সম্প্রতি করোনার কারণে লকডাউন চলাকালীন স্কুল সব বন্ধ থাকায় গতানুগতিক নিয়মে পরিবর্তন এসেছে। কিন্তু তা সত্ত্বেও এই দীর্ঘ ছুটিতে এবং এই লকডাউন-এর আগেও বাচ্চাদের স্কুলে গরমের ছুটি পড়়ার আগে থেকেই শহরের লিডিং সংবাদপত্রগুলিতে প্রচুর বিজ্ঞাপন দেখতে পাওয়া যেত এবং প্যামফ্লেট ছাপিয়েও বিলি করা হতো।

এই পরম্পরা আজও একই ভাবে বিদ্যমান। বিজ্ঞাপনে, ছুটিতে কোথায় ক্যাম্প করা হচ্ছে, সেখানে কী কী সুবিধা দেওয়া হচ্ছে, বাচ্চাদের বিভিন্ন অ্যাকটিভিটির একটা বিস্তৃত বিবরণ ইত্যাদি দেওয়া থাকে। এগুলি অবশ্যই বেশ একটা মোটা অর্থের বিনিময়ে। অনেক বাবা-মা-ই চান এইসব অরগানাইজেশনে নিজেদের বাচ্চাদের নাম নথিভুক্ত করাতে, যাতে ছুটিতেও স্কুলের মতোই কড়া শাসনের মধ্যেই বাচ্চারা থাকে। এখন বাচ্চাদের নানারকম গঠনমূলক creative activity কাজে ব্যস্ত রাখার জন্য যে-রকম বহু হালফিল ফ্যাশনের অরগানাইজেশন শহরগুলিতে গজিয়ে উঠেছে তেমনি মা-বাবাদের কাছেও তাদের বাচ্চাদের সেখানে পাঠানো ধীরে ধীরে খুবই জনপ্রিয় হয়ে উঠছে।

কিন্তু একটা কথা বলতেই হবে যে, প্রায়শই অভিভাবকেরা এটা ভুলে যান, বাচ্চাদের লম্বা ছুটির সময়টুকুই সেই স্বর্ণমুহূর্ত, যেখানে মা-বাবারা তাদের বাচ্চাদের সঙ্গে একটু ভালো সময় অতিবাহিত করবার সুযোগ পান। তাই সন্তানকে বাইরের কোনও গঠনমূলক অরগানাইজেশনে না-পাঠিয়ে নিজেদের অমূল্য সময় বাচ্চাদের সঙ্গে ভাগ করে নিতে পারলেই সবথেকে ভালো হয় এবং বাড়ির পরিবেশেই তাকে খেলার মাধ্যমে বিভিন্ন শিক্ষায় শিক্ষিত creative activity করে পারদর্শী করে তোলা সম্ভব হয়।

বিশেষকরে যে-সব অভিভাবকেরা চাকুরিজীবী, তাদের কাছে বাচ্চাদের স্কুলের লম্বা ছুটিটুকুই একমাত্র সময়, যখন তারা সন্তানদের হূদয়ের কাছাকাছি আসার বড়ো একটা সুযোগ পান। এইসময়েই গতানুগতিক দৈনন্দিন সংসারের একঘেয়েমি কাটিয়ে উঠে বাচ্চাদের সঙ্গে একাত্মতা অনুভব করার সুযোগ লাভ করেন। অভিভাবকেরা তাদের কাজের সময় এবং অবসর সময় বুদ্ধিমত্তার সঙ্গে ভাগ করে নিতে পারেন এবং মা-বাবা উভয়ে পরামর্শ করে অফিসে ছুটির দরখাস্ত ফেলতে পারেন। বাচ্চাদের মনেও, মা-বাবার সঙ্গে একটা পুরো দিন কাটানোর সুন্দর অনুভূতির প্রভাব পড়ে।

সন্তানের সঙ্গে অভিভাবকদের হূদয়ের বন্ধন যত দৃঢ় হবে ততই পারিবারিক বন্ধনের শিকড় গভীর পর্যন্ত বিস্তৃত হবে। এখনকার এই ব্যস্ত জীবনে বাড়িতে একসঙ্গে থাকলেও, সকলকে একসঙ্গে নিয়ে কোয়ালিটি টাইম অতিবাহিত করা সম্ভব হয়ে ওঠে না। তাই বাচ্চাদের ছুটি পড়লেই তাদের সঙ্গে নিয়ে কিছুটা ভালো সময় কাটিয়ে নেওয়ার সুযোগ কখনওই হাতছাড়া করা উচিত নয়। খেলাধুলো, বাগানের পরিচর্যা, বাড়ির কাজকেই ফ্যামিলির সকলের মধ্যে মজাদার ভাবে ভাগ করে দেওয়া, আত্মীয়স্বজনের বাড়িতে বেড়াতে যাওয়া অথবা হইহই করে সকলে মিলে পিকনিকে যাওয়ার মধ্যে দিয়েই সন্তানকে সময় দেওয়া এবং এর মাধ্যমেই নানা শিক্ষায় তাদের শিক্ষিত করে তোলা উচিত অভিভাবকদের।

বাচ্চাদের জন্য কী ভালো

প্রকৃতির সান্নিধ্যে রেখে বাচ্চাদের বড়ো করে তোলা উচিত এবং বাচ্চাদের কাছে সুস্থ নির্মল পরিবেশে নিঃশ্বাস নিতে পারার সুযোগ যদি থাকে তাকে হাতছাড়া করা কখনওই উচিত নয়। ধরুন সন্তানের লম্বা ছুটির অবসরে বাড়ির সকলে মিলে বাইরে ঘুরতে যাওয়ার কোনও প্ল্যান রয়েছে। বাচ্চাদের সামিল করুন ছুটির প্ল্যান সাজাবার সময়। মনে হতে পারে যে প্ল্যান বানাতে বাচ্চাদের ইচ্ছে জানার কী প্রয়োজন। কিন্তু প্রয়োজন অবশ্যই আছে। বাড়ির চার দেয়ালে বন্ধ থাকার থেকে বাইরের পরিবেশ বাচ্চাদের কাছে সবসময়ই প্রিয়। বেড়াতে যাওয়ার আগে নিজেরাও যেমন জায়গাটি সম্পর্কে বিস্তারিত জানুন তেমনি বাচ্চাদের কাছেও জায়গাটি সম্পর্কে বর্ণনা দিন ও তাদের আগ্রহ এবং আকর্ষণ বাড়়াতে সাহায্য করুন। তাদের জায়গাটির নাম বলে, জায়গাটি সম্পর্কে নিজে থেকে তথ্য সংগ্রহ করতে পরামর্শ দিন। এতে বাচ্চাদের আগ্রহ আরও বাড়বে। যদি ঐতিহাসিক কোনও জায়গা অথবা বিখ্যাত টুরিস্ট স্পট হয়ে থাকে তাহলে তার উপর লেখা বই পড়া অথবা তৈরি ফিলম দেখতে বাচ্চাদের উদ্বুদ্ধ করুন। বাচ্চাদেরই বলুন নেট সার্ফ করে বার করতে, কোন কোন দর্শনীয় জায়গায়, তারা যেতে পছন্দ করবে এবং সেখানে পৌঁছে তারা কী কী অ্যাক্টিভিটি বেছে নেবে?

বাচ্চারা এখন আউটডোর খেলাধুলোর জগৎটা প্রায় ভুলতে বসেছে বললেই চলে। তাদের অধিকাংশ সময় জুড়ে জায়গা করে নিয়েছে টিভি এবং ভিডিও গেমস। শহুরে একঘেয়ে জীবনের মেকি জীবনযাত্রাকে পিছনে ফেলে মাঝেমধ্যে অভিভাবকদের উচিত শিশুকে গ্রামের জীবনের সঙ্গেও পরিচয় করানো। গ্রামের জীবনটাই আমাদের আসল পরিচয় এবং শহরে এই জীবনের একাংশও খুঁজে পাওয়া যায় না। গ্রাম্য পরিবেশে গাছে উঠে টাটকা ফল পেড়ে খাওয়া, খেতের টাটকা শাকসবজি, পুকুরে নেমে সাঁতার কাটা অথবা পাড়ের ধারে বসে সবুজ প্রকৃতিকে উপভোগ করা ইত্যাদি বাঁধনছাড়া ক্রিয়াকলাপ বাচ্চাদের মন এবং শরীর, দুই-ই ফ্রেশ রাখে। গ্রামের পরিবেশে কিছুদিন কাটাতে পারলে আমরা আমাদের ঐতিহ্যের ইতিহাসের সঙ্গে সন্তানকে পরিচিত করাতে পারি এবং তারাও জীবনের মূল্যবোধের প্রয়োজনীয়তা উপলব্ধি করতে পারে।

মনে রাখা দরকার, বাচ্চাদের সময় দেওয়ার আর একটি উপায় হল, বাচ্চাদের সঙ্গে নিয়ে খেতে বসা। স্কুল চলাকালীন পরিবারের সকলের একসঙ্গে খাওয়াদাওয়া করা সম্ভব হয় না। তাই ছুটির সময়টাকেই একসঙ্গে কাটাবার উপযুক্ত সময় হিসেবে বাছুন। বাচ্চাদের সঙ্গে খাবারের মেনু ঠিক করুন, খাবার বানাবার সময় বাচ্চাদের সঙ্গে নিয়ে বানান, যাতে তারা পূর্ণ সহযোগিতা করার সুযোগ পায়।

খেলার ছলে, পড়াশোনার ক্ষেত্রে বুদ্ধিটাকে শান দেওয়ারও এটাই হল উপযুক্ত সময়। বাচ্চাদের জন্য বিভিন্ন বিষয়ের উপর বই বাছুন। লাইব্রেরিতে যেতে বাচ্চাদের আগ্রহ জোগান যাতে তাদের পছন্দের বিষয়ের উপর বই পড়তে পারে। পরের বছর আপনার সন্তান যে ক্লাসে প্রোমোশন পাবে সেই ক্লাসের বই অগ্রিম কিনে এনে তাকে মাঝেমধ্যে বইটির বিষয়গুলির সঙ্গে পরিচিত করান।

এছাড়াও ছুটির লম্বা সময়টাকে একটি কিংবা দুটি ‘থিম-এ’ ভাগ করে নিন। ‘থিম’ শব্দটা খুবই চটকদার এবং সকলের কাছে এখন প্রিয়। বাচ্চারা সহজেই আকর্ষণ বোধ করবে। বাচ্চাদের পছন্দের বিষয় বাছুন এবং সেটাকেই কেন্দ্রে রেখে কী কী করবেন তার তালিকা প্রস্তুত করুন। বিষয় যে-কোনও কিছুই হতে পারে যেমন, হস্তশিল্প, বই, সিনেমা এমনকী মিউজিকও। আপনার ‘থিম’ অনুযায়ী বিভিন্ন জায়গায় বাচ্চাদের নিয়ে যান এবং বিস্তারিতভাবে ওদের সঙ্গে আলোচনাও করুন।

ইনডোর অ্যাকটিভিটির মাধ্যমেও বাচ্চাদের গঠনমূলক প্রতিভাকে তুলে ধরা যায়। ওদের সঙ্গে বসে একসঙ্গে রং-তুলি দিয়ে কিছু আঁকুন, ওদের স্কুলের প্রোজেক্টে হাত লাগান। সবজি বিভিন্ন আকারে কেটে কীভাবে ভেজিটেবেল ব্লকপ্রিন্ট করানো যায় তার ট্রেনিং দিন। বাড়িতে যদি কোনও গৃহপালিত পশু থেকে থাকে তাহলে তার খাওয়ানো, ঘোরানো, শোয়ানো ইত্যাদির দায়িত্ব সন্তানকে দিন। প্রথম প্রথম অসুবিধা হলেও পরে আর অসুবিধা থাকবে না এবং পশুপ্রেমও এতে বৃদ্ধি পাবে।

রিসার্চ করে দেখা গেছে ছুটির সময় যেসব বাচ্চারা অলসভাবে দিন না কাটিয়ে রীতিমতো খেলাধুলো, বইপড়া ইত্যাদি করে সময় কাটিয়েছে তারা স্কুল খোলার পর পড়াশুনোতেও ভালো ভাবে মন দিতে পারছে এবং পরীক্ষাগুলোতেও ভালো রেজাল্ট করছে।

বাগানের কাজেও বাচ্চাদের ব্যস্ত রাখতে অথবা কিছুটা সময় কাটাতে দিতে পারেন। চাইলে দু-একজন বন্ধুকেও, নিজের সন্তানকে সঙ্গে নিতে বলুন। সকলকে সঙ্গে নিয়ে ওদের পছন্দের কোনও খাবার তৈরি করুন কারণ শারীরিক পরিশ্রমের পর লোভনীয় খাওয়া ওদের পাওনা হয়। বাড়ির কিছু কিছু দায়িত্ব ওদের উপর ছাড়ুন। বাচ্চারা যা খেতে ভালোবাসে ওদেরকে সঙ্গে করেই সেগুলি বানান যাতে ওদের মনে হয় ওরা নিজেরাই খাবারটা বানিয়েছে আর আপনি শুধু সাধ্যমতো ওদের সাহায্য করেছেন। ওদের বসিয়েই সারা সপ্তাহে কী কী স্পেশাল খাবার তৈরি করা হবে তার একটা লিস্ট চটপট বানিয়ে ফেলুন।

রান্নাঘরেও ওদের ক্রিয়েটিভ মনটাকে সক্রিয় রাখতে চেষ্টা করুন। যেমন ধরুন, একটা ট্রে-তে একটু চিনি ছড়িয়ে দিন। এক কাপ গলানো চকোলেট, একটা আইসিং সুগার টিউব, কিছু বিস্কুট এবং কাপ-কেক এনে বাচ্চাদের হাতে দিন। বাচ্চারা বিস্কুট এবং কেকগুলিকে চকোলেটে ডুবিয়ে আইসিং সুগার টিউবের সাহায্যে নানা ডিজাইনে সাজিয়ে সারভিং প্লেটে সাজাতে পারলে নিজেরাই দেখবেন, প্রচণ্ড আনন্দ পাচ্ছে। ওদের কাজে বাহবা দিন। নিজেদেরই তৈরি কুকিজ বাচ্চাদের এবং বড়োদের খাওয়াতে বেশি করে উৎসাহ দিন।

বাড়িতে বাচ্চাদের হয় নিজেদের মতো করে থাকতে দিন নয়তো কখনও শেখান বাড়ির অন্যান্য ছোটো ছোটো কাজগুলি কীভাবে নিজেরা নিজেদের হাতে করতে পারে। যেমন, নিজেদের ঘর পরিষ্কার রাখা, খাবার টেবিল সাজানো, রান্নাঘরের ছোটোখাটো কাজগুলি করা ইত্যাদি। ছোটো হলেও আপনার সংসারে তাদের যে প্রয়োজন রয়েছে, প্রতিটি মুহূর্তে সেটা ওদের বুঝতে দিন আপনার ওদের প্রতি ব্যবহারে।

নানা সমীক্ষায় দেখা গেছে যেসব বাচ্চাদের ওপর পড়াশোনা ও কাজের মাত্রাতীত বোঝা চাপানো হয়েছে, তারা নানারকম মানসিক অসুবিধার শিকার হয়ে পড়ে, যেমন স্ট্রেস, ডিপ্রেশন ইত্যাদি। তাই পড়াশোনার সঙ্গে সঙ্গে কিছুদিনের একটা লম্বা ছুটিরও বাচ্চাদের দরকার রয়েছে। কোনও বাচ্চার অভিনয়ের দিকে ঝোঁক, কারও বা মিমিক্রি-তে, কেউ বা পাপেট অথবা কাগজ রং, পেনসিল ইত্যাদি দিয়ে ছবি আঁকতে ভালোবাসে। কারও বা নাচ-গানে সহজাত আকর্ষণ থাকে। যার যে-বিষয়ে আগ্রহ, তাকে সেই বিষয়টিকে creative activity নিয়ে এক্সপেরিমেন্ট অথবা আলোচনা করতে সাহায্য করুন। নতুন নতুন পন্থার সঙ্গে তাকে পরিচয় করান যাতে স্বতঃস্ফূর্তভাবে তার ক্রিয়েটিভ মনটা প্রকাশ হতে পারে।

সবশেষে একটা কথা মনে রাখা অবশ্যই দরকার যে, বাচ্চাদের তাদের ঠাকুমা-ঠাকুরদা, আত্মীয়স্বজন, বন্ধু-বান্ধব সকলের সঙ্গে সম্পর্কের বন্ধন দৃঢ় করা উচিত। সকলের বাড়িতে যাওয়া-আসার সুযোগ করে দিতে হয় বাচ্চাদের। এতে সম্পর্ক অটুট হয়। বাড়ির চার দেয়ালের একঘেয়েমি এবং মানসিক চাপও অনেকটা লাঘব হয় এতে।

সুতরাং আনন্দে থাকুন এবং বাচ্চাদেরও আনন্দে ছুটি কাটাতে দিন।

 

আরো গল্প পড়তে ক্লিক করুন...