পয়লা মাঘ। রাঢ় বাংলায় তার আগের দিন পালিত হয় পৌষ সংক্রান্তির পরব। প্রান্তিকজনের ঘরে ঘরে মাসেক কাল ধরে হয় টুসু ঠাকরুনের পরব পালন। শেষ হয়, বাঁধের জলে দেবীর চৌদল ভাসিয়ে দিয়ে। কিন্তু পরবের উত্তাপ চলে আরও ক’টা দিন। সদ্য শ্রমের ফসল উঠেছে চাষীর ঘরে। এই সময়টা কিঞ্চিৎ স্বচ্ছলতার বিনিময়ে সুখ সওদা করে মানুষ। পরদিন পয়লা মাঘ দলিত জন, পাহাড়কে পুজো করে শীত ভোরে। মাঝি পাড়ার নায়া (পুরোহিত) মাঘ-ভোরে স্নান করে পাহাড়ের শীর্ষে উঠে সাদা মোর্গার রক্ত দিয়ে পাহাড়কে তুষ্ট করবে।আতপ চাল ছড়িয়ে মন্ত্র পড়ে মারাং দেবতাকে বলে– ‘হে পাহাড় বাবা, তোমার কৃপায় আমাদের সারা বছরের আহার। তুমি পাহাড়ে যোগাও খাস আলু, বনকচু, কন্দ, পিয়াল,ভুররু, পাকা কেঁদ, ভ্যালাই, মাদাল, কাঁঠাল, বেল– তাই খেয়ে ভূমিপুত্র বাঁচে। তোমার চিহড় পাতায় কুটির ছাওয়া হয়। চিহড় দড়ি সংসারের ব্যবহারে লাগে। পাহাড়ে কতই ভাম, কাঁটাচুয়া, সজারু, শশক, গোসাপ আমাদের অভাবের দিনের খাদ্য। আমাদের যাদের হাতে কাজ নাই, জমিন নাই, পঞ্চায়েতি বরাত নাই তাদের কাছে তুমিই দানসাগর হে মারাং বাবা!’

পাহাড় পুজোকে কেন্দ্র করে বড়োসড়ো মেলা লাগে মাঠা পাহাড়ে। আমাদের সেই মেলায় যাওয়ার প্রস্তুতি পর্বে সাতসকালেই যুধিষ্টির হাজির এক দুঃসংবাদ মুখে নিয়ে। যুধিষ্টির অযোধ্যা ভ্রমণে আমার স্থানীয় গাইড ও ভাই বলা যায়। বলল, মাঠার মেলায় যাওয়ার কোনও গাড়ি নেই বাঘমুন্ডি বাজারে। সব আগেভাগে চুক্তিবদ্ধ হয়ে গেছে আগুন দরে।

ট্রেকার, ট্রলি, নিদেনপক্ষে একটা ভ্যান রিক্সা?

সব ঢুঁ-ঢুঁ দাদা।

– তা হলে? একেই শীতকাল। দিনটা ভয়ংকর রকমের মেঘলা। শিশির দানা ঝরছে বৃষ্টির মতো, আর উত্তরের কনকনে বাতাস। বাঘমুন্ডির এই সেচ– বাংলো থেকে মাঠার দূরত্ব কতটা?

সে অপরাধী মুখে বলল– ১০ কিমি।

সে জন্যে যাওয়া তো থেমে থাকবে না। সুতরাং আমাদের প্রস্তুতি পর্ব চলতে থাকল।যুধিষ্ঠির যাওয়ার ভাবনাটুকু আমাদের মধ্যে চারিয়ে দিয়ে, সঠিক সময়ে হাজির হওয়ার অঙ্গীকারে চলে গেল।

ছাতাটাঁড়ের মোড়ে এসে দেখি অসংখ্য মানুষের পায়ে একই ঠিকানা– মাঠার মেলা। মেয়েদের গলায় কোরাস গান টুসুর– কালিমাটির বাজারে লঁক জমেছ্যে হাজারে / সিথায় লঁকে বাঁকা চখে চায় / হমার টুসু মাঠার মেলায় যায়।’

পুরুষের মনে এক বাসনা, মেলা মানে ফুর্তিপানি, ঝান্ডি খেলা, অফুরান খুশির আগুনে পুড়ে ভস্ম হয়ে যাওয়া। আমরাও সামিল হলাম সেই আনন্দ দরিয়ায় স্নান করতে। আবহাওয়া ক্রমশ খারাপ হতে থাকে। মেঘ আরও কালো হয়েছে। কুয়াশা আরও ঘন। মানুষগুলি ঘষা কাচের আড়ালে মেলার আনন্দে হেসে, গেয়ে, নেচে চলেছে। পাশ দিয়ে ছুটে যাচ্ছে মানুষের পিণ্ড নিয়ে ট্রাক ট্রেকার। সেখানে মাইকে উড়ে গেল গানের কলি– ধমসা মাদলে লাচে লাচনির যৈবন…

পায়ে পায়ে এ যাত্রায় বেশ মজাই লাগছে। কিশোর, যুবক, বুড়োবুড়ি, কিশোরী, যুবতি, প্রৌঢ়া। স্ত্রীলোকের ভিড়ই বেশি। মাঠাবাবার দরবারে তাদের মাঙন এবং নালিশ দুটোই যে বেশি। ভাবতে অবাকই লাগে এই একটা দিন শঠ এবং সৎ, খঞ্জ এবং ভণ্ড, ধূর্ত-আর্ত, স্বাক্ষর-নিরক্ষর, ধনী-নির্ধন এই একই পথ ধরে একই পদক্ষেপে চলেছে মাঠা বাবার মেলায়।

আমাদের সঙ্গে জুটে গেছে দিকপতি সরেন। তার হাতে খড়ের মোড়কে একটি কবুতর। যুধিষ্ঠির তাকে সুধাল– হ্যাঁ রে দিকপতি তোর পরিবারটি ঘরে ফিরল কবে?

সে সব কয়টি দাঁত বিকশিত করে বলল ওকে অনেকটা করে বুঝালাম, ওর বাপ ভি বুঝাল, তার পরেতে স্বামী ঘরে ফিরল। মাঠাবাবার মানত ছিল। তাই এই…। সে দেখায় বাবুইবাসার মতো একটি খড়ের মোড়কে কবুতরটি। যুধিষ্ঠির বলে, দাদা বুঝলেন কিছু?

– কিছু তো বুঝেছি কিন্তু…।

সে বলে, এ হল স্রেফ ইচ্ছাপূরণের ঘুষ। পাহাড়ের মাথায় চড়ে মাঠাবাবার নামে উড়িয়ে দেবে পাখিটিকে। ওর সরলা ঘরে ফিরেছে সেই আনন্দে চিড়িয়াটি উড়তে উড়তে হারিয়ে যাবে গর্গা পাহাড়ের ভাঁজে।

– তোমার সরলা কিন্তু খুব সরলটি নয়, যাই বলো হে দিকপতি।

আমার কথায় সে হাঁ-হাঁ করে ওঠে। বলে– পরিবারটি হামার সরলই বটে। গাঁয়ের অই ছক্রা উয়াঁর মাথাট ঘুঁরাঞ দিচ্ছে।

তাও ভালো। বিশ্বাসে মিলায় রত্ন, তর্কে বহু ফাঁক।

দিকপতি এগিয়ে গেছে। আমরাও গল্পে গল্পে কুদলুং নদী পেরিয়ে, রেরেংটাঁড় গ্রাম পার করে পথের পঞ্চাশভাগ সাবড়ে ফেলেছি। পথের যাত্রা আরামপ্রদ করতে যুধিষ্ঠির দুর্জয় মুড়াকে পাকড়াও করল। তার কাঁধেও ঘুষের উপাদান, একটি কচি পাঁঠা।

গাইডকে বললাম –দ্যাখো তো ওর কাঁধে বড়ো ঘুষ, মানে ওর সরলাটি বুঝি বরাবরের মতো বিদেয় হয়েছে?

যুধিষ্ঠির হেসে বলে– হঁ রে দুর্জয় ঘর-ঘরণী সব ঠিক ত?

সে বলে– সব ঠিকেই আছে।

– ত অই ছাগল লিঁয়ে চলছিস?

– এ বৎসর দমে ফসল হল। আড়হই বিঘা জমি স্বর্ণতে (ধান) ভরাভরি। এক দানা ধানও গনেশ বাবা (হাতি) খেতে পারেনি।

যুধিষ্ঠির বলে– কেন? গনেশের একাদশী চলছিল?

– না, রাত পাহারা দিলাম যে পালা করে। তাহাই মাঠাবাবাকে এই পাঁঠা।

Purulia

মনে ভাবি, এই পল্লীর রূপ। মানুষগুলির মনে সামান্য বিশ্বাসের টোপে সহজেই ওদের লুটে নেওয়া যায়, সে ঈশ্বর থেকে সরকার সকলেই। গল্পে কথায় অভিজ্ঞতা বাড়ে। চলতে চলতে পথ কমে। সঙ্গে চলেছে মেয়েরা হাজার বর্ণের প্রজাপতি হয়ে। তাদের মনে খুশির উতোল। গলায় ঝুমুর গান। পরনে রঙিন বস্ত্র, খোঁপায় ফুল, কানে ঝুমকো, গলায় কুঞ্জ হার,কথায় তারা উড়ান তুবড়ি। ওদের একজন বলে,

– অতগুলান আনজান লঁক লিঁয়ে কুথা চলেছ্য গ যুধিষ্ঠির দাদা?

– তু কুথাকে চলছিস। হামরা মেলায় যাছি বটে।

– যুধিষ্ঠির রসিকতা করে, হামাদিগে সঙ্গে লিঁবি কি?

ওরা হাসিতে দুলতে থাকে। অপর একটি মেয়ে বলে,

– হামাদিকের কিস্টোঠাকুর ডাঁড়ায়ে আছে কোদমতলে, হাতে পিরিতের ফাঁস লিঁয়ে।

– এ্যাই পরদেশিরাও ফাঁস দিথে জানে।

ওরা আরও হাসে– অই বাপ! শহরকে ডরাঁন লাগে।

যুধিষ্ঠির সুধায়– ডর ক্যানে বটে?

– তু জান নাই?

ওরা কটাক্ষ হেনে এগিয়ে গেল। আমাদের গাইড বলে মেলার এটুকুই আমাদের মজা-তামাশা দাদা। আপনারা হয়তো ভুল বুঝছেন।

– ভুল নয়, ভাবছি এই সব গ্রামীণ মেয়েদের তুলনায় শহরের মেয়েরা সরলতায় কতই পিছু-পা। এদের মনটা স্ফটিক স্বচ্ছ বলেই এমন আচরণ করতে পারে।

দুয়ারসিনি থেকেই পথ রুখল স্বেচ্ছাসেবীর দল। যান নিয়ন্ত্রণ কঠোর হল। গাড়ির লম্বা লাইন পথের এক পাশে, অপর পাশে হাজার পনেরো সাইকেল জমা পড়েছে ইতিমধ্যেই। এবারে আধ মাইল হাঁটা। বাঁ-দিকে মাঠা পাহাড় হাতের নাগালে এসে পড়েছে। ডান দিকে বিচ্ছিন্ন বাড়িঘর এবং চাষের মাঠ।

পথে পা চালাবার উপায় নেই। পাকা সড়কের বাঁ-পাশের ফাঁকা মাঠে মেলার দোকান। তার মধ্যে দিয়ে পথ করে, ভারী জঙ্গল কাঁধে মাঠা পাহাড় ৭০০ ফুট উঠে দাঁড়িয়েছে।

সড়কের ডান দিকেও সারবদ্ধ তাঁবু– চা, ভাজাভুজি, দম-ঘুঘনি, জিলিপি, গজার দোকান। মেলার মাঠের পাশেই ফরেস্ট রেঞ্জ অফিস, সুন্দর এক বন বাংলো। আমরা গিয়ে খুঁজতে থাকি যতীন দাসের দোকানটিকে। মাঠা বাংলোয় থাকার সুবাদে তাঁকেই দেওয়া থাকত আমাদের খাওয়ার বরাত। যতীনদার স্ত্রী খুবই ব্যস্ত আজ। কাজের ফাঁকে একবার দেখতে পেয়ে বলেন

– আজ দোকানের হালটাই বদলে গেছে দেখছ তো? সেই ভাতের হোটেল আজ মেলার হোটেল।

– বদলে গেছ তুমিও বউদি! পরনে থান কবে উঠল?

যতীন বউদি চোখ নামিয়ে বলেন,

– এই তো সাত মাস, গেল জষ্টিতে। চন্দ্রবোড়ার ছোবলে লোকটা…। তারপর একটু সহজ হয়ে বলেন,

– বাঁচতে তো হবে। দোকানটা আমিই ধরলাম।

– বেশ করেছ।

বউদি আমাদের গরম সিঙাড়া, বালুসাই, চা খাইয়ে দিলেন এক প্রস্থ। দোকানের সামনে পাঁচ-সাতটা খাটিয়া পাতা। সেখানে ছোটো এক মজলিস জমছে। আমার আপাতত ঠেক হল ওখানেই। সঙ্গী ছবি  তুলিয়ে ভেসে পড়েছে মেলার ভিড়ে।

আবহাওয়ার চেহারা যেন একটু ফিরেছে। মাথার উপরে কালো মেঘ সরে গিয়ে ভাতের ফ্যানের রং ধরেছে। তবে কুয়াশার ঝাপটা ভিজিয়ে দিচ্ছে মানুষের বসন-ভূষণ-বাসনা। ব্যতিক্রম শুধু যারা দারুর ক্রিয়ায় তাবৎ মেলাটাই মজাতে চায়। তাদের মধ্যে শিরোমণি ওই কলেশ্বর সিং মুড়া। মাথায় জড়ানো মাফলার, মলিন ট্রাউজার, মোটা জামার উপরে ছেঁড়া জহর কোট। তার কথার দমকে পাঁচটা লোক রগড় পায়। মানুষটা এক সময় ছো পালায় রাবন নাচত। নামডাকও হয়েছিল কিছু। তারপর বোতলের দমে নাচের দম ফুরোল। দলছুট হয়ে গেল। কিন্তু রাবন চরিত্রটিকে ভালোবেসে মানভূমের পথেঘাটে বীর বিক্রমে রাবন বধ পালা ধরে– ‘হামাকে বধিবে অই ভিখারি রাঘবে? এক হাঁথে তুলে লিঁয়ে ফিকে দিব্য অযোধ্যা দুয়ারে। হামি রাবন বট্যে, লংকা অধিপতি। হাঃ! হাঃ! হাঃ!’। তার বোলচাল, শরীরের ভাষা অন্য এক মাত্রা পেয়ে বাস। প্রতিবাদের মাত্রা। আমি ভাবি নির্যাতিত, শোষিত, লাঞ্ছিত শ্রেণিভূক্ত এই নিঃস্ব হরিজনটি, তথাকথিত সভ্য সমাজের প্রতি তার প্রবল ক্ষোভ উগরে দেয় রাবণ চরিত্রটির মধ্য দিয়ে।

ওকে কাছে ডেকে বসাতে যাই। সে কাছে আসে কিন্তু বসে না। তার ভিতরে নেশার ক্রিয়া, তার চেহারায় দৃপ্ত ভাব। কঠিন মুখে বলে– হঁ বলেন।

– বলি রাবন পালা শোনালে একটু চা-বড়া খেয়ে যাও।

– কে খাওয়াবে?

– আমিই খাওয়াব।

– কেন দিবেন পয়সা?

– আরে বাবা আজ মকর দিন, তাই…। সে আমাকে অবজ্ঞা করে কথার মাঝেই ভিড়ে মিশে গেল।

খাটিয়ায় বসা মজলিসি মানুষগুলি ক্ষেপে উঠেছে– দেখছ টেংরা মাতালের দশা। কেউ ফুট কাটে– আরে বাবা পেটে নাই ভাথ তাহার আবার জাত। অই বলে না ফবরা ঢিঁবির আওয়াজ বেশি। মানুষগুলি চেনে কলেস্বরকে।

– ও করে কী?

আমার প্রশ্নে একজন বলে– লঁকটা দুটা কাজ করে দাদা।

ছো পালা করে আর ভকে (খিদে) পড়লে গাছ চুরায়।

অর্থাৎ জঙ্গল কাটে। শুনলাম মানভূমের রাবন রাজার জীবন বৃত্তান্ত। আর কথার ঝোঁকে কয়েক প্রস্থ চা আর ভাজাভুজি উড়েছে।

বান্দোডি, ধসকা, ডাভা নানা গাঁয়ের মানুষ এসে বসেছে দোকানের আড্ডায়। তাদের একজনের সঙ্গে একটি কচি পাঁঠা, জবাই হবে বাবার মাথায়। লোকটির নাম ধনপতি সিং বাবু। তার সঙ্গে খুচরো আলাপে বলি,

– তোমার সমস্যাটা কী?

সে টেনে টেনে বলে,

– সমস্যা হল বেটার বউ-টা রাইতে ঘরে থাকছে নাই। পাঁচ জনা বলছে উয়াঁর ডান (ডাইনি) লাঁগেছে।

– কী করে বুঝলে?

– ডান লাগলে উয়াঁরা আন্ধার রাইতে ঘরে থাকবে নাই।

– তা হলে?

তাই ধনপতি মাঠাবাবাকে পাঁঠার রক্ত ঘুষ দিয়ে সমস্যার বিহিত চায়। একজন বলে ওঠে,

– হবে না রে ধনপতি। তুই একটা ভালো দেখে গুনিন লাগা।

কেউ বলে– তুমি জগদ্দল ওঝাকে ধরো। ভালো ভূত নামায়।

ধনপতি বলে– ওকেই খবর করেছি। সে বেস্ত মানুষ, সময় করে আসবে বলেছে।

ধনপতির কথার মাঝেই এক নব্য যুবক আমার অপর পাশে এসে বসেছে। সে শুনল সব। এক সময় আমাকে প্রশ্ন করল– কী বুঝলেন? গপ্পো-কথা শুনলেন তো?

– কী বুঝব, এ তোমাদের গোঁড়া দেশাচার।

– ‘তোমাদের’ নয়, দেশটা আপনারও স্যার। অই যে লোকটা ধনপতি, টাকা পয়সায় শাঁসালো। ওর ছেলেটা ক্রিমিনাল। পাশের গাঁ থেকে মেয়েটাকে তুলে এনেছে। ও গাঁয়েতেই মেয়েটির ভালোবাসার লোক আছে। এখন গুনিনকে পয়সা খাইয়ে ঝাড় ফুঁকের নামে কোনও খতরনাক নিদান কিনবে। ষোলো আনার বিচারে তা পাশ হয়ে যাবে। সবই টাকা পয়সা লেনদেনের ছকে সাজানো কেস।

– তোমরা রুখে ওঠো।

– একা হয় না স্যার। সকলে দলবদ্ধ হতে হয়। দেখছেন তো লোকেরা ওকে ডাকিনের ছাপ লাগিয়েই দিয়েছে।

– তা হলে কী হবে?

– ওকে মেরে দেবে। মানে! প্রাণে।

– তা হলে থানা-পুলিশ অন্তত করে রাখো।

– নাঃ আপনাকে বোঝানো বৃথা স্যার।

– তোমার কী করা হয়?

– কলেজ পাশ দিয়ে একটা ইস্কুলে মাস্টারির চাকরি করি আর এই সব অনাচার চোখের সামনে দেখি। শিক্ষা সচেতনতার আলো আসতে আরো পঞ্চাশ বছরের অপেক্ষা। ততদিনে আরও কত মেয়ে কাঁচা শরীর নিয়ে পুড়বে! আপনাকে তো দেখতে হবে না। কিন্তু কিছু একটা করতে তো হয়।

ছেলেটি তার যোগাযোগের বিবরণ লিখে দিয়ে বলে– আপনি শহরে ফিরে ভাবুন। আমি সঙ্গে আছি স্যার। ওর ঠিকানা লেখা চিরকুটটি পার্সে ভরে নিয়ে উঠে পড়ি।

ঘুরতে ঘুরতে মেলার মাঠে ঢুকে দেখি কেনাকাটার ধুম লেগেছে। বিশেষ করে মেয়েদের প্রসাধনীর দোকানগুলিতে। হার, চুড়ি, দুল, বেশর, নখরঞ্জনী থেকে চিনা সিঁদুর, আলতা, কাঙ্গি, সস্তা পমেটম। ওদিকে বাসন, বসন, কোদাল কাস্তো দা-কাটারি। বাঁশের ঝুড়ি, মাটির হাঁড়ি। জুতো থেকে ছবির ক্যালেন্ডার বেচাকেনার কমতি নেই। ওদিকে খাবার স্টলে তেলের লুচি, ঝাল আলুর দম, রংদার দানাদার, হলুদ লবঙ্গ, অমৃতি। সেই সব পাঁচমিশেল ভিড় ঠেলে পাহাড়ের পায়ের কাছে গিয়ে থমকে যাই। খেটেল মানুষগুলি কত আশা, আকাঙ্খা, আকুতি নিয়ে মাঠাবাবার পাকদন্ডি ধরে মানতের ডালি হাতে চলতে গিয়ে থমকে দাঁড়ায়। সেই ভিড় ঠেলে উপরে ওঠার সাধ্য নেই আমার। মানুষের এই দৃশ্য দেখি আর এই ভূমিরই এক প্রবচন মনে পড়ে যায়– ‘ধন যৈবন আড়াই দিন, নজর ভরে মানুষ চিন’।

Purulia Travelogue

আমি বে-পথে পাহাড়ের পিঠে জঙ্গলের ঘেরাটোপে বসে মানুষে মনোযোগী হই। পাশেই পাকদন্ডির কাঁচাপথে নামছে পাঁঠার মুন্ডহীন ধড়গুলি। রক্তে পথ পিচ্ছিল, দু-ধারের গাছপালা রক্তাক্ত। পুরো পাহাড়টি গভীর জঙ্গলে ঢাকা। শুনেছি এই পাহাড়ে শ্বাপদের বাস। বিশেষ করে হাতি, ভালুক, ময়ূর, সজারু, খটাস, প্যাঙ্গোলিন। আজ তারা সরে পড়েছে ভিন পাহাড়ের আস্তানায়।

জঙ্গলের পকেটে বসে দেখি একটি বয়স্ক স্ত্রীলোক ধর্ম বিশ্বাসের জোরে বুক-সমান চড়াই টানেন। মানুষের স্রোত উপেক্ষা করে তাঁর চলায় বিপদের ঝুঁকি। সবই ওই মারাংবুরুর জোর। আর-এক স্ত্রীলোক তার শিশু কোলে উঠছে বিপজ্জনক চড়াই ধরে। আমি বলি ওকে নীচে রাখতে পারোনি?

মা-টি হেসে বলে– ওর নামেই যে মানত গো। ছ্যানাকে আমার পুঁয়ে (রোগ) ধরল। ডাক্তার, হেকিম করলাম তা’পরেতে বাবার নামে রাখলাম। ত সুস্থ হয়ে পড়ল।

– কী মানত তোমার?

– দু’টা কবুতর উড়াব বাবার নামে।

জানি কড়িফটকা মানুষের কাছে ওটুকুই অনেক বেশি। বাবার শিখরে উঠে মাঠার নামে উড়িয়ে দেবে দু’টি কবুতর। সে যত উড়বে তত মানত পূরণ হবে। এই সর্বহারার বিশ্বাস।

দিন ফুরিয়ে এলেও মেলার দম ফুরোয় না। দলের পর দল ঢুকছে গলায় টুসু গান নিয়ে–দই চিঁড়া মাখে দিলম বস টুসু আহারে / কাল টুসু লিঁয়ে যাব টাটানগর বাজারে।’ ছেলের দল, মেয়ের দল, ছেলেমেয়ে জোড়ের দল চলেছে হাসি, মস্করায়। যে-মস্করা আজ গানে গানে, এবং মেয়েদের মুখে তাৎক্ষণিক রচিত। মেয়েরা গান দেয় ছেলেদের দিকে–জুতা জামা রদ চশমা টেরি কাটা চুল /  ছকরা আর ছুঁস না পর পুরুষের ফুল।’

ছেলের দল খুশিতে সিটি দেয়, খানিক হিন্দি নাচ দেয় রাস্তা জুড়ে। মানুষের হাতে কাঁধে মাদল ধমসা তো আছেই। ভিড়ের মধ্যে বৃত্ত রচনা করে চলে নাচ, গান, বাদ্য। মানুষ চূড়ান্ত আনন্দে পৌঁছে যায়। দেখি ছেলেমেয়েদের গানে নাচে প্রাণের জোড়। প্রাণে প্রাণে প্রেমের ঘোর। ভুখা মানুষের অনাবিল নাচ-গান-রগড়-তামাশা বড়ো দুর্লভ পাওয়া। আমি দু’চোখ ভরে নিই, আর বুকের ভল্টে চালান করে দিই।

ওদিকে ঝান্ডি কলে পড়ে চলে রাজা ফকিরের খেলা। জুয়ার এক দানেই কেউ মাৎ, কেউ কাৎ। খেলার মাঠে জুয়া এবং মোরগ লড়াই আবশ্যিক বিনোদন। ভিড়ের টানে যুধিষ্ঠির আমার থেকে আলগা-ছুট হয়ে পড়ল। সে বিনা আমি দিকহারা। শেষ বেলায় মেলার দম বেড়েছে দশ গুন। ওকে খুঁজতে থাকি সাধ্যমতো আর মানুষের এলোমেলো টানে আরও বে-পথ হয়ে পড়ি। হঠাৎ দেখা হয় সেই মেয়েগুলির সঙ্গে। সেই ‘কোদমতলার কিস্টোঠাকুরের’ সঙ্গে চলছে রাধিকার পরাগ মিলনের খেলা। আমাকে চিনতে পেরে হাত নাড়ে ওরা। আমিও জবাব দিই। মানব দরিয়ায় ভেসে দেখি পাহাড়বাবার খেলা। একদিকে জুয়ার কল পেতে টেনে নিচ্ছেন দীনজনের সামান্য সম্বল। অপর দিকে ভরিয়ে দিচ্ছেন ধনে-প্রাণে-প্রেমে।

আমার ঠিক সামনেই একজোড়া ছেলেমেয়ের বোলচাল কানে এল–

মেয়েটি বলে– ত আমাকে বললে কেন মেলায় দেখা হব্যে? ছেলেটির উত্তর– কী করব্য, শহর থাকতে দাদারা আসলেন যে।

– দাদা বড়ো হঁল্য কি আমি?

– দাদা হঁল্য গুরুজন তু হলি আপনজন।

– তাই আপনজন ছাড়ে গুরুজনে মজলে বটে? মেয়েটির গলায় স্পষ্টত অভিমান।

ছেলেটি বলতে চেষ্টা করে– মেলা কি ফুরাঁয়ে যাছে মানভূম থাকতে? রাগ করিস না অল্কা কাল তকে লিঁয়ে যাব নিধিয়ার মেলা।

মেয়েটি দৃঢ়তার সঙ্গে বলে– আমি নাই যাব নিধিয়া। পলিমাটি প্রতিমার অভিমানি মুখটি দেখতে বড়ো অভিলাষ হল, অপর দিকে তার মানভঞ্জনে আমাকেই এগিয়ে আসতে হল। দুজনকেই বিব্রত করে পিছন থেকে বলে উঠলাম– হ্যাঁ রে যুধিষ্টির! মুজরিমটি ধরা পড়ে গিয়ে স্মার্ট হতে চেষ্টা করে। বলে দাদা– এ হঁল্য অল্কা। মেয়েটি পিছন ফিরে তাকাল। লজ্জায়, ভয়ে, শিহরণে, বাতাস লাগা গামার পাতার মতো তাকে দিশাহারা মনে হল। আমি বলি– তোরা এগিয়ে যা। মেলা শেষে দেখা হবে যতীন বউদির দোকানে। উলটো পথে ভিড়ের ঝাপটায় ভেসে যাই আর ভাবি–  ‘প্রেমের ফাঁদ পাতা ভুবনে /  কে কোথায় ধরা পড়ে কে জানে।’

আদিবাসীদের আনন্দের দম বড়োই প্রলম্বিত। এখন প্রতিদিনই গ্রামে গ্রামে নাচ-গান চলবে। এদিকে মেঘলা শীত বেলায় অন্ধকার নেমে এল সময়ের আগেই। মেলা গুটোল। মাতাল লুটোল ঝোপেঝাড়ে। মানত পূরণের পুণ্যার্থী ফিরল হৃষ্ট মনে, প্রেমিক ফিরল পূর্ণ কুম্ভটি হয়ে। বেচা-কেনায় লাভ কুড়িয়ে ফিরছে মহাজন। আর ফিরছে লোভের ফাঁদে ঝান্ডি কলে দান দিয়ে শূণ্য হাতে ফকিরজন। এই শূন্য-পূর্ণর মহাসম্মেলন মাঠা পাহাড়ের মেলা।

বেলা শেষের মেলা শেষে রাত্রিকে আলিঙ্গন করে, জনশূন্য প্রান্তরে দাঁড়ানো অরণ্যময় মাঠা ক্রমশ দানব রূপ ধারণ করে। সে এখন ধবংসের, শঙ্কার, সর্বনাশের প্রতীক যেন। দিনরাতের ফারাকে প্রকৃতির এই রূপ বদল দেখি আর অবাক হই! দূরে মাদল ধমসায় আনন্দের লহর ক্রমশ বিলীন হতে থাকে। মেলার শেষ মানুষটি ফিরে গেলে আমিও ফিরি ফেরার পথে, ফেরি ঘাটে।

জরুরি তথ্য

কীভাবে যাবেন – হাওড়া স্টেশন থেকে রাত্রের আদ্রা-চক্রধরপুর প্যাসেঞ্জার ধরে পরদিন সকালে বরাভূম স্টেশনে নেমে গাড়িতে যাওয়া পুরুলিয়ার ছাতাটাঁড়ে।

আরো গল্প পড়তে ক্লিক করুন...