গ্যাসে গরম দুধ ফুটছে আর দুলাল অল্প অল্প করে ছানা কাটা পাউডার মিশিয়ে যাচ্ছে। ছানা কাটাও যে এত শক্ত কাজ কে জানত! কাল পাউডার বেশি পড়ে গেছিল, কী তেতো, কী তেতো! মুখেই তোলা গেল না। জানলায় একটা কাক এসে বসে রোজ সকালে, তার পেটেই গেল সব।
আজ তাই দুলাল খুব সাবধানে পাউডার মেশাচ্ছে। ছোট্ট সুন্দর প্লাস্টিকের কৌটোয় এই এতটুকু একটা বেগুনি চামচ, তাতে করেই তুলছে একটু একটু করে। দুধটা দানা পাকাতে শুরু করেছে। দুলাল পাউডার মেশানো বন্ধ করে। চামচটা কৌটোয় রেখে দেখে, যেটুকু পাউডার আছে তাতে এ মাসটা হেসেখেলে চলে যাবে। রান্নাঘরের লাগোয়া ছোট্ট স্টোররুম। এই জায়গাটা দুলাল রেখেছিল লিফটের জন্য। পাঁচতলা অ্যাপার্টমেন্ট। যারা চার বা পাঁচতলায় থাকবে তাদের কথা ভেবেই লিফট করতে চেয়েছিল। সবারই তো বয়স হচ্ছে। কিন্তু বউগুলো মহা বেয়াড়া। কাঁইমাঁই কাঁইমাঁই করে বলল, ‘লিফট চাই না, আমাদের কিচেনের সঙ্গে অ্যাটাচড স্টোররুম চাই।’ ব্যস্, লিফট বন্ধ। দুদিন পরেই টের পাবে মজা। মেয়েদের হাঁটু সবার আগে খারাপ হয়। এদিকে ফেসিয়াল করাবে, ওদিকে হাঁটু পালটাতে হবে। নকল হাঁটু নিয়ে সিঁড়ি ভাঙার কষ্ট বুঝবে হাড়ে হাড়ে!
সেই স্টোররুমে গিয়ে থরে থরে সাজানো ছোটো-বড়ো কৌটোর মধ্যে দুলাল চিত্রার্পিতের মতো দাঁড়িয়ে রইল। চাল, ডাল, আটা, ময়দা, তেল, মশলা যা আছে আরও দু’মাস চলে যাবে। বাথরুমের বক্স মিররের মধ্যেও শ্যাম্পু, সাবান, বডি অয়েল। কমোডের পেছনের তাকে বাথরুম ঘষার অ্যাসিড, ব্রাশ। তাকে এখনও সংসারের একটা ছোট্ট জিনিসও একটা স্কচ-ব্রাইট কি টুথপেস্ট – কিছু কিনতে হয়নি।
শংকরী সব সাজিয়ে রেখে গেছে। যেমন বাড়িঘর, তেমনি নিজের শরীরটাও ঘষেমেজে রাখতে পছন্দ করত। পার্লারে যাবার সময় পেত না বলে একটা মেয়ে নিয়মিত বাড়িতে এসে ফেসিয়াল, হেনা, বডি মাসাজ করে দিয়ে যেত। দুলালের পছন্দ ছিল না এসব, বিশেষ করে আদুড় গায়ে বাইরের লোককে দিয়ে বডি মাসাজ, যতই মেয়েমানুষ হোক না। শংকরী মুখ টিপে হেসে বলত, ‘যে মন্দিরে নিত্য ঘন্টা বাজিয়ে পুজো করতে যাও, সেটা ঘষেমেজে না রাখলে হবে?’ মাথার চুল থেকে পায়ের নখ পর্যন্ত ঝকঝকে রাখা যার রোজকার সাধনা ছিল, সে টের পেল না তার দেহমন্দিরে কালসাপ বাসা বেঁধেছে?
দুলাল ছানা আর দুটো ক্রিমক্র্যাকার বিস্কিট নিয়ে শোবার ঘরের লাগোয়া ব্যালকনিতে এসে বসল, এই তার সকালের ব্রেকফাস্ট। ছেলে উঠলে তাকে ডিম-টোস্ট কিংবা নুডলস করে দেবে। তবে সে দশটার আগে নয়। একটু পরে রান্নার মাসি আসবে। তাকে রান্না বুঝিয়ে দিতে হবে। এই রে, ফ্রিজ থেকে মাছ বার করে রাখা হয়নি তো। দুলাল ছানার বাটি রেখে দৌড়ে ভেতরে যায়। ইস্, একদম বরফ হয়ে আছে। মাসি এসে চ্যাঁচামেচি জুড়ে দেবে। একদিকে ভাত, অন্যদিকে মাছ ভাজতে বসিয়ে সে তরকারি কুটে নেয়। আজ মাছের বরফ গলার জন্য দাঁড়িয়ে থাকতে হবে তাকে। দুলাল জানে, মাসি গরমজল ঢেলে দেবে মাছে, এত দামি মাছটা একদম নষ্ট হয়ে যাবে।
দুলাল দেখল আটটা কাতলার পিস একসঙ্গে জমাট বেঁধে আছে। রান্না তো হবে মাত্র দুটো। রাতে তারা বাপ-ব্যাটা রুটি তরকারি খায়। তরকারি মাসিই করে যায়। গদি থেকে ফেরার পথে দুলাল রুটি কিনে আনে। ছেলে তো অর্ধেক দিন চাইনিজ-মাইনিজ খেয়ে আসে। মাসির রান্না তরকারি তার গলা দিয়ে নামে না। এত পয়সা নষ্ট দেখে খেপে যায় দুলাল। কিন্তু এটা সত্যি, শংকরীর হাতের রান্না যে খেয়েছে, সে কাজের মাসির হাতে খাবে কী করে? সকালে তবু গরম গরম মাছের ঝোল ভাত বেরোনোর তাড়ায় খেয়ে নেওয়া যায়। ভাতের মধ্যে দুলালের জন্যে একগাদা সেদ্ধ দেওয়া থাকে– উচ্ছে, পেঁপে, ভিন্ডি, কখনও কুমড়ো। নীচের ফ্ল্যাট থেকে বাচ্চুর মা ছেলের জন্যে ভাজাভুজি দিয়ে যায় রোজই। কিন্তু রাতের খাবার গলা দিয়ে নামে না। পয়সা দিয়ে কেনা সবজি, তাই শুধু মুখেই খানিকটা খেয়ে নেয় দুলাল। বাকিটা ফেলা যায়। রুটি চারটে দুধ-কলা দিয়ে খায় শেষে।
নাঃ, দুপিস দুপিস করে মাছ আলাদা আলাদা বাক্সে তুলে রাখতে হবে। দুলাল ঠিক করে আজই ফেরার পথে কিনে আনবে চারটে ছোটো প্লাস্টিকের বাক্স। আবার কী ভেবে রান্নাঘরে যায় একবার। গ্যাসের বাঁপাশের তাকে অনেক বাসনপত্র ধুয়েমুছে রাখা। এত বাসন লাগে না বলে দেখার দরকার হয়নি। দুলাল দেখল সেখানে ছোটো ছোটো চারটে মাছ রাখার ট্রান্সপারেন্ট প্লাস্টিকের বক্স ধুয়ে রাখা আছে। তাকে এগুলোও কিনতে হবে না। স্বস্তির শ্বাস ফেলল দুলাল। বেমক্বা জলও চলে এল চোখে। একটা মানুষ চলে গিয়েও ঘরের প্রতিটি কোনাকাঞ্চিতে ছড়িয়ে আছে। এ ঘর থেকে ও ঘরে গেলেই তার সঙ্গে দেখা হয়ে যাচ্ছে দুলালের। শুধু তাকে ছুঁতে পারছে না সে। সেই বেদানার আভা ঠিকরোনো গায়ে মুখ রাখতে পারছে না।
দুলালের মনে পড়ল ব্যালকনিতে ছানা আর বিস্কিট ফেলে এসেছে। সে আবার দৌড়ে গেল। এতক্ষণে কাক সেসবের ভুষ্টিনাশ করেছে নির্ঘাত। এ শহরে পাখি বলতে শুধু কাক। এত ধুলো, ধোঁয়া, শব্দ, মোবাইল টাওয়ার– কিছুই এদের দমাতে পারে না। নাঃ, খাবার ঠিকই আছে। শুধু ধুলো পড়েছে একটু। পাঁচতলায় হাওয়া বড্ড বেশি। ছানা একটু মুখে দিয়েছে, অমনি দুলালের মনে পড়ল তরকারির সবজি গুছিয়ে আসা হয়নি, যাক, মাসি নেবে নয় গুছিয়ে। বিস্কিটে একটা কামড় বসাতেই ডোরবেল বাজল। উঃ, একটু খাওয়ারও ফুরসত নেই। মাসি এসে পড়ল নাকি এত তাড়াতাড়ি! খেতে খেতে উঠে গেলে
শংকরী খুব রাগ করত। কিছুতেই উঠতে দিত না দুলালকে খাওয়া ফেলে। নিজেই গ্যাস কমিয়ে ছুটে যেত দরজা খুলতে। আর এখন! দুলাল তার আধখাওয়া বিস্কিট আর ছানার প্লেট ডাইনিং টেবিলে রেখে দরজা খুলে দিল। না, রান্নার মাসি নয়, মানি, সেজ ভাইয়ের মেয়ে। ওরা তিনতলায় থাকে।
‘জেঠু, আমাদের কমোডের ফ্ল্যাশ কাজ করছে না!’ দুলালের মাথা চিড়িক করে উঠল রাগে। মানিকতলায় ভাড়া বাড়ি থেকে সল্টলেকের এই পাঁচতলা ফ্ল্যাটে পুরো পরিবারটিকে যে একার চেষ্টায় নিয়ে এসেছে। বহু আগে কিনে রাখা জমি। বাড়ির প্ল্যান পাকা করানো থেকে পাথর কেনা, পার্টির ছেলেদের টাকা দেওয়া থেকে বেসমেন্টে দারোয়ানের ঘর– সব ঝক্বি সামলে সে তিল তিল করে বাড়িটা তুলেছে। শুধু বাড়ি নয়, প্রতিটি ফ্ল্যাটের খাট, আলমারি, ড্রেসিংটেবিলের মতো আসবাবও দেওয়া হয়েছে যৌথ ব্যাবসা থেকে। এভাবে একতরফা পেতে পেতে বউগুলো কি তেলিয়ে গেছে। বাথরুমের মগ থেকে ফেসিয়ালের খরচ সবই বারোয়ারি খরচ থেকে আদায় করতে চায়। আক্বেল দ্যাখো, ফ্ল্যাশ কাজ করছে না তো প্লাম্বারকে ফোন কর, তা না, ভাসুরকে ডাকছে। শংকরী থাকলে নয় একটা কথা ছিল। তখন তো তাকে সংসারের কুটোটি নাড়তে হতো না। এখন দুলাল নিজের ঘর সামলাবে না ভাইয়ের বাথরুম দেখতে ছুটবে!
‘তোর বাবাকে বল প্লাম্বারকে ফোন করতে।’ বলেই দুলাল দড়াম করে দরজাটা বন্ধ করে দেয়। আবার বেল। এবার রান্নার মাসি। রান্নার মাসি ভেতরে ঢুকে এলে দুলাল আর দরজা বন্ধ করে না। মাসি বললেও, রাঁধুনিটি যুবতি মেয়েমানুষ। পাঁচবাড়ি কাজ করেও ঢলোঢলো শরীর। তাই সে যতক্ষণ কাজ করে, ততক্ষণ দরজা খোলা রাখে দুলাল। ঘরের কাজ সারতে সারতে বারবার দরজায় চোখ রাখে। এ বাড়িতে সকাল থেকে ঘরে ঘরে বাইরের লোক কাজে ঢোকে। বেশিরভাগই কেষ্টপুরের খালপাড় থেকে। সুযোগ বুঝে কে কখন কী হাতিয়ে নেবে তার ঠিক কী। তার চোখ থেকে থেকে রান্নার মাসিকেও নজর করে। আঁচলে চাল ডাল বেঁধে নিয়ে গেলে যদিও তার কিছু করার নেই। চুপচাপ হজম করে যেতে হবে। বলতে গেলে সে উলটে কেস খেয়ে যাবে। সংসারে কেবল একা মেয়েমানুষ নয়, একা পুরুষমানুষেরও অনেক বিপদ। সেদিন যখন দেখল শাক কুটতে কুটতে মশা মেরে, সেই হাতেই শাক ধুল, তখন রান্নাঘরে একটা অল-আউট জ্বালিয়ে আসা ছাড়া তার কিছু করার ছিল না। দুলাল ফ্রিজ থেকে থোড়, উচ্ছে, পেঁপে আর বেগুন বার করে দিল।
‘থোড় চচ্চড়ি সরষে দিয়ে, উচ্ছে আর পেঁপে সেদ্ধ, বেগুন দিয়ে মাছের ঝোল।’
থোড় দেখে মাসির মুখ কালো। তার ওপর দুলাল বলল, ‘মাছের তেল আছে অনেকটা, চালের গুঁড়ো দিয়ে দাদার জন্য বড়া বানিয়ে দিও।’
মাসি খরখরে গলায় বলে, ‘চালের গুঁড়ো বার করে দিয়ে যান মেসো।’
চালের গুঁড়ো! এতদিন দরকার পড়েনি কোনও। দুলাল আবার স্টোররুমে ঢোকে। খুঁজতে হয় না বেশি। প্রতিটি কৌটোর গায়ে লেবেল সাঁটা। শংকরী নিজের হাতে বড়ো বড়ো করে লিখে আঠা দিয়ে সেঁটে রেখেছে। দুলাল লেখাটার গায়ে হাত বুলোয়। তার মাথা ঝিমঝিম করে। এইসব তো একদিন না একদিন ফুরোবেই। তখন আবার কিনে কৌটোয় কৌটোয় তুলে রাখা– এসব তো কাজের লোক দিয়ে হবে না। তাকেই করতে হবে। শংকরীর ভাঁড়ার যেন না ফুরোয়! ফুরোচ্ছেও না। সব জিনিস চাইলেই পেয়ে যাচ্ছে। এমনকী ঠাকুরের ধূপ, বাতাসা, কাটিং মিছরি পর্যন্ত এখনও কিনতে হয়নি। লক্ষ্মীবারের হত্তুকি, সুপুরি, এক টাকার কয়েন সব রাখা নিখুঁতভাবে। পিসিমা এসে পনেরো দিন ছিল, তখন সব ওলটপালট করেছিল। দুলালের সহ্য হয়নি।
শংকরী চলে যাবার পরদিনই পিসিমা চলে এসেছিল নবদ্বীপ থেকে। অন্য গোত্রের মানুষ, তার ঠাকুরসেবায় দোষ নেই। সে সময় দুলাল কোনও দিকে তাকায়নি। ওর শরীর মন কেমন অসাড় হয়ে গেছিল। মাঝে মাঝে নিজেকে ঝাঁকিয়ে নিয়ে ও জিজ্ঞেস করত ‘আমি কি বেঁচে আছি?’ কিন্তু শ্রাদ্ধের জোগাড়যন্ত্র শুরু হতেই ও আর এমন নিভৃতে থাকতে পারল না। খুঁটিনাটি কেনাকাটা, প্যান্ডেল, নেমন্তন্নের লিস্ট, কার্ডের ডিজাইন, খবরের কাগজে শোকস্তম্ভ– সব কিছুই সে ছাড়া হবে না। এমন অপদার্থ তার ভাইগুলো! নেমন্তন্নর লিস্ট করতে বসে মনে পড়ল অনেকদিন আগে যে -পুরুতঠাকুর তাদের মানিকতলার বাড়িতে পুজো করতে আসতেন, সেই ইন্দুমাধব ভট্টাচার্যির কথা। বয়স হওয়ার জন্য অনেকদিন আসতে পারেন না, বেঁচে আছেন কিনা কে জানে।
ঠাকুরের সিংহাসনের পাশে একটা ছোট্ট তেপায়া চৌকিতে রাখা লক্ষ্মীর পাঁচালির মধ্যে একটুকরো কাগজে তাঁর ঠিকানা লিখে রেখেছিল শংকরী। সেই ঠিকানাটা খুঁজতে ঠাকুরঘরে এসে দুলাল অবাক। পুবমুখে রাখা সিংহাসনটা উত্তরমুখ করে কে বসাল! সবকিছুই পরিপাটি করে রাখা কিন্তু আগের মতো কোনওটাই নয়। গঙ্গাজলের সারি সারি বোতল, ঠাকুরের একরাশ বাসন, পঞ্চপ্রদীপ, চামর– সবকিছু পিসিমা নিজের ইচ্ছেমতো, সুবিধেমতো গুছিয়ে নিয়েছে। রাগে দুলালের মাথা দপদপ করতে লাগল। এখনও শ্রাদ্ধ চোকেনি।
শংকরীর নিজের হাতে সাজানো সংসার এলোমেলো করা শুরু হয়ে গেল! সে চিৎকার করে ডাকল, ‘পিসি, ও পিসি।’ বাড়িতে থইথই করছে আত্মীয়স্বজন। বাইরের লোকও বিস্তর। তার মধ্যেই রাগে দিগ্বিদিক শূন্য দুলাল পিসিকে যা-তা শুনিয়ে দিল। পিসি কেঁদেকেটে তক্ষুনি নবদ্বীপ চলে যেতে চাইল। তখন আবার তাকে হাতে পায়ে ধরে রাখতে হল দুলালকে।
সেই পিসি সপ্তাখানেক আগে চলে গেছে। সিংহাসন আবার আগের মতো পুবমুখো করে বসানো হয়েছে। শুধু ঠাকুরের সিংহাসন নয়, আলমারি, আলনা, যেখানে যেমন ছিল সব তেমনটাই রেখে দিয়েছে দুলাল। শুধু রান্নাঘরটা পারছে না। এই পাঁচবাড়ি কাজ করা রান্নার লোকগুলো যা করে যায়। অনেক চেষ্টা করেও রান্নাঘরটা আগের মতো রাখতে পারছে না দুলাল।
অথচ শংকরী তাকে প্রতিমুহূর্তে আড়াল থেকে সাহায্য করে যাচ্ছে। এখনও অবধি চাল, ডাল, মশলা থেকে শুরু করে সাবান, ফিনাইল কিছুই কিনতে হয়নি তাকে! সব কিছু থরে থরে সাজিয়ে রেখে গেছে শংকরী।
মধুসূদনদাদার দইয়ের ভাঁড়ের মতো তার সংসারের রসদ যেন অফুরন্ত। শ্রাদ্ধের সময় প্রচুর এক টাকা, দু’টাকার কয়েনের দরকার হয়েছিল। সেগুলোও হঠাৎ একটা পুরোনো পাউডারের কৌটোয় পেয়ে গেল। একটা বেবি পাউডারের কৌটো। ছেলেমেয়েকে ছোটোবেলায় এই পাউডার মাখাত শংকরী। দুলাল কিন্তু কৌটোর মধ্যে ছেলেমেয়ের নয়, শংকরীর গায়ের গন্ধ পেল। কৌটোয় একটু তলানি পাউডার পড়ে ছিল সত্যি সত্যি। আর সেই পাউডারের গুঁড়ো গায়ে মেখে একরাশ কয়েন– এক টাকা, দু টাকা, পাঁচ টাকা, দু-একটা দশ টাকারও। সেগুলো হাতে নিয়ে দুলাল তাদের একসঙ্গে পথচলার এতগুলো বছর দেখতে পাচ্ছিল। কত বছর ধরে এগুলো সঞ্চয় করেছে শংকরী! এই সংসারের মতো, তিলে তিলে সে জমিয়ে তুলেছে খুচরোর ভাণ্ডারও।
সব আছে, শুধু সেই-ই নেই।
কয়েনগুলো পেয়ে যাবার পর থেকে জীবনটা ভারি রহস্যময় মনে হচ্ছে দুলালের। আগে এরকম কখনও হয়নি। শংকরী যখন ছিল তখন বড়োবাজারে গদিতে যাওয়া আর বাড়ি ফেরা– এর বাইরে কোনও কিছু নিয়ে ভাবার দরকার হয়নি তার। এখন মনে হচ্ছে জীবনের আনাচেকানাচে তার জন্য অনেক অজানা অপ্রত্যাশিত বিস্ময় অপেক্ষা করে আছে। দুলাল বাড়িতে যতক্ষণ থাকে, এটা ঝাড়ে, ওটা ঝাড়ে, এটা টানে, ওটা খোলে আর দুরুদুরু বুকে ভাবে, এবার কী বেরোবে। শংকরী কোথায় না কোথায়, কত কী যে লুকিয়ে রেখে গেছে। ‘ও মেসো, হয়ে গেছে। ঠান্ডা হলে বাটিগুলো ঢাকা দিয়ে দেবেন। আমি ওবেলার তরকারি আলাদা বাটিতে রেখেছি। ঘাঁটাঘাঁটি করলে নষ্ট হয়ে যাবে।’
দুলাল দরজা বন্ধ করতে যায় রান্নার মাসির পেছন পেছন। হঠাৎ মাসি ঘুরে দাঁড়িয়ে ব্লাউজের মধ্যে হাত ঢুকিয়ে দেয়। দুলালের গলা শুকিয়ে কাঠ। হাত ঢুকোনো আর বার করে আনার ফাঁকে এক ঝলক দেখা যায় পুরুষ্ট দুই স্তনের মধ্যের গহন খাঁজ।
মহিলাটি দুলালের চোখের তাক বুঝে ঠোঁট টিপে হাসে, তারপর হাত বাড়িয়ে দুলালের হাতে দুটো একশো টাকার নোট দেয়। দুলাল হতভম্বের মতো তাকায়।
‘শুকনোলংকা খুঁজতে গিয়ে একটা কৌটোর মধ্যে পেলাম। আমরা গরিব হতে পারি, চোর নই।’
দুশো টাকা আর অপমানটুকু গিলে নিয়ে দুলাল দেখে মহিলা কেমন দপদপিয়ে সিঁড়ি দিয়ে নেমে যাচ্ছে। দুলাল অসহায় ভাবে দেখে ওর চলে যাওয়া। কাল আবার আসবে তো? দরজা বন্ধ করে ঘুরে দাঁড়াতেই চমকে যায়। ছেলের ঘরের দরজা খোলা। বিছানায় উপুড় শোয়া ছেলে একটু উঁচু হয়ে তার দিকে স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। বাবলু কি দেখেছে দুলাল রান্নার মাসির বুকের খাঁজের দিকে…
সে ঢোঁক গিলে বলে, ‘কী রে, দশটা বেজে গেল। ওঠ এবার। আমাকে তো সব গুছিয়ে বেরোতে হবে।’
বাবলু ওই একই ভঙ্গিতে শুয়ে শুয়ে বলে,
‘বাপি আজ রাতে আমি দীঘা যাচ্ছি।’
‘দীঘা! কেন?’
‘এমনি, ভালো লাগছে না। ইন্দ্ররা যাচ্ছে গাড়ি নিয়ে, আমাকে ধরেছে। ঘুরে আসি।’
একুশ পূর্ণ হয়নি এখনও। সামনের এপ্রিলে ওর জন্মদিন। এই প্রথম শংকরী পায়েস রাঁধবে না। ছেলে নিয়ে অশান্তির শেষ ছিল না শংকরীর। অত টাকা দিয়ে বিবিএ-তে ভর্তি করা হল, দুম করে ছেড়ে দিয়ে গাড়ির বিজনেস করবে বলে মেতে উঠল। রাত দুপুরে ফেরা, এক রাশ বন্ধু, ক্লাব, পুজো। অবশ্য এখনও ছেলের মুখ থেকে মদের গন্ধ পায়নি দুলাল। কিন্তু দীঘা! মা চলে গেছে দু ‘মাসও হয়নি।
দুলাল বিড়বিড় করে বলল ‘যা খুশি কর।’
ব্যালকনিতে গিয়ে দাঁড়ায়। নীচ দিয়ে গাড়ি ছুটছে বিরামহীন। কোথাও কিছু অভাব, বেদনা চোখে পড়ে না। শুধু তার ঘরেই… বেআদব ছেলেকে তার ঘাড়ে ফেলে ড্যাং ড্যাং করে চলে গেল শংকরী। মনটা হুহু করে। বেরোতে ইচ্ছে করে না একেকদিন। কিন্তু ফাঁকা বাড়িতে থাকার কথা ভাবলেই আঁতকে ওঠে। গদিতে তবু পাঁচটা লোকের মুখ দেখা যায়। বাবলু তো একটু পরেই বেরিয়ে যাবে।
বাবলু চ্যাঁচায় ‘বাপি শুনে যাও।’
এতবড়ো ছেলে, একটু দুধ গরম করে নেওয়া কি ম্যাগি করা– সেটুকুও পারে না। সব বাপ করে দেবে। ছেলেকে মাথায় তুলে দিয়ে গেছে শংকরী। এখন ঠ্যালা সামলাও।
‘কী হল? ম্যাগিটা করতে পারছিস না?’
‘সে সব নয়। একেবারে ভাত খেয়ে বেরোব।’ মেঝেতে বসে ছেলে ব্যাগ গুছোচ্ছে।
‘কী হল আবার?’
‘বাপি, দ্যাখো তো, মা বলেছিল, আমার দুটো ইনার কিনেছে। দ্যাখো না প্লিজ কোথায় আছে। বাড়িরগুলো নিয়ে যাওয়া যাবে না।’
খুব ক্লান্ত লাগে দুলালের। মনে হয়, পালিয়ে যায় কোথাও। এই সংসার তাকে একটুও রেহাই দেবে না। সারাদিন সে এগুলোই করবে নাকি?
ব্যাজার মুখে শোবার ঘরে এসে আলমারি খোলে দুলাল। সব থরে থরে সাজানো। ছেলের, বাপের, শংকরীর কাপড়জামা– সব আলাদা আলাদা তাকে। এমনভাবে গুছিয়ে গেছে শংকরী যে অন্ধ মানুষও খুঁজে পেয়ে যাবে। কিন্তু দুলাল বিমূঢ়ের মতো দাঁড়িয়ে থাকে আলমারি খুলে। তার মনে হয়, এই মহাসমুদ্র থেকে প্রার্থিত জিনিসটি সে খুঁজে পাবে না।
‘পেলে, বাপি?’ ছেলের চিৎকারে হুঁশ ফেরে দুলালের। গা ঝাড়া দিয়ে ওঠে সে। ছেলের তাকে খুব সহজেই পেয়ে যায় প্যাকেটে নতুন দুটো ইনার। আলমারি এবার বন্ধ করলেই হয়। দুলাল তবু দাঁড়িয়ে থাকে আরও খানিকক্ষণ। হ্যাঙারে ঝোলানো শংকরীর শাড়িগুলোর ঘ্রাণ নেয়। প্রতিটা দামি শাড়ির সঙ্গে ম্যাচিং ব্লাউজ আর ক্লাচব্যাগ মিলিয়ে মিলিয়ে রাখা। সেজেগুজে বেরোলে মাথা ঘুরে যেত সবার। সেসময় দুলালের তাকিয়ে দেখার সময় হয়নি। একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে আলমারি বন্ধ করতে গিয়ে থমকে যায় সে। আরে, এই দামি দামি ক্লাচব্যাগগুলোর মধ্যে এই ছেঁড়া ছেঁড়া পার্সটা কেন? আবছা মনে পড়ে, বহুবছর আগে নবদ্বীপ যাবার সময় ট্রেন থেকে কিনেছিল এটা। বহুদিন দেখেনি। এটা ব্যবহার করত নাকি শংকরী?
কী মনে হতে ব্যাগটা বার করে খোলে দুলাল, অমনি তার চোখ যেন ঝলসে যায়। ব্যাগের মধ্যে অল্প কিছু খুচরো টাকা আর একটা হলুদ রসিদের মধ্যে শুয়ে এটা কী? একটা বাঁশি! সোনার বাঁশি! রসিদটা খুলে দেখে চিত্রালি জুয়েলার্সের বিল। পেড। শংকরী এত টাকা মিটিয়ে দিয়ে গেছে! চায়নি তো তার কাছে! নিজের জমানো হাতখরচ থেকেই এত টাকা মিটিয়ে দিয়ে গেছে শংকরী?
দুলাল বিছানায় ধপ্ করে বসে পড়ে। তার মনে পড়ে যাচ্ছে এবার। গোপালের জন্য একটা সোনার বাঁশি গড়িয়ে দেবার আবদার করেছিল শংকরী। চিত্রালি থেকেই বরাবর সে গয়না বানায়। সেখানে দেখে পছন্দ করে এসেছিল। শুনেই দুলাল চটে লাল। ‘অত বাড়াবাড়ি কোরো না। গোপালের সোনার বাঁশি! যত্তসব। তুমি বাঁশি গড়ালে বাকি বউরা তো সোনার সিংহাসন চেয়ে বসবে।’
আর একটাও কথা বলেনি শংকরী এ নিয়ে। কিন্তু বাঁশি সে ঠিকই গড়িয়ে রেখে গেছে। নিজের তিল তিল করে জমানো পয়সা দিয়ে শোধও করে গেছে। জন্মাষ্টমীতে হয়তো গোপালের হাতে তুলে দেবে, এমন সাধ ছিল তার। কিন্তু কালরোগ একটুও সময় দিল না। টাটা মেমোরিয়াল থেকে ঘুরে আসার এক সপ্তাহের মধ্যেই…
দু-তিনবার ডেকে সাড়া না পেয়ে এঘরে আসে বাবলু। বাবাকে ওইভাবে খাটে বসে থাকতে দেখে একটু ঘাবড়ে যায় সে।
‘কী হল, পাওনি?’
উত্তরে দুলাল ছেলের চোখের সামনে তার হাতের পাতা মেলে ধরে। সোনার বাঁশির আভায় মুহুর্তে ঘর আলো হয়ে যায়। এখন শুধু ফুঁ দেবার অপেক্ষা।