বর্ষাকে আমরা প্রাণভরে স্বাগত জানাই কারণ প্রচণ্ড গরমের দাবদাহ থেকে মানুষ, প্রাণী এবং প্রকৃতির মুক্তির এটাই একমাত্র বিকল্প। প্রকৃতির সৌন্দর্য বর্ষাতেই হয়ে ওঠে মনোরম। চারিদিক ভরে যায় সবুজে। তপ্ত, ঝলসানো গ্রীষ্মের প্রকৃতি যেন হঠাৎই রূপ বদলায় বর্ষায়।
বর্ষাকাল যেমন সঙ্গে করে আনে শরীর জুড়োনো ঠান্ডার পরিবেশ তেমনি এই মরশুমেই নানা ধরনের অসুবিধারও সম্মুখীন হতে হয় আমাদের। সবথেকে অসুবিধা হয় খাবার এবং খাদ্যবস্তু স্টোর করা নিয়ে। এই সময়ে খুব সহজেই খাবার খারাপ হয়ে যাওয়ার সমস্যা তৈরি হয়।
বর্ষায় বাতাসে হিউমিডিটি-র পরিমাণ প্রচুর বেড়ে যায়। হিউমিড ক্লাইমেট খুব তাড়াতাড়ি খাদ্যবস্তুতে পচন ধরায়। খাবারে উপস্থিত মাইক্রো-অর্গ্যানিজম, পোকামাকড় ইত্যাদি খাবারকে তাড়াতাড়ি খারাপ করে। মাইক্রো-অর্গ্যানিজম বলতে বোঝায় ব্যাকটেরিয়া, ইস্ট, মোল্ড ইত্যাদি যেগুলি খাবার খারাপ করতে সাহায্য করে। এদের সংখ্যা বৃদ্ধির উপযুক্ত সময়ই হল স্যাঁতসেতে মরশুম। খাবার সংরক্ষণের পদ্ধতি জানা থাকলে সময়মতো সুস্বাদু খাবারের অভাব হবে না। অল্প একটু কেয়ার এবং সঠিক খাবার স্টোর করার উপায় জানলে, খাদ্যসামগ্রী পচবার অথবা খারাপ হয়ে যাওয়ার হাত থেকে মুক্তি পাওয়া সম্ভব।
নানা ধরনের ডাল এবং হোলগ্রেনস স্টোর করার উপায় –
বর্ষার মরশুমে ডাল এবং রাজমা, ছোলা, বিনস ইত্যাদি খাদ্যসামগ্রী খুব তাড়াতাড়ি খারাপ হয়ে যাওয়ার ভয় থাকে। কী উপায়ে বর্ষাকালেও এগুলি তরতাজা রাখা যায় তারই কিছু টিপস এখানে দেওয়া হল।
১) মাইক্রোওয়েভ প্রুফ কাচের পাত্রে ডাল রেখে ২ থেকে ৩ মিনিট মাইক্রোওয়েভ করে নিন। ঠান্ডা করে এয়ারটাইট পাত্রে স্টোর করে রাখুন।
২) মোটা পাতের পাত্রে ডাল নিয়ে অল্প আঁচে রাখুন। কিছুক্ষণ পরপরই ডালটা নাড়াতে থাকুন। এভাবে পুরো ডাল হালকা রোস্ট হয়ে গেলে নামিয়ে ঠান্ডা হতে দিন। পুরো প্রক্রিয়াটিতে সময় লাগবে ৫ থেকে ৭ মিনিট। ঠান্ডা হয়ে গেলে স্টোর করুন এয়ারটাইট পাত্রে।
৩) যে-ডাল অঙ্কুরিত অবস্থায় খেতে চান, সেটি মাইক্রোওয়েভ অথবা রোস্ট করবেন না। যেমন গোটা মুগডাল। বাজার থেকে ডালের প্যাকেট কিনে, ফ্রিজে প্যাকেটশুদ্ধু ঢুকিয়ে রাখুন।
৪) অঙ্কুরসমেত খাওয়ার জন্যে যে-খাদ্যসামগ্রী আপনি রাখতে চান, তাতে বোরিক পাউডার মিশিয়ে রাখুন। তবে ব্যবহারের সময় বারবার ধুয়ে নিতে কোনওমতেই যেন ভুল না হয়।
৫) এক মুঠো শুকনো নিমপাতা অথবা শুকিয়ে নেওয়া হলুদ, চালে অথবা হোলগ্রেন-এর মধ্যে রেখে দিলে খাদ্যসামগ্রীগুলি খারাপ হবে না। চালের মধ্যেও বোরিক পাউডার মিশিয়ে রাখা যায়।
৬) ময়দা, বেসনে যদি তেজপাতা রেখে দেওয়া হয়, তাহলে এগুলি ময়েশ্চার ফ্রি থাকবে।
৭) বরবটির দানা, ছোলা, কাবুলি মটর ইত্যাদি ফ্রিজে রাখুন অথবা বোরিক পাউডার দিয়ে স্টোর করুন।
সুজি, দালিয়া, বেসন ইত্যাদি খাদ্যসামগ্রীর বর্ষাকালে বিশেষ খেয়াল রাখা জরুরি। বর্ষায় ফাংগাস ও ব্যাকটেরিয়া আক্রমণ করে বেশিরভাগ খাদ্যবস্তুকে। এগুলি ৫-৭ মিনিট রোস্ট করে অথবা মাইক্রোওয়েভ করে নিন, যাতে এর থেকে ময়েশ্চার সম্পূর্ণভাবে চলে যায়। ঠান্ডা হয়ে গেলে এয়ারটাইট কনটেনার-এ স্টোর করে রাখুন। এগুলি বাইরেও রাখতে পারেন কিন্তু যদি ফ্রিজে রেখে দেন, তাহলে অনেক বেশি সময় খাদ্যসামগ্রীগুলি ফ্রেশ থাকবে। মাইক্রোওয়েভ-এর সাহায্যে ময়েশ্চার সম্পূর্ণভাবে বেরিয়ে যাওয়ার পর যদি ফ্রিজ-এ জিনিসটি রেখে দেওয়া যায় তাহলে খাবারে ব্যাকটিরিয়াল গ্রোথ বন্ধ করা যাবে, ফলে খাবারও সহজে খারাপ হবে না।
মশলাপাতি কীভাবে স্টোর করবেন?
মশলা ছাড়া ভারতীয় রান্নার কথা ভাবাই যায় না। রান্নার অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ হল বিভিন্ন রকমের মশলা। রান্নায় বিশেষ স্বাদ আনতে ভারতীয়রা মশলা ব্যবহার করেন। বর্ষায় মশলা ফ্রেশ রাখা বেশ কঠিন কাজ।
কীভাবে ব্যবহারের জন্য মশলা ফ্রেশ রাখবেন
১) তেঁতুল রোদে শুকিয়ে নিয়ে নুন দিয়ে মাখিয়ে এয়ারটাইট পাত্রে বর্ষার জন্য স্টোর করে রাখুন।
২) শুকনোলংকা ১ মিনিটেরও কম যদি মাইক্রোওয়েভ করে নেন তাহলে খারাপ হবে না।
৩) বর্ষার সময়টায় প্রায়ই দেখা যায় শুকনোলংকার গুঁড়োর উপর একটা সাদা রঙের লেয়ার পড়ে যায়। এটি একধরনের ফাংগাল গ্রোথ এবং এটি যদি খাবারের সঙ্গে পেটে চলে যায় তাহলে খুবই ক্ষতিকারক। এটা থেকে বাঁচতে, শুকনোলংকার গুঁড়োর মধ্যে কয়েকটি লবঙ্গ দিয়ে রাখলেই ফাংগাল গ্রোথ হবে না। এতে লংকার গুঁড়ো ফ্রেশও থাকবে এবং দলাও পাকাবে না অতিরিক্ত ময়েশ্চার-এর জন্য।
৪) গোলমরিচ, এলাচ, আস্ত জিরে এবং ধনের মধ্যে শুকনো তেজপাতা দিয়ে রাখুন।
৫) বর্ষার হিউমিড ক্লাইমেট-এ নুন দলা পাকিয়ে যায়। এর থেকে বাঁচতে নুনের মধ্যে কয়েকটি লবঙ্গ দিয়ে রাখুন। নুন ঝরঝরে থাকবে।
৬) গুঁড়ো করা মশলা এয়ারটাইট পাত্রে স্টোর করে ফ্রিজের ভিতরে রেখে দিলে অনেকদিন পর্যন্ত ভালো থাকবে।
শাকসবজি কীভাবে ফ্রেশ রাখবেন?
ফুলকপি, গাজর, বিনস, বাঁধাকপি, ক্যাপসিকাম ইত্যাদি সবজি খবরের কাগজে মুড়ে একটি প্লাস্টিক-এর ব্যাগে অথবা জিপার ব্যাগে করে ফ্রিজ-এ রাখুন। খবরের কাগজ ময়েশ্চার শুষে নিয়ে সবজি ফ্রেশ রাখতে সাহায্য করে। তিনদিন অন্তর খবরের কাগজ বদলে ফেলবেন যাতে আরও বেশিদিন সবজি তরতাজা থাকে।
পালংশাক, স্যালাড-এর পাতা, মেথিশাক, ধনেপাতা, পুদিনাপাতা ইত্যাদি এয়ারটাইট পাত্রে রেখে ফ্রিজ-এ স্টোর করুন। পাত্রটির মধ্যে রাখার আগে পাত্রের নীচে খবরের কাগজ বিছিয়ে উপরে ওগুলি রাখুন। উপরটাও একটা খবরের কাগজ দিয়ে ঢেকে দেবেন। তারপর ঢাকনা বন্ধ করুন। এভাবে স্টোর করতে পারলে ১ সপ্তাহ এই শাকপাতাগুলি টাটকা রাখা যাবে। মেথিশাক এবং পুদিনাপাতা রোদে শুকিয়ে নিয়েও অনেকদিনের জন্য স্টোর করা যায়।
চিনি কীভাবে স্টোর করবেন?
বর্ষাকালে আবহাওয়ায় প্রচুর ময়েশ্চার থাকার জন্যে, চিনি খুব তাড়াতাড়ি ময়েশ্চার টেনে নেয়। চিনির পাত্রের ঢাকনা একটু খোলা রাখলেই চিনি স্যাঁতসেঁতে হয়ে দলা পাকিয়ে যায়। ফ্রি ফ্লোয়িং ব্যাপারটা থাকে না। কয়েকটি লবঙ্গ যদি চিনির পাত্রে রেখে দেওয়া যায় তাহলে চিনিতে ময়েশ্চার ঢুকবে না এবং চিনিও ভালো থাকবে।
বিস্কিট, নিমকি ইত্যাদি মুচমুচে জিনিস স্টোর করতে
বর্ষার মরশুমে প্যাকেট খুললেই বিস্কিট, ওয়েফার, আলুর চিপস, নিমকি ইত্যাদি খাবারের মুচমুচে ভাব হারিয়ে যায়। মুচমুচে ভাব বজায় রাখতে গেলে, খোলা প্যাকেটের মুখ আটকে ফ্রিজ-এ রেখে দিন।
এই কয়েকটি সোজা এবং ঘরোয়া পদ্ধতি মেনে চললেই, বর্ষাকালেও তাজা খাবারের স্বাদ বাড়িতে বসেই গ্রহণ করতে পারবেন।