‘তোদের ধারণা, খুনটা তা হলে তারক করেনি।’ প্রশ্নটা করল কালকেতু।জয়ন্তনারায়ণ বলল, ‘পুরোনো কেস হিস্ট্রি ঘেঁটে তো আমারও তাই মনে হল। ওর মুখ থেকে পুরো ঘটনাটা শুনলে, তোরও তাই মনে হবে।’সমর্থন করল রাহুল, ‘বেচারি সাড়ে চার বছর ধরে জেলে। মাঝে মাঝে আমার এই অফিসে ডাস্টিংয়ের কাজ করতে আসে। তখন কথা বলে দেখেছি, অত্যন্ত নিরীহ টাইপের। দশ বছরের চাকরিতে ভাই প্রচুর ক্রিমিনাল দেখেছি। সেই অভিজ্ঞতা থেকে বলতে পারি, তারক খুন করতে পারে না। কেসটা তুই নিবি কালকেতু? দ্যাখ না, ওকে বাঁচাতে পারিস কি না?’

জয়ন্তনারায়ণ বলল, ‘আলিপুরের ফাস্ট ট্র্যাক কোর্টে যে ল’ইয়ার তারকের হয়ে দাঁড়িয়েছিল, সে আমার খুব পরিচিত। কেস রিলেটেড কাগজপত্তর যা ওর কাছে আছে, সেগুলো আমাকে দেবে বলেছে। ওর মুখে যা শুনেছি, তাতে আমার মনে হয়, তুই ইনভেস্টিগেট করলে, তারককে বের করে আনা যাবে।’রাহুল বলল, ‘আমাদের এই জেলে আগে যিনি ওয়েলফেয়ার অফিসার ছিলেন, তারকের কেসটা তিনি লিগ্যাল এইড-এর কাছে রেফার করেছিলেন। হাইকোর্টে আপিলও করা হয়েছিল। কিন্তু যা হয়, চার বছর ধরে ধামাচাপা পড়ে আছে। একটু খোঁচাখুঁচি করা দরকার।’

কালকেতু বলল, ‘তারকের সঙ্গে কি একবার কথা বলা যাবে?’‘সার্টেনলি। ওকে ডেকে পাঠিয়েছি। এই এল বলে। ততক্ষণে চা খেয়ে নে।’দমদম সেন্ট্রাল জেল সুপারের অফিস ঘর। বসে কথা বলছে ওরা তিনজন। রাহুলের সঙ্গে কালকেতুর অনেক দিনের বন্ধুত্ব। একটা সময় ওরা একই স্কুলে পড়ত। কালকেতু এখন বহুল প্রচারিত একটা খবরের কাগজের সাংবাদিক। সুযোগ পেলে সেইসঙ্গে গোয়েন্দাগিরিও করে। আর কারেকশনাল সার্ভিসেসে চাকরি নিয়ে রাহুল এখন দমদম সেন্ট্রাল জেলের সুপার। আসানসোল থেকে বদলি হয়ে এখানে এসেছে।

জয়ন্তনারায়ণ কলকাতা হাইকোর্টের ল’ইয়ার। ও লিগ্যাল এইড-এর সঙ্গেও যুক্ত, বিনা পয়সায় যারা আইনি পরামর্শ দেয়। সাজাপ্রাপ্ত আসামিদের মধ্যে যারা সুবিচার পায়নি, জয়ন্তনারায়ণরা তাদের পাশে গিয়ে দাঁড়ায়। খবরের কাগজে প্রায়ই ওর নাম বেরোয়। টিভিতে ওকে দেখা যায়। আর সেইসূত্রেই কালকেতুর সঙ্গে ওর আলাপ। সমবয়সি বলে ওদের দু’জনের মধ্যেও বন্ধুত্ব হয়ে গিয়েছে। কোর্টে আইনি লড়াই করতে নামার আগে জয়ন্তনারায়ণ মাঝে মাঝেই কালকেতুর সাহায্য নেয়।

গত বছর এই দমদম সেন্ট্রাল জেল থেকেই ওরা দু’জন ছাড়িয়ে নিয়ে গিয়েছিল স্ট্যালোন ওরফে রণজয় মিত্র বলে এক সাজাপ্রাপ্তকে। বহরমপুরে একটা বাচ্চা মেয়েকে কিডন্যাপিং আর খুনের অভিযোগে স্ট্যালোনের সাজা হয়েছিল। আড়াই বছর বাদে সেই কেসটা হাতে নিয়ে নতুনভাবে তদন্তে নেমেছিল কালকেতু। চার্জশিটে অনেক গরমিল বের করেছিল। তারপর আইনি লড়াইটা হাইকোর্টে লড়ে জয়ন্তনারায়ণ। আসল খুনি শেষ পর্যন্ত ধরা পড়ে।

জয়ন্তনারায়ণ প্রায়ই বলে, ‘আইনের ফাঁক দিয়ে যদি কোনও অপরাধী ছাড়া পেয়ে যায়, তা হলে ক্ষতি নেই। কিন্তু, কোনও নির্দোষ লোক যেন শাস্তি না পায়।’ এই কারণেই তারক চক্রবর্তীর কেসটা হাইকোর্টে ও লড়তে চায়। তাই রহস্য উদ্ধারের জন্য ডেকে এনেছে কালকেতুকে। ষাট বছর বয়সি এক মহিলা… সুজাতা মিত্রকে পুড়িয়ে মারার অভিযোগ তারকের বিরুদ্ধে। হাসপাতালে সেই মহিলা নাকি মারা যাওয়ার আগে জবানবন্দিও দিয়ে যান পুলিশের কাছে। সেটাই বড়ো প্রমাণ হয়ে দাঁড়ায় তারকের বিরুদ্ধে। মামলা চলার সময় তারক নাকি বারবার বলেছিল, ও নির্দোষ। কিন্তু, আলিপুরে ফাস্ট ট্র্যাক কোর্টের জজসাহেব ওর কথা শোনেননি। তিনি লাইফ সেনটেন্স দেন।

চায়ে চুমুক দেওয়ার ফাঁকে রাহুল বলে উঠল, ‘এই তো… তারক এসে গিয়েছে।’

মুখ ফিরিয়ে কালকেতু দেখল, সাতাশ-আঠাশ বছর বয়সি একটা ছেলে ঘরে এসে দাঁড়িয়েছে। অত্যন্ত কুণ্ঠিত গলায় সে বলল, ‘আমাকে ডেকেছেন স্যার?’

‘হ্যাঁ।’ রাহুল বলল, ‘তোমার এত দেরি হল যে?’

‘এতক্ষণ ক্যাফেটেরিয়ার স্টক মিলিয়ে দেখছিলাম স্যার।’

‘তাই বলো।’ রাহুল ঘাড় ঘুরিয়ে বলল, ‘জানিস কালকেতু, আমাদের জেলের ভিতর একটা ক্যাফেটেরিয়া আছে। সাজাপ্রাপ্তরা কো-অপারেটিভ বেসিসে সেটা চালায়। বাইরের ক্যাফেটেরিয়ার মতো এখানেও সব নামি ব্র্যান্ডের খাবার কিনতে পাওয়া যায়। কনভিক্টরা জেলে খাটাখাটনির জন্য যা রোজগার করে, সেই টাকা দিয়ে ক্যাফেটেরিয়ায় খাবার কিনে খায়। পরে তোকে সেখানে নিয়ে যাব। এখন চট করে তুই তারকের সঙ্গে কথা বলে নে। একটু পরে ওদের গুনতি শুরু হবে। ওকে হাজিরা দিতে হবে সেখানে।’

রাহুল পরিচয় করিয়ে দেওয়ার পর কালকেতু সরাসরি জিজ্ঞেস করল, ‘সুজাতা মিত্রকে তা হলে তুমি খুন করনি, তারক?’উত্তর দিতে কয়েক সেকেন্ড সময় নিল ছেলেটা। নিজেকে গুছিয়ে নিয়ে বলল, ‘না স্যার। উনি ছিলেন আমার মায়ের মতো। ওনাকে মা, আর ওনার হাজবেন্ডকে বাবা বলে ডাকতাম। ওনাকে আমি খুন করব কেন?’

‘সুজাতা মিত্রকে কতদিন ধরে চিনতে?’

‘বছর দশেক তো বটেই। তখন গড়িয়াহাটের মোড়ে একটা নামি শাড়ির দোকানে আমি সেলস ম্যানের চাকরি করতাম। আমার আদত বাড়ি বড়ো জাগুলিয়ায়। সেখান থেকে রোজ যাতায়াতের অসুবিধে হতো। তাই টালিগঞ্জে ওনাদের বাড়িতে একটা ঘর আমি ভাড়া নিয়েছিলাম।’

‘তুমি কি তখন একাই থাকতে?’‘হ্যাঁ স্যার। ওনাদেরও কোনও সন্তান ছিল না। বয়স্ক দুটো মানুষ, আপদ-বিপদে আমাকেই ওনারা ডাকতেন। আমিও যথাসাধ্য করতাম। রোজ সকালে বাজার করে দিতাম। ব্যাংক থেকে টাকা তুলে আনতাম। বাবা মাঝে মাঝে অসুস্থ হয়ে পড়তেন। তখন আমাকেই ডাক্তার ডেকে আনতে হতো। ওনারা আমাকে খুব বিশ্বাস করতেন স্যার। আমাকে সন্তানের মতো দেখতেন।’

‘বাড়িতে আর কে কে থাকতেন?’‘ওনাদের অংশে আর কেউ থাকতেন না। আলাদা পোর্শনে ওনাদের জ্ঞাতিরা অনেকে ছিলেন। তেনাদের সঙ্গে সম্পক্ব ভালো ছিল না। মাঝে মাঝেই তেনারা উৎপাত করতেন। আমাকেও তেনারা ভালো চোখে দেখতেন না। জ্ঞাতিরা চাইতেন, ভাড়া ছেড়ে আমি যেন উঠে যাই। বাবার এক ভাইপো… তার নাম নান্টু, আমাকে ভয় দেখিয়েছিল, জানে মেরে দেবে।’

‘তা সত্ত্বেও, তুমি থেকে গেলে কেন?’‘হয়তো চলে যেতাম। কিন্তু, বাবা মারা যাওয়ার মাস ছয়েক আগে মা জোর করে আমার বিয়ে দিলেন। আমার বউ ছন্দা খুব সুন্দরী। ভয় পেতাম, সারাদিন আমি দোকানে কাটাই। বউকে অচেনা জায়গায় নিয়ে গিয়ে তুললে হয়তো আরও বিপদে পড়ব। তা ছাড়া, তখন ছন্দাকে নিয়ে বেরিয়ে এলে মা-বাবা খুব কষ্ট পেতেন। ওনারা ছন্দাকেও খুব ভালোবাসতেন।’

‘তোমার স্ত্রীকে কি সুজাতা মিত্রই পছন্দ করে এনেছিলেন?’‘হ্যাঁ স্যার। বোড়ালের এক কালী মন্দিরে মা প্রায়ই যেতেন। সেখানে প্রথম উনি ছন্দাকে দেখেন। আলাপ হওয়ার পর মা জানতে পারেন, ছন্দা খুব দুঃখী মেয়ে। মামা ছাড়া ওর আর কেউ নেই। সেই মামাও ওকে দু’বেলা খেতে দেন না। আমার সঙ্গে বিয়ে দেওয়ার কথা তখনই মায়ের মাথায় খেলে যায়।’

‘সুজাতা মিত্রের আত্মীয়রা তোমাকে উৎখাত করতে চেয়েছিলেন কেন?’‘স্যার, বাবা একদিন আমাকে বলেছিলেন, আমরা আর কদ্দিনই বা বাঁচব। তোরা দু’জন আমাদের জন্য এত করিস… আমরা ভাবছি, তোরা যে-ঘরটায় থাকিস, সেটা তোদের দান করে দেব। প্রথমে না না করেছিলাম। কিন্তু, ওনারা জোরাজুরি করতে থাকায়, ছন্দাই আমাকে পরামর্শটা দিয়েছিল। ঘর যদি দেওয়ার ইচ্ছেই ওনাদের থাকে, তা হলে লেখাপড়া করে দিতে বলো। যেন ঘরটা আমরা ওনাদের থেকে কিনে নিয়েছি। শুনে মা আর বাবা তাতেই রাজি হয়ে গেলেন। উকিল মারফত লিখেও দিয়েছিলেন। এ কথা কানে যাওয়ার পর থেকে ওনাদের জ্ঞাতিরা আমার উপর আরও চটে যান। এরপর বাবা হার্টফেল করে মারা গেলেন। তারপর মা আমাকে ডেকে বললেন, ‘তোদের আর আলাদা রান্না করে খেতে হবে না। ছন্দাকে বল, আমার হেঁসেল সামলাতে।

‘বাড়িতে তোমার মায়ের কাছে আর কেউ যাতায়াত করত?’‘বাইরের লোক বলতে আসত মোল্লার বস্তি থেকে মন্টির মা। বাসন মাজা, ঘর-দোর পোঁছা, মাকে রান্নায় সাহায্য করা… এইসব কাজ করত। আর মায়ের এক বোনঝি, নাম জানি না।’

‘তোমার কি মনে হয়, জ্ঞাতিদেরই কেউ ষড়যন্ত্র করে তোমাকে ফাঁসিয়েছে?’‘আমি জানি না স্যার।’‘সুজাতা মিত্র যেদিন খুন হন, সেদিন তুমি কোথায় ছিলে তারক?’‘আগের দিন আমি আর ছন্দা তারাপীঠে গিয়েছিলাম। অনেক রাতে ভিজতে ভিজতে আমরা বাড়ি ফিরেছিলাম। কেন-না, সেদিন মারাত্মক বৃষ্টি হচ্ছিল। তাই দোতলায় উঠে মাকে আর আমরা ডিসটার্ব করিনি।

ভোরবেলায় হঠাৎ আমার ঘরের দরজায় দুমদাম শব্দ। কারা যেন লাথি মেরে ভেঙে ফেলার চেষ্টা করছেন। আমার আগে ছন্দার ঘুম ভেঙে গিয়েছিল। জানলা অল্প ফাঁক করে ও দেখে, পাড়ার প্রচুর লোক জড়ো হয়ে গালাগাল দিচ্ছেন আমার নামে। আমি নাকি গায়ে কেরোসিন ঢেলে মাকে মেরে ফেলেছি। ছন্দা দরজা খুলে দিতেই উনারা বাইরে বের করে নিয়ে গিয়ে আমাকে মারতে শুরু করলেন। মারের চোটে আমি অজ্ঞান হয়ে গেছিলাম।’

‘তোমার মা ঠিক কীভাবে মারা যান?’‘স্যার, রোজ ভোরবেলায় ঘুম থেকে উঠে মা নিজেই স্টোভে চা বানিয়ে খেতেন। সিঁড়ির নীচে রান্না করার একফালি জায়গায়। আমাদের জন্য উনি ওয়েট করতেন না। পরে ছন্দার মুখে শুনেছি, সেদিন জনতা স্টোভ জ্বালাতে গিয়ে মা শাড়িতে আগুন ধরিয়ে ফেলেন। সেইসময় ছন্দাকে ডাকতে ডাকতে জ্বলন্ত অবস্থাতেই উনি বেরিয়ে গিয়ে বাড়ির লাগানো পুকুরে ঝাঁপ দেন। মর্নিং ওয়াক করতে বেরিয়েছিলেন পাড়ার দু’একজন। তেনারা পুকুর থেকে মাকে উদ্ধার করে বাঙ্গুর হাসপাতালে নিয়ে যান। শুনেছি, পরদিন সকালবেলায় মা মারা যান।’

‘তোমার মা মারা যাওয়ার আগে পুলিশকে বলে গিয়েছিলেন, তুমি নাকি ওঁর গায়ে কেরোসিন ঢেলে আগুন জ্বালিয়ে দিয়েছিলে?’‘কথাটা সত্যি নয় স্যার। মা ওর’ম কথা বলতেই পারেন না। পুলিশ মিথ্যে মামলা সাজিয়েছে। মার্ডার করার পিছনে একটা কারণ তো থাকবে? চার্জশিটে পুলিশ কিন্তু সেটা বলতে পারেনি। আপনি কাগজপত্তর দেখলেই সব বুঝতে পারবেন। স্যার, আমি শুনেছি আপনি সত্যের জন্য লড়েন। আপনার কাছে একটাই অনুরোধ। স্ট্যালোনকে আপনি যেভাবে বাঁচিয়ে ছিলেন, আমাকেও সেভাবে বের করে নিয়ে যান। হাতজোড় করে বলছি।’

‘ছন্দা এখন কোথায়? সে কি তোমার সঙ্গে দেখা করতে আসে?’উত্তর না দিয়ে তারক খানিকক্ষণ মুখ নীচু করে রইল। তারপর বলল, ‘একজন মার্ডারারের সঙ্গে কে আর সম্পক্ব রাখতে চায়, বলুন। প্রথম প্রথম আলিপুর জেলে দু’একদিন ও দেখা করতে এসেছিল। ওর ফ্যামিলির লোকেরা এখন আসতে দেয় না। জানি না, ছন্দা এখন কোথায় আছে?’

বাইরে থেকে চিৎকার করে কারা যেন কী বলছে। শুনে রাহুল বলল, ‘কালকেতু তোর কি আর কিছু জিজ্ঞেস করার আছে? আপাতত তারককে ছেড়ে দে। বন্দিদের গুনতির সময় হয়ে গিয়েছে। তারক, তুমি যাও।’তাড়াহুড়ো করে তারক সিঁড়ি দিয়ে নেমে গেল। হাত ঘড়ির দিকে তাকিয়ে কালকেতু দেখল, প্রায় বারোটা বাজে। বারকয়েক এই জেলে আসার কারণে নিয়মটা ও জানে। জেলে দিনে মোট পাঁচবার গুনতি হয়। এই সময়টায় তৃতীয়বার। ওয়ার্ডাররা মিলিয়ে দেখে নেন, বন্দিদের সবাই হাজির আছে, না কি কেউ পালিয়ে গিয়েছে?

দুই

সকালে খবরের কাগজটা খুঁটিয়ে পড়ছিল কালকেতু। সিঁথিতে এক বয়স্কা মহিলা নমিতা মুখার্জি খুন হয়েছেন। স্বামী অনেকদিন আগে মারা গিয়েছেন। ছেলে-মেয়ে দু’জনেই বিদেশে থাকেন। দোতলা বাড়িতে তিনি একাই থাকতেন। অসুস্থ ছিলেন বলে খুব একটা বাইরে বেরোতেন না। বাড়ি থেকে দুর্গন্ধ বেরোতে দেখে প্রতিবেশীরা পুলিশে খবর দেন।

দরজা ভেঙে ঘরে ঢুকে পুলিশ মৃতদেহ দেখতে পায়। গলা টিপে হত্যা। নমিতা মুখার্জিকে দেখাশুনো করার জন্য প্রায়ই একজন অল্পবয়সি আয়া আসত। পুলিশ তাকে খুঁজছে। বাড়ি থেকে সোনার গয়না আর টাকাপয়সা সব উধাও।গত এক মাসে শহরের দুটো প্রান্তে একই ধরনের খুন। হপ্তা তিনেক আগে সল্টলেকের একটা বাড়িতেও বয়স্ক এক ভদ্রলোক এইভাবে খুন হয়েছিলেন। সেই সমীরণ সাহারও কোনও নিকটাত্মীয় ছিল না। সেই ঘটনাতেও বাড়ির কাজের মেয়েকে খুঁজে পায়নি পুলিশ।

দুটো ঘটনার মধ্যে কোনও যোগসূত্র আছে কি না, তা নিয়ে ভাবছিল কালকেতু। আছে কি না, সেটা নিশ্চিত করে বলতে পারবে তথাগত। ছেলেটা আগে ওদের কাগজেই রিপোর্টারের চাকরি করত। তখন কয়েকটা কেসে কালকেতুকে সাহায্যও করেছে। কিন্তু তথাগত হঠাৎ স্কলারশিপ নিয়ে লন্ডনে চলে যায়। নতুন ধরনের জার্নালিজম শিখে এসেছে। ডেটা জার্নালিজম। একই ধরনের খবর বিশ্লেষণ করে, তারপর ও তথ্য সরবরাহ করে।তথাগতকে ফোন করতে যাওয়ার সময়ই হঠাৎ ডোর বেলের শব্দ। দরজা খুলে কালকেতু দেখে জয়ন্তনারায়ণ দাঁড়িয়ে। হাসিমুখে ও বলল, ‘এসো, এসো। তোমার সঙ্গে আজই আমি কন্ট্যাক্ট করতাম।’

ভিতরে ঢুকে সোফায় বসে জয়ন্তনারায়ণ বলল, ‘কোর্টে যাওয়ার আগে ভাবলাম, তোমার সঙ্গে একবার দেখা করে যাই। তারকের কেসটা নিয়ে কতদূর এগোলে?’‘ইনভেস্টিগেশন শুরু করে দিয়েছি। টালিগঞ্জে গিরিজাপ্রসাদ মিত্র রোডে সুজাতা দেবীর সেই বাড়িতে আমি কাল গিয়েছিলাম। পুরনো বাড়িটা ভেঙে এখন মাল্টিস্টোরিড বিল্ডিং হয়েছে। শুনলাম, সুজাতা দেবীর ভাসুর আর দুই দেওর এক প্রোমোটারের কাছে বাড়ি বিক্রি করে অন্য কোথাও চলে গিয়েছেন।’

জয়ন্তনারায়ণ বলল, ‘তোমার জন্য কিছু ফোটোগ্রাফ আর কাগজপত্তর নিয়ে এসেছি। চার্জশিট, সুরতহালের কপি, ময়না তদন্তের রিপোর্ট এর মধ্যে রয়েছে। দেখলেই বুঝতে পারবে, কত গরমিল আছে। আমার তো মনে হল, ওটা মার্ডার নয়। একটা অ্যাক্সিডেন্ট। সুজাতা মিত্রের আত্মীয়রা তারককে এর মধ্যে জড়িয়ে দিয়ে ফায়দা তুলেছেন। যাতে সম্পত্তির ভাগ ওকে দিতে না হয়।’

সঙ্গে আনা অ্যাটাচি কেস থেকে কিছু কাগজপত্তর আর ছবি বের করল জয়ন্তনারায়ণ। একটা ছবি এগিয়ে দিয়ে তার পর বলল, ‘এই ছবিটা ভালো করে দ্যাখো। সেইদিনই পুলিশের ফোটোগ্রাফার তুলেছিল। মেঝেয় স্টোভটা যেখানে রয়েছে, ঠিক তার চার-পাঁচ ফুট উপরেই দেয়ালে লাগানো তাক দুটো লক্ষ্য কর। একটা তাকে কয়েকটা কাচের বয়ামে চা, চিনি আর নানারকম মশলা রয়েছে। আমার মনে হয়, স্টোভ জ্বালানোর পর উঠে দাঁড়িয়ে… একটু ঝুঁকে সুজাতা মিত্র সম্ভবত তাক থেকে বয়াম নামাতে চেয়েছিলেন। সেইসময়ই শাড়ির আঁচলে কোনওভাবে আগুন লেগে যায়। বাড়ির সবাই তখন ঘুমিয়ে। ডাকলে কারও সাহায্য পেতেন না। সুজাতা মিত্র তাই দৌড়ে পুকুরে ঝাঁপিয়ে আগুন নেভাতে চেয়েছিলেন।’

সাত-আটটা ছবি সেন্টার টেবিলে সাজিয়ে দিল জয়ন্তনারায়ণ। একটা একটা করে তুলে খুঁটিয়ে ছবিগুলো দেখতে লাগল কালকেতু। একটা ছবিতে কেরোসিনের বোতলের দিকে ওর নজর গেল। প্রায় ভর্তিই রয়েছে। কেউ যদি সুজাতা মিত্রের গায়ে কেরোসিন ঢেলে পুড়িয়ে মারার চেষ্টা করতেন, তা হলে বোতলটা ভর্তি থাকত না। কথাটা মনে হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে কালকেতু বলল, ‘তোমার ধারণাই ঠিক। ভদ্রমহিলার গায়ে আগুন অন্য কোনওভাবে লেগেছিল।’

উৎসাহ পেয়ে জয়ন্তনারায়ণ বলল, ‘গায়ে কেরোসিন ঢেলে কাউকে খুন করা হলে মেঝেতে অথবা দেয়ালে কেরোসিনের গন্ধ বা চিহ্ন পাওয়া যেত। সুরতহাল রিপোর্টে কিন্তু তার কোনও উল্লেখ নেই। অর্থাৎ কিনা, গন্ধ পাওয়া যায়নি। ভদ্রমহিলার ডাইং স্টেটমেন্ট নিয়েও আমার সন্দেহ আছে। ডাক্তারের রিপোর্টে সিক্সটি পার্সেন্ট বার্ন-এর কথা লেখা আছে। যতক্ষণ উনি বেঁচেছিলেন, দু’ঘন্টা অন্তর ডাক্তার নাকি ওঁকে পেথিড্রিন ইঞ্জেকশন দিয়েছিলেন। ওঁর মুখে অক্সিজেন মাস্কও ছিল। তা হলে উনি ডাইং স্টেটমেন্টটা দিলেন কখন এবং কীভাবে? তখন তো ওঁর ঘুমের ঘোরে থাকার কথা। কথা বলার অবস্থায় উনি থাকতেই পারেন না।’

কালকেতু বলল, ‘বাঙ্গুর হাসপাতালে গিয়ে সেই ডাক্তার… অরিন্দম বসুর খোঁজ করেছিলাম। উনি ট্রান্সফার হয়ে এখন বেহালার বিদ্যাসাগর হাসপাতালে। সেখানে গিয়ে দেখা করেছিলাম। বয়স্ক ভদ্রলোক বারবারই বলতে লাগলেন, সাড়ে পাঁচ বছর আগেকার ব্যাপার। কিছুই নাকি তাঁর মনে নেই। ওঁর বডি ল্যাঙ্গুয়েজ দেখে আমার কিন্তু মনে হল, উনি কিছু লুকোতে চাইছেন।’

‘কেসটা হাইকোর্টে রিওপেন হোক, তারপর দেখব, উনি লুকোন কী করে? কাঠগড়ায় তুলে এমন রগড়ানি দেব, সব খুলে বলতে বাধ্য হবেন।’

‘আরও শোনও, টালিগঞ্জ থানার যে-ইনভেস্টিগেটিং অফিসার তারককে অ্যারেস্ট করেছিলেন, সেই সুজয় রাফতান এখন সিঁথি থানার ওসি। আমি রিপোর্টার শুনে, ভদ্রলোক প্রথমে অ্যাভয়েড করছিলেন। পরে অবশ্য অনেকক্ষণ কথা বলার পর স্বীকার করলেন, উনি চার্জশিট দেননি। শেষ মুহূর্তে কেসটা তাঁর হাত থেকে নিয়ে সিনিয়র এক অফিসারকে দেওয়া হয়েছিল। নাম দিব্যেন্দু গাঙ্গুলি। প্রোমোশন পেয়ে তিনি এখন লালবাজারের ডিডি-তে।

শুনে খানিকটা থমকে গেল জয়ন্তনারায়ণ। তারপর বলল, ‘তা হলে তো এটা অ্যাক্সিডেন্টাল ডেথ হতে পারে না ভাই। কেউ না কেউ ইনফ্লুয়েন্স খাটিয়ে এই চেঞ্জটা করিয়েছেন। কার ইন্টারেস্ট ছিল? অ্যাদ্দিন পর কি তাঁকে ট্রেস করতে পারবে?

হেসে কালকেতু বলল, ‘চেষ্টা তো করবই। তোমার কথাতেই বলি, সত্য কখনও চাপা থাকে না ভাই।’

তিন

 তথাগত-র ফোনের জন্য অপেক্ষা করছে কালকেতু। ফোনটা পেলেই সুজাতা মিত্রের খুনের রহস্য ও উদ্ধার করে ফেলবে। সন্ধে প্রায় সাড়ে ছ’টা। দিনের আলো এখনও পুরোপুরি যায়নি। দমদম সেন্ট্রাল জেলের ক্যাফেটেরিয়ায় ওকে আর জয়ন্তনারায়ণকে কফি খাওয়াতে নিয়ে গিয়েছে রাহুল। ওদের জন্য কফি বানাচ্ছে তারক। কালকেতু ভাবতেও পারেনি, জেলের ভিতর এমন ঝকঝকে একটা ক্যাফেটেরিয়া থাকতে পারে। ঘন্টা খানেক আগে বন্দিদের পঞ্চম ও শেষবারের মতো গুনতি হয়ে গিয়েছে। ফলে সবাই এখন ওয়ার্ডের ভিতরে। কালকেতুরা যখন ক্যাফেটেরিয়ায় ঢোকে, সেইসময়ও সামনের মাঠে বন্দিদের কয়েকজন ফুটবল খেলছিল। এখন একেবারে ফাঁকা।

তারকের আপিলের মামলাটা আজই হাইকোর্টে উঠেছে। শুনানির পর কালকেতুকে সঙ্গে নিয়ে জয়ন্তনারায়ণ এগজিবিটগুলো দেখতে গিয়েছিল। শাড়ির পোড়া অংশ, কেরোসিনের বোতল, ফরেনসিক রিপোর্ট, পুলিশের তোলা আরও কিছু ছবি ওরা খুঁটিয়ে দেখে এসেছে। হাইকোর্ট পাড়া থেকে দমদম ক্যান্টনমেন্টে আসার পথে জয়ন্তনারায়ণ খুশিতে টগবগ করে ফুটছিল। ফরেনসিক রিপোর্ট অনুযায়ী, কেরোসিনের বোতলে সুজাতা মিত্রের ছাড়া আর কারওর আঙুলের ছাপ পাওয়া যায়নি।

তার মানে, ওই বোতল তারক ছোঁয়নি। তাই কেরোসিন গায়ে ঢেলে মেরে ফেলার অভিযোগ উঠতেই পারে না ওর বিরুদ্ধে। আরও বড়ো ব্যাপার, সুজাতা মিত্র যখন মৃত্যুকালীন জবানবন্দি দেন, তখন কোনও ম্যাজিস্ট্রেট হাজির ছিলেন না। সেইসময় ভদ্রমহিলা ফিজিক্যালি ফিট ছিলেন কিনা, তা নিয়ে ডাক্তারের সার্টিফিকেটও এগজিবিটে নেই।মামলা চলার সময় তারকের উকিল এইসব পয়েন্ট কেন তোলেনি, গাড়ি চালানোর সময় জয়ন্তনারায়ণ তা নিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করছিল। ও নিশ্চিত, খুব অল্পদিনের মধ্যেই তারককে জেল থেকে বের করে নিয়ে যেতে পারবে।

ক্যাফেটেরিয়ায় বসে ও সেই কথাই বলতে শুরু করল রাহুলকে। কিন্তু, কালকেতুর মাথায় এখন অন্য চিন্তা ঘুরছে। গত একমাস ধরে তারকের কেসটা নিয়ে ও মারাত্মক খেটেছে। সন্দেহভাজন পাঁচজনের একটা লিস্ট তৈরি করেছিল ও এবং চেনা ছক ধরেই এগোচ্ছিল। কিন্তু, সুজাতা মিত্রের ভাসুর আর দেওরদের সম্পর্কে তথ্য সংগ্রহ করতে গিয়ে, মোল্লার বস্তিতে মন্টির মায়ের কাছে পৌঁছোনোর পর ও একশো আশি ডিগ্রি ঘুরে যায়। আসল অপরাধী কে, মোটামুটি ও তা আন্দাজ করতে পেরেছে। এ ব্যাপারে পরে ওকে খানিকটা সাহায্য করেছেন সিঁথি থানার ওসি সুজয় রাফতান। বাকিটা জানাবে তথাগত।

তারক তিন কাপ কফি বানিয়ে ট্রে-তে করে নিয়ে এসেছে। কফিতে চুমুক দিয়ে রাহুল জিজ্ঞেস করল, ‘তুই কদ্দূর এগোলি রে কালকেতু? ওটা প্রমোটার চক্রের কাজ, তাই না?’কালকেতু বলল, ‘প্রথমে আমারও তাই মনে হয়েছিল। পরে দেখলাম, তা নয়। বাড়িটা কোনও প্রোমোটারের টার্গেট ছিল না। সুজাতা মিত্র মারা যাওয়ার প্রায় এক বছর পর, ওঁর ভাসুরপো নান্টু মিত্রই উদ্যোগ নিয়ে পুরো বাড়িটা বিক্রি করে দেন এক প্রোমোটারকে।’

‘তারকের অংশটা বিক্রি হল কীভাবে?’

‘সেটা জানার জন্যই প্রোমোটার ভদ্রলোকের সঙ্গে আমি দেখা করেছিলাম। উনি আসলে মাছের আড়তদার। ওঁর সাইড বিজনেস প্রোমোটিং করা। তাই টিপিক্যাল প্রোমোটারদের মতো নির্দয় নন। ভদ্রলোক আমাকে সব কাগজপত্তর দেখালেন। ঘরটা তারকের বউ ছন্দার নামে লিখে দিয়েছিলেন সুজাতা মিত্রের হাজব্যান্ড। পাঁচ লাখ টাকায় ছন্দা সেটা বিক্রি করে প্রোমোটারকে। এর ভিতর কোনও কারচুপি নেই। তবে, তারক অবশ্য এখনও ঘর বিক্রির কথা জানে না।’

‘তা হলে ভদ্রমহিলাকে খুন করল কে?’

‘আমার সন্দেহ হয়েছিল আরও দু’জনের উপর। সুজাতা মিত্রের বোনঝি কৃষ্ণা ও তার বয়ফ্রেন্ড দীপক। এদের কথা আমি জানতে পারি মন্টির মা… অর্থাৎ কি না সুজাতা মিত্রের কাজের লোকের কাছ থেকে। চন্দননগর থেকে এরা দু’জন দেখা করতে আসত। সুজাতা মিত্রের নামে পাঁচ লাখ টাকার বিমা করা ছিল। সাত বছরের পলিসি হোল্ডার। উনি নমিনি করে দিয়েছিলেন কৃষ্ণাকে। দীপক ছেলেটার সম্পর্কে খোঁজ করে জানতে পারি, বেকার এবং রাফিয়ান টাইপের। খুনের আগের দিন দুপুরে কৃষ্ণা আর দীপক টালিগঞ্জে এসেছিল। শুনে তাই মনে হয়েছিল, বিমার টাকা পাওয়ার লোভে হয়তো দীপকই খুন করে থাকতে পারে। কিন্তু, পরে জানলাম, খুনের দিন ভোরবেলায় ওরা চন্দননগরেই ছিল।’

জয়ন্তনারায়ণ এতক্ষণ চুপ করে শুনছিল। আর থাকতে না পেরে জিজ্ঞেস করল, ‘তুমি যে সেদিন বললে, ইনভেস্টিগেটিং অফিসার সুজয় রাফতানের হাত থেকে কেসটা নিয়ে অন্য একজনকে দেওয়া হয়েছিল, সেটা কী কারণে? এর পিছনে কার ইন্টারেস্ট ছিল?’

কালকেতু বলল, ‘কারণ একটা ছিল। কিন্তু কারও কোনও ইন্টারেস্ট ছিল না। মনে করে দ্যাখো, এখানে প্রথম দিন তারক আমাদের একটা কথা বলেছিল… ওর বউ ছন্দা খুব সুন্দরী। কী, মনে পড়ছে? তদন্ত করতে গিয়ে সুজয় রাফতান প্রেমে পড়ে গিয়েছিলেন ছন্দার। লাভ অ্যাট ফার্স্ট সাইট বলা যায়।

সুজয়বাবু তখন ব্যাচেলর। অনিশ্চিত ভবিষ্যতের কথা ভেবে ছন্দাও হয়তো খানিকটা এগিয়েছিল। দু’জনকে মাঝে মাঝেই এদিক সেদিক দেখা যাচ্ছিল। থানায় এ কথা জানাজানি হয়ে যাওয়ার পর ওসি কেসটা সুজয়বাবুর হাত থেকে কেড়ে নিয়ে দিব্যেন্দু গাঙ্গুলি বলে অন্য এক এসআইয়ের হাতে দেন। জয়ন্তনারায়ণ, তুমি তো জানো পুলিশের উপর মহলে আমার অনেক জানাশোনা আছে। ওঁদেরই একজন আমাকে এ কথাটা বলেছেন।’

জয়ন্তনারায়ণ আর কী একটা প্রশ্ন করতে যাচ্ছিল, এমন সময় কালকেতুর মোবাইল ফোনটা বেজে উঠল। পর্দায় তথাগতর নাম। হাত তুলে জয়ন্তনারায়ণকে থামিয়ে কালকেতু ফোনে জিজ্ঞেস করল, ‘হ্যাঁ, বল। আমার সন্দেহটা কি ঠিক?’

ওদিক থেকে তথাগতর উত্তেজিত গলা, ‘একদম ঠিক। গায়ত্রী বলে মেয়েটাকে আজ সিঁথির পুলিশ অ্যারেস্ট করেছে।’কালকেতু বলল, ‘ঠিক আছে। এখন ছাড়ি। পরে তোর সঙ্গে কথা বলব, কেমন?’

ফোনটা কেটে দিয়ে স্বস্তির নিশ্বাস ফেলে কালকেতু মুখ ফিরিয়ে বলল, ‘যাক, রহস্যভেদ হয়ে গেল।’রাহুল জিজ্ঞেস করল, ‘কার ফোন ছিল রে?’

‘তথাগতর। আমি এখন কনফার্মড। সুজাতা মিত্রের আসল খুনি আজ ধরা পড়েছে।’‘তাই নাকি? কে সে?’

‘তা হলে গোড়া থেকে বলি। শুরু থেকেই আমার ধারণা ছিল, সুজাতা মিত্রের খুনি বাইরের কেউ নন। অত ভোরে কেউ যদি খুন করতে ঢুকতেন, তা হলে কারও না কারও চোখে পড়ে যেতেন। খুনি বাড়িরই কেউ, যিনি জানতেন, খুব ভোরে উঠে ভদ্রমহিলার চা খাওয়ার অভ্যাস আছে। আর সেটাই খুন করার মোক্ষম সময়। ভাসুরপো নান্টুর উপর আমার সন্দেহ হয়েছিল। পাড়ায় খোঁজ করে জানলাম, বাজে টাইপের ছেলে। তবে খুন করার মতো গাটস নেই। এর পরই প্রোমোটারের বাড়ি, ইনশিয়োরেন্স অফিস, চন্দননগর থেকে ঘুরে আসি।

কোথাও ক্লু পেলাম না। শেষে মোল্লার বস্তিতে গিয়ে আমি মন্টির মায়ের সঙ্গে কথা বলি। প্রথমে বুড়ি মুখ খুলতে চাইছিল না। পরে হাজার টাকার নোট বাড়িয়ে দিতেই সুড়সুড় করে সব বলে ফেলল। খুনের একমাত্র আই উইটনেস। কিন্তু নান্টুর ভয়ে পুলিশকে সেদিন কথাটা বলতে পারেনি।’

‘খুনটা কে করেছিল?’

বলছি। সে সুজাতা মিত্রকেই শুধু খুন করেনি। তার পর আরও চারটে মার্ডার করেছে। বরানগরে সুভাষ রায়, বড়োবাজারে অঞ্জলি আগরওয়াল, সল্টলেকে সমীরণ সাহা এবং একদম লেটেস্ট সিঁথিতে নমিতা মুখোপাধ্যায় বলে একজনকে। সব ভিক্টিমই এক ধরনের। তাঁরা বিত্তবান এবং নিঃসঙ্গ। কখনও কাজের লোক, কখনও আয়া, কখনও বিউটিশিয়ান হয়ে সে বাড়িতে ঢুকত। ছ’আট মাস সময় নিয়ে ঘনিষ্ঠতা বাড়িয়ে, হঠাৎ একদিন মার্ডার করে হাওয়া হয়ে যেত। সেইসঙ্গে লুটপাটও করত। তার পিছনে অবশ্য বড়ো একটা অর্গানাইজড গ্যাং ছিল। সেটা অপারেট করত বোড়াল বলে একটা জায়গা থেকে।’

জয়ন্তনারায়ণ জিজ্ঞেস করল, ‘বোড়াল! মানে… ছন্দা যেখানকার মেয়ে?’কালকেতু বলল, ‘ঠিক তাই। আমি ছন্দার কথাই বলছি। ওকে সেদিন খুন করতে দেখেছিল মন্টির মা। বৃষ্টি হওয়ায় আগের রাতে আর মোল্লার বস্তিতে ফিরতে পারেনি মন্টির মা। দোতলায় ওঠার সিঁড়ির ল্যান্ডিংয়ে চাটাই পেতে শুয়ে পড়েছিল। ভোরবেলায় সুজাতা মিত্র যখন নীচে নেমে যান, তখন ওর ঘুম ভেঙে যায়। একটু পরে ও দেখতে পায়, নীচের ঘরের দরজা খুলে ছন্দা বেরিয়ে এসেছে।

সুজাতা মিত্র যখন স্টোভ জ্বালাতে ব্যস্ত, তখন পিছন থেকে দেশলাই কাঠি জ্বালিয়ে ও ছুড়ে মারে। তারপরই দ্রুত পায়ে ছন্দা ফের ঘরে ঢুকে যায়। তোমাদের মনে আছে কিনা জানি না, তারক বলেছিল, শাড়িতে আগুন লাগার পর সুজাতা মিত্র ছন্দা ছন্দা বলে পুকুরের দিকে দৌড়ে গিয়েছিলেন। হয়তো ছন্দার দুষ্কর্ম তিনি দেখে ফেলেছিলেন। মন্টির মা আমাকে বলেছে, একটু পরেই নান্টু দোতলা থেকে নেমে লোকজন জড়ো করে রটিয়ে দেয়, তারকই গায়ে আগুন লাগিয়েছে।

‘কিন্তু, ছন্দা খুন করল কেন? ওর মোটিভটা কি?’

‘ও সুজাতা মিত্রের কাছে ধরা পড়ে গিয়েছিল। তারক দোকানে বেরিয়ে যাওয়ার পর, দুপুরে প্রায়ই নান্টু ওর ঘরে এসে ঢুকত। বুঝতেই পারছ, কী কারণে এসে ঢুকত। মন্টির মা আমাকে বলেছে, এ নিয়ে সুজাতা মিত্র ওকে বকাবকিও করেন। কিন্তু, তাতে আরও বেপরোয়া হয়ে যায় ছন্দা। বোড়াল থেকে একদিন ওর মামা এসে নাকি ভদ্রমহিলাকে থ্রেট করে। তারই পরিণতি এই খুন। আসলে তো মামা নয়, ওদের গ্যাংয়েরই কেউ হবে। খুনের দিন দুপুরে সেই মামা এসে না কি ছন্দারই সাহায্য নিয়ে আলমারি ফাঁকা করে।’

রাহুল জিজ্ঞেস করল, ‘এই ছন্দাই যে বাকি মার্ডারগুলো করেছে, তার কী প্রমাণ আছে?’

কালকেতু বলল, ‘এই প্রশ্নটাই আমি আশা করেছিলাম। প্রথমবার ধরা না পড়ে ছন্দার সাহস বেড়ে যায়। একইভাবে বরানগরে ও সুভাষ রায়ের বাড়িতে ঢুকেছিল কাজের লোক হয়ে। নাম নিয়েছিল রেখা। বৃদ্ধ ভদ্রলোককে মাস তিনেক পর মার্ডার করে টাকা-পয়সা হাতিয়ে ও পালিয়ে যায়। সেইসময় প্রতিবেশীদের দিয়ে বরানগরের পুলিশ রেখার একটা স্কেচ তৈরি করে রেখেছিল।

এর পর বড়োবাজারে অঞ্জলি আগরওয়ালের বাড়িতে ছন্দা যায় বিউটিশিয়ান সেজে। সেবার প্রচুর সোনার গয়না নিয়ে চম্পট দিয়েছিল। সুন্দর মুখ, চমৎকার ব্যবহার… কেউ ওকে সন্দেহ করত না। কিন্তু, ছন্দা ধরা পড়ে গেল সিঁথিতে নমিতা মুখোপাধ্যায়ের মার্ডার করে।

সিঁথিতে ও নাম নিয়েছিল গায়ত্রী। স্কেচ বানিয়ে সুজয় রাফতান ওকে চিনে ফেলে। এ ব্যাপারে আমাকে প্রথম আন্দাজ দেয় ডেটা জার্নালিস্ট তথাগত। আলাদা সময়ে আলাদা জায়গায় ঘটে যাওয়া ঘটনাগুলো জোড়া দিয়ে ও-ই প্রথম আমাকে বলে, এ সব একই লোকের কাজ। আজ দুপুরেই সুজয়বাবুর সঙ্গে ফোনে আমি কথা বলেছি। উনি মারাত্মক রেগে আছেন ছন্দার উপর। বললেন, চার্জশিটটা এমনভাবে তৈরি করবেন, ছন্দা যাতে ফাঁসির দড়ি এড়াতে না পারে।’সব শুনে রাহুল বলল, ‘আমি জানতাম ভাই কালকেতু, তুই-ই পারবি।’

জয়ন্তনারায়ণ বলল, ‘চলো, ওঠা যাক।’তিনজনেই উঠে দাঁড়িয়েছে, এমন সময় তারক এগিয়ে এসে হাতজোড় করে দাঁড়াল। ওর চোখ-মুখ বিবর্ণ হয়ে গিয়েছে। তিনজন লক্ষ্যই করেনি, ক্যাফেটেরিয়ার কাউন্টারে বসে তারক সব শুনছে।

রাহুল জিজ্ঞেস করল, ‘কিছু বলবে নাকি তারক?’

‘হ্যাঁ স্যার।’ তারক বলল, ‘আমার হয়ে হাইকোর্টে… মামলা লড়ার আর দরকার নেই। কী হবে আমার বাইরে বেরিয়ে? আপনাদের মুখে আজ যা শুনলাম, তাতে বেঁচে থাকার কোনও ইচ্ছে আর আমার নেই। প্লিজ স্যার, বাকি জীবনটা আমায় জেলেই কাটাতে দিন।’

আরো গল্প পড়তে ক্লিক করুন...