পিপারিয়া স্টেশনে আমাদের নামিয়ে ট্রেনটা প্ল্যাটফর্ম ছেড়ে চলে যেতেই, প্রায় ফিল্ম স্লাইডের মতো অপরূপ দৃশ্য উন্মেচিত হল চোখের সামনে। এসে পড়েছি মধ্যপ্রদেশের অপরূপ প্রকৃতির মাঝখানে। আমাদের গন্তব্য পাঁচমারি। যশ চোপড়ার ছবির লোকেশনের মতোই মনহরণ করা এক টুরিস্ট ডেস্টিনেশন। বহু নাম শুনেছি মধ্যপ্রদেশের এই সুন্দরীর। এবার চাক্ষুস করার পালা। সাতপুরার রানিকে দেখব বলে ভোপাল পৌঁছে ট্রেন ধরেছিলাম পিপারিয়ার। এখান থেকে রিজার্ভ ট্যাক্সি-তে পৌছব গন্তব্যে। সুতরাং দেরি না করে ৩৫০০ ফিট উচ্চতায় ছোট্ট হিল স্টেশন পাঁচমারির সর্পিল পথে ছুটে চলল গাড়ি।
অক্টোবরের শেষ তবু হাড় কাঁপানো ঠান্ডার অনুভূতি তেমন নেই পাঁচমারিতে। বরং ভারি মনোরম আবহাওয়া। বাজার অঞ্চলে একটিই বাঙালির দোকান এবং সেখানে সেদ্ধ চালের ভাত পর্যন্ত পাওয়া যায়। পরদিন আমাদের সাইটসিয়িং-এর পালা শুরু। গাড়ি ভাড়া করে প্রথমেই হান্ডি কোহ। ভেবেছিলাম হাড়ির মতো দেখতে কোনও প্রপাত। তা একেবারেই নয়। নদীর খাত আর জঙ্গুলে পরিবেশ ঘেরা জায়গাটিতে ব্রিটিশ জমানায় কোনও এক ‘অ্যান্ডি সাহেব’ নাকি আত্মহত্যা করেছিলেন। সেই থেকেই এই নামকরণ।
পরের গন্তব্য জটাশংকর। গুহা মন্দিরের দেবতা শিব। স্ট্যালাকটাইট পাথরের খণ্ড, শিবলিঙ্গের আকার নিয়েছে, তিনিই দেবতা রূপে পূজিত। একটি ছোটো জলাধার যার নাম জম্বুদ্বীপ— তার উৎস এখানেই। পাঁচমারির অন্যতম আকর্ষণ পাণ্ডবগুহা। কথিত আছে এটাই নাকি একসময় পাণ্ডবদের আশ্রয়স্থল ছিল।
এবার গাড়ি গিয়ে পৌঁছল রজত জলপ্রপাত। সিলভার ফলস নামেই এটি খ্যাত। জঙ্গলে ছায়াময় পাহাড়ি পথ দিয়ে একটু এগোলেই চোখে পড়বে পাঁচটি কুণ্ড— যা দ্রৌপদী কুণ্ড নামে খ্যাত। শুনেছিলাম পাঁচমারি এলে অপ্সরা বিহার জলপ্রপাত না দেখে ফেরা উচিত নয়। কথাটার সত্যতা অনুভব করলাম ওই অপূর্ব প্রপাতের সামনে দাঁড়িয়ে। ব্রিটিশ শাসনকালে নাকি সাহেব-মেমদের অতি প্রিয় হ্যাংআউট ছিল এই প্রপাত। এখানে তারা জলকেলি করতেন। আরও একটি জনপ্রিয় জলপ্রপাত হল যমুনা প্রপাত বা বি ফলস। এটা ফোটোগ্রাফারদের পছন্দের জায়গা। প্রাণ ভরে ছবি তুলুন এই প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের।
পরের দিনটা আমরা রেখেছিলাম ডাচেস ফলস-এ ট্রেকিং-এর জন্য। সবুজ বনস্থলির মধ্যে দিয়ে ৪ কিলোমিটার ট্রেক। তারপর দেখা মেলে এক অপরূপ ঝরনার। এটি সাতপুরা ন্যাশনাল পার্ক-এর অন্তর্গত। অগ্রিম পারমিট সংগ্রহ করে ঘুরে নেওয়া যায় এই সংরক্ষিত বনাঞ্চল।
পরেরদিন সূর্যোদয় দেখতে আমরা বেছে নিলাম প্রিয়দর্শিনি পয়েন্ট। বিকেলটা অবশ্যই বরাদ্দ ছিল ধূপগড়ে সূর্যাস্ত দেখার জন্য। ৪৪২৯ ফিট উচ্চতায় দাঁড়িয়ে সাতপুরা রেঞ্জের ওপারে সূর্য ডোবা দেখতে অপার্থিব লাগে। গাড়ি যত উপরে উঠবে, ততই ঠান্ডা হাওয়ার কাঁপুনি টের পাবেন শরীরে।
আজ আমাদের ফেরার দিন। তবু আসার আগে গুপ্ত মহাদেব দেখার লোভ সামলাতে পারলাম না। পাতা পড়ার শব্দ পাওয়া যায়, এতটাই নির্জন এই জায়গা। অদ্ভুত বনজ সৌন্দর্যে ঘেরা। গুহার মধ্যে শিবলিঙ্গ আর গুহার দেয়াল বেয়ে কোনও এক অজানা উৎস থেকে গড়িয়ে নামছে জল। গুহাপথ পেরিয়ে বেরিয়ে আসতে আসতে মনে হল, পাঁচমারি আসা সার্থক। এক ভিন্ন ভ্রমণের স্বাদে ঝুলি ভরে দিল, পাহাড়-পরি পাঁচমারি।