জারি হয়েছে। অতএব এখন দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ধৈর্যের পরীক্ষা দেওয়া।
যাইহোক, এখানে একটা দোকানে পুরি-তরকারি আর চা খাওয়া হল। তারপর ১০টা নাগাদ বাস ছাড়ল। পথের দুধারে শুধু সবুজের আন্তরিকতা, চা বাগানের সবুজ, তারপর শুরু হল নরম সবুজ শষ্যখেত। খেত শেষ হতে শুরু হল অরণ্য। গভীর বন– কার্বিআংলং। কিছুদূর যাবার পর পথের ওপর একটা বোর্ডে দেখলাম লেখা আছে ‘গরম পানি’। শুনলাম এখানে হট স্প্রিং আছে। আর কিছুটা এগিয়ে আবার দাঁড়িয়ে গেল বাস। আমরা মানসিক ভাবে এবার সত্যিই ভেঙে পড়লাম। কী জানি কি হয়। অবশেষে প্রায় ঘন্টা খানেক পর বাস ছাড়ল। খানিকক্ষণ চলার পর দেখলাম একটা নদীর ধারে খুন হওয়া মৃতদেহগুলির, পুলিশ পাহারায় সৎকার করা হচ্ছে। মনটা খুব খারাপ হয়ে গেল, মানুষের হিংসার বলি আর কত হবে কে জানে! যাই হোক, পথে আর বাস থামেনি।