এক মুঠো জীবন

নীল রঙের দরজা। তাতে আটকে রাখা চিঠির বাক্স। এক পাশে খড়খড়ি দেওয়া জানলা। বন্ধ। সবুজ রং ছিল এক সময়। এখন বিবর্ণ। সময়ের ছোপ ধরা দেয়ালের পলেস্তরা খসে পড়ছে অনেক দিন হল। তালা বন্ধ দরজার কাঠ ক্ষয়ে গেছে অনেকটাই। নতুন করে টুকরো কাঠ লাগিয়ে চেষ্টা করা হয়েছে কাঠামোটা ধরে রাখার। কিন্তু সময়টাকে ধরে রাখা যায়নি।

দেয়ালের কালশিটে দাগগুলো বলিরেখার মতোই স্পষ্ট। দুপুরের রোদ নরম চাদরের মতো জড়িয়ে আছে বাড়িটাকে। চিঠির বাক্স এখন ফাঁকাই পড়ে থাকে। চিঠি আসে না অনেক দিন। ধুলো জমেছে অনেক। পোকামাকড়ের ঘরবসতি তার এলাকা বিস্তারে ব্যস্ত। কেউ খুলেও দেখে না চিঠির বাক্স।

সে অনেক কাল আগের কথা। নিঝুম দুপুরে হঠাৎ খুলে যেত দরজা। চুড়ির মৃদু শব্দ। আধখোলা দরজার ভিতর থেকে কেউ দ্রুত হাতে তুলে নিত চিঠি। রঙিন খামে ঠিকানা লেখা। পরক্ষণেই বন্ধ হয়ে যেত দরজা। তারপর সারা দুপুর শুধুই ঠোঁটের কোণে লুকিয়ে থাকা হাসি। কোনও দিন চোখ ভরা জল। বারংবার, ফিরে ফিরে পড়া সাদা পাতার বুকে রাবীন্দ্রিক ছন্দে লেখা নীল অক্ষরের বিরহগাথা অথবা নিছকই কেজো কথায় ফিকে হয়ে যাওয়া অনুভূতিমালা।

আতরগন্ধী চিঠির ঘ্রাণে স্মৃতিমেদুর বিকেলগুলোয় বয়ে যেত বাসন্তী বাতাস। আকাশে ভেসে বেড়াত ঘুড়ি। রঙিন চিঠিগুলো যেন একটু আগেই সযত্নে রক্ষিত কারুকাজ করা বাক্সের ডালা খুলে চলে গেছে ওই সই-মেঘেদের কাছাকাছি, গোপন কথাটি বলার জন্য। হারিয়ে গেছে পোস্টকার্ড, ইনল্যান্ড বা খামে-ভরা চিঠির সুষমা।

চাইনিজ কালিতে হাতের লেখার শিল্প, অসাবধানতায় পড়ে যাওয়া দু-এক ফোঁটা কালির দাগ এখন কল্পনাতেও আসে না। এখন কাঠের তৈরি চিঠির বাক্সের বদলে ইনবক্স-এ মেসেজ আর ইমোজির মজা। তবু কেউ হয়তো এখনও বইয়ের ফাঁকে রাখা, হাতে-লেখা বিবর্ণ চিঠিটাকে মাঝে মাঝে খুলে নিয়ে পড়ে।

হয়তো তার একটা চিঠির বাক্স আজও আছে গোপন… যার রং নীল।

                                                                                                      লেখক : অয়ন সেন

 

জ্ঞানপাপী

Bengali story

পেটে অসহ্য যন্ত্রণা! যেন গত দশ বছরে পাকানো বিয়ার বেলি ছাপিয়ে নাভিকুণ্ডলী শিরাদাঁড়া-টা ছুঁয়ে ফেলবে! ইমার্জেন্সিতে স্ট্রেচার থেকে বেডে দেওয়ার পরেও মনে হচ্ছে, পৃথিবীটা ঘুরছে। আর সেই ফাঁকে দেখা দিয়ে যাচ্ছে কত মুখ। সেই ক্লাস এইটে ইস্কুলের পাট চুকিয়ে দেওয়ার সময়ে ভূগোল বই-এ জগা পড়েছিল সে কথা। কিন্তু ওই হাওড়া স্টেশনে ল্যাম্পপোস্ট-এর গায়ে কে.সি পালের নিজে হাতে লেখা, সূর্য‌ পৃথিবীর চারিদিকে ঘোরে এটাই সত্যি মনে হয়েছিল। কিন্তু আজ যমরাজের ডাকে প্রায় সাড়া দিতে দিতে অজস্র মাউথফুল গালি দিতে গিয়ে মনে পড়ে গেল

গ্যালিলিও… বেডে শুয়ে ভাবল গালি দিয়ে লি-ও লি-ও করে কুত্তাকে বিস্কুট খাওয়ানোর নাম করে মনে রাখত নামটা। এখনও চোখ বন্ধ করেও যেন নাগরদোলা। আজ তো মাল-ই খায়নি। তবে ওই গ্যালিলিও মালটা ঠিকই বলেছে বটে। সব ঘোরে, শুধু সূর্য এক জায়গায় খাম্বার মতো দাঁড়িয়ে। সিগারেট-ও সকাল থেকে একটাই। জিভটা এত মোটা লাগছিল যে, কিছু খেতেই ইচ্ছে হচ্ছিল না।

স্ট্রেচারে করে নিয়ে আসার সময়ে শুনতে পেয়েছিল, কে একটা বলল, আরে ডা. গাঙ্গুলী লন্ডন থেকে এফআরসিএস, যেন ঈশ্বর। ভাবতে ভাবতে নার্স এসে ঠুসে দিল ইঞ্জেকশন। জগা দেখতে পায়নি তাই। নাহলে পেটের ব্যাথায় নয়, ইঞ্জেকশনের সিরিঞ্জ দেখেই হার্টফেল করে মরে যেত। রোগ সারাতে অবশেষে সেই লন্ডনফেরত ঈশ্বর এলেন।

কী করলে ঠিক হব ডাক্তারবাবু?

মদ আর সিগারেট খাওয়া এক্কেবারে কমিয়ে দিতে হবে।

এটা বলার জন্য আপনি এত লেখাপড়া করে সময় নষ্ট করলেন? লন্ডনে ডাক্তারি শেখার খরচও নেহাত কম নয়! সকলে সুযোগও পায় না।

মা-নে?

লে হালুয়া! এটা কে না জানে! আমি দাদা কেলাস এইট পাশ, দীনবন্ধু ইস্কুল থেকে… পরশু যে-রিকশাওয়ালাটা আমাকে নিয়ে আসছিল, মাল খেয়ে টাল হয়ে গাছের গায়ে সল্লিড ধাক্কা। ওকে আমিও একই কথা বলেছি। পয়সাও নি-ই নি… আপনি লন্ডনে ডাক্তারি পাশ দিয়েছেন, আমার থেকে টাকাও নেবেন, অনেক। তাহলে এখন বলুন, মদ আর সিগারেট এই দুটোকে রেখে আমি ভালো হব আর ভালো থাকব কী করে? তবে না বুঝব আপনি ডাক্তারের ডাক্তার!

আমি পারব না।

এই কে আছিস! চ রে আমাকে বাড়ি নিয়ে চ… এর দ্বারা কিস্যু হবে না, অনেক হইচে!

ডাক্তারবাবু স্টেথো নামিয়ে রাখলেন টেবিলের ওপর।

 

 লেখক : আর্য চ্যাটার্জী

আরো গল্প পড়তে ক্লিক করুন...