সন্তানের জন্মের পরেই মায়েদের চিন্তা শুরু হয়ে যায়। কী করে বাচ্চাকে বড়ো করবে, কবে থেকে শিশু চলাফেরা শুরু করবে ইত্যাদি ইত্যাদি। । সত্যি কথা বলতে সন্তানকে বড়ো করে তোলাটা গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বের মধ্যে পড়ে। শিশুর শারীরিক এবং মানসিক বিকাশের Child Development জন্যে বড়োদের আদর ভালোবাসার খুবই প্রয়োজন।

বাচ্চাদের প্রতি মা-বাবার যে-দায়িত্ব, সেটা ডিউটি মনে করে নয় বরং ভালোবেসে পালন করা উচিত। বড়োদের এই ভালোবাসাই সঠিক ভাবে বাচ্চাদের মানুষ করে তুলতে সাহায্য করে। অরুণিমা চাকরি করে। ওর ৩ বছরের একটি মেয়ে আছে। মেয়েকে বাড়িতে রেখে অরুণিমাকে অফিস যেতে হয়। ওর কাছে ওর সন্তানের তিল তিল করে বেড়ে ওঠাটা একটা বিস্ময়। কথায় কথায় ও বলছিল, ‘রোজ অফিস থেকে বাড়ি ফিরে মনে হয় আমার মেয়ের মধ্যে রোজই কোনও না কোনও পরিবর্তন হচ্ছে। রোজই নতুন নতুন জিনিস ওর মধ্যে লক্ষ্য করি। ওর কথা বলার স্টাইল, ভালোবাসা প্রকাশ করার স্টাইল, সবকিছুর মধ্যেই পরিবর্তন এসেছে মনে হয়। অফিসের সারাদিনের ক্লান্তি, মেয়েকে দেখে এক নিমেষে গায়েব হয়ে যায়।’

চাইল্ড স্পেশালিস্টদের মতে প্রথম ৪ বছর পর্যন্ত বাচ্চারা জীবনের ৮০ শতাংশ জিনিস শিখে ফেলে। বাকি ২০ শতাংশ শেখে সারা জীবন ধরে। শিশুর নিষ্পাপ সরলতার সঙ্গে সঙ্গে তার মধ্যে কাজ করে নতুন কিছু শেখা এবং জানার আগ্রহ। শিশুর বয়স যখন এক বছরের কম থাকে তখন হাতের সামনে যা পায়, তাই মুখের মধ্যে পুরে দেওয়ার একটা প্রবণতা থাকে তাদের। কারণ এই সময়টাতে শিশুর টেস্ট অর্গ্যান বিকশিত হওয়া শুরু হয়।

গুটি থেকে প্রজাপতি

চোখের সামনে বাচ্চাদের বড়ো হয়ে উঠতে দেখাটা মা-বাবার কাছে যথেষ্ট আনন্দের। প্রথমবার বাচ্চাকে কোলে নিলে মনে হয় সারা জীবনের যতটা আনন্দ পাওনা ছিল, তা মুহূর্তে পাওয়া হয়ে গেল। জন্ম থেকে নিয়ে শিশুদের ব্যবহারে রোজই পরিবর্তন আসে। খুব তাড়াতাড়ি তারা সবকিছু শিখতে থাকে। বাচ্চার উপযুক্ত দেখভাল দায়িত্ব মনে না করে, আনন্দ উপভোগ করার জন্যে শুধু করুন। বাচ্চার উপর রাগারাগি করা উচিত নয়। বাচ্চার সার্বিক বিকাশের ক্ষেত্রে স্পর্শর, একটা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে। কোথাও থেকে ফিরে আসার পর শিশুকে জড়িয়ে ধরে আদর করা, তাকে কোলে তুলে নেওয়ায় তার প্রতি ভালোবাসার অনুভূতিই ফুটিয়ে তোলা হয়। শিশুর নিজেরও মনে হয় সে সকলের আদরের, সকলেই তাকে ভালোবাসে। কথা বলতে না শিখলেও বাচ্চারা বুঝতে পারে তার প্রতি অন্যদের কী মানসিকতা। বাচ্চাকে আদর করতে গেলে দেখা যায় সেও তার ছোট্ট হাতটি তুলে বড়োদের গলা জড়িয়ে ধরছে। মায়ের স্পর্শ বাচ্চাদের কাছে সবচেয়ে প্রিয়। ঘুমের মধ্যেও বাচ্চা মায়ের গায়ের গন্ধ আর স্পর্শ ঠিকই বুঝতে পারে। এছাড়াও বাচ্চাদের সঙ্গে সর্বক্ষণ কথা বলতে থাকলে বাচ্চারা খুব তাড়াতাড়ি কথা বলতে শেখে।

প্রতিদিনই একটু করে বড়ো হওয়া

জন্মের পর থেকে প্রথম ৫ বছর বাচ্চাদের গ্রোথ অথবা বিকাশ হয় খুব তাড়াতাড়ি। শেখার আসল সময় এটাই। খাওয়াদাওয়া থেকে শুরু করে হাঁটতে শেখা, শিরদাঁড়া সোজা করে বসা, কথা বলা, অন্যের সঙ্গে বন্ধুত্ব করা সবই শিশু এই বয়সের মধ্যেই শেখে। প্রতিদিনই নানা ধরনের পরিবর্তন চোখে পড়ে তাদের মধ্যে। এই সময় শিশুর মনে নানারকম প্রশ্ন উদয় হয় এবং অভিভাবকের দায়িত্ব সেই সব প্রশ্নের সঠিক সমাধান করে দেওয়া। সঠিক উত্তর দেওয়া। বাচ্চাকে উপযুক্ত মানুষ হিসেবে গড়ে তুলতে গেলে, বড়োরা যে ব্যবহার বাচ্চাদের থেকে আশা করেন, ঠিক সেই ব্যবহারই বড়োদের বাচ্চাদের সঙ্গেও করা উচিত।

যদি বড়োরা ভাবেন নিজেদের সন্তান সকলের সঙ্গে ভালো ব্যবহার করুক, তাহলে বড়োদেরও কর্তব্য বাচ্চার সামনে সকলের সঙ্গে ভালো ব্যবহার করা। কখনও কারও সঙ্গে চেঁচিয়ে কথা বলা উচিত নয় এবং অপ্রীতিকর শব্দও ব্যবহার করা বাঞ্ছনীয় নয়। আসল কথা হল বাচ্চারা একতাল নরম মাটির মতো। তার চিন্তাধারা, তাকে সঠিক রাস্তায় পরিচালনা করার দায়িত্ব অভিভাবকদের। এর মধ্যে বাচ্চার খাওয়াদাওয়ার অভ্যাস থেকে শুরু করে সবার সঙ্গে তার ব্যবহার কী হবে– সবই গুরুত্বপূর্ণ। এই সময়ের মধ্যে বাচ্চা যে-শিক্ষা পেয়ে বড়ো হবে, সারা জীবন সেটাই সে অবলম্বন করে চলবে। ভালোবাসা এবং শাসনের মধ্যে কী প্রভেদ সেটাও এই সময়ে বাচ্চারা ধীরে ধীরে শেখে।

খাওয়াদাওয়ার অভ্যাস

৫ বছর বয়সের মধ্যে বাচ্চাকে দুধ ছাড়াও অন্যান্য পুষ্টিকর খাবার খাওয়ার অভ্যাসও ধীরে ধীরে করাতে হয়। বাড়ির তৈরি সব খাবারই এইসময় একটু একটু করে খাওয়াবার অভ্যাস করানো উচিত। সবুজ শাকসবজি, মরশুমি ফল, বাচ্চার মস্তিষ্ক গঠনের সঙ্গে সঙ্গে মানসিক ও শারীরিক ভাবে শিশুকে সুস্থ রাখতেও খুবই প্রয়োজন। বড়োরা নিজেদের কাজ বাঁচাবার জন্য বাজার থেকে খাবার কিনেও বাচ্চাকে খাওয়ান। ফলে বাইরের খাবারের প্রতি বাচ্চার আসক্তি জন্মায়। পরে চেষ্টা করলেও তাকে হেলদি খাবারের অভ্যাস করানো সম্ভব হয় না। তাই বাড়ির ভাত, ডাল, রুটি, সবজি, মাছ ইত্যাদির অভ্যাস ছোটো থেকেই বাচ্চাদের করাতে হয়।

সুরক্ষিত পরিবেশ

বাচ্চার সুরক্ষার জন্যে বাড়ির পরিবেশও সুরক্ষিত রাখা খুবই দরকার। যতদিন পর্যন্ত বাচ্চা বড়ো না হয় ততদিন বেছে বেছে বাড়ির আসবাব কেনা উচিত। খুব শার্প কর্নার-যুক্ত অথবা খুব উঁচু আসবাব বাড়িতে রাখা উচিত নয় কারণ প্রায়সই দেখা যায় উঁচু খাট থেকে বাচ্চারা পড়ে গিয়ে শরীরে অথবা মাথায় চোট পায়।

বাচ্চাকে বাড়িতে একলা রেখে বেরোনো কখনও উচিত নয়। ইলেকট্রিক প্লাগ পয়েন্ট টেপ দিয়ে বন্ধ রাখলে বাচ্চা ওর মধ্যে আঙুল ঢোকাতে পারবে না, কারণ জিজ্ঞাসু স্বভাবের জন্যে বাচ্চারা প্লাগ পয়েন্টে হামেশাই আঙুল ঢোকাবার চেষ্টা করে। মোবাইল চার্জার প্লাগ পয়েন্টে লাগিয়ে রেখে চলে যাওয়া উচিত নয়। রান্নাঘরে ধারালো জিনিসপত্র যেমন বঁটি, ছুরি, কাঁচি যেন বাচ্চাদের হাতের বাইরে রাখা থাকে। গ্যাস সিলিন্ডার ব্যবহারের পর রেগুলেটর অফ করে দেওয়াই বাঞ্ছনীয়।

খেলনা এবং বন্ধু

বাচ্চাদের খেলনা কেনার সময় বিশেষ খেয়াল রাখুন। ১ বছরের কম বয়সি বাচ্চারা হাতে যা পায়, মুখে দেবার চেষ্টা করে। এইজন্যে ওদের জন্যে ভালো কোম্পানির খেলনা কিনে দেওয়া উচিত। তাছাড়াও এমন খেলনা হওয়া উচিত যেটাতে বাচ্চাদের কোনওরকম বিপদের সম্ভাবনা থাকবে না। সময় পেলেই বাচ্চাদের পার্কে নিয়ে যান সেখানে স্বাধীনভাবে তাদের খেলতে দিন কিন্তু নিজের চোখের আড়ালে যেতে দেবেন না। স্বাধীনভাবে খেলাধুলো করলে বাচ্চাদের শারীরিক এবং মানসিক বিকাশ Child Development হয়। এছাড়া নিজের বয়সি বাচ্চাদের সঙ্গে পার্কে মেশার এবং বন্ধুত্ব করার সুযোগও হয়, ফলে যে-কোনও কাজ খুব তাড়াতাড়ি শেখে বাচ্চারা। তাছাড়াও দেখা গেছে একা একা বাচ্চারা খেতে না চাইলেও সমবয়সি বন্ধুদের সঙ্গে থাকলে খাওয়া নিয়ে সাধারণত কোনও ঝামেলা বাচ্চারা করে না।

খেয়াল রাখুন

১)   বাচ্চাদের পুষ্টিকর খাবার খেতে দিন। খাবারে মরশুমি ফল এবং সবুজ শাকসবজি রাখুন। এছাড়াও বাচ্চাকে দুধ, দই, ছানা পর্যাপ্ত পরিমাণে দিন।

২)   স্পর্শর মাধ্যমে ওকে বুঝতে দিন যে আপনারা ওকে কতটা ভালোবাসেন। এতে বাচ্চা নিজেকে সুরক্ষিত মনে করবে। বাচ্চার সামগ্রিক বিকাশের জন্যে মানসিক সুরক্ষার অনুভূতি প্রচণ্ড জরুরি।

৩)   বাচ্চার পুরো ঘুম যাতে হয় সেই খেয়াল রাখবেন।

৪)   বাচ্চা যদি বোতলের দুধ খায় তাহলে খেয়াল রাখবেন বোতল যাতে ভালো করে পরিষ্কার এবং স্টেরিলাইজ করা হয়।

৫)   ধারালো এবং ক্ষতি করতে পারে এমন বস্তু বাচ্চার হাতের বাইরে রাখুন।

৬)   বাচ্চাকে নিজের এজ গ্রুপের বাচ্চাদের সঙ্গে মিশতে দিন। তাতে বাচ্চা তাড়াতাড়ি শিখতে পারবে।

৭)   বাচ্চার পোশাক সুতির এবং পরিষ্কার হওয়া উচিত।

৮)   বাচ্চার ছাড়া জামাকাপড় ডেটলে ভিজিয়ে রেখে পরিষ্কার করে কেচে তোলা বাঞ্ছনীয়।

৯)   বাচ্চার মালিশের তেল, শ্যাম্পু, ক্রিম, সাবান ভালো কোম্পানির হওয়া উচিত।

১০)  সুযোগ পেলেই বাচ্চাকে বাড়ির বাইরে ঘুরিয়ে আনুন।

১১)  বাচ্চার সঙ্গে সবসময় কথা বলুন। মুখে বলতে থাকুন আপনি ওকে কতটা ভালোবাসেন।

১২)  যাদের সাথে বাচ্চা কমফর্টেবল ফিল না করে তাদের কোলে বাচ্চাকে তার ইচ্ছার বিরুদ্ধে দেবেন না।

 

আরো গল্প পড়তে ক্লিক করুন...